নারকীয়তার নয়া নজির
example of hellishness

রাঢ়বঙ্গের এক অখ্যাত গ্রামে যে নারকীয়তার নয়া নজির তৈরি হল তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একদশক আগে শাসনের গোড়াপত্তনকালে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বদলা নয়, বদল চাই’! কিন্তু বগটুই গণহত্যা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, বদলা নেওয়ার শাসন নীতির কোনও বদল হয়নি। নতুন যা লক্ষ্যণীয়, পশ্চিমবাংলাকে কার্যত ‘বিরোধীশূন্য গণতান্ত্রিক’(!) করে তোলার স্বৈরাচারী উৎপীড়ন এমনকি নির্মম প্রহসনবশত শাসক তৃণমূলের অন্দরেও হরেক কায়েমী স্বার্থকে কেন্দ্র করে বদলার খুনোখুনি ও হাড়ে হিম ধরানো অরাজকতার মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনছে। জেলায় জেলায় এজাতীয় ঘটনাবলী ও সমাচার প্রায় প্রাত্যহিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এইসব নানা গোষ্ঠীসংঘাতে জড়িত থাকা ওপর থেকে নিচুতলা পর্যন্ত নেতা-মাথা বাছতে উজার হচ্ছে দল। তাই একই ঘটনায় পাঁচ নেতা পাঁচরকম সাফাই দেন। এর নমুনা মিলল বগটুই হত্যাকাণ্ডের প্রথম প্রতিক্রিয়ায়ও। নবান্ন থেকে ঘটনাস্থলে সপার্ষদ পাঠানো কলকাতার মেয়রের সাথে দলের মহাসচিবের, সংসদীয় দলনেতার সাথে সর্বেসর্বা দলনেত্রীর, দলের এক মুখপাত্রের সাথে বীরভূম জেলা সভাপতির — কারও সাথে কারুর বক্তব্যের ন্যূনতম সামঞ্জস্য নেই। একই দলের নানা মুনির নানা মত এই কারণেই যে, প্রকৃত তথ্য কিভাবে আড়াল করা হবে তার দিশা খুঁজে না পাওয়া, বোঝাবুঝিতে ঐকমত্য হতে না পারা। চোরামী ঢাকতে অগত্যা উগরে দিতে হয় দলবাণী — ‘সবার উপরে দলনেত্রী সত্য, তাহার উপরে নাই’! আর দলনেত্রীর মুখে সেই অতি পরিচিত ভাঙা রেকর্ডের কলকলানি। ‘যা ঘটেছে তা দুর্ভাগ্যজনক’, ‘নিন্দা করছি’, ‘কাউকে ছাড়া হবে না’, ‘অপরাধীদের রং দেখা হবে না’, ‘রাজ্যের বদনাম করতে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে! উৎস-কারণ এক, তার আড়াল খুঁজতে গল্প তৈরি হচ্ছে আরেক। পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের ‘ক্লোজ’ করার মধ্যে কোনও স্বচ্ছ নিরপেক্ষ তদন্তের সাধু অবস্থান নেই। ওসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তথ্য বেফাঁস হওয়ার মুখ বন্ধ করতে। কারণ, নির্দিষ্ট রাতের ঘটনাপ্রবাহের সময় টহলদার পুলিশের উপস্থিতি ছিল মাত্র তিন মিনিটের পথের ব্যবধানে, আর থানা আড়াই কিমির মধ্যে! তবু বোমা-গুলি-ঘরবাড়িতে আগুন লাগা ও আর্ত চিৎকারের তান্ডব চলা পরিবেশে পুলিশ অনুপস্থিত হয়ে রয়েছিল কেন? রাতভোর মূক-বধির হয়ে থাকল কেন? সকালে ঘটনাস্থলে পৌঁছে রাজ্য পুলিশের এক বড় কর্তা আগাম কী করে বলতে পারলেন এই ঘটনায় কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক নেই?

মুখ্যমন্ত্রীর অনড় অবস্থান — সব সামলাবে ‘সিট’! কিন্তু কেন? বিচারবিভাগীয় তদন্ত নয় কেন? রহস্যের প্রকৃত উন্মোচন হয়ে যাবে সেই ভয়ে? ‘সিট’ থাকলে অভয় নিশ্চিত! কেন্দ্রের তোতা যেমন ‘নিয়া’ (এনআইএ), সিবিআই; রাজ্যের তোতা তেমনি সিআইডি, ‘সিট’ (এসআইটি)। ‘সিট’ আনিস হত্যারহস্যকে ক্রমেই আরও জটরহস্যে পর্যবসিত করে রাখছে। খুনীদের দ্রুত স্বচ্ছ বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা হওয়া চাই। শুধু তাই নয়, নেপথ্যে থাকা দলের খুনে চূড়ামনিদের চেহারাও সামনে আসা প্রয়োজন। মা-সন্তান সহ সপরিবারে শাসক হিংসায় ভস্মীভূত হচ্ছেন, অন্যদিকে ‘সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে চোখের জল মুছে মায়ের আঁচল দিয়ে সন্তান আগলানোর মতো বাংলাকে রক্ষার’ ললিত বাণী শোনানো হচ্ছে! এই স্বৈরাচারী দ্বিচারিতার বিরোধিতায় সোচ্চার সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। পথে নামতে হবে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে, নাগরিক অধিকার রক্ষার শক্তিকে, সুশীল সমাজকে। এ সময়ে চুপ করে থাকা শব্দহীন পাপ। তবে গণতন্ত্রের ভেকধারী ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে সুযোগ দেওয়া যাবে না।

খণ্ড-29
সংখ্যা-12