ধর্ম সংসদের নামে ঘৃণার বাণী প্রচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন
hate speech

জাতীয় রাজধানী দিল্লীতে, উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে, আর ছত্তিশগড়ের রাইপুরে সমাবেশ সংগঠিত করে গেরুয়াধারী নেতারা মুসলমানদের গণহারে হত‍্যা করার আহ্বান রাখলেন এবং ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার শপথ পাঠ করালেন। ‘ধর্ম সংসদ’ নাম দেওয়া এই সমাবেশগুলির পুরোভাগে আছে সন্ত্রাসবাদীদের এক ভয়ঙ্কর হিংস্র নেটওয়ার্ক। ধর্মের নামে তারা প্রকাশ‍্যে হিন্দু শিশুদের সন্ত্রাসবাদে দীক্ষিত করছে এবং অস্ত্র শিক্ষা দিচ্ছে।

ওরা প্রকাশ‍্যেই গডসের প্রতি ওদের আনুগত‍্য ঘোষণা করে। সেই গডসের প্রতি, যে গডসে গান্ধীকে হত‍্যা করেছিল এবং যাকে স্বাধীন ভারতের প্রথম সন্ত্রাসবাদী বলা হয়। বিবিধের মাঝে মহান মিলনের গণতান্ত্রিক এই ভারতকে ওরা গডসের ভারতে পর্যবসিত করার ঘোষণা দেয়। ওদের এইসব কথাগুলির প্রতিধ্বনি তোলে বিজেপি’র নেতা, মন্ত্রী ও অন‍্যান‍্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ব্যাঙ্গালুরুর বিজেপির এমপি তেজস্বী সুরিয়া সম্প্রতি সার্বিক ‘ঘর ওয়াপসি’, অর্থাৎ মুসলমান ও খ্রিস্টানদের গণহারে ধর্মান্তরিত করার আহ্বান রাখলেন। তারপর অবশ‍্য তিনি মন্তব‍্য ‘প্রত‍্যাহার’ করে নিলেন ‘বিতর্ক এড়াতে’। নতুন বছর এগিয়ে আসার সাথে সাথে দেশের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ হিসেবে হাজির হল সংঘ পরিবারের সন্ত্রাসবাদী এজেণ্ডা যা বিজেপি ও তার সরকারগুলির দ্বারা পৃষ্ঠপোষিত হচ্ছে।

দেশে যখন সবচেয়ে বেশি দরকার কৃষকের, শ্রমিকের, যুবদের, ছাত্রছাত্রীদের, মহিলাদের ‘সংসদ’ সংগঠিত করে কাজ, ক্ষুধা, স্বাস্থ‍্য, শিক্ষা, সামাজিক ন‍্যায় ও সমতার প্রশ্নগুলি চর্চায় আনা, তখন ধর্ম ও বিশ্বাসের নামে এরকম ঘৃণা-সংসদ সংগঠিত করছে এরা কোন শক্তি? উত্তরটা অজানা নয়। নজরটা ওদের আসন্ন নির্বাচনের দিকেই। চাকরি, কৃষি, স্বাস্থ‍্য ও শিক্ষায় বিজেপি সরকারের অপরাধসম ব‍্যর্থতা থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দিতেই এই ঘৃণার জমায়েতগুলি সংগঠিত করছে ওরা। আর মহান মিলনের গণতান্ত্রিক ভারতকে কর্তৃত্ববাদী ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বানানোর যে ঘৃণ‍্য উদ্দেশ‍্য সংঘ পরিবারের আছে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন‍্যও সংগঠিত হচ্ছে এই জমায়েতগুলি।

নরসিংহানন্দ বা সাধ্বী অন্নপূর্ণার মতো ঘৃণা প্রচারকেরা এখন হিন্দুদের বিভিন্ন প্রখ‍্যাত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির মাথা (নরসিংহানন্দ যেমন জুনা আখড়ার প্রধান) এবং একই সাথে তারা বজরং দলের মতো সংঘী বাহিনীরও নেতা। হিন্দুদের জন‍্য সবচেয়ে বড় বিপদ এইসব পুরুষ ও নারীদের দিক থেকেই আসছে যারা হিন্দু ঘরের শিশুদের মনকে বিষিয়ে দিচ্ছে এবং তাদের টেররিস্ট কার্যকলাপের দিকে চালিত করছে।

এইসব নেতারা মুসলমান বিক্রেতাদের বয়কট করতে, অস্ত্র শানাতে, গডসের আদর্শ গ্রহন করতে এবং সমগ্র মুসলমান সম্প্রদায়টাকেই মুছে ফেলতে হিন্দুদের উস্কানি দেওয়ার জন‍্য হিন্দু ধর্মের দোহায় দেয়। এতদসত্বেও অধিকাংশ শংকরাচার্য, আচার্য, সদগুরু ইত‍্যাদি বিভিন্ন হিন্দু বিশ্বাসের বিভিন্ন ধর্মীয় নেতারা তো লজ্জাজনকভাবে মৌন আছেনই, এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত, যারা কিনা ভারতের সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার শপথ নিয়েছেন তাঁরাও, সম্পূর্ণ নীরব আছে।

