সম্পাদকীয়
রেশনে গরিবদের পাওনা ফের অনিশ্চয়তায়!
poor in the ration!

নতুন বছরে কিছু নতুন পাওয়ার আশা জাগে মানুষের, বিশেষ করে দারিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষজন মুখিয়ে থাকেন যদি অভাব মোচনে কিছু নতুন প্রাপ্তিযোগের খবর মেলে। কিন্তু ২০২২ সালের সূচনায় বাংলার গরিব জনগণের উল্টে শুরু হল বঞ্চনার পালা। এরাজ্যের ‘গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’র আওতায় গণ্য হওয়া মানুষেরা জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রের কোটা অনুযায়ী খাদ্যশস্যের পরিষেবা পাবেন না। এরকমই জানিয়েছে অল ইন্ডিয়া ফেয়ার প্রাইস শপ ফেডারেশন। এআইএফপিএসএফ’এর কাছে খবর পৌঁছেছে বাংলার জন্য কেন্দ্রের উপরোক্ত বরাদ্দের ভাঁড়ারে লেগেছে টান। আরও খবর হল, এফসিআই নাকি রাজ্যের চাহিদা অনুযায়ী ধান সংগ্রহ করে উঠতে পারেনি! কিন্তু কেন করে উঠতে পারেনি তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। শুধু জানা যাচ্ছে, জানুয়ারির কোটা ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া হবে — ফেব্রুয়ারির কোটা মার্চে দেওয়া হবে। তারপর মার্চের পাওনা কবে মেটানো হবে, আদৌ হবে কিনা সে খবর নেই। বরাদ্দ সরবরাহের দায় কেন্দ্র স্থির করেছে একমাস করে পিছিয়ে দেবে। তাহলে জানুয়ারির এই খাদ্যশস্য পাওয়ার ঘাটতিটা পূরণ হবে কোথা থেকে? হয় অনাহার-অর্ধাহার থাকতে হবে। বাজার থেকে চাল-আটা কিনে অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন মেটানোর উপায় কৈ!

সরকারপক্ষ খাদ্যশস্যের প্রশ্নে বাজার অর্থনীতিকে প্রাধান্য দেওয়ার পরিণামে বাস্তবে কোপটা পড়ছে দু’ভাবে। একদিকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান-চালের সরকারি সংগ্রহ অভিযানে দেওয়া হচ্ছে চরম ঢিলা। ফলত অবিলম্বে ব্যয় উসুলের তাড়নায় চাষিকে বাধ্য করা হচ্ছে ফড়ে-দাদনদার চক্রের মাধ্যমে বাজারের শক্তিগুলোর কাছে খাদ্যশস্য বেচে দিতে, এবং অতি লোকসানে। ফলে চাষিসমাজ পড়ছে সংকটের আবর্তে। এই কারণে গত একবছর যাবত কৃষক আন্দোলন চলেছে। অন্যদিকে সেই খাদ্যশস্যের বাজার দাম চড়া হয়েই চলেছে। বিশেষত পশ্চিমবাংলায় পরপর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক শস্যহানি হওয়ায় মওকা বুঝে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিগুলো ভীষণ সক্রিয় হয়েছে। আরও চড়িয়ে দিয়েছে সবরকমের চাল-আটা ইত্যাদির দাম। তাই গরিব মানুষেরা ক্ষুধার জ্বালা মেটাবে কী করে? ঋণ করে পেট ভরানোর উপায় করতে গেলে উপরন্তু তাড়া করবে সুদের ভোগান্তি। নাহলে অগত্যা খাদ্যশস্য গ্রহণের পরিমাণ কমে যাওয়াই অনিবার্য। ২০২১ সালের নভেম্বরেও কেন্দ্র দম্ভ দেখাতে ছাড়েনি, মোদী আমলে ভারত হয়ে উঠেছে বাইরের দুনিয়ায় যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য খাদ্যশস্যের রপ্তানীকারক দেশ। অথচ এরা লজ্জার মাথা খেয়ে স্বীকার করে না বিশ্ব ক্ষুধার সূচকে ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ২০২০ সালে ৯৪, আর ২০২১ সালে ১০১। সামনে আবার সেই আরও দুঃসহ দুরবস্থারই সম্মুখীন হতে হবে। কেন্দ্রের তরফে বলা হচ্ছে, উদ্ভুত সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছে নাকি কেবল এই পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে। এখানে এফসিআই মারফত খাদ্যশস্য ঠিকমতো সংগ্রহ না হওয়ার কারণেই সমস্যা তৈরি হয়েছে। এভাবে কেন্দ্র সংগ্রহে ভাটা চলার পেছনে যদি ‘যুক্তিজাল’ বিছোতে চায় যে, যেহেতু এই রাজ্য থেকে এফসিআই মারফত ধান-চাল সংগ্রহ করে রেশনে উপরোক্ত বিনামূল্যে খাদ্যশস্যের কোটা মেটানো হয়, আর সেটা যেহেতু অতি সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে সংগ্রহ করার উপায় থাকেনি, তাই মাসিক সরবরাহ একমাস করে পিছোবে। কিন্তু এই যুক্তির ধৃষ্টতা ধোপে টেঁকে না। কারণ, প্রথমত কেন্দ্রের বরাদ্দ কোটার নির্ধারিত মেয়াদকাল হল চারমাস। প্রতি চারমাস অন্তর খতিয়ে দেখে কোটা বৃদ্ধি-হ্রাসের পলিসি পুনর্বিন্যাস করার কথা। তাহলে এরাজ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটার আগে সময় থাকতে মজুদ সারা হয়নি কেন? তাছাড়া এই রাজ্য থেকে মজুদ করা না গেলেও জরুরি প্রয়োজনে অন্য রাজ্য থেকে সংগ্রহ করে দেওয়া হবে না কেন? ‘এক দেশ, এক রেশন’এর ঢাক পেটানোয় বিরতি হয় না। অথচ যখন-তখন পোহাতে হয় রেশন-বঞ্চনা।

