‘নিলাম’ অ‍্যাপ সংঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িক ও নারী-বিরোধী চরিত্র উন্মোচিত করল
Expose Women Character Of The Sangh

ভারতের মুসলমান মহিলাদের নতুন বছর শুরু হল বর্ষ পুরানো ইসলামবিদ্বেষী অবমাননার এক নতুন সংস্করণের অপমান দিয়ে, হিন্দু প্রভুত্ববাদী শক্তির দ্বারা। সোশ‍্যাল মিডিয়া প্রোফাইল থেকে মুসলমান মহিলাদের নাম ও ছবি চুরি করে একটি অ‍্যাপের মাধ‍্যমে তুলে ধরা হল অনলাইনে ‘নিলাম’ করার বিজ্ঞাপন দিয়ে। এই মুসলমান মহিলাদের অনেকেই হলেন প্রথিতযশা সাংবাদিক ও আন্দোলনকর্মী। গতবছর একই রকম একটি অ‍্যাপের মাধ‍্যমে মুসলমান মহিলাদের অনলাইনে ‘নিলাম’ করা হয়েছিল। এবারে সেই অ‍্যাপেরই এক নয়া সংস্করণ। অ‍্যাপটির নাম দেওয়া হয়েছে অবমাননাকর গালি ব‍্যবহার করে। হিন্দু প্রভুত্ববাদীরা মুসলমান মহিলাদের প্রতি এই গালি ব‍্যবহার করে থাকে, আমরা সেইসব শব্দ উচ্চারণ করব না।

দিল্লী পুলিশ জানিয়েছে যে তারা প্রথম অ‍্যাপটির বিষয়েই এখনও তদন্ত এগিয়ে উঠতে পারেনি। ফলস্বরূপ দুষ্কৃতিরা অবাধ ছাড়পত্র পেয়ে গেছে। সর্বশেষ ক্ষেত্রটিতে অবশ‍্য মুম্বই পুলিশ খানিক এগিয়েছে এবং শ্বেতা সিং নামে এক তরুণী ও বিশাল কুমার ঝা নামক এক তরুণকে দুস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তদন্ত এগিয়ে নিয়ে এর পেছনে থাকা হিন্দু প্রভুত্ববাদী নেটওয়ার্ক ও তার কুশীলবদের সমগ্র চক্রটিকে উন্মোচিত করা একান্ত জরুরি।

একথা অবশ‍্যই স্মরণ করতে হবে যে এই ‘নিলাম’ অ‍্যাপগুলি আসলে মুসলমান মহিলাদের যৌন নিপীড়নের শিকার বানানোর বৃহত্তর বাস্তুতন্ত্রেরই অংশ মাত্র। যখন জামিয়া-মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্রী তথা সিএএ-বিরোধি আন্দোলনকর্মী সাফুরা জারগারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তখন তাঁর গর্ভবতী অবস্থাকে যৌন কুৎসার বিষয় বানিয়েছিল হিন্দু প্রভুত্ববাদী বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের নেতৃত্ত্বে অনলাইন হাঙ্গামাকারী জনতা। যখন ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করা হয়েছিল তখন বিজেপি নেতারা জনসমক্ষে প্রকাশ‍্য বিবৃতি জারি করে বলেছিল যে হিন্দু পুরুষেরা এবার কাশ্মীরে জমি কিনতে পারবে আর কাশ্মীরী মহিলাদের ‘বিবাহ’ করতে পারবে।

অবাক বিষয়, এই হিন্দু প্রভুত্ববাদীরাই, যারা মুসলমান মেয়েদের নিজের সম্পত্তি মনে করে, হিন্দু মেয়েদেরও যৌনতা ও প্রজননের যন্ত্র হিসেবে গণ‍্য করে। যতি নরসিংহানন্দ, যিনি মুসলমানদের গণহত‍্যা করার ডাক দিয়ে ঘৃণা সমাবেশ সংগঠিত করেন, বারংবার মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মেয়েদেরই যৌন সম্পত্তি ও শিশু উৎপাদন যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। যতি বলেছেন যে মুসলমান মহিলারা সব পুরুষের যৌনতার কাছে নিজেদের সহজলভ‍্য করে থাকেন। তারপর তিনি বলেন যে হিন্দু মেয়েদের অবশ‍্যই মুসলমান মেয়েদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হবে আরও বেশি ‘পবিত্র ডিএনএ’ সম্পন্ন সন্তান উৎপাদন করে, এবং তা করা সম্ভব হবে ‘ধর্মাচার্যদের’ (তাঁর মতো) অনেক স্ত্রী রাখার অনুমোদন দিয়ে।

যতির কথাগুলোকে ‘প্রান্তীয়’ মতামত বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। মুসলমান মেয়েদের অনলাইন নিলামে চড়নো অ্যাপগুলির একটির নির্মাতা শ্বেতা সিং কিছু পোস্টারও বানিয়েছেন হিন্দু মেয়েদের শিশু উৎপাদনকারী যন্ত্র হিসেবে তুলে ধরে। এই পোস্টারগুলি হিটলারী জমানার জার্মানিতে প্রচারিত পোস্টার থেকে নকল করা। ফ‍্যাসিস্টরা মেয়েদের দাসী হিসেবে গণ‍্য করে। সংঘ পরিবারের স্বপ্ন বাস্তব করে ভারত যদি কর্তৃত্ববাদী হিন্দু নেশন হয়ে ওঠে তাহলে সেই ভারতে মেয়েদের অবস্থা কী হবে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এই ‘নিলাম’ অ‍্যাপ আর য্যোতি নরসিংহানন্দের বাণী।

ভারতের গরিব জনতা হিন্দু প্রভুত্ববাদীদের দ্বারা একেকটা সম্প্রদায়ের মহিলাদের ‘গর্ভ’ হিসেবে চিহ্নিত করে সমগ্র সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার গণহত‍্যা সংগঠিত করতে দেখেছে। তাঁদের কাছে এ কোনও নতুন বিষয় নয়। ১৯৯০ দশকে সংঘী-সামন্তী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠি রণবীর সেনা দলিত ও অতি-পিছড়ে বর্গের গ্রামকে-গ্রাম নরসংহার সংগঠিত করেছিল। ওরা বিশেষভাবে নিশানা বানিয়েছিল ওইসব সম্প্রদায়ের মহিলাদের। রণবীর সেনাপ্রধান ব্রহ্মেশ্বর সিং মহিলা ও শিশুদের নিধন করার যুক্তি হিসেবে বারংবার বলেছিল, “মেয়ে সাপেরা সাপেরই জন্ম দেয়, এবং সাপের বাচ্চারা বড় হয়ে সাপই হয়”। আজ আমরা সেই একই বাণী একই শব্দ শুনছি — মুসলমানদের গণহারে হত‍্যা করার আহ্বান করা হচ্ছে এবং মুসলমান মহিলাদের যৌন সম্পত্তি ও প্রজনন যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।

এরকম এক সময়ে ভারতের গ্রামীণ ভূমিহীন গরিবদের অতি অবশ‍্যই তাঁদের মুসলমান ভাইবোনদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। জার্মানির মহান ফ‍্যাসিবাদ-বিরোধী কবি বের্টল্ট ব্রেখট যেমন বলেছেন, “নিপীড়িতের জন‍্য নিপীড়িতের অনুকম্পা অপরিহার্য। এটাই দুনিয়ার একমাত্র আশার জায়গা।”

- এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৪ জানুয়ারি ২০২২

খণ্ড-29
সংখ্যা-2