প্রতিবেদন
নরেন্দ্র মোদী জমানায় বিপন্ন সিদ্দিক কাপ্পানরা
Siddique Kappans

নরেন্দ্র মোদী যা বলেন তার প্রতি তিনি বিশ্বস্ত থাকেন, এমন কথা কেউই জোর দিয়ে বলতে পারবেন না। সংসদে ঢুকে তিনি সংবিধানকে প্রণাম করেন, আবার বলেন “আমাদের সংবিধানই আমাদের সবাইকে এক সূত্রে বেঁধেছে”। এরপরও আমরা দেখি সংবিধানের লাগাতার লঙ্ঘন, সংবিধানে বিধৃত অধিকার থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত করার নিরবচ্ছিন্ন সক্রিয়তা। প্রধানমন্ত্রী পদে ২০১৪ সালে বসার পরই নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ভারতের “গণতন্ত্র টিকবে না যদি না আমরা বাক-স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করতে পারি”। উপরাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাঈয়া নাইডুর কণ্ঠেও শোনা গিয়েছিল, “সংবাদপত্রের ওপর যে কোনো আক্রমণই জাতীয় স্বার্থের প্রতি ক্ষতিকারক এবং সবাইকেই এর বিরোধিতা করতে হবে”। কিন্তু সাত বছরেরও বেশি নরেন্দ্র মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি জমানায় সংবাদ মাধ্যমের প্রতি ঘোষিত এই গুরুত্ব উপেক্ষিতই থেকেছে, স্বাধীনতাকামী সংবাদ জগতের প্রতি, সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকদের প্রতি বৈরিতাকেই তারা জাহির করে এসেছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ‘দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন’ হতে হবে বলে তারা বলেছে, এবং দায়িত্ববোধের এই দাবি ঐ স্বাধীনতার কাছে কাঁটা বলেই প্রতিপন্ন হয়েছে। মোদী সরকারের সমালোচকরা, ভিন্নমত পোষণকারীরা যেমন সরকারের বিষ নজরে পড়েছে, সরকারের নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির সরকারের দুরভিসন্ধির দিকে আঙুল তোলা সাংবাদিকদেরও সরকার তার নিশানা বানিয়েছে, দেশদ্রোহ ও ইউএপিএ’র মতো দানবীয় আইন তাদের কারান্তরীণ করেছে, দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় অভিযুক্ত হয়ে তারা হাঁসফাঁস করেছে, সাংবাদিক নামের পেশাটাই বিপন্নতার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। বৈরী জ্ঞানে বন্দিত যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণতা দেখিয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন বিনোদ দুয়া, রাণা আয়ুব, মৃণাল পাণ্ডে, রাজদীপ সরদেশাই, বরখা দত্ত, প্রভৃতি। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নির্ভীক সাংবাদিকতার দৃষ্টান্ত রেখে যাওয়া গৌরী লঙ্কেশের এই জমানায় হত্যাও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রতি জমানার অসহিষ্ণুতাকেই নির্দেশিত করে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রতি মোদী সরকার কতটা ক্রোধোন্মত্ত তার প্রতিপাদনে আমরা এখানে দুটো ঘটনার উল্লেখ করব।

গতবছর ২৬ জানুয়ারি তিন কৃষি আইন বিলোপের দাবিতে প্রতিবাদরত কৃষকরা বড় প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত করলেন। প্রতিবাদের সেই কর্মসূচি পালনের সময় এক কৃষক মারা গেলেন। পুলিশ বলল ট্রাক্টর উল্টে কৃষকের মৃত্যু ঘটেছে। আর পরিবারের সদস্যরা বললেন — ঐ কৃষককে গুলি করে মারা হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের বক্তব্যকে তুলে ধরে খবর করায় নরেন্দ্র মোদী সরকার আট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করল — তাদের বিরুদ্ধে জাতীয় সংহতিকে বিপন্ন করে তোলা এবং এমনকি দেশদ্রোহের অভিযোগও পেশ হল। অভিযুক্ত সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন ‘দ্য ওয়্যার’ ওয়েব পত্রিকার প্রধান সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভরদরাজন। তিনি বললেন, “মৃত ব্যক্তির আত্মীয়রা ময়না তদন্তের রিপোর্ট বা মৃত্যুর পুলিশি ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাদের বিবৃতির ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করাটা কি মিডিয়ার পক্ষে অপরাধ?”

