খবরা-খবর
জোর খাটিয়ে নাগাল্যান্ডে আবারো আফস্পা বহাল কেন্দ্রের
AFSPA is again in force in Nagaland

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ৩০ ডিসেম্বর বিজ্ঞপ্তি জারি করে নাগাল্যান্ডে সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনের (আফস্পা) মেয়াদ আরো ছ’মাস বৃদ্ধির যে পদক্ষেপ করেছে তা নাগাল্যান্ডের এক রাজনৈতিক দল এনপিএফ’এর কথায় “কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে” দেওয়া। কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত যে নাগা জনগণের এবং তারসাথে সমগ্ৰ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগণের ক্ষোভ এবং অপমান বোধকে তীব্রতর করে তুলবে তা বোঝার জন্য বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন নেই। মাসখানেক আগে, ডিসেম্বরের ৪ ও ৫ তারিখে সেনারা নাগাল্যান্ডের ‘মন’ জেলার ওটিং গ্ৰামে সংঘটিত করল ১৪ জন শ্রমিক এবং নিরীহ, নিরপরাধ গ্ৰামবাসীদের গণহত্যা। সেনাদের গুলিতে আহত হলেন আরো ৩৫ জন স্থানীয় মানুষ। নাগা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগণের সেনা ও আফস্পা বিরোধী রোষ প্রবল মাত্রায় বিস্ফারিত হল। আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি সোচ্চারে ফেটে পড়ল। নাগাল্যান্ড বিধানসভা ২০ ডিসেম্বর একদিনের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করে সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব নিল — নাগাল্যাণ্ড এবং সমগ্ৰ উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে আফস্পা প্রত্যাহারের জন্য বিধানসভা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে। এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নাগাল্যান্ডের নেতৃবৃন্দকে দিল্লীতে বৈঠকে ডাকলেন। বৈঠকে ডাকার জন্য নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেফিউ রিও, উপ-মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই প্যাটন এবং এনপিএফ নেতা টি আর জেলিয়াং অমিত শাহ’র প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন “বিষয়টিতে চূড়ান্ত গুরুত্ব দেওয়া এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষায় ইতিবাচকভাবে সাড়া দেওয়ার” জন্য। ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আফস্পা প্রত্যাহার সম্পর্কে সদর্থক সংকেত পাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। কিন্তু অমিত শাহ’র মতো ধুরন্ধর রাজনীতিবিদদের বাইরের হাবভাব দেখে ভেতরের ভাবনাকে ঠাওর করা যে দুঃসাধ্য, নাগাল্যান্ডের নেতাদের কি সেই বোধ ছিল না? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সিদ্ধান্ত তাঁদের প্রত্যাশার এবং নাগাল্যান্ডের ‘জনগণের আকাঙ্ক্ষার’ যে কথা তাঁরা বারবার বলছিলেন, তার প্রতি এক প্রবল আঘাত হয়েই সামনে এল।

নাগাল্যান্ডের নেতারা বহুদিন ধরেই জানিয়ে আসছিলেন, নাগাল্যান্ডের আইন ও শৃঙ্খলার অবস্থা এখন অশান্ত নয়। নাগা বিদ্রোহী গোষ্ঠিগুলোর সঙ্গে কেন্দ্র সরকারের দীর্ঘকাল ধরেই যুদ্ধবিরতি চলছে। নাগা রাজনৈতিক ইস্যুটার সমাধানে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সংগঠনের সঙ্গে শান্তি আলোচনাও অব্যাহত। রাজ্য নেতৃবৃন্দের মতে তাই এই রাজ্যকে ‘উপদ্রুত এলাকা’ বলে ঘোষণা করার — যা আফস্পা জারির শর্ত — কোনো যৌক্তিক ভিত্তি থাকতে পারে না। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্য রাজ্যগুলোর নেতৃবৃন্দ এবং জনগণও একই অভিমত পোষণ করে থাকেন। এই সেদিন, গত ২৯ ডিসেম্বর মনিপুর মানবাধিকার কমিশনও এই সুচিন্তিত মত প্রকাশ করল যে, মনিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি আফস্পা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে না। মানবাধিকার কমিশনের মতে মনিপুরে ‘উপদ্রুত এলাকা’র মর্যাদা অব্যাহতভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটা আর ‘ন্যায্য’ নয়, কেননা, বিদ্রোহীদের ‘প্রকোপ বৃদ্ধির’ কার্যকলাপ অনেক হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু, যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নিজের কঠোর ভাবমূর্তি নির্মাণে অত্যন্ত সচেতন ও সচেষ্ট, আফস্পা প্রত্যাহারের নাগাল্যান্ড বিধানসভার প্রস্তাবে সহমত পোষণের ‘নরম’ পদক্ষেপ তাদের ভাবমূর্তির সঙ্গে মানানসই হবে কিভাবে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তিতে অতএব বলা হল, “কেন্দ্রীয় সরকার এই মত পোষণ করে যে, সমগ্ৰ নাগাল্যান্ড রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এলাকা এমন এক অশান্ত ও বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে যে অসামরিক কর্তৃপক্ষের সহায়তায় সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানোটা জরুরি।” স্থানীয় অসামরিক কর্তৃপক্ষ, রাজ্যের শাসকরা সেনাবাহিনীর সহায়তার কোনো প্রয়োজন অনুভব না করলেও কয়েক হাজার কিমি দূরে বসে থাকা নেতা ও আমলারা সেই সহায়তা কতটা অপরিহার্য তা অবলীলায় জেনে যাচ্ছেন! ভাষ্যকাররা যখন বলেন যে, বহু বছর ধরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও দিল্লীর শাসকরা তার মর্ম উপলব্ধিতে ব্যর্থ, সেই অভিমতকে বোধহয় খুব একটা ভিত্তিহীন বলা যাবে না।

