প্রতিবেদন
রাষ্ট্রের দানবিক দাপটকে প্রতিহত করার দাবি জানাচ্ছে কাশ্মীর পরিস্থিতি
The situation in Kashmir

কাশ্মীরে সেনা অপরাধের অভিযোগে পুলিশের তদন্তে উপত্যকার জনগণ যদি অনাস্থা প্রকাশ করেন, সেটাকে কি অনধিকার কাজ বলা যায়? তদন্তে সত্য অনুদঘাটিত থাকছে এবং সেনাদের অপরাধকে আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে মনে হলে তদন্তের সমালোচনা ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোটা কি স্বাভাবিক ও ন্যায্য ব্যাপার বলে বিবেচিত হওয়ার নয়? কিন্তু যেখানে জঙ্গি সক্রিয়তার পাশাপাশি সেনা ও পুলিশের নিপীড়ন ও নির্মমতা এক প্রশ্নহীন বিস্তৃত বাস্তবতা, সেখানে সাধারণ অসামরিক জনগণের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডকেই প্রশ্নের মুখে ফেলা হচ্ছে। শ্রীনগর সংলগ্ন হায়দারপোরায় তথাকথিত সংঘর্ষের ঘটনাটা ঘটে গতবছরের ১৫ নভেম্বর, যে ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছিল। এদের মধ্যে তিনজন হলেন দন্ত চিকিৎসক মুদাসিসর গুল, ব্যবসায়ী ও যেখানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে সেই বাড়ির মালিক আলতাফ আহমেদ ভাট এবং গুলের অফিসে কাজ করা আমির মাগরে উপত্যকার নাগরিক এবং অন্যজন বিলাল ভাই হল পাকিস্তানি নাগরিক। নিহতদের পরিবার এবং সাধারণ জনগণের দিক থেকে এটাকে ভুয়ো সংঘর্ষ এবং সেনাদের দ্বারা ঠাণ্ডা মাথায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বলে অভিহিত করা এবং তার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ সংগঠিত হলে প্রশাসনের তরফে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। তদন্তের জন্য গঠন করা বিশেষ তদন্তকারী দল বা ‘সিট’ তাদের রিপোর্ট পেশ করে গত ২৮ ডিসেম্বর এবং তাতে নিহত চারজনকেই জঙ্গি ও জঙ্গি-সহযোগী বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু জনগণের উপলব্ধি ও বিশ্বাসে যেটা ভুয়ো সংঘর্ষ ছাড়া অন্য কিছু নয়, পুলিশের রিপোর্টে সেটি সম্পূর্ণ বিপরীত রূপে উপস্থাপিত হওয়ায় তাঁরা রিপোর্টের সমালোচনা করলেন। কিন্তু পুলিশ বলল সেই সমালোচনা আসলে হল ‘মনগড়া বিবৃতি’ যা সাধারণ জনগণ অথবা সমাজের বিশেষ অংশের মধ্যে “প্ররোচনা, গুজব, আতঙ্ক ও ত্রাস” সৃষ্টি করতে চায়। পুলিশ সেই সমালোচনা বন্ধের নির্দেশ দিল, বন্ধ না হলে দণ্ডবিধি কাজে লাগিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হল। যে ঘটনা এত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যাতে নিহতদের পরিবার ও জনগণ এবং পুলিশ ও প্রশাসন সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে, তথাকথিত সংঘর্ষের সেই ঘটনাটার দিকে ফিরে তাকানোটা জরুরি।

হায়দারপোরার ঘটনা প্রসঙ্গে পুলিশ জানিয়েছিল, সেই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদীদের উপস্থিতি রয়েছে বলে তারা খবর পেয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সেনারা বাড়ির মালিক আলতাফ আহমেদ ভাট ও দন্ত চিকিৎসক মুদাসিসর গুলকে তাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল জঙ্গিদের লুকিয়ে থাকা স্থানকে চিহ্নিত করার জন্যে। ওয়েব পত্রিকা ‘দ্য প্রিন্ট’এর ২১ নভেম্বর সংস্করণে অনন্যা ভরদ্বাজের প্রতিবেদনে হায়দারপোরা ঘটনা প্রসঙ্গে পুলিশের একটা বিবৃতি উল্লিখিত হয়েছে যাতে বলা হয়, “আলতাফ আহমেদ নামে বাড়ির মালিক এবং মুদাসিসর গুল নামে ভাড়াটেকে তল্লাশি দলের সঙ্গে যেতে বলা হয়।... কিন্তু প্রথম দিকে হওয়া গুলির বিনিময়ে তল্লাশি দলের সঙ্গে যাওয়া উভয় ব্যক্তিই গুলিতে গুরুতর রূপে আহত হন এবং পরে মারা যান। এরপর যে সংঘর্ষ শুরু হয় তাতে ঘরে লুকিয়ে থাকা উভয় জঙ্গিকে নিকেশ করা হয় এবং সংঘর্ষ স্থল থেকে তাদের দেহ উদ্ধার হয়।”

