খবরা-খবর
ছোট ছোট প্রতিবাদের প্রতিস্পর্ধা ছড়িয়ে দিতে ঐক‍্যবদ্ধ হতে হবে
spread the competition of small protests

নরেন্দ্রপুর থানা যে ধারাগুলিতে দ্বিতীয় দফায় গ্রেপ্তার আইসা’র ছাত্রছাত্রীদের ওপর মামলা দিয়েছে তারমধ‍্যে আছে ৩৩৩ ধারা — “পুলিশকে তার ডিউটিতে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ‍্যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হামলা চালিয়ে মারাত্মক জখম করা”। পুলিশ সকলকে রাস্তায় ফেলে পেটালো, থানার ভেতরে নিয়ে মারল, মহিলাদের রেপথ্রেট দিল, তারপর অভিযোগ আনল পুলিশেরই ওপর হামলা চালিয়ে মারাত্মক জখম করার! পুলিশ মারাত্মক জখম হওয়ার মেডিক‍্যাল সার্টিফিকেটও জমা দিয়েছে নিশ্চয়। গভীর রাতে দু’জন কমরেডকে থানা লকআপ থেকে বারুইপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বডি ফিটনেস সার্টিফিকেট আনতে; হলুদ রঙের স্লিপে আগে থেকেই ফিটনেস সার্টিফিকেট লেখা ছিল, সেখানে নাম ও বয়স বসিয়ে দিলেন ইমার্জেন্সিতে বসে থাকা ডাক্তার! একই পদ্ধতিতে পুলিশের ‘মারাত্মক জখম’ হওয়ার সার্টিফিকেটও ডাক্তারবাবুরা বানিয়ে রেখেছিলেন নিশ্চয়।

নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্রছাত্রীদের ওপর, থানার সামনের রাস্তায়। থানার ভেতরে নেগোশিয়েশন চলছিল, ছাত্রছাত্রীরা রেলিঙের ধারে বসেছিল তাঁদের কমরেডদের ছাড়া পাওয়ার অপেক্ষায়। তারা গান গাইছিল মৃদুস্বরে ডাফলি বাজিয়ে। থানার বারান্দা থেকে কমরেডদের নেমে আসতে দেখে শ্লোগান দিতে শুরু করে তারা। নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ এই শ্লোগান তোলাকে তাদের কর্তৃত্ত্বকে চ‍্যালেঞ্জ করা হিসেবে নেয় এবং তৎক্ষণাৎ ছাত্রছাত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহূর্তে ওপর থেকে নেমে আসে আরও কয়েকজন। অধিকাংশই সাধারণ পোশাকে, তারা পুলিশ না ভাড়াটে গুণ্ডা বোঝার উপায় নেই। রাস্তায় ফেলে মারা শুরু হয় এবং তারপর চ‍্যাংদোলা করে থানার ভেতর নিয়ে যায় ওরা। সেখানে আরেক পর্ব অত‍্যাচার চলে। ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। পাসওয়ার্ড দিতে না চাওয়ায় বুকে লাথি মারে পুলিশ। লকাপে ঢুকিয়ে নেওয়ার পরেও ক্রমাগত হেনস্থা করে চলে কমরেড সৌমি জানা ও বর্ষা বড়ালকে।

মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার ঊর্ধে তুলে ধরে একটা ছোট প্রতিবাদ ছিল। থানা থেকে অনেকটা দূরে বিশ-বাইশ জনের একটা ছোট সাধারণ প্রতিবাদকেও সহ‍্য করতে নারাজ পুলিশ। প্রথম পর্বে গ্রেপ্তার করে আইসার তিনজন, এপিডিআরের দু’জন ও আইপোয়া’র একজনকে। খবর পেয়ে অনেকে আসতে শুরু করেন। গ্রেপ্তার হওয়া কমরেডদের ছাড়ার ব‍িষয়ে কথা বলতে যারা ভেতরে যান তাঁদের সাথেও দুর্ব‍্যবহার করে পুলিশ। শেষে দশটা নাগাদ ছাড়া পাওয়ার পর শ্লোগান তোলায় আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ।

‘বারুইপুর পুলিশ জেলা’র অন্তর্গত এই থানা। প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের পেটানোর সময় যে আক্রোশ ও জিঘাংসা পুলিশ প্রকাশ করছিল তার ধরণ খানিকটা আরএসএস অনুপ্রাণিত মবলিঞ্চিং ধরণের। সঙ্ঘীদের মতোই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও মহিলাদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব‍্য এবং ‘হিন্দু ভাবাবেগ’ আহত করার অভিযোগ তুলছিল ওরা। ছাত্রছাত্রীদের কোমরে দড়ি বেঁধে অপমানিত করতে করতে আদালতে নিয়ে যাওয়ার মধ‍্যেও পুলিশের এই মনোভাব ব‍্যক্ত হয়েছে। কিছুদিন আগে এই পুলিশ জেলারই সোনারপুর থানার সোহরাব হোসেন ও তাঁর পরিবারের ওপর নির্মম সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়েছিল। এই মামলাটি এখন নরেন্দ্রপুর থানার আওতায় চলছে এবং সেখানে তাদের সাম্প্রদায়িক অবস্থান প্রকট হয়েছে। বৃহত্তর কলকাতার মধ‍্যেই, কামালগাজি মোড়ে অবস্থিত, এই থানার বাড়িটিও উদ্ভট। ছয়তলা বিশাল বিল্ডিং জুড়ে একই সাথে থানা ও বিয়েবাড়ি। বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল, আলোকমালায় সাজানো ছিল থানা। থানার ভেতর শাসানোর সময় পুলিশ আক্ষেপ করছিল যে এইসব ঝামেলার ফলে আর বিয়েবাড়ি ভাড়া নিতে চাইবে না কেউ!

ভারতীয় সমাজের পুরানো ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনা দলিত আন্দোলনের অবিচ্ছেদ‍্য অঙ্গ এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হবে কি হবে না সে প্রশ্ন তোলার অধিকারও সকলের আছে। এই অধিকারের পক্ষে না দাঁড়ালে তা ব্রাহ্মণ‍্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ। ছোট ছোট প্রতিবাদগুলি স্পর্ধা তৈরি করে। বিকট শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে একলা মানুষের রুখে দাঁড়ানো যে কত বড় হয়ে উঠতে পারে তা বারবার দেখছি আমরা। সেই কারণে এই ছোট প্রতিবাদকে নৃশংস প্রতিহিংসা নামিয়ে সন্ত্রস্ত ও স্তব্ধ করে দিতে চাইছে পুলিশ প্রশাসন। এ ধরনের প্রতিটি হামলার ঘটনাকে বৃহত্তর ঐক‍্যের সমাবেশমঞ্চ বানিয়ে আমাদের এগোতে হবে এবং ছড়িয়ে দিতে হবে প্রতিটি অন‍্যায়ের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ ছোট ও দৃঢ় প্রতিবাদের প্রতিস্পর্ধা।

- মলয় তেওয়ারি

খণ্ড-29
সংখ্যা-6