Be vocal against spreading hate speech

ক্রিস্টমাস ডে খ্রিস্টানদের জন‍্য পবিত্র দিন এবং সকলের জন‍্যই উৎসবের দিন। কিন্তু সংঘীদের কাছে এটা সান্তা ক্লজের কুশপুতুল পোড়ানোর দিন হয়ে যায়। এই আক্রমণগুলোর সাথে আসে খ্রিষ্টানদের পরিচালিত স্কুল ও প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর সংঘীদের হিংস্র হামলা। মাদার টেরেসা প্রতিষ্ঠিত মিশনারিজ অব চ‍্যারিটি ভারতের মুমূর্ষু ও দুস্থদের কল‍্যাণে বিবিধ দাতব‍্য ও সেবামূলক কার্যকলাপের জন‍্য পরিচিত। মোদী সরকার এদের তহবিলে দান আসা বন্ধ করে দিয়েছে। মুসলমান সংখ‍্যালঘুদের পাশাপাশি খ্রিস্টান সংখ‍্যালঘুরাও সংঘী সন্ত্রাসবাদের নিশানা।

একথা খুব স্পষ্ট যে বিজেপি’র প্রতি ভারতের জনতার খুব দ্রুতই মোহভঙ্গ হচ্ছে এবং বিজেপি জমি হারাচ্ছে। হিমাচল প্রদেশের উপনির্বাচনে হারের পর চণ্ডীগড় কর্পোরেশন ইলেকশনে ভোট ও আসনসংখ‍্যা উভয় কমে যাওয়া তার সর্বশেষ সূচক। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও উন্মাদনা এখন মোদী সরকারের শেষ আশ্রয়। সম্ভবত মোদী সরকার বিশ্বাস করে যে কৃষি আইন প্রত‍্যাহারের সাথে সাথে কৃষক আন্দোলন সহ অন‍্যান‍্য আন্দোলন পেছনের সারিতে চলে যাবে এবং অনুপ্রেরণাময় সংগ্রামের মধ‍্যে দিয়ে যে লড়াকু মানসিকতা ও সংহতির মেজাজ তৈরি হয়েছে তা স্তিমিত ও নিস্ক্রিয় হয়ে যাবে। আর বিজেপি সেই সুযোগে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দিয়ে, জনতাকে দমিয়ে দিয়ে, ক্ষমতা ও রাজনৈতিক এজেণ্ডার ওপর নিজেদের কব্জা পুনরায় কায়েম করে নেবে।

এই এজেণ্ডা নামিয়ে আনতে বিজেপি কেবলমাত্র নিজস্ব সংগঠন ও নেটওয়ার্কের ওপরই নির্ভর করে এগোচ্ছে না। বিরোধী পক্ষের দুর্বলতাকেও সে কাজে লাগাচ্ছে। এবং বিজেপিরই মতাদর্শগত ময়দানে বিজেপি’রই তৈরি করা শর্তে বিজেপি’কে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যে প্রবণতা কংগ্রেসের একাংশ ও আপ’এর মতো নতুন দল সহ বিভিন্ন অবিজেপি দলগুলির মধ‍্যে দেখা যাচ্ছে সেই প্রবণতাকেও কাজে লাগিয়ে এগোচ্ছে বিজেপি। রাইপুরের কর্মসূচিতে কংগ্রেস নেতাদের কয়েকজনের উপস্থিতি এবং বাঘেলা সরকারের জড়দগব নিষ্ক্রিয় ভূমিকা এই বিষয়টা দেখিয়ে দেয়।

হিন্দু বিশ্বাসের নামে চলা এই সন্ত্রাসবাদকে প্রতিরোধ করতে সক্রিয়ভাবে সংগঠিত হওয়া ভারতের প্রতিটি গণআন্দোলন এবং প্রতিটি নাগরিকের অবশ‍্যকর্তব্য। এপ্রশ্নে নীরবতা আসলে কুকর্মের সহযোগিতার নামান্তর। প্রত‍িটি নগর শহর গ্রাম মহল্লা, প্রতিটি গলি ও রাজপথ, প্রত‍্যেক এলাকায় প্রতিবাদ সংগঠিত করতে হবে বিজেপি’র পৃষ্ঠপোষকতায় চলা এই সন্ত্রাসবাদী জমায়েতগুলির বিরুদ্ধে। এটাই নতুন বছরের অঙ্গীকার।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৮ ডিসেম্বর ২০২১ সংখ্যা)

খণ্ড-29
সংখ্যা-1