সংঘর্ষের ঘটনার পরপরই নিহত চার ব্যক্তির দেহ পুলিশ কবর দিয়ে দেয়। কিন্তু নিহতদের পরিবার এবং সাধারণ জনগণের দিক থেকে প্রবল প্রতিবাদের মুখে পুলিশ মুদাসিসর গুল ও আলতাফ আহমেদ ভাটের দেহ কবর থেকে তুলে দুই পরিবারের হাতে দেয় এবং পরিবার যথাবিহিত নিয়ম মেনে তাদের সমাধিস্থ করে।

state's monstrous power be resisted

সেনারা যে আলতাফ আহমেদ ভাট এবং মুদাসিসর গুলকে তাদের সঙ্গে তল্লাশিতে নিয়ে গিয়েছিল, তা নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের সঙ্গে পুলিশের বিবৃতির মিল রয়েছে। কিন্তু পুলিশকে নিয়ে গঠিত ‘সিট’এর ২৮ ডিসেম্বরের রিপোর্টে যা বলা হল তারসঙ্গে পুলিশের দেওয়া আগের বিবৃতির আর মিল থাকছে না। ‘সিট’এর রিপোর্টে বলা হল — বিলাল ভাই ও আমির মাগরে ছিল প্রশিক্ষণ পাওয়া জঙ্গি আর মুদাসিসর গুল ও আলতাফ আহমেদ ভাট ছিল জঙ্গি সহযোগী। মুদাসিসর গুল, দুই জঙ্গি বিলাল ভাই ও আমির মাগরেকে কয়েক দিন নিজের চেম্বারে অর্থাৎ, আলতাফ আহমেদ ভাটের বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন। তিনি দুই জঙ্গিকে আলতাফের বাড়িতে পৌঁছে দেন এবং বিলাল ভাই তাঁকে হত্যা করে প্রমাণ লোপের উদ্দেশ্যে। জঙ্গিরা আলতাফ আহমেদ ভাটকে মানব ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে সেনাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে চলে।

‘সিট’এর এই রিপোর্টকে যেমন নিহতদের পরিবারের লোকজন মানেনি, সেরকমই প্রত্যাখ্যান করেছে সমস্ত রাজনৈতিক দল। আলতাফ ভাটের ভাই আবদুল মজিদ তার দাদাকে জঙ্গিদের মানব ঢাল হিসাবে ব্যবহার করার পুলিশি আখ্যানকে আষাঢ়ে কাহিনী বলে অভিহিত করে বলেন, “তাঁর মাথাকে চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়েছিল এবং দেহের বিভিন্ন অংশ ভাঙ্গা হয়েছিল। পুলিশ যা বলছে তা নির্ভেজাল মিথ্যাচার।” ‘সিট’এর রিপোর্টে মুদাসিসর গুলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে খণ্ডন করে তাঁর স্ত্রী হুমারিয়া বলেন, “ওরা বলছে মুদাসিসর নিজের গাড়িতে ওদের নিয়ে গিয়েছিলেন; তখন ওরা কেন তাঁকে গ্ৰেপ্তার করল না?” আমির মাগরের বাবা ৫৮ বছর বয়সী আব্দুল লতিফ মাগরে জঙ্গি দমনে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সাহসিকতার পুরষ্কার পেয়েছিলেন এবং ‘সিট’এর রিপোর্ট বেরোনোর পর তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল, “আমার ছেলে কি করে জঙ্গি হতে পারে, কেননা, এই অঞ্চলে জঙ্গি কার্যকলাপ শীর্ষে পৌঁছোনোর সময় আমি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি?”

হায়দারপোরার ঘটনা নিয়ে ‘সিট’এর তদন্ত রিপোর্ট যে কোনো রাজনৈতিক দলের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি, তার প্রমাণস্বরূপ দুটো মাত্র প্রতিক্রিয়া এখানে আমরা উপস্থাপিত করব। কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করছে পাঁচদলের যে গুপকর জোট, তার মুখপাত্র সিপিআই(এম) নেতা ইউসুফ তরিগামি বলেছেন, “জনগণের মধ্যে এই ধারণাটা জোরালোভাবে রয়েছে যে নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনায় নিহত অসামরিক নাগরিকদের মানব ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছিল এবং পুলিশের সাম্প্রতিকতম বিবৃতি ধামাচাপা দেওয়ার একটা বানানো গল্প। সাধারণ জনগণ এবং নিপীড়নের শিকার হওয়া নিহতদের পরিবারগুলোর ন্যায়সংগত উদ্বেগের পক্ষে এটা একেবারেই যথেষ্ট নয়।” বিজেপি ঘনিষ্ঠ পিপলস্ কনফারেন্স তাদের বিবৃতিতে বলেছে, “এরআগে হওয়া হাজার-হাজার তদন্তের সঙ্গে কমা বা পূর্ণচ্ছেদের, এবং পুনরাবৃত্তির ও প্রতিরূপের একটাও অদলবদল নেই। ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করার নৈতিক সাহস এই সরকারের আছে বলে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস আমাদের নেই।”