বাংলাদেশে দুর্গামণ্ডপে কোরান রাখার প্রতিক্রিয়ায় গতবছর অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে ত্রিপুরায় কয়েকটা মসজিদের ওপর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের হামলা হল, সংখ্যালঘুদের দোকানপাটও আক্রমণের মুখে পড়ল। বিজেপি শাসিত ত্রিপুরায় সংখ্যালঘুদের ওপর এই ধরনের আক্রমণের কথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অস্বীকার করলেও হামলার ভিডিও সমাজ মাধ্যমে ভাইরাল হল। ত্রিপুরা সরকার সমাজ মাধ্যমে ভিডিও তোলা ও শেয়ার করার জন্য ১০২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করল। এবং এফআইআর’এ বলা হল যে, এরা সমাজ মাধ্যমে ভিত্তিহীন খবর ছড়িয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বৈরিতাকে বাড়িয়ে তুলেছে, সমাজে অশান্তির সৃষ্টি করেছে। অভিযুক্তদের মধ্যে আইনজীবী, সমাজ আন্দোলনের কর্মীরা ছাড়াও কয়েকজন সাংবাদিকও ছিলেন। দু’জন সাংবাদিককে গ্ৰেপ্তার করা হয় এবং তাঁরা জামিনে মুক্তি পান। প্রশাসনিক পক্ষপাতে গোটা ব্যাপারটায় এভাবে ওলটপালট ঘটে গেল। সাংবাদিক সহ যাঁরা ঘটনার তদন্তে নামলেন, প্রকৃত ঘটনাকে উন্মোচিত করলেন, বিজেপি প্রশাসনের চোখে তাঁরা হয়ে গেলেন অপরাধী, আর যারা হামলা চালাল তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্ব নিয়ে চলার, সরকারের সমালোচকদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ন মনোভাব পোষণের এই সরকারের কাছে সাংবাদিকদের কাজের স্বাধীনতার আমল না পাওয়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। চলমান ঘটনাবলীকে হিন্দুত্ববাদীদের অভিপ্রেত ধারায় উপস্থাপিত করতে অস্বীকার করা মুসলিম সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানও নরেন্দ্র মোদীদের প্রতিহিংসার লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়লেন। কিন্তু কেন?

সিদ্দিক কাপ্পান হলেন কেরলের সাংবাদিক এবং তিনি মালায়ালম ভাষাতেই লেখেন। কাপ্পান একটা গাড়িতে আর তিনজনের সঙ্গে যাচ্ছিলেন হাথরস, গণধর্ষিতা দলিত যুবতীর মৃত্যু এবং পরিবারের অনুমতি না নিয়েই পুলিশের তাকে রাতের অন্ধকারে দাহ করা সম্পর্কিত খবর সংগ্রহে। কিন্তু হাথরস পৌঁছানোর আগেই টোল প্লাজার কাছে গাড়ি থামিয়ে পুলিশ তাদের আটক করে ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর। পুলিশ বলে, গাড়িতে তার সঙ্গীরা ছিল পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার (পিএফআই) সদস্য এবং কাপ্পানের সঙ্গে এই সংগঠনের যোগ রয়েছে। আরও বলল, সাম্প্রদায়িক হিংসা উস্কিয়ে তোলার জন্য, সামাজিক অশান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই তিনি হাথরস যাচ্ছিলেন। পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া মুসলিম সংগঠন হলেও তা সরকার নিষিদ্ধ সংগঠন নয় এবং কেউ তার সদস্য হলে বা তারসঙ্গে কারো যোগ থাকলে সেটাকে অপরাধ বলে বিবেচিত করার যুক্তিগ্ৰাহ্য কোনো কারণ থাকতে পারে না। বিজেপি জানতো এবং তাদের পুলিশের কাছেও এই তথ্য ছিল যে, দিল্লীর নিজামুদ্দিনের মারকাজ মসজিদে তাবলিগি জামাতের ধর্মীয় জমায়েতই ভারতে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য দায়ী বলে বিজেপি ও তাদের প্রশাসন যে প্রচার চালাচ্ছিল, কাপ্পান তাঁর প্রতিবেদনে সেটাকে মিথ্যাচার বলে প্রতিপন্ন করেন; তাঁর প্রতিবেদনে দিল্লীর শাহিনবাগে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রতিফলিত হয়েছিল; দিল্লীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রকৃত উস্কানি কাদের ছিল তার উন্মোচন তিনি তাঁর লেখায় ঘটিয়েছিলেন; শাহিনবাগে সিএএ বিরোধী আন্দোলনস্থলের কাছে কপিল গুর্জর নামে হিন্দুত্ব সমর্থক যে গুলি চালিয়েছিল এবং “হিন্দু রাষ্ট্র জিন্দাবাদ” শ্লোগান দিয়েছিল, সেটাকে তিনি গান্ধীর ওপর নাথুরাম গডসের গুলিচালনার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সংখ্যাগুরুর আধিপত্য জনিত উৎপীড়নকে মান্যতা দিতে না চাওয়া সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের বিজেপি’র বিষদৃষ্টিতে না পড়াটাই বিচিত্র ব্যাপার হত।

