প্রতিবেদন
রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ই স্পর্ধিত করছে হিন্দুত্বর সন্ত্রাসবাদীদের
Hindutva terrorists

উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে পেরিয়ে যাওয়া বছরটার ১৭-১৯ ডিসেম্বর সংগঠিত হল ধর্ম সংসদ। এর আয়োজক ছিলেন উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের ডসনা দেবী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত যতি নরসিংহানন্দ সরস্বতী। আয়োজক নরসিংহানন্দ হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে মুসলিমদের গণহত্যার আহ্বান জানালেন। হিন্দুদের আজ প্রভাকরণ, ভিন্দ্রানওয়ালের মতো অস্ত্রধারীদের প্রয়োজন বলেও তিনি ঘোষণা করেন। আরএসএস’এর শাখা সংগঠন হিন্দু মহাসভার নেত্রী অন্নপূর্ণা মা বলেন, “আমরা ১০০ সেনা চাই জেতার জন্য, যারা ওদের ২০ লক্ষ জনকে মারবে”। তাঁর অভিমতে ধর্মনিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত ভারতের সংবিধান ভুল এবং গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেই হিন্দুদের আদর্শ। বিহার থেকে আসা ধর্মগুরু ধর্মদাস জানালেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে হত্যার তাঁর অভিলাষের কথা, কেননা, মনমোহন সিং নাকি সংসদে রাষ্ট্রের সম্পদের ওপর সংখ্যালঘুদের অধিকারের কথা বলেছিলেন। ধর্ম সংসদে আর এক ব্যক্তিত্ব, হিন্দুরক্ষা সেনার প্রবোধানন্দ গিরির সহিংস আহ্বান ছিল এই রকম, “মায়ানমারের মতো আমাদের পুলিশ, সেনা, রাজনীতিবিদ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে। এবার ‘সাফাই অভিযান’ চালাতে হবে।”

একই ধরনের ঘটনা ১৯ ডিসেম্বর ঘটল জাতীয় রাজধানী দিল্লীর গোবিন্দপুরি এলাকায়। দু’দশক আগে যোগী আদিত্যনাথ প্রতিষ্ঠিত হিন্দু যুব বাহিনী নামক সংগঠনের ডাকা সভায় বেশকিছু হিন্দু যুবককে শপথ বাক্য পাঠ করালেন সুদর্শন নিউজ চ্যানেলের সম্পাদক সুরেশ চাভাঙ্ক। সেই শপথটা ছিল — “ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে হলে লড়ো, মরো এবং দরকার হলে মারো”। নাৎসিরা যেভাবে স্যালুট জানাত, সেই ঢঙে ডান হাত সামনে বাড়িয়ে ‘শপথ’ আওড়ালেন হিন্দু যুবরা। এই শপথ আরো কয়েকটি স্থানে অনুষ্ঠিত হয়, এবং উদ্যোগগুলোর পিছনে যে একটা পরিকল্পনা কাজ করছে তা প্রতিভাত হয়।

ছত্তিশগড়ের রায়পুরেও সংগঠিত হয় ধর্ম সংসদ। সেখানে ধর্মগুরু কালীচরণ মহারাজ ওরফে অভিজিৎ সরগ নাথুরাম গডসের কাজকে দেশপ্রেমের নিদর্শন বলে অভিহিত করলেন। তিনি বললেন, গান্ধীর জন্যই ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হতে পারেনি। কংগ্রেসের কয়েকজন নেতা ধর্ম সংসদে যোগ দিলেও গান্ধী বিরোধিতা ও গডসে বন্দনায় অস্বস্তি বোধ করে সংসদ ছেড়ে চলে যান। এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভূপেন বাঘেল সরকার কালীচরণ মহারাজের বিরুদ্ধে এফআইআর করে এবং গোপন স্থান থেকে তাঁকে গ্ৰেপ্তার করা হয় ৩০ ডিসেম্বর।

একটা কথা এখানে স্পষ্টভাবে বলাটা জরুরি। যারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে মুসলিমদের গণহত্যার কথা বলে, সংখ্যালঘু বিদ্বেষ উস্কিয়ে তুলতে তৎপর হয়, গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে আদর্শ বলে জ্ঞান করে, তারা নির্ভেজাল সন্ত্রাসবাদী ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