দিন যত গড়াচ্ছে, ভারতীয় রাষ্ট্রের তুঘলকি শাসনের মাত্রা আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। সংবিধানকে অগ্ৰাহ্য করা, গণতন্ত্রকে পরিহার করা, হিন্দুত্বর বাহুবলী শক্তিগুলোর দাপটকে বাড়িয়ে চলার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। রাষ্ট্রের এই দানবীয় রূপের সামনে জনগণের অধিকারগুলো মুখ থুবড়ে পড়ছে। ভারতে মানবাধিকারের এই বিপর্যয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আলোড়ন তোলে। কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা হরণের পর সেখানে ভারত সরকার সৃষ্ট মানবাধিকারের বিপন্নতা নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশলেট। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা, জনসমাবেশের অসম্মতি, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের গ্ৰেপ্তারি নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। সম্প্রতি তিনি আবার বলেছেন, “সারা ভারতে ইউএপিএ’কে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক, আর দেশে এই আইন প্রয়োগের সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটছে জম্মু ও কাশ্মীরে।” এছাড়া দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের এই দানবীয় রূপে ধারণাগত অবয়ব প্রদান করছেন রাষ্ট্রেরই গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত কিছু ব্যক্তিত্ব। অল্প কিছুদিন আগে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় যিনি প্রয়াত হলেন, প্রতিরক্ষা কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে প্রধান সেই বিপিন রাওয়াত বলেছিলেন, ‘সন্ত্রাসবাদীদের’ হত্যা করলে সেটা মানবাধিকারের কোনো লঙ্ঘন হতে পারেনা। তাঁর নির্দিষ্ট কথাগুলো ছিল এরকম, “কাশ্মীরের মানুষজন বলছেন যে তাঁরা জঙ্গিদের গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলবেন, তাঁরা এমন ব্যবস্থা করবেন বলছেন যার মাধ্যমে জঙ্গিরা গণপ্রহারের শিকার হয়। এটা একটা ইতিবাচক লক্ষ্মণ। জঙ্গিকে হত্যা করলে সেটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন হবে কেমন করে? আপনার এলাকায় কোনো জঙ্গি সক্রিয় হলে তাকে আপনি হত্যা করতে পারবেন না কেন?” রাওয়াতের বক্তব্য শুধু কাশ্মীরের বাস্তবতার বিপরীতই নয়, তা বিজেপি’র প্রিয় বিষয় লিঞ্চিং বা গণপিটুনির ওকালতি করছে। তাঁর অভিমত অনুযায়ী ‘সন্ত্রাসবাদী’ বা ‘জঙ্গি’ বলে কাউকে দাগিয়ে দিতে পারলেই সে হয়ে পড়বে মানবাধিকার বর্জিত ব্যক্তি, বেঁচে থাকার অধিকার তার আর থাকবে না। হায়দারপোরার ‘সংঘর্ষ হত্যার’ ঘটনা নিয়ে ‘সিট’এর রিপোর্টও যেন রাওয়াত তত্ত্বেরই প্রতিফলন। সেনারা নিয়ে যাচ্ছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা যাদের দেখলেন, পুলিশের বিবৃতিতে যাদের তল্লাশি দলের সঙ্গে যেতে বলা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হল, ‘সিট’এর রিপোর্টে তারা হয়ে গেল জঙ্গি-সহযোগী। আর তাই তাদের হত্যাও কোনো আইনি বিধানের লঙ্ঘন এবং সেই হত্যার জন্য কেউ দায়ী হতে পারে না! কিছু কঠোর আইনই তো এই অবস্থানকে মদত জোগাচ্ছে! দানবীয় ও গণতন্ত্রের পরিপন্থী ইউএপিএ এবং সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনের দশক-দশক ধরে নিরবচ্ছিন্ন প্রয়োগ রাষ্ট্রের দুরাচারী ভাবমূর্তিকেই প্রবলতর করছে। রাষ্ট্রের এই দানবীয় দাপটকে প্রতিহত করাটাই নতুন বছরে ভারতীয় জনগণের সামনে এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে আসছে।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-29
সংখ্যা-2