প্রতিবেদন
পুরাণ ও ইতিহাস প্রসঙ্গে
mythology and history

কোনও কোনও বৌদ্ধ পুরাণ মনে করে, সমন্তভদ্র জগতের প্রথম মানব। সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বৌদ্ধ সাহিত্যে বড় একটা আলোচনা নেই। সমন্তভদ্র বা আদি-বুদ্ধের শ্রীপাদ থেকে হাঁটা শুরু করার আগে বলে নেওয়া দরকার, সেমেটিক পুরাণের আদমও হাঁটা শুরু করেছিলেন এই আদম’স পিক বা শ্রীপাদায়া থেকে। আদম জগতের প্রথম মানব।

বুদ্ধকে তাঁর শিষ্যরা একবার জিগ্যেস করেছিলেন, “এই জগৎ কোথা হইতে আসিল?”

শাক্যসিংহ বুদ্ধদেব জবাব দিয়েছিলেন, পৃথিবী ও তারকারাজি যখন আপনা-আপনি তৈরি হল তখন থেকে জগতের উৎপত্তি। অতঃপর অপ ও মরুৎ এলো, তারপর পৃথিবীতে সৃষ্টি হল সাগরের। জীবন তখনও তৈরি হয়নি।

এরপর সৃষ্টি হল এক অনবদ্য বিষয় — তার নাম ফ্রম বা প্রম, যাকে সহজ ভাবে অতল সত্তারাজি বলা যেতে পারে। এই সত্তা হল স্বর্গের বা পরলোকের বাইরে/অতিবর্তী একটি বিস্তার/ডাইমেনশন।

“তাহলে মানব এলো কোথা থেকে?”

মানব এসেছে যুগপৎ দোজখ/নরকের সত্তা এবং ফ্রম থেকে।

হিন্দু পুরাণ বলে, প্রথম মানব মনু। তাঁর সঙ্গিনী শতরূপা। আবার ভবিষ্যপুরাণে আদম ও হব্যবতীর কথা আছে। কাহিনীসমূহের মধ্যে মিল থাকা স্বাভাবিক। আদমের মতো সমন্তভদ্র বা আদি-বুদ্ধকে প্রথম মানব বলেন বহু মানুষ। আবার সমন্তভদ্র ‘ত্রয়ী’ হিসাবেও উপস্থাপিত হন — সমন্তভদ্র, শাক্যমুনি ও বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী — এই তিনের সমন্বয়ে। অনেকটা আমাদের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের আদলে। মহেশ্বর বা শিবের পীঠস্থান ওই আদম’স পিক বা শ্রীপাদায়া — অনেকের বিশ্বাস, ওই বিরাট পদচিহ্ন শিবের ছাড়া আর কারও হতে পারেনা। তবে কি শিব প্রথম জাগতিক সত্তা?

মহাদেবকে কোনও রসিক ভক্ত জিগ্যেস করেছিলেন, আপনার পিতা কে? জবাব এসেছিল — বিষ্ণু। আর আপনার পিতামহ? ব্রহ্মা। তা হলে আপনার প্রপিতামহ কে? শৈব উত্তরঃ আমি নিজেই।

সমন্তভদ্র কেন বঙ্গোপসাগর পার হতে চান? এই জলরাশি সহসা আবির্ভূত হলোই বা কেন? সমন্তভদ্র মানুষ, সন্তরণ তাঁর সহজাত নয়, অর্জন করতে হবে। বিরাট বিরাট ঢেউ দেখে ভয় পাচ্ছেন তিনি। সমন্তভদ্রী আছেন সাগরের ওপারে। যেতেই হবে। প্রমালোক থেকে সাহায্য এল। কী এই প্ৰমালোক ? প্ৰম বা ফ্রম হল আলো। স্বর্গ হল মানুষের কাছে আলোস্বরূপ। আর প্ৰমালোক হল স্বর্গের কাছে আলো।