কেন্দ্রের ‘গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’ প্রকল্পে রয়েছেন এরাজ্যের ৬ কোটি ১ লক্ষ মানুষ। কেন্দ্র জাহির করছে এবাবদ বিগত চারমাসে খাদ্যশস্য সরবরাহ করার সর্বশেষ নির্ধারিত পরিমাণ হল ৩০ কোটি ৫০ লক্ষ মেট্রিক টন। কেন্দ্রের কথা হল, রাজ্যের চাহিদার ভিত্তিতেই বরাদ্দের পরিমাণ স্থির করা হয়। যদিও রাজ্য সরকারের রিপোর্ট কার্ডও স্বচ্ছ নয়। এবিষয়ে তাই কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যেকার তর্কাতর্কি থেকে দোষের ভাগের প্রকৃত তল পাওয়া খুব মুশকিল। তবে কেন্দ্র এটা ভোলাতে পারবে না যে, সহজে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য সরবারাহের এই দায় নিতে চায়নি। ক’দিন আগেও শোনা গেল কেন্দ্র-রাজ্যের শাসকরা যে যার লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে ‘ভূয়ো’ ছেঁটে ফেলার অভিযান শুরু করতে চলেছে। মোদী জমানায় বেকারি বৃদ্ধি ৪৫ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তার ওপর ২০২০’র প্রথম ত্রৈমাসিক পর্ব থেকে অতিমারীর চোটে কর্মসংস্থানের সংকট এক ধাক্কায় চরমে উঠে যায়। প্রচন্ড বিধ্বস্ত হয় সমগ্র অসংগঠিত ক্ষেত্র। রাজ্যে রাজ্যে দৃশ্যমান হতে থাকে কপর্দকশূন্য ভুখা জনতার ক্রমবর্ধমান ভীড়। এই প্রেক্ষিতে ২০২০ থেকেই দেশজুড়ে ঝড় ওঠে — “ভাষণ নয়, রেশন দাও, প্রতি শূন্য হাতে নগদ দাও!!” এরই চাপে কেন্দ্র কেবল বিনামূল্যে রেশন দিতে শুরু করে। তাও পর্যাপ্ত নয়, কিছু পরিমাণে। নগদ দেওয়ার নাম আজ পর্যন্ত করেনি। ২০২১ সালের শেষের শুরুর দিনগুলো থেকেই কেন্দ্র খবর ভাসাতে থাকে, বিনামূল্যে রেশন আর দেওয়া হবে না। সুতরাং সন্দেহ জাগা অবিচিত্র নয়, পশ্চিমবাংলায় গরিব কল্যাণ খাতে অন্ন বণ্টনের মাসিক কোটা স্থগিত রাখা ও একমাস পিছিয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনও পরিকল্পিত প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়া হচ্ছে না তো!

খণ্ড-29
সংখ্যা-1