প্রতিবেদন
উনবিংশ শতাব্দীর এক অনন্য সমাজ সংস্কারক প্যারীচরণ সরকার
Paricharan Sarkar

প্যারীচরণ সরকার উনবিংশ শতাব্দীর অনন্য এক সমাজ সংস্কারক ছিলেন। অবিভক্ত বাংলায় প্রথম যে বালিকা বিদ্যালয় গড়ে ওঠে তারও অন্যতম কারিগর ছিলেন প্যারীচরণ। অপর দু’জনের একজন ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা তথা বিদ্যাসাগর, আরেকজন কালীকৃষ্ণ মিত্র। যদিও বারাসাতে প্রথম যে বালিকা বিদ্যালয় গড়ে ওঠে তার প্রধান দুই রূপকার হিসেবে কালীকৃষ্ণ মিত্র ও প্যারীচরণ সরকারের নামই অনেকের লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু নারী শিক্ষা বিস্তারে প্রথম উদ্যোগ নেওয়ার পেছনে প্রেরণা ও সক্রিয়তা ছিল ঈশ্বরচন্দ্র শর্মার। তৎকালীন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জি টি মার্শাল (যিনি মেজর ছিলেন একসময়) ও শিক্ষা সচিব মোয়াট নারী শিক্ষার বিদ্যালয় স্থাপনে ঈশ্বরচন্দ্রকে প্রচন্ড সহযোগিতা করেছিলেন। প্যারীচরণকে বিদ্যাসাগর হুগলির এক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সচিবকে বলে বারাসাতের বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করার বন্দোবস্ত করেন। বিদ্যাসাগরের চেয়ে বয়সে সাড়ে তিন বছরের ছোট প্যারীচরণের জন্ম হয়েছিল ১৮২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতায় তদানীন্তন কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, অধুনা বিধান সরণীর শ্রীমানী মার্কেট সংলগ্ন চোরবাগান এলাকায় অমর বসু সরণীতে। তিনি হিন্দু কলেজে পড়াশুনা করেন এবং পরে ঐ প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনাও করেন। উত্তর ২৪ পরগণার জমিদাররা কালীকৃষ্ণ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাধ সেধেছিল। বিদ্যালয়টির ‘কালীকৃষ্ণ’ নামকরণ হয় তাঁর মৃত্যুর পরে। সেই সময়ে মোয়াট সাহেবকে অনুরোধ করে বিদ্যাসাগর সরকারি কোষাগার থেকে টাকা মঞ্জুর করিয়ে বিদ্যালয়টি স্থাপনে প্যারীচরণ ও কালীকৃষ্ণকে সহযোগিতা করেন। জমিদাররা লেঠেল বাহিনী পাঠিয়ে বিদ্যালয়টি যাতে হতে না পারে তার অপচেষ্টা করে। মঞ্জুরিকৃত টাকা ফেরত চলে যায়। পরে মার্শাল সাহেবকে ধরে জমিদারদের কড়া বার্তা দিয়ে তাদের বিরত করেন বিদ্যাসাগর। প্যারীচরণ ও কালীকৃষ্ণের অক্লান্ত পরিশ্রমে অবশেষে বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ডাঃ নবীনকৃষ্ণ ও কালীকৃষ্ণদের বাড়িতে। প্রধান সমস্যা দাঁড়ায় ছাত্রী পাওয়া নিয়ে। তবে অভিভাবকরা প্যারীচরণ ও কালীকৃষ্ণের প্রতি আস্থাভাজন হয়ে ছাত্রীদের পাঠাতে শুরু করেন। নবীনকৃষ্ণ ও কালীকৃষ্ণ দুই ভাই তাঁদের কন্যা সন্তানদের পাঠান। এসমস্ত তথ্য জানা গেল বিদ্যাসাগর চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রাণপুরুষ প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। ‘বঙ্গদূত’ বের হোত গোবরডাঙ্গা থেকে, ঐ পত্রিকাতে এসব তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছিল।