প্রম বা ফ্রমের কোনও অনুভূতি নেই, কিন্তু সে অনুভূতি ব্যক্ত করতে সক্ষম।

সমন্তভদ্র জলরাশি পার হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। এলেন তৎ-আগত শক্তি যাকে বলা যায় প্রমালোক কিংবা জিব্রাইল। তিনি তামাটে আলোর মতো দেখতে। জিব্রাইল এসে বলে দিলেন, সামনের ওই মহোদধি, যাকে বলা যেতে পারে ‘পূর্বপয়োধি’ তা অতিক্রম করার উপায়। জলের মতো স্বচ্ছ সেই পথ। তামাটে আলো দেখিয়ে দিল, অগভীর জলস্তরের শুলুকসন্ধান। সেই ছায়াপথ ধরে ধরে পাথর ফেলতে ফেলতে ক্রমাগত এগিয়ে যেতে থাকলেন সমন্তভদ্র। পরে সমন্তভদ্রের উত্তরসূরিরা ওই জলরাশির নাম রাখবেন বঙ্গোপসাগর/কলিঙ্গ সাগর/চোল সাগর।

‘মাটা আলোকে গিনাদেবি সনসার ইয়ে/ মাগে জীবন হাদে তেমে ইশক রবে’ নামে সিংহলী ভাষায় একটি ধ্রুপদী গান আছে, যে গানটি পপাকারে রিমেক করেছেন ‘মানিকে মাগে হিথে’-খ্যাত য়োহানা। মূল গানটি বহু কাল ধরে প্রচলিত সিংহলে, “সংসারে আলো এনে দাও আমাকে, আমার জীবনের দেওয়াল বেশ শক্ত, আমি ভালবাসি তোমাকে”… ১৯৩৫ সালে গানটি গেয়েছিলেন পিল্লাভালু গজপতি কৃষ্ণবেণী। যেন-বা সমন্তভদ্রের সুরে। প্রশান্ত পদছায়ায় তৈরি হল ‘সমন্তভদ্র-সেতু’, যাকে কেউ বলে আদমের ব্রিজ, কেউ বা রামসেতু।

সমন্তভদ্রের কাছে ঈশ্বর বলে কিছু নেই। তাঁর কাছে একটি জগত আছে, যাকে তিনি সংসার বলে থাকেন। রাতে খুব ভয় করে তাঁর, তাই সব সময় দিনের অপেক্ষা করেন। সর্বদা আলো খোঁজেন তিনি। আলোর মধ্য দিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন দুস্তর পারাবার পার হলেন আদিবুদ্ধ। ক্রমে ক্রমে তিনি বুঝেছেন, এই জগত পরিচালনা করে পঞ্চবাণ। বাণ হল নিয়ম। তিনি সংখ্যার ধারণা নিয়ে জন্মেছেন, তাই পাঁচ বুঝতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু বাণ বড় শক্ত বিষয়। তাঁর চিত্তে আছে এক প্রকারের বাণ। আর গাছপালা, সাগর, পাহাড় চলে আর এক নিয়মে, প্রমালোকে তার নাম ‘ঋত’। এবংবিধ রয়েছে বীর্য বাণ — যে নিয়মে তিনি সেতু বানিয়েছেন। আর আছে মনের শক্তিনীতি — তাকে বলে ধর্ম নিয়ম, সে ক্ষণে ক্ষণে পালটাতে থাকে। শেষ বাণ হল কর্মনিয়ম। এই পাঁচ স্কন্ধ মিলিয়ে ঈশ্বর বললে ঈশ্বর; না বললে নয়। এই পঞ্চবাণ নিরাকার, অপার সাগর, তিনি মহোদধি, তিনিই পয়োধি। সেই নিরাকারের উপর সেতু বানিয়ে সমন্তভদ্রীর কাছে যাওয়ার পথ সুগম করলেন আদিবুদ্ধ। একের সঙ্গে একের মিলনে হবে দুই। এই সংখ্যাও নিরাকার।

মন্নর থেকে পম্বনে পৌঁছলেন সমন্তভদ্র। কিন্তু কোথায় সমন্তভদ্রী? তিনি আছেন বহু দূরে। সে অনেক দিনের পথ। হেঁটে যেতে হবে বহু দিন, অনেক মাস।

- শামিম আহমেদ

খণ্ড-29
সংখ্যা-6