Siddique are endangered in the time of Modi

বিজেপি এবং উত্তরপ্রদেশ পুলিশ আরো জানতো আরএসএস মুখপত্র অর্গানাইজার-এর সহকারী সম্পাদক জি শ্রীধাথনের সঙ্গে সিদ্দিক কাপ্পানের সংঘাতের কথা। কাপ্পানকে গ্ৰেপ্তারের পর পুলিশ ৫,০০০ পৃষ্ঠার যে চার্জশিট দাখিল করে তাতে এই বাদানুবাদকে একটা বিষয় করা হয়েছে। ওয়েব পত্রিকা ‘নিউজলন্ড্রি’ কাপ্পান মামলায় তাদের তদন্তে জানিয়েছে — উত্তরপ্রদেশ পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্কফোর্স চার্জশিট তৈরিতে ‘ইণ্ডাস স্ক্রলস’ নামক ওয়েবসাইট-এর প্রধান সম্পাদক এবং অর্গানাইজার-এর সহকারী সম্পাদক জি শ্রীধাথনের একটা মন্তব্যে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। শ্রীধাথন তাঁর লেখায় অভিযোগ পেশ করেছিলেন — জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রর মৃত্যু নিয়ে কাপ্পান ভুয়ো খবর ছড়িয়েছেন এবং তিনি পিএফআই’এর টাকা নিয়ে হিন্দু-বিরোধী সংবাদ প্রচার করে থাকেন। গ্ৰেপ্তার হওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে কাপ্পান জি শ্রীধাথনের মন্তব্যের প্রতিবাদ করে তাঁর কাছে মানহানির মামলার নোটিস পাঠিয়ে লেখাটি সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানান এবং নোটিসে উল্লেখ করেন, “এটা অত্যন্ত ধিক্কারজনক ও নিন্দনীয় যে আপনাদের এই প্রকাশনায় মানহানির এরকম একটা প্রবন্ধ থাকবে যেটা নিজেই একটা ‘ভুয়ো খবর’।” উত্তরপ্রদেশ পুলিশ ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্টে বলে, কাপ্পান সাংবাদিক না হয়েও নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে জাহির করেন। আবার তাঁর প্রতিবেদনগুলোতে প্ররোচনা সৃষ্টির জন্য কাপ্পান কি ধরনের লেখা লেখেন তা দেখানোর উদ্দেশ্যে পুলিশ তাদের চার্জশিটে কাপ্পানের লেখা ৩৬টা প্রতিবেদনও জুড়েছে! অতএব, নরেন্দ্র মোদীরা চায়, ‘দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন’ সাংবাদিকতা সেটাই হবে যেটা হিন্দুত্বর অনুগামী বলে দেখা যাবে এবং যেটা বিজেপি অনুসৃত নীতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে না। সুপ্রিম কোর্টে কাপ্পানের হয়ে মামলা লড়ছে ‘কেরল ইউনিয়ন অব ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস’। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের চার্জশিটের বিরুদ্ধে তারা যথার্থভাবেই বলেছে, “উত্তরপ্রদেশ পুলিশ যা করেছে তা সাংবাদিকতাকে অপরাধ বলে গণ্য করা ছাড়া অন্য কিছু নয়। এটা সংবিধান প্রদত্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রকৃত স্পিরিটের বিরুদ্ধেই রায়।” কাপ্পান হিন্দুত্ব বিরোধী মনস্ক হওয়ায়, বিজেপি’র সংখ্যালঘু বিরোধী অনাচারের প্রতিবাদী হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের রোষ সহজেই বোধগম্য। এরপরও একটা প্রশ্ন জাগে — হিন্দুত্ববাদ বিরোধী অবস্থান নিয়ে লেখালেখি করায় অনেককে কেন্দ্রের ও বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলোর কোপে পড়তে হলেও সবাইকে দীর্ঘ কারাবাস ভোগ করতে হচ্ছেনা। কিন্তু কাপ্পানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি, নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বোধকে আহত করা, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং আরো অনেক অভিযোগ এনে, দেশদ্রোহী আইন ও ইউএপিএ প্রয়োগ করে ১৫ মাসেরও বেশি কারান্তরীণ করে রাখাকে অনুধাবন করতে গেলে সাংবাদিক সমর হরলঙ্কারের এই মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য, যেটি স্বাতী ভট্টাচার্য আনন্দবাজার পত্রিকায় ১০ জানুয়ারির সংস্করণে ‘একে সাংবাদিক, তায় সংখ্যালঘু’ শীর্ষক উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “সিদ্দিক কাপ্পান যেসব বিষয়ে লেখেন, তার অনেকগুলো নিয়ে আমিও লিখি, যেমন ভারতীয় রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য, মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য। তিনি যে জেলে আছেন, আমি নেই, তার কারণ আমি হিন্দু, এবং ইংরেজিতে লিখি।”