‘ওটিং’ গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত আর একটা উদ্বেগজনক বিষয় প্রত্যক্ষ করতে হল নাগাল্যান্ডের জনগণকে। শ্রমিক ও সাধারণ গ্ৰামবাসীদের হত্যাকাণ্ডে নাগাল্যান্ড সরকার যেমন এক বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করেছে, সেনাবাহিনীও উচ্চপদস্থ সেনাকর্তার নেতৃত্বে গঠন করেছে তদন্ত কমিটি। সেই কমিটির লোকজন ঘটনার তদন্তে, ৪ ও ৫ ডিসেম্বরের ঘটনা কেন ও কিভাবে ঘটল তা জানতে হত্যাস্থলে গেলেন, প্রত্যক্ষদর্শী-চিকিৎসক-পুলিশদের সঙ্গে কথা বললেন। কিন্তু স্থানীয় জনগণ অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, সেনা তদন্তকারীদের মধ্যে উপস্থিত রয়েছেন ‘ওটিং’ হত্যাকাণ্ডে জড়িত একাধিক কমাণ্ডো। কোন ভাবনা থেকে তাদের তদন্তকারী দলের সদস্য করা হল? যারা সরল, অহিংস শ্রমিক ও গ্ৰামবাসীদের হত্যা করল, সেই হত্যাকারীরাই আবার হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করবে! অতজন মানুষের হত্যা এবং তার আড়াই গুণ মানুষকে আহত করার জন্য কারা দায়ী তা নির্ণয় করে তারা রিপোর্ট দেবে! সেই তদন্ত সত্যের প্রতি কতটা অনুগত থাকবে! স্থানীয় জনগণের এক সংগঠন যথার্থভাবেই বলেছে, “এই ঘটনা সেনার তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল। সেনাবাহিনী অভিযুক্তদের সাজা না দিয়ে কড়া নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছে এবং বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যাকারীদের ফের কনিয়াক (স্থানীয় জনজাতি) ভূমিতে নিয়ে আসার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে।” হত্যাকারীদের হাতেই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সত্যের পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাই কি প্রকট নয়?

ওটিং হত্যাকাণ্ডের পর সংগঠন ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে সমগ্ৰ নাগা জনগণ যেমন আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি তুলেছিলেন, তেমনি চেয়েছিলেন এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ন্যায়বিচার, নিরপরাধ জনগণের হত্যার জন্য দায়ী সেনাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। নাগা সংগঠন ‘টিপিও’ তাদের বিবৃতিতে বলেছিল, “ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কমাণ্ডোদের দ্বারা সংঘটিত স্বেচ্ছাপ্রণোদিত গুলি চালনার ঘটনা ভারত সরকার ও তার প্রতিভূদের নাগা ইস্যুটার শান্তিপূর্ণ সমাধানের আন্তরিকতাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়।” দ্য নাগাল্যান্ড স্টেট কমিশন ফর উইমেন দাবি জানিয়েছিল, “যেকোনো মূল্যেই নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে ন্যায়বিচার দিতে হবে।” আফস্পার মেয়াদ ছ’মাস বৃদ্ধির কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত এবং সেনার তদন্তকারী দলের মধ্যে হত্যায় জড়িত কমাণ্ডোদের উপস্থিতি নাগা জনগণের এই উভয় আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের পথকে কন্টকিতই করল। প্রথমে আমরা জেনেছিলাম যে, নাগাল্যান্ড থেকে আফস্পা প্রত্যাহারের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি করা কমিটি ৪৫ দিনের মধ্যে তাদের রিপোর্ট দেবে। কিন্তু এখন আমরা জানছি সেই সময়সীমা এর দ্বিগুণ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সূত্রকে উদ্ধৃত করে ৩১ ডিসেম্বর সংস্করণের দ্য টেলিগ্ৰাফ সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে, “উচ্চপর্যায়ের কমিটি তিনমাসের মধ্যে তাদের রিপোর্ট দেবে আর সেই রিপোর্ট যতক্ষণ না পেশ হচ্ছে ততক্ষণ (আফস্পা) সম্প্রসারণ করা হল।” কেন্দ্রীয় সরকার, বিশেষভাবে তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অভিপ্রায় অতএব — নাগা জনগণ এবং রাজ্যের সরকার আফস্পা প্রত্যাহার নিয়ে ছ’মাস মুখে কুলুপ এঁটে থাকুক। আর, ন্যায়বিচারের ব্যাপারটা সেনাদেরই বিচারসাপেক্ষ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগণ এবং সেখানকার রাজনীতিবিদরাও বারবারই এই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে থাকেন যে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট রাজ্যগুলোর কণ্ঠস্বরের প্রতি নরেন্দ্র মোদী সরকারের রয়েছে ‘চূড়ান্ত অবজ্ঞা’। অতএব, সেই অবজ্ঞা, উপেক্ষাকে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে সংবিধান প্রদত্ত জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার বিপর্যস্ত হতেই থাকবে, জাতীয় নিরাপত্তার নামে প্রত্যাখ্যাত হতে থাকবে বুনিয়াদি অধিকার, মানবাধিকার সমূহ। নাগা সংগঠন এনপিএফ’এর বিধায়ক ইমকং এল ইমচেন প্রস্তাব দিয়েছিলেন, “কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি করা কমিটি রিপোর্ট না দেওয়া পর্যন্ত নাগাল্যান্ডে আফস্পাকে মুলতুবি রাখা হোক”। সেটুকু করতেও স্বৈর সরকারের কি প্রবল অনীহা!

খণ্ড-29
সংখ্যা-2