প্যারীচরণ সরকারের জন্মের দ্বিশতবর্ষ উদযাপন শুরু হয়েছে। শিক্ষা বিস্তারে তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার নবজাগরণের রূপকার বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় কুমার দত্ত। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামও উল্লেখ করা যায়। তারও আগে রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও ডিরোজিও সলতেটা পাকিয়ে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে রামমোহন রায়। প্যারীচরণ সরকার, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রামগোপাল ঘোষ, ইয়ংবেঙ্গলের প্যারীচাঁদ মিত্র, রামকৃষ্ণ মল্লিক, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী, শিবচন্দ্র দেব প্রমুখ ব্যক্তিত্বও নবজাগরণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। মনে রাখতে হবে নারী শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন মিশনারীরাও। ড্রিংক ওয়াটার বেথুন সেইরকমই একজন মিশনারী যিনি বারাসাতের বিদ্যালয়টি দেখে কলকাতায় ১৮৪৯ সালে একটি বাালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সহযোগী হিসাবে পেয়েছিলেন রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা, মদনমোহন তর্কলঙ্কারকে। বেথুনের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা স্ত্রী শিক্ষা আন্দোলনে প্রচন্ড গতি এনে দেয়। ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীও নারী শিক্ষার সক্রিয় সমর্থক ছিল। বেথুন সাহেব বিদ্যাসাগরকে তাঁর বিদ্যালয়ের অবৈতনিক সম্পাদক করেছিলেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরে বেথুন সাহেবের প্রয়াণ ঘটে, পরবর্তীতে তাঁর নামে বিদ্যালয়টির নামকরণ হয় ‘বেথুন বালিকা বিদ্যালয়’।

বেথুন বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পরে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বালিকা বিদ্যালয় গড়ার কাজে হাত লাগান সমাজের বিদ্যোৎসাহী ও সম্পন্নশালী কিছু মানুষ। সুখসাগরের কাশীশ্বর মিত্র, কোন্নগড়ের শিবচন্দ্র দেব, বারুইপুরের প্রসন্নকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজকুমার রায়চৌধুরী এবং কালীকুমার রায়চৌধুরী, খড়দহের রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জানবাজারের প্রিয়নাথ দত্ত, রাণাঘাটের রামশঙ্কর সেন, ঘাটালের রামচন্দ্র পালিত ও প্যারীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ আরও অনেকে স্ব স্ব অঞ্চলে মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বামবোধিনী পত্রিকার ১৮৬৬’র অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ১৮৬৫ অব্দের “শিক্ষাসংক্রান্ত বিজ্ঞাপনীতে নিহিত হইয়াছে বঙ্গদেশে ১৮১টি বালিকা বিদ্যালয় সংস্থাপিত হইয়াছে এবং তাহাতে ৪,১১১টি বালিকা অধ্যয়ন করিতেছে”। (আশীষ খাস্তগীর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমী, ২৫ নভেম্বর ২০১৯, পৃঃ ৯০)।

বিদ্যাসাগর ও অন্যান্যদের উদ্যোগে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার সাথে সাথে শিশুদের জন্য বাংলা ও ইংরেজীতে স্কুল শিক্ষার পাঠ্য বই লেখার উদ্যোগও শুরু হয়। বিদ্যাসাগর ও প্যারীচরণ মিলে স্থির করেন বিদ্যাসাগর বাংলা বই ‘বোধদয়’ ও প্যারীচরণ ইংরেজী বই ‘ফার্স্ট বুক অফ রিডিং ফর নেটিভ চিলড্রেন’ লিখবেন। তাঁদের বই পড়েই শিশুরা বাংলা ও ইংরেজী শিখেছে। প্যারীচরণের বইটি প্রকাশ হয়েছিল ১৮৫০ সালে। বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সাল নাগাদ, যদিও বোধদয় প্রকাশিত হয় আগেই। ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশে দেরী হওয়ার কারণ ছিল তাঁর অধ্যাপনা, অধ্যক্ষতা ও সরকারি স্কুল পরিদর্শন, বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত যুক্তি নির্মাণ, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা, বন্ধু অক্ষয় দত্তকে সহযোগিতা করা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকা। প্যারীচরণ আপামর শিক্ষার্থীদের ইংরেজী শিক্ষার প্রাণপুরুষ। পরে তিনি ইংরেজী শিক্ষার সবচেয়ে বিখ্যাত পাঠ্যবই লিখেছেন। মদনমোহন তর্কলঙ্কার লিখেছিলেন শিশু পাঠ্যবই।