সাংবাদিকতাকে ‘দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন’ করতে চাওয়ার নরেন্দ্র মোদীদের তৎপরতা যেমন বস্তুনিষ্ঠ, সরকারের কাছে প্রশ্ন তোলা সাংবাদিকতাকে কোণঠাসা করেছে, অন্যদিকে তা উদ্ভব ঘটিয়েছে ‘গোডি’ মিডিয়ার যারা সরকারের প্রচারযন্ত্র হিসেবে কাজ করে চলে, বিজেপি-আরএসএস’এর সাম্প্রদায়িক দুরভিসন্ধিতে মদত জোগায়। ভুয়ো সংবাদ পরিবেশন করে, ঘৃণা ও ধর্মান্ধতা ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের নিশানা বানায়; সরকারের নীতির সমালোচকদের, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরোধীদের, সত্য উদঘাটনের প্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ নামিয়ে তাদের দেশদ্রোহী, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী, পাকিস্তানপন্থী, মাওবাদী, শহুরে নকশাল বানিয়ে দেয়। এরই সাথে আবার আবির্ভাব ঘটেছে বিজেপির ট্রোল বাহিনীর —তারা সমাজ মাধ্যমে অন্যান্যদের সঙ্গে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও ঘৃণার অভিযান চালায়; আর সাংবাদিক নারী হলে ধর্ষণ এবং এমনকি হত্যার হুমকিও পান। ‘ফ্রি-স্পিচ কালেকটিভ’ সংস্থার পক্ষে গীতা সেসু তথ্য সংকলিত করে জানিয়েছেন, ২০২০ সালে ভারতে ৬৭ জন সাংবাদিক গ্ৰেপ্তার হয়েছিলেন এবং দৈহিক আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন প্রায় ২০০ জন। সংবাদ জগৎ এবং সাংবাদিকদের ওপর এই আক্রমণ আন্তর্জাতিক নজরেও এসেছে। ফরাসি এনজিও ‘রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস’ বিশ্বে সংবাদ জগতের স্বাধীনতার যে সূচক বার করে তাতে ভারতের স্থানের ক্রমাবনতি ঘটেছে বলে দেখা যাচ্ছে। তাদের মূল্যায়নে ১৮০টা দেশের মধ্যে ২০১০ সালে ভারতের স্থান ছিল ১২২, তারপর ২০১৬তে ১৩৩ থেকে ২০২১ সালে তা নেমে এসেছে ১৪২তম স্থানে। রিপোর্টে ভারত সাংবাদিকদের পক্ষে সবচেয়ে ‘বিপজ্জনক’ দেশগুলোর অন্যতম বলে যে অভিমত ব্যক্ত হয়েছে তার যথার্থতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। ২০২১ সালের রিপোর্টে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে এমন ৩৭ জন রাষ্ট্রপ্রধানের তালিকায় রাখা হয়েছে যাঁরা হলেন ‘সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার লুণ্ঠনকারী’। নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে বলতে গিয়ে রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে, “সংবাদ জগতের ভালো অংশের মালিকানা থাকা শত-শত কোটির অধিকারী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে”, এবং তারা তাঁর “চূড়ান্ত বিভেদজনক ও নিন্দনীয়” বক্তৃতাগুলোকে প্রচারের আলোয় নিয়ে এসে তাঁর সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের প্রসার ঘটায়। এই অভিমতের সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হুবহু মিলে যায়। এবং এটা যে আবশ্যকতাকে তুলে ধরে তা হল, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার বিপর্যয় রোধে বিভেদকামী মতাদর্শের বিরুদ্ধে ও ক্ষমতা থেকে তার বাহকদের অপসারণের লক্ষ্যে লড়াইটা যেমন জরুরি, সেরকমই গুরুত্বপূর্ণ হল সংবাদ জগতের ওপর কর্পোরেট আধিপত্যকে খর্ব করা।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-29
সংখ্যা-5