প্রতিবেদন
সরকারি উদ্যোগে ধান সংগ্রহ : একটি খণ্ডচিত্র
Paddy collection

এরাজ্যে সরকারি উদ্যোগে ধান সংগ্রহের চিত্রটা ঠিক কেমন? কৃষকদের ঠিক কত শতাংশ সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারেন আর কৃষকের নাম করে ফড়ে-ব্যবসাদাররাই বা (মিল মালিকেরা তো বটেই) কতটা মুনাফা পকেটস্থ করে — এসব নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। দুধ-জল মিশিয়ে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার কতটা সরকার পূরণ করতে পারে তারও হদিশ মেলা বেশ দুষ্কর। সামান্য খোঁজ খবর নিতে গিয়েই তো চক্ষু চড়কগাছ! গত ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে (১২ ডিসেম্বর ২০২১) এক বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র থেকে জানা গেল, হুগলী জেলায় এবার (২০২১-২২ সংগ্রহ বর্ষে) ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছে ৪ লক্ষ ২৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, আর ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৭ হাজার মেট্রিক টন। এভাবে চললে, গন্তব্যের অনেক আগেই না গাড়ি থেমে যায়! অবশ্য শুরুর এই জড়তা কাটিয়ে এখন ধান সংগ্রহের ক্ষেত্রে নিশ্চয় কিছুটা গতি সঞ্চার হয়েছে। জেলার অন্তত একটি ব্লকে অনুসন্ধান চালানোর পর, এর বাস্তব চেহারা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই প্রতিবেদনে হুগলী জেলার পান্ডুয়া ব্লকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ধান সংগ্রহের চিত্রটা তুলে ধরা হচ্ছে। তবে এর আগে, সরকারি উদ্যোগে ধান সংগ্রহের সাধারণ নিয়মবিধি ও প্রাথমিক বিষয়ে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া যেতে পারে।

সরকার কোনও বছরের অক্টোবর মাস থেকে পরের বছর সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ধান সংগ্রহ করে। তবে অক্টোবর মাস তো বাংলা হিসেবে আশ্বিন মাস। তখন আমন ধান সবে পাকতে শুরু করে। কৃষক তার জমির ধান কেটে তা খামারে আনতে আনতে অঘ্রাণ মাস গড়িয়ে যায়। সোজা কথায় ধান সংগ্রহের কাজটা ব্যবহারিকভাবে শুরু হয় ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। আর জোর কদমে কাজটা চলে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ অবধি। সে যাই হোক, একজন কৃষক সরকারকে সর্বোচ্চ ৭৫ বস্তা (৬০ কেজি) বা ৪৮ কুইন্টাল ধান বিক্রি করতে পারেন। এক একর পর্যন্ত জমির মালিক সরকারকে দিতে পারেন ৩০ বস্তা বা ১৮ কুইন্টাল ধান। সরকারের ঘোষিত এই নীতি বা নিয়ম কার্যক্ষেত্রে অনুসৃত হয় কিনা সেটা অন্য ব্যাপার। সরকার ধান সংগ্রহ করে – (১) খাদ্য দপ্তর অথবা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ নিগম (ইসিএসসি) কর্তৃক চালিত স্থায়ী শিবির (সিপিসি) মারফত, (২) ইসিএসসি বা বেনফেড চালিত অস্থায়ী শিবির (ডিপিসি) মারফত, (৩) স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে, (৪) সমবায় সমিতির মাধ্যমে এবং (৫) কৃষি উৎপাদক সংস্থা (এফপিও) মারফত।

গতবছর (২০২০-২১) পর্যন্ত পান্ডুয়া ব্লকে ধান সংগ্রহের স্থায়ী শিবির ছিল মাত্র একটি — পান্ডুয়া গঞ্জের ‘নিয়ন্ত্রিত বাজারে’। এবারে আরও একটি স্থায়ী শিবির খোলা হয়েছে (রামেশ্বরপুরে)। বেনফেড চালিত একটি অস্থায়ী শিবির ধান কিনছে পাঁচগড়া-তোরগ্রাম পঞ্চায়েতের নপাড়ায়। কোনও স্বনির্ভর গোষ্ঠী এবছর এখনও অবধি ধান কেনেনি, যদিও গতবছর মহিলাদের একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী (জায়ের-দ্বারবাসিনী পঞ্চায়েতের দীঘা গ্রামে) দক্ষতার সঙ্গে প্রায় ২ হাজার কুইন্টাল ধান সংগ্রহ করেছিল। একটি সমবায় সমিতি (শিবনগর, সিমলাগড়-ভিটাসিন জিপি) ধান সংগ্রহ করছে। দুটি কৃষি উৎপাদক সংস্থা — ‘কৃষিবিপ্লব’ এবং ‘কল্পতরু’ও ধান সংগ্রহ করছে। ব্লকে গ্রামের সংখ্যা ১৫৮, আর এবছর স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে সরকারি দরে ধান সংগ্রহের কেন্দ্র — এখনও পর্যন্ত সাকুল্যে ৬টি। ব্লকে মোট ধানচাষির প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ করা খুব দুরূহ, তবে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯ জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত পান্ডুয়া ব্লকে ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পে আবেদন করেছেন ২৩,৯৩৩ জন। ধরে নেওয়া যায়, এরা প্রত্যেকেই ধান চাষ করে থাকেন। এদের মধ্যে অনেকে নিজেরা চাষ করেন না। ঠিকা চাষি বা ভাগচাষিরা তাঁদের জমি চাষ করেন। তবে ধান চাষির সংখ্যাটা অবশ্যই ২৫,০০০ ছাড়িয়ে যাবে, কেননা অনেক চাষি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জমি চাষ করলেও, মিউটেশন করাতে না পারায় জমির পর্চা হাতে পাননি এবং ‘কৃষক বন্ধু’র জন্য আবেদন করতে পারেননি।

