প্রতিবেদন
সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী সমাজ শাসন ব্যবস্থার গঠন
system of the Santals

সাঁওতালরা হলেন ভারতের অন্যতম একটি তৃতীয় বৃহত্তম প্রধান আদিম অধিবাসী গোষ্ঠী। তাঁরা নিজেদেরকে হড় বা হড় হপন আবার সান্তাড় বলেও অভিহিত করে থাকেন। সান্তাড় তথা সাঁওতালরা হলেন ভারতের অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর মতো একটি জাতি, যে জাতি নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী শাসন ব্যবস্থার দ্বারা নিজেদেরকে পরিচালিত করে থাকেন। সান্তাড়দের পুরাণ তথা ধর্মগ্রন্থ জমসিম বিন্তি (যা হল সারিধরম-এর ধর্মগ্রন্থ) থেকে জানা যায় যে, সেরমাপুরী তথা স্বর্গে চাঁওরিয়া মেলা নামক এক দৈব বিচারালয়ে এমন একজন শাসনকার্য ও বিচারকার্য পরিচালনা ও সম্পাদন করতেন যিনি হলেন সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও ধ্বংসকর্তা। সান্তাড়দের কাছে ইনি হলেন ঠাকুর জিউ। ঠাকুর জিউ’র আদেশ মতো বিচার সভার আয়োজন এবং সকল দেবতাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল মারাংবুরুর উপর, যাঁর পূর্ব নাম হল লিটা এবং এই বার্তা বাহকের জন্য তিনি লিটা গোডেৎ নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। সান্তাড়ি গোডেৎ বা গডেৎ কথাটির বাংলা অর্থ হল বার্তা বাহক।

সান্তাড়দের এই পৌরাণিক তথা স্বর্গীয় চাঁওরিয়া মেলা’র প্রতিরূপ হল প্রতিটি সান্তাড় গ্রামে এক একটি করে মাঁঝিথান এবং এক একজন করে মাঁঝি বা গ্রাম প্রধান থাকেন এবং মূখ্যত তাঁরাই শাসনকার্য ও বিচারকার্য পরিচালনা করে থাকেন। প্রতিটি সান্তাড় গ্রামেই মাঁঝিদের বার্তা বাহকরূপে এক একজন গোডেৎ বা গডেৎ থাকেন। এটিও হল মানব সমাজে স্বর্গীয় লিটা গোডেৎ এর প্রতিরূপ।

আদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত সান্তাড়দের সমাজ ব্যবস্থায় মঁড়ে হড় বা পঞ্চজন ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়। এই পাঁচজন হলেন মাঁঝি (গ্রাম প্রধান), পারানিক (সহকারী গ্রাম প্রধান), জগ-মাঁঝি (নৈতিক অভিভাবক), জগ-পারানিক (সহকারী নৈতিক অভিভাবক) এবং গোডেৎ বা গডেৎ (বার্তা বাহক)। এছাড়াও নায়কে (সান্তাড় পুরোহিত) এবং কুডাম নায়কে (সহকারী সান্তাড় পুরোহিত) নামে আরোও দু’জন উক্ত পঞ্চজন ব্যবস্থার অন্তর্গত থাকেন যাঁরা গ্রামের সকলের পক্ষ থেকে দেব-দেবীদের পূজা দিয়ে থাকে।

traditional social system of the Santals

মাঁঝি - ইনি হলেন গ্রামের সর্বসাধারণের পিতাস্বরূপ এবং ইনি সকলের মঙ্গল ও কল্যাণ সাধনে নিয়োজিত থাকেন। তাই গ্রামের সকলের এবং সকল কিছুর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত থাকে। এই মাঁঝি পদটি আদিতে দৈবনির্বাচিত পদ হিসেবে থাকলেও বর্তমানে তা সর্বসাধারণের দ্বারা গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ মাঁঝি হল একটি পদ এবং যিনি মাঁঝি পদে নির্বাচিত হয়ে জনসাধারণের কল্যাণ ও মঙ্গল সাধন করতে ব্যর্থ হন তাহলে গণতান্ত্রিক উপায়ে তাঁকে ওই পদ থেকে পদচ্যুত করা হয়। তাই তিনি সর্বদাই জনকল্যাণকামী হন এবং গ্রামের সকলকে নিজ সন্তানস্বরূপ দেখবেন ও সর্ব কাজে তাদের সহযোগিতা করবেন।

ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাঁর নির্দেশ ও আদেশ অনুসারে ধর্মীয় পূজার্চনা অনুষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। সামাজিক ক্ষেত্রে সমাজে তাঁর নির্দেশ ও আদেশ অনুসারে জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যুতে শ্রাদ্ধাদি কার্য পরিচালিত ও সম্পাদিত হয়ে থাকে। প্রশাসন ও বিচারসভার ক্ষেত্রে তিনি হলেন মঁড়ে হড় ব্যবস্থার (পঞ্চজন ব্যবস্থার) রূপায়ণ তথা বাস্তবায়ন করেন এবং বিচারের ক্ষেত্রে সমস্ত গ্রামীণ তথা সামাজিক সমস্যার বিচার ও মীমাংসা করে থাকেন পঞ্চজন ব্যবস্থার দ্বারা।

পারানিক – ইনি হলেন মাঁঝি এর সহকারী। ইনি মাঁঝির অনুপস্থিতিতে মাঁঝির সমস্ত দায়িত্ব সম্পাদন করে থাকেন। এছাড়া মাঁঝির পদচ্যুতিতে বা পদত্যাগে বা মৃত্যু হলে এবং মাঁঝির কোনো পুত্র সন্তান (মাঁঝি যোগ্য) না থাকলে পারানিকই মাঁঝি পদে নিযুক্ত হন। এই পদটিরও গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন ও পদচ্যুতি রয়েছে।

জগ-মাঁঝি – ইনি হলেন গ্রামের নৈতিক অভিভাবক। এই পদটিরও গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন ও পদচ্যুতি রয়েছে। ইনি গ্রামের যুবক-যুবতীদের নৈতিক শিক্ষা দিয়ে থাকেন এবং তাদের আচার-আচরণের নৈতিক মূল্যায়নও করে থাকেন। অর্থাৎ যুবক-যুবতীদের আচার-আচরণের নৈতিকতা দেখার দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত থাকে। গ্রামের মধ্যে যুবক-যুবতীদের দ্বারা যেমন কোনো অনৈতিক এবং অসামাজিক কিছু না ঘটে এবং একই সঙ্গে বাইরে থেকেই যেন নিজ গ্রামে (তথা সমাজে) কোনো অনৈতিক ও অসামাজিক কিছু না প্রবেশ করে সেই দিকটিও দেখাশোনা করেন।

জগ-পারানিক – ইনি হলেন গ্রামের সহকারী নৈতিক অভিভাবক। ইনি জগ-মাঁঝির অনুপস্থিতিতে তাঁর দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এই পদটিরও গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন ও পদচ্যুতি রয়েছে।

নায়কে – ইনি হলেন প্রধান সান্তাড় পুরোহিত। ইনি গ্রামের সকলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী বিভিন্ন ধর্মীয় পূজায় জাতীয় দেব-দেবীদের পূজা দিয়ে থাকেন। তবে ইনি প্রধানত সান্তাড়দের জাতীয় দেবদেবীদের এবং শুভাকাঙ্ক্ষী দেবদেবীদের পূজা দেওয়ার জন্য নিযুক্ত হন। আদিতে থেকে এখন পর্যন্ত এই পদটি হল দৈবনির্বাচিত যারফলে এটি বংশগতভাবে চলতে থাকে।

কুডাম নায়কে – ইনি হলেন সহকারী সান্তাড় পুরোহিত কিন্তু ইনি গ্রামের সকলের পক্ষ থেকে জাতীয় দেবদেবীদের থেকে নিম্নস্তরের দেবদেবীদের পূজা দিয়ে থাকেন। এটি ও দৈবনির্বাচিত পদ তবে এটির পদত্যাগ, পদচ্যুতি ইত্যাদি রয়েছে।

উপরের আলোচনায় সান্তাড়দের যে সমাজ শাসন ব্যবস্থা আমরা দেখলাম তা হল সারিধরম গ্রন্থ জমসিম বিন্তি ভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী পৌরাণিক তথা স্বর্গীয় শাসন ব্যবস্থা তথা সমাজ ব্যবস্থার প্রতিরূপ বা দৃষ্টান্ত।

- সুব্রত টুডু

খণ্ড-29
সংখ্যা-6