তবে, হিন্দুত্বর এই সংখ্যালঘু বিরোধী আস্ফালনের বিরুদ্ধে নাগরিক ও রাজনৈতিক সমাজ নিশ্চুপ থাকেনি। বিভিন্ন রাজ্যের নানা স্থানে মুসলিম বিদ্বেষী উন্মাদনাকে বন্ধ করা এবং হিন্দুত্ববাদকে প্রতিহত করার সক্রিয়তা দেখা যায়। সুপ্রিম কোর্টের ৭৬ জন আইনজীবী, প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণাকে চিঠি দিয়ে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এই উগ্ৰতাকে অপরাধ বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। চিঠিতে তাঁরা বলেছেন, ধর্ম সংসদে সাধু-সাধ্বীরা যা বলেছেন তা শুধু ঘৃণা-ভাষণই নয়, মন্তব্যগুলো একটা গোটা সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার কথাই বলে। প্রধান বিচারপতির কাছে তাঁদের তাই বিনীত নিবেদন, “রেওয়াজ হয়ে ওঠা ঘটনাগুলোকে প্রতিহত করতে জরুরী বিচারবিভাগীয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন”। পাঁচ প্রাক্তন সেনাপ্রধান (নৌসেনা প্রধান এল রামদাস, বিষ্ণু ভগত, অরুণ প্রকাশ ও আর কে ধাওয়ান এবং প্রাক্তন বায়ুসেনা প্রধান এস পি ত্যাগি) রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি চিঠি লিখেছেন, যে চিঠির প্রতিলিপি তাঁরা প্রধান বিচারপতি, উপরাষ্ট্রপতি এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের কাছে পাঠিয়েছেন। তাঁদের চিঠিতে বলা হয়েছে, “মাননীয় রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই ধরনের প্রচেষ্টাকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার নিবেদন আমরা জানাচ্ছি, এবং হিংসার এই উস্কানিকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ধিক্কার জানানোর আবেদন করছি”। প্রাক্তন এক লেফটেন্যান্ট জেনারেলও তাঁর প্রতিবাদপত্রে বলেছেন, “ঘৃণার এই কারবারিরা ধর্মান্ধ এবং দেশের সামাজিক কাঠামোর কাছে এক বিপদ। সরকার কেন তাদের গ্ৰেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ এবং দেশদ্রোহী আইন প্রয়োগ করছে না?” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন টেনিস তারকা মার্টিনা নাভ্রাতিলোভাও হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম-বিরোধী হিংসার উস্কানির নিন্দা করেছেন বলেও খবর বেরিয়েছে।

Hindutva terrorists are being pampered

রাজনৈতিক ময়দানে সিপিআই(এমএল) প্রতিবাদে সক্রিয় থেকেছে। দিল্লীতে নাগরিকদের সংগঠিত প্রতিবাদে সিপিআই(এমএল), এআইএসএ এবং এআইসিসিটিইউ অংশ নেয়। ঐ প্রতিবাদসভা থেকে দাবি ওঠে — যতি নরসিংহানন্দ, অন্নপূর্ণা মা এবং ধর্ম সংসদে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা অন্যান্য ঘৃণা প্রচারকদের গ্ৰেপ্তার করতে হবে। সেদিনের প্রতিবাদ সভায় সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, দেশে বিভাজন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিজেপি সমর্থিত এই চরম দক্ষিণপন্থী ব্যক্তিগণ ও সংগঠনগুলো সাম্প্রদায়িক তাস খেলছে। উত্তরাখণ্ডে ঘৃণা-ভাষণগুলোতে মুসলিমদের গণহত্যার যে আহ্বান জানানো হয়েছে তারসঙ্গে নাজি জার্মানির ‘চূড়ান্ত সমাধান’এর মিল আছে বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, সামনের নির্বাচনগুলোতে এই ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলোকে পরাস্ত করতে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের যে স্বপ্ন স্বাধীনতা আন্দোলন তুলে ধরেছিল, সেই ঐতিহ্যকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

ধর্ম সংসদ অনুষ্ঠিত হওয়ার রাজ্য উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন স্থানেও সিপিআই(এমএল) প্রতিবাদ সংগঠিত করে। সংগঠনের গাড়োয়াল শাখা ঘৃণা প্রচারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে রাজ্যের ডিজিপি’কে একটা স্মারকলিপি দেয়। স্মারকলিপিতে গাড়োয়াল শাখার সম্পাদক ইন্দ্রেশ মইখুরি বলেছেন, ঘৃণা-ভাষণগুলোতে হিংসাকে উস্কিয়ে তোলা, অস্ত্র সংগ্রহ করা এবং গণহত্যার আহ্বান জানানো হয়েছে। উত্তরাখণ্ডের আইন ও শৃঙ্খলাকে এইভাবে দূষিত করে তুলতে কাউকেই দেওয়া যাবে না। বিন্দূখাট্টার লালকুঁয়াতে প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত হয় যা শেষে একটা জনসভায় পরিণতি লাভ করে। সেই সভায় দলের উত্তরাখণ্ড রাজ্য সম্পাদক রাজা বহুগুণা বলেন, ভারত গণতান্ত্রিক দেশ, সমাজকে সংবিধান মেনে পরিচালিত হতে হবে, ধর্মীয় হুমকির কোনো স্থান এখানে হতে পারে না। পাঁচটা রাজ্যে নির্বাচনের আগে জনগণ ধর্মের এই হুমকিবাজিকে মেনে নেবেন না। তিনি অভিযোগ করেন, উগ্ৰ ধর্মান্ধরা উত্তরাখণ্ড সরকারের সুরক্ষা পাচ্ছে, আর তাই এর দায় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে।