এখন দেখা যাক, মোটামুটি ২৫,০০০ চাষির মধ্যে এবছর এখনও পর্যন্ত মোট কত চাষি সরকারকে ধান বেচতে পেরেছেন।

১) পান্ডুয়া নিয়ন্ত্রিত বাজারের স্থায়ী শিবির ১,৯৬১ জন কৃষকের থেকে ধান সংগ্রহ করেছে ৫৪,৬৪৩ কুইন্টাল।
২) রামেশ্বরপুরের স্থায়ী শিবির ৪০০ জন কৃষকের থেকে ধান সংগ্রহ করেছে ১১,০০০ কুইন্টাল।
৩) পাঁচগড়া-তোরগ্রাম অঞ্চলে বেনফেড ৬৪ জন কৃষকের থেকে কিনেছে ১,১০০ কুইন্টাল ধান।
৪) কল্পতরু (এফপিও) ১২৯ জন কৃষকের থেকে কিনেছে ৫,০০০ কুইন্টাল ধান।
৫) কৃষিবিপ্লব (এফপিও) ৭০ জন কৃষকের থেকে কিনেছে ৩,৫০০ কুইন্টাল ধান।
৬) শিবনগর সমবায় ৭০ জন কৃষকের থেকে কিনেছে ১,৭০০ কুইন্টাল ধান।

(যাবতীয় তথ্য ১৭ জানুয়ারি ২০২২ অবধি সংগৃহীত)

তাহলে হিসেব বলছে, এযাবৎ ২,৬৯৪ জন চাষির থেকে ধান কেনা হয়েছে এবং সংখ্যাটি হল ব্লকের মোট কৃষকের ১০.৭৭ শতাংশ মাত্র। সরকারি ধান সংগ্রহের পরিমাণ অবশ্যই গতবছরের তুলনায় কম। পান্ডুয়া নিয়ন্ত্রিত বাজারের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক বলছেন, “এখনও পর্যন্ত এই কেন্দ্রে যে পরিমাণ ধান কেনা হয়েছে তা গতবছরের পরিমাণের অর্ধেক মাত্র। যদিও তখন একটিই সিপিসি ছিল। এবার আর একটি সিপিসি (রামেশ্বরপুর) থেকেও ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে।” রামেশ্বরপুরের সংগৃহীত ধানের পরিমাণকে ‘পান্ডুয়া নিয়ন্ত্রিত বাজারের’ কেনা ধানের সঙ্গে যোগ করলেও পরিমাণটা গতবছরের থেকে প্রায় ৩৯ শতাংশ নিচে।

Paddy collection a fragment

এবছর ধান কেনার পরিমাণ এমন কম হওয়ার একটা কারণ, ধানের বাজারদর গতবছরের তুলনায় এবার অনেকটা ভালো। বেশ কয়েকদিন ৯৬০ টাকা বস্তা দরেও ধান বিক্রি হয়েছে — যা গতবছরের তুলনায় ৫০-৬০ টাকা বেশি। সরকারকে ধান দেওয়ার ক্ষেত্রে চাষিকে বেশ কিছু ঝক্কি সামলাতে হয়। প্রথমত গ্রাম থেকে অনেক দূরে ক্রয়কেন্দ্র। সেখান থেকে টোকেন পাওয়া গেলেও, নির্দেশিত রাইসমিলে অন্তত ২০ দিনের আগে ওই ধান দেওয়া যাবে না। এর ওপর, সরকারি নিয়মে; আর্দ্রতার পরিমাণ অনুযায়ী কুইন্টাল প্রতি ৭ কেজি ধান বেশি দিতে হবে (আসলে মিল মালিক ৬০ কেজি বস্তার বদলে ৬৫-৬৬ কেজিও নিয়ে নেয়)। এছাড়া টাকা পাওয়ার জন্য আর একবার ক্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে। একজন চাষি তো সাফ বলে দিলেন, “সবদিক হিসেব করে দেখেছি, সরকারকে ধান দিলে বস্তা পিছু খুব জোর ১২০ টাকা বেশি পাওয়া যাবে। দু’তিন দিন দৌড়োদৌড়ির চেয়ে, ঘরে বসে সঙ্গে সঙ্গে নগদ যা পাওয়া যায় সেটাই ভালো।” এখানে উল্লেখ্য, চাষি ইচ্ছা করলে রাইস মিলের পরিবর্তে সিপিসি’তেও ধান সরবরাহ করতে পারেন। কিন্তু সিপিসি’তে ট্রাক্টরশুদ্ধ ওজন করার ব্যবস্থা না থাকার ফলে ধান ওজনের জন্য কৃষককে সারাদিন বসে থাকতে হয়। সেজন্য অনেকেই রাইস মিলে ধান দেওয়ার জন্য টোকেন নেন।