প্যারীচরণের জন্ম কলকাতায় হলেও তাঁদের আদি বাড়ি ছিল হুগলী জেলার তারগ্রামে। তিনি সহপাঠি ছিলেন শিক্ষাবিদ ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের, পড়েছেন হিন্দু কলেজে। তাঁর পিতা ভৈরব চন্দ্র সরকার ইংরেজদের জাহাজ মেরামতিতে সহায়তা করে প্রচুর অর্থোপার্জন করেছিলেন। তবে অল্প বয়সে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় তাঁর লেখাপড়া চালানো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র প্যারীচরণ হেয়ার সাহেব প্রতিষ্ঠিত কলুটোলা শাখা বিদ্যালয় থেকে সব বিষয়ে সোনার মেডেল ও বৃত্তি পেয়ে লেখাপড়ায় অগ্রগতি ঘটিয়েছেন। পিতা ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর ফলে হিন্দু কলেজের পাঠ শেষ করতে পারেননি, পারিবারিক বিপর্যয়ের কারণে হুগলীর ব্যাঙ্কে চাকরি নিতে হয়। তারপরে হুগলীর সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগদান। আর তারপরে বারাসাত সরকারি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান। আরও পরে হন কলুটোলা হেয়ার স্ট্রীট স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তারপরে হিন্দু কলেজে (১৮৫৫ থেকে পরিচিত প্রেসিডেন্সী কলেজ) অধ্যাপক পদে যোগ দেন। চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর তিনি ইংরেজী পড়ানোর দায়িত্ব পান। ঐ কলেজে তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসাবে ইংরেজী পড়ানোর অধ্যাপক। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আলোচনা করে যেহেতু ‘ফার্স্ট বুক’ রচিত হয় তাই বর্ণপরিচয়ের সঙ্গে এর বিন্যাস অনেকটা একরকম। ‘বর্ণপরিচয়’ দ্বিতীয় ভাগের সঙ্গে অবশ্য এর সামঞ্জস্য খোঁজা অর্থহীন। কেননা ইংরেজীতে যুক্তব্যঞ্জন নেই। দ্বিতীয় ভাগ থেকে বর্ণপরিচয়’এর পরিকল্পনা আলাদা হয়ে গেছে। ‘ফার্স্ট বুক’এ বর্ণালীর বিন্যাস করা হয় বড় ও ছোট হরফে। পবিত্র কুমার সরকার লিখেছেন, “১৮৭০ সালে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত এক স্কুল রিভিউ কমিটি তাঁর ইংরেজী শিক্ষার বইগুলি সম্পর্কে মন্তব্য করে — অন দ্য হোল, দ্য বেস্ট উই হ্যাভ সীন ফর দ্য লোয়ার ক্লাসেস।”

তিনি শুধু পাঠদান ও পাঠ্য পুস্তক লিখিয়ে হিসাবে খ্যাত ছিলেন না, বহুমুখী সামাজিক কার্যকলাপেও জড়িত ছিলেন। এ সংক্রান্ত একটি ইংরেজী পত্রিকা ‘দ্য ওয়েল উইশার’ এবং বাংলায় ‘হিতসাধক’ তিনি কিছুদিন প্রকাশ করেছিলেন। উনিশ শতকের বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির মতো তিনিও ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন, কর্মোদ্যোগী, বহুমাত্রিক সফল এক সমাজ সংস্কারক। বিদ্যাসাগরের প্রতিভার বিকিরণের ছায়ায় তাঁকে আচ্ছন্ন হতে হয়নি। নিজ প্রতিভার বিকিরণেই তিনি বিদ্যাসাগরের মতো মহান পুরুষের সহযোদ্ধা হিসাবে প্রতিভাত হয়েছিলেন। এরকম এক বহু গুণসম্পন্ন মহান হৃদয়ের প্রয়াণ ঘটে ১৮৭৫’র ১ অক্টোবর, হাত কেটে যাওয়া থেকে গ্যাংগ্রীন হয়ে।

উনিশ শতকে নারী শিক্ষা বিস্তারের অগ্রণী — নারী মুক্তির দিশারী এই মহান পুরুষের দ্বিশত জন্ম বার্ষিকীতে আমরা বিস্মৃত থাকব?

- নিত্যানন্দ ঘোষ

খণ্ড-29
সংখ্যা-6