‘পরিবর্তন’এর সরকারের এক দশক : পরিবর্তন না পশ্চাদগমন
A decade of ‘change’ government

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে আমাদের মতো অপেশাদার সমাজ অর্থনীতির লেখকদের পক্ষে আলোচনা ক্রমাগত দুস্কর হয়ে উঠেছে। অতীতে নিয়মিত রাজ্যের অর্থনৈতিক পর্যালোচনা (ইকোনোমিক রিভিউ) প্রকাশিত হত ও তারসাথে প্রকাশিত হত পরিসংখ্যানের টেবিল। বামফ্রন্ট সরকারের শেষের দিকে সেগুলি সরকারি ওয়েবসাইটেও পাওয়া যেত। এখন রাজ্য সরকারের ওয়েবসাইটে ইকোনোমিক রিভিউ রয়েছে ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০২০-২১। শেষেরটি নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখা গেল পরিসংখ্যানের পরিশিষ্ট কিছুই নেই। রয়েছে কী কী প্রকল্প চালু করা হয়েছে তার বিজ্ঞাপন। ওদিকে নিতি আয়োগের প্রকাশিত ডিসেম্বর ২০২১’র ‘হেলদি স্টেটস, প্রোগ্রেসিভ ইন্ডিয়া: হেলথ্ ইনডেক্স রাউন্ড ফোর ২০১৯-২০’ নামক প্রতিবেদনে পশ্চিবঙ্গ সরকার কোনো তথ্য দেয়নি বলে সেখানেও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া গেলনা। ফলে জুন ২০১৯ থেকে দুটি পর্যায়ে এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত হওয়া ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ্ সার্ভে ফাইভ বা জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৫ (এনএফএইচএস ৫)-এ প্রকাশিত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কিছু তথ্য নিয়ে দেখতে চাইলাম পশ্চিমবঙ্গের নারী শিশুর স্বাস্থ্য কেমন। এর পাশাপাশি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হ্যান্ডবুক অফ স্ট্যাটিস্টিকস অন ইন্ডিয়ান ইকনোমির উপর ভিত্তি করে রাজ্যের মাথাপিছু আয় ও এনএসএস কর্তৃক করা, কিন্তু অপ্রকাশিত, গৃহস্থের ভোগব্যয় সংক্রান্ত তথ্যের উপর নির্ভর করে রাজ্যের অর্থনৈতিক হাল হকিকতের সামান্য কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করব।

১১ বছর আগে যখন তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল তখন শ্লোগান ছিল ‘পরিবর্তন’। মোড়ে মোড়ে হোর্ডিং’এ বহু বিদ্বজ্জনের ছবি ও ‘পরিবর্তন’ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে লাগানো হয়েছিল। পরিবর্তন এলো ক্ষমতায় থাকা শাসক দলের। কিন্তু কী পরিবর্তন এল রাজ্যে। উত্তরটা প্রয়োজন। ‘দূয়ারে সরকার’, ‘দুয়ারে রেশন’, ‘স্বাস্থ্যসাথী’ এসবের দৈনন্দিন বিজ্ঞাপনে চোখ ভরলেও মন ভরেছে কি? সেটা দেখতে গেলে কিছু বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে। যতটা তথ্য পাওয়া গেছে তার দিকে চোখ রেখে বামফ্রন্ট ও তৃণমূলের শাসনের তুলনা করা যাক।

মাথাপিছু আয় এবং ক্ষেত্রগত উৎপাদন

১৯৬০ দশকের গোড়া পর্যন্ত মাথাপিছু আয়ের নিরিখে সারা দেশে এরাজ্যের স্থান ছিল তৃতীয়, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের পরে, জাতীয় গড়ের থেকে বেশি। ১৯৮০’র গোড়ায় তা জাতীয় আয়ের সমান হয়ে পড়ে। ১৯৯০’র গোড়ায় মাথাপিছু আয়ে পশ্চিমবঙ্গ সপ্তম স্থানে চলে যায়। ২০০০ সালে দশম ও ২০১১ সালে একাদশতম স্থানে পিছিয়ে যাই আমরা। এক দশক বাদেও সেই পতন থামেনি। আমাদের স্থান এখন চতুর্দশ।

মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধির হার ১৯৯৩-৯৪ থেকে ১৯৯৯-২০০০ এই ছ’বছরে ছিল বার্ষিক ৫.৫ শতাংশ, যেখানে জাতীয় গড় ছিল ৪.৬ শতাংশ। পরবর্তী দশকে জাতীয় গড় বেড়ে হল ৫.৫ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গের গড় কমে দাঁড়াল ৪.৯ শতাংশ। ২০১১-১২ থেকে ২০১৯-২০-তে পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধির হার আরো কমে ৪.২ শতাংশ হয়েছে। অবশ্য জাতীয় গড়ও কমে ৫.২ শতাংশ হয়েছে। তবে জাতীয় গড়ের সাথে রাজ্যের ফারাকটা বেড়েছে, ০.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ১ শতাংশ হয়েছে। নিচের সারণীতে, নীট উৎপাদন (মাথাপিছু) বৃদ্ধির হার, মোট উৎপাদন (ক্ষেত্রীয়) বৃদ্ধির হারের তুলনা দেওয়া হল পশ্চিমবঙ্গ ও সারা ভারতের মধ্যে।

change or retreat

লক্ষ্যণীয় যে রাজ্যের বৃদ্ধির হার জাতীয় হারের থেকে ১৯৯০’র দশকে বেশি ছিল। বামফ্রন্টের শেষ দশকে তা জাতীয় গড়ের থেকে কমে গিয়েছিল। তারপরে তৃণমূল শাসনেও তা জাতীয় গড়ের থেকে কম রয়েছে। কেবল তাই নয় তা বামফ্রন্টের শেষ দশকের গড়ের থেকেও কম হয়েছে। মনে রাখা দরকার এই আলোচনায় কোভিড১৯-এর সময়কার বছরগুলিকে ধরা হয়নি।

অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার তিনটি সময়কালেই সারা দেশের থেকে বেশি। ১৯৯৪-২০০০ সময়কালে গড় বৃদ্ধির হার ৪.২ শতাংশ, যা আলোচ্য তিনটি সময়কালের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু তৎপরবর্তী এই শতকের প্রথম দশকে তা অনেক কমে যায়। তৃণমূল সরকারের সময়ে তা অনেকটা বেড়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে কৃষির বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমছে। তৃণমূলের আমলে ম্যানুফাকচারিং ও পরিষেবাক্ষেত্রের বৃদ্ধির হার কমেছে ও তা ভারতের থেকে অনেকটাই কম। পরিষেবা ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট আমলের সাফল্য অনেক বেশি একদিকে বৃদ্ধির হার দুই অঙ্কে পৌছেঁছিল, অপরদিকে তা সারা দেশের তুলনায় বেশ খানিকটা বেশি ছিল।

ফলে একথা বলা যায় রাজ্যে উথপাদন বৃদ্ধির নিরিখে তৃণমূল যদি কোনো পরিবর্তন এনে থাকে, তা এক নেতিবাচক পরিবর্তন।

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৫’ রিপোর্ট। রিপোর্ট অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা কেমন দেখা যাক।

সাক্ষরতা ও বিদ্যালয় শিক্ষা

পশ্চিমবঙ্গে ওই সমীক্ষা হয়েছিল ২১ জুন ২০১৮ থেকে ৮ অক্টোবর, ২০১৯ পর্যন্ত, কোভিডের অনেকটাই আগে। ফলে লকডাউন কোভিড এগুলির প্রভাব পড়েনি। সারা ভারতে তা চলে ১৭ জুন ২০১৯ থেকে ৩০ জানুয়ারি ২০২০ এবং ২ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ৩০ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত, দু’দফায়। ফলে সেক্ষেত্রে কোভিডের প্রভাব পড়েছে ও তা নেতিবাচক হওয়াই স্বাভাবিক। ওই সমীক্ষার প্রকাশিত তথ্য অনুসারে সারা ভারতের মহিলা সাক্ষরতার (৭১.৫ শতাংশ) তুলনায় এরাজ্যের সাক্ষরতা (৭২.৯ শতাংশ) বেশি। তবে পুরুষদের ক্ষেত্রে দেশ (৮৪.৪ শতাংশ) রাজ্যের (৮০.২ শতাংশ) তুলনায় এগিয়ে আছে।  কিন্তু ১০ বছরের বেশি বিদ্যালয়ে গিয়েছে এমন নারীর শতাংশ রাজ্যে মাত্র ৩২.৯ শতাংশ যা দেশের ৪১ শতাংশের তুলনায় অনেকটাই কম। পুরুষদের ক্ষেত্রেও রাজ্যের হার (৪৬.৭ শতাংশ) দেশের (৫৭.১ শতাংশ) থেকে অনেক কম।

কম বয়সে বিবাহ ও গর্ভধারণ

কম বয়সে বিবাহের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ কয়েক যোজন পিছিয়ে আছে। ২০-২৪ বছরের মহিলাদের মধ্যে ৪১.৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৮ বছরের কমে বিয়ে হয়েছে এই রাজ্যে যা সারা দেশের ২৩.৩ শতাংশের প্রায় দ্বিগুণ। সমীক্ষার সময়ে ১৫-১৯ বছর বয়স্ক নারীদের মধ্যে ১৬.৪ শতাংশ গর্ভবতী বা সন্তানবতী ছিল; এক্ষেত্রেও সারা দেশের তুলনায় আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। ওই হার সারা দেশে ৬.৮ শতাংশ। এরাজ্যে নাবালিকাদের মধ্যে গর্ভধারণের হার ৮.১ শতাংশ, সারা দেশে ৪.৩ শতাংশ। ফলে কন্যাশ্রীর ফল কী হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে।

রক্তাল্পতা

৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের ক্ষেত্রে রক্তাল্পতায় ভুগছে ৬৯ শতাংশ শিশু (সারা ভারতে ৬৭.১ শতাংশ)। ১৫-৪৯ বছর বয়স্ক নারীদের মধ্যে রক্তাল্পতা রয়েছে এই রাজ্যে ৭১.৪ শতাংশের, দেশে তা রয়েছে ৫৭ শতাংশের ক্ষেত্রে। ১৫-১৯ এই বয়ঃগোষ্ঠিতেও ৭০.৮ শতাংশের রক্তাল্পতা রয়েছে যা দেশের ৫৯.১ শতাংশের তুলনায় বেশি। পুরুষদের ক্ষেত্রেও রাজ্যে রক্তাল্পতার হার অনেক বেশি সারা দেশের তুলনায়; ১৫-১৯ বছরের ক্ষেত্রে ৩৮.৭ শতাংশ (সারা দেশে ৩১.১ শতাংশ) ও ১৫-৪৯ বছরের মধ্যে ৩৮.৯ শতাংশ (সারা দেশে ২৫ শতাংশ)।  রক্তাল্পতার এই ভয়াবহ হার উদ্বেগজনক। আগেই বলা হয়েছে যে রাজ্যের ক্ষেত্রে পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা কোভিড১৯’র সংক্রমণের বছর খানেক আগেই করা হয়েছে। ফলে কোভিড১৯-এর পরে এই ভয়াবহতা আরো কতটা বেড়েছে তা অনুমেয়।

- অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-11