এবছর সরকারি ধান সংগ্রহের পরিমাণ কম হওয়ার আর একটা কারণ, এবার ধানের ফলন হয়েছে কম। একজন আদিবাসী বর্গাদার জানালেন, তিনি গতবছর সরকারকে (এফপিও) ১০০ বস্তা ধান বেচেছিলেন আর এবার বেচেছেন ৬৬ বস্তা। ফলন মার খাওয়ায় এবার তিনি সরকারকে কম ধান দিতে পেরেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ওই বর্গাদার প্রত্যক্ষ সরকারি কেন্দ্রে ধান দিতে গিয়ে নাকাল হয়ে শেষে এফপিও’র দ্বারস্থ হয়েছেন। তিনি নিজেও এফপিও’টির শেয়ার হোল্ডার। এধরনের এফপিও ১৫০ থেকে ২০০ কৃষককে নিয়ে গঠিত অংশীদারী সংস্থা, যেখানে প্রত্যেক চাষি এককালীন এক হাজার টাকা দেন, সংস্থার অংশীদার হন এবং সংস্থার মূলধন গড়ে  ওঠে। এফপিও’টির পরিচালন পদ্ধতি মন্দ নয়। যে কারণে বর্গাদারটিকে কোথাও যেতে হয়নি। তার বাড়ি থেকেই এফপিও’র নিজস্ব গাড়ি এসে ধান বয়ে নিয়ে গেছে।

সংগ্রহ কেন্দ্রের অপ্রতুলতা, দিনের দিনই ধান সংগ্রহ না করে ‘লম্বা তারিখ দেওয়া’, আর্দ্রতার অজুহাতে বেশি ধান নেওয়া এবং সর্বোপরি নিজস্ব নামে জমির পর্চা না থাকায় অনেক চাষীই সরকারকে ধান দিতে পারেন না। তথাপি কিছু ক্ষুদ্র কৃষকও সরকারকে ধান দিতে পারছেন। কিন্তু সরকারকে ধান বেচার বেশিরভাগ ফায়দাটা নিচ্ছে কিছু ধুরন্ধর চাষি ও মধ্যসত্বভোগী। দু’একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হতে পারে। একজন কৃষক তাঁর জমির পরিমাণ অনুযায়ী যত বস্তার টোকেন পাওয়ার কথা তার থেকে বেশি বস্তার টোকেন ম্যানেজ করে নিলেন। এরপর নিজের গোলার ধানকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ না করে বাজার থেকে সস্তায় ধান কিনে সেই ধান সরকারকে বেচে দিয়ে বস্তাপিছু দুশো-সওয়া দুশো টাকা লাভ তুলে নিলেন। পরে ধানের বাজার চড়া হলে গোলায় সঞ্চিত ধান বিক্রি করে আবার বেশ কিছু টাকা কামালেন। এছাড়া ‘১০০ দিনের কাজের’ মতো ফড়েদের কারচুপি তো আছেই। ‘১০০ দিনের কাজ’ না করেও যেমন অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকে যায় এবং সুপারভাইজার বা শাসক দলের দাদা কমিশন পেয়ে যান, তেমনি ফড়ে বা ব্যবসাদার ‘বিশ্বস্ত’ চাষির পর্চা; আধারকার্ড ইত্যাদি দেখিয়ে সস্তায় কেনা ধান সরকারকে সাপ্লাই করে, আর চাষি কিছু কমিশনের বিনিময়ে ব্যবসাদারকে টাকা তুলে দেয়। এই মোটা দাগের দুর্নীতি মানুষের গা-সওয়া। তবে সরকার যখন দেখে, লক্ষ্যমাত্রার থেকে সংগ্রহের পরিমাণ অনেক কম তখন সব নিয়ম কানুন শিথিল হয়ে যায়। আগে একবার যিনি টোকেন পেয়েছিলেন, তিনি অবলীলায় পুনরায় টোকেন তুলে আনেন। আর বলা বাহুল্য, ততদিনে গরিবের ঘরে আর ধান নেই। ধান যাঁর গোলায় বাঁধা থাকে তিনিই বেশি ধান বিক্রির সুযোগটার ‘সদ্ব্যবহার’ করেন।  

- মুকুল কুমার

খণ্ড-29
সংখ্যা-4