Hindutva terrorists are being pampered - bihar

বিহারের পাটনায় সিপিআই(এমএল) ও এআইপিএফ ২৭ ডিসেম্বর প্রতিবাদ সংগঠিত করে। প্রতিবাদ সভাগুলোতে বক্তারা বলেন, গান্ধীর দেশে গডসের মাহাত্ম্যের প্রচার কাজে দেবে না। দেশের জনগণ ঘৃণার এই প্রচারকে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করবেন। সারা ভারত কিষাণ মহাসভার সাধারণ সম্পাদক রাজারাম সিং বলেন, মুসলিম বিরোধী ঘৃণার এই প্রচারের পিছনে রয়েছে বিজেপি ও আরএসএস। জাতি-বিরোধী শক্তিগুলো সংবিধানকে প্রহসনে পরিণত করছে এবং দেশের মিশ্র সংস্কৃতি ও ঐক্যের বিপর্যয় ঘটালেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছেনা। পাটনা ছাড়াও প্রতিবাদ সংগঠিত হয় বেগুসরাই, আরা, বেতাইয়া, ডুমরাঁও ও অন্যান্য জেলায়। এই সমস্ত প্রতিবাদ অনুষ্ঠান থেকে কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা যতি নরসিংহানন্দ, প্রবোধানন্দ ও অন্যান্যদের গ্ৰেপ্তারের দাবি ওঠে। যারা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উস্কিয়ে তুলছে তারা যোগ্য জবাব পাবে বলেও বক্তারা জানান।

এআইপিএফ’এর বক্তারা ভারতের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে অটুট রাখা এবং ধর্মের নামে জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির দুরভিসন্ধিকে ব্যর্থ করার অঙ্গীকার করেন।

ঘটনাবলীর বিকাশ ক্রমান্বয়ে দেখিয়ে চলেছে যে, ন্যায়-অন্যায়ের সিদ্ধান্তে নরেন্দ্র মোদী সরকার চূড়ান্ত রূপেই একদেশদর্শী। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের তারা বিনাবিচারে বছরের পর বছর জেলে আটক রাখে, আর ঘৃণা-ভাষণের মহা আয়োজন থেকে মুসলিমদের গণহত্যার ডাক দেওয়া হলেও পুলিশ-প্রশাসনের কোনো হেলদোল দেখা যায়না। ঘটনার কয়েকদিন পর মূল অভিযুক্ত হিসেবে পুলিশ চিহ্নিত করে ধর্ম সংসদের সংগঠনে গুরুত্বহীন এক ব্যক্তি ওয়াসিম রিজভি ওরফে জিতেন্দ্র নারায়ণ ত্যাগীকে। এই রিজভি গতবছরের ৮ ডিসেম্বর মুসলমান ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু ধর্ম গ্ৰহণ করেন এবং আরো জানা যায়, সিয়া ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকার সময় আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআই’এর তদন্ত চলছে। ধর্ম সংসদের মূল হোতা এবং মুসলিম গণহত্যার আহ্বানের পয়লা নম্বরের পাণ্ডা নরসিংহানন্দের অপরাধে পুলিশ হাত গুটিয়ে থাকে। ঘটনার দু’সপ্তাহ পর আর কয়েকজনের সঙ্গে পুলিশ তাঁর নামে অভিযোগ দায়ের করলেও এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্ৰেপ্তার করা হয়নি। নিজেদের নিষ্ক্রিয়তার ওজর হিসাবে উত্তরাখণ্ডের ডিজি বলেন — ঘটনা নিয়ে কোনো অশান্তি হয়নি, কাউকে তাই গ্ৰেপ্তার করা হয়নি! হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনে “লড়াই কর, মর এবং প্রয়োজন হলে মারো”র শপথ গ্ৰহণ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরও অমিত শাহ’র নিয়ন্ত্রণে থাকা দিল্লী পুলিশ কোনো পদক্ষেপ করেনা। নরসিংহানন্দ যখন ধর্ম সংসদ অনুষ্ঠিত করতে হরিদ্বার আসেন, বা সুদর্শন নিউজ চ্যানেলের প্রধান হিন্দুরাষ্ট্রের বাস্তবায়নে যুবকদের ‘মর ও মারো’র শপথ বাক্য পাঠ করান, তখন তাঁদের এই বোধে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না যে, তাঁদের কাজ প্রশাসনের পরিপূর্ণ সমর্থন পাবে। ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণ ঘটানোতেই যাদের যাবতীয় তৎপরতা চালিত হয়, সংখ্যাগুরুবাদই যাদের চালিকা নীতি, সংখ্যালঘু গণহত্যার ডাক তাদের যে একটুও বিচলিত করবেনা, অনুষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তারা সেকথা খুব ভালো করেই জানতেন।

প্রতিবেদনের শেষে একটা প্রশ্ন — নরসিংহানন্দ সরস্বতী জানিয়েছেন, তিনি ২২-২৩ জানুয়ারি আলিগড়ে আর একটা ধর্ম সংসদ অনুষ্ঠিত করবেন। প্রশাসন কি হাত গুটিয়ে থেকে সেই আয়োজনে সবুজ সংকেত দেবে? ভালো সংখ্যক মুসলিম বাস করা আলিগড়েও কি মুসলিম-বিরোধী বিদ্বেষকে উস্কিয়ে তোলা হবে? মুসলিম গণহত্যার আওয়াজ আবার ওঠানো হবে?

খণ্ড-29
সংখ্যা-1