আজকের দেশব্রতী : ২৪ মার্চ ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati_24-march-22moulali programmeRampurhat genocide

তৃণমূল আশ্রিত সমাজবিরোধীদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান!
সোচ্চারে উত্তাল প্রতিবাদী সভা মৌলালীতে

রামপুরহাটের গণহত্যার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ সভা সংগঠিত হয় ২৩ মার্চ কলকাতার মৌলালীতে। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ছাড়াও পিডিএস, স্বরাজ ইন্ডিয়া, সিপিবি, বন্দীমুক্তি কমিটি সহ আরও কয়েকটি সংগঠন এতে যুক্ত হয়। সভায় সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল বলেন, মুখ্যমন্ত্রী বলছেন রাজ্যে নাকি ষড়যন্ত্র চলছে! আসলে সত্য ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া, সন্ত্রাসের সমস্ত ঘটনাকে আড়াল করা এটা তৃণমূলেরই বড় ষড়যন্ত্র। এর মধ্য দিয়েই ওরা রাজ্যের বুকে খুনের রাজনীতি কায়েম করতে চাইছে। রামপুরহাটে নারী শিশু হত্যা, তথা গণহত্যা করে ওরা সমগ্র বিরোধীপক্ষকে দমন করে রাখতে চাইছে। চোরাকারবারি, তোলাবাজি, আর্থিক লেনদেনের অবৈধ কারবার চালানোই এই গণহত্যার পেছনে অন্যতম কারণ। পুলিশকে শাসকদলের আজ্ঞাবহ করে তোলা হয়েছে যেখানে পুলিশ মহিলা আন্দোলনকারীদের ধর্ষণ করার হুমকি দিচ্ছে। গণতন্ত্র ও সুশাসনের সপক্ষে পশ্চিমবাংলার মানুষের গণরায়ের প্রতি এভাবে তৃণমূল বিশ্বাসঘাতকতা করছে।

পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য ও কলকাতা জেলা সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী বলেন, বিরোধীদের নিকেশ করার নীতি নিয়ে চলেছে তৃণমূল, যারা আজ আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত। তাদের এই স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে উঠবেই। স্বরাজ ইন্ডিয়ার সহ সভাপতি কল্যাণ সেনগুপ্ত বলেন, শাসকের লুঠের ভাগবাটোয়ারার জন্য নিরীহ মহিলা ও শিশুদের প্রাণ চলে গেল। একে বাংলার মানুষ মেনে নেবে না। বন্দীমুক্তি কমিটির নেতা মানবাধিকার কর্মী ছোটন দাস বলেন, যাদের প্রাণ চলে গেল শাসক তৃণমূলের নেতারা বলছে তারা ‘আমাদের লোক’! তিনি প্রশ্ন তোলেন, তাহলেই কী তাদের হত্যা করার অধিকার জন্মে যায় নাকি! মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারই আজ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ঘটনার পর ঐ এলাকায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ — অনুসন্ধানের কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এতেই প্রমাণ হয়, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়! সত্যকে আড়াল করার এই প্রচেষ্টা কেন?

প্রগতিশীল মহিলা সমিতির ইন্দ্রাণী দত্ত বলেন, বাংলার মানুষ এ রাজ্যকে মৃত্যু উপত্যকা বানাতে দেবে না। অমিত দাশগুপ্ত বলেন, তৃণমূলের মনোভাব হলো ক্ষমতা — আরো ক্ষমতা চাই, বিরোধীদের শূন্য করে দিতে হবে। এইভাবে এক খুনের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। গণহত্যা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী চুপ। পুলিশ কি তাহলে চোখ বুজে থাকবে? মুখ্যমন্ত্রী বলছেন এ রাজ্যে নাকি কর্মসংস্থান হয়েছে ১ কোটি ২০ লক্ষ! কোথায় কাজ হয়েছে তিনি বলতে পারেননি। তাহলে কী চোরাচালান, তোলাবাজিতে কর্মসংস্থান হয়েছে! প্রতিবাদ সভায় এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সিপিবি-র বর্ণালী মুখার্জি, আইসার সায়ন্তন প্রমুখ। সঞ্চালক রাজ্য কমিটি সদস্য জয়তু দেশমুখ বলেন, রুটি-রুজি-জীবন-জীবিকার প্রতিটি প্রশ্নে, স্বাধীন মতপ্রকাশের উপর এ রাজ্যে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। মানুষ বেঁচে থাকার লড়াই চালানোর মধ্য দিয়েই সন্ত্রাসের মোকাবিলা করবে। তবে ঘোলাজলে মাছ ধরার বিজেপির চক্রান্ত রাজ্যের মানুষকে অবশ্যই প্রতিহত করতে সচেতন থাকতে হবে।

Bogtui massacre at Rampurhat in Birbhum

রামপুরহাটে গণনিধনের পরের দিন ২২ মার্চ ২০২২ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির এক প্রেস বিবৃতিতে হত্যাকাণ্ডের বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয় – রাজ্যজুড়ে, প্রতিবাদী যুবক, নির্বাচিত রাজনৈতিক কর্মীর একের পর এক হত্যার ঘটনায় রাজ্যবাসী চিন্তিত, ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন। পুলিশ ও শাসক দলের রাজনৈতিক মদতপুষ্ট সমাজবিরোধীরা রাজ্যজুড়ে সন্ত্রাসের পরিবেশ গড়ে তুলতে উঠে-পড়ে লেগেছে। এই প্রেক্ষাপটে ২১ মার্চ সন্ধ্যায় রামপুরহাটের বগটুইয়ে গ্রামে বিবাদমান গোষ্ঠীর বোমায় নিহত হন তৃণমূল কংগ্রেসের পঞ্চায়েত উপপ্রধান ভাদু শেখ। বছর খানেক আগে ভাদু শেখের ভাইও খুন হয়েছিলেন। সে খুনেরও কোন বিচার হয়নি। বাদু শেখের মৃত্যুর খবর গ্রামে আসতেই উত্তেজনা তৈরি হয়। পুলিশ পিকেট বসে। পুলিশের উপস্থিতি সত্ত্বেও গভীর রাতে ৭-৮টি বাড়িতে আগুন লাগানো হয়। অগ্নিদগ্ধ একটি বাড়ি থেকেই ৮টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। দমকলের হিসেবে ৬ জন মহিলা ও ২টি শিশু সহ ১০ জন অগ্নিদগ্ধের দেহ উদ্ধার হয়। রাজ্য পুলিশের প্রধান ৮টি মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছেন।

অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিবাদমান দুই গোষ্ঠী এই হত্যা ও গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন। অথচ সুকৌশলে টিভি’র শর্ট সার্কিটে আগুন লেগেছে বলে প্রচার চালানো হচ্ছে। আমরা অবিলম্বে রামপুরহাটের এই গণহত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। শাসক দলের ক্ষমতার বৃত্তে আকণ্ঠ জড়িয়ে পড়া রাজ্য পুলিশ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের পুলিশ অধিকারিকরা এই ধরনের হত্যা/গণহত্যায় যুক্ত হয়ে পড়ছে বলেই অভিযোগ উঠেছে। এবং তা নাকচ করে দেওয়া যাচ্ছে না।

রাজ্যজুড়ে শাসক দলের এই রাজনৈতিক সন্ত্রাস, এবং হত্যা/গণহত্যার রাজনীতির বিরুদ্ধে রাজ্যের বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ও শান্তিপ্রিয় জনগণকে সোচ্চার হতে হবে।

on Karnataka High Court's verdict on hijab

হিজাব পরিধানকারী বালিকা ও মহিলাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের বিষয়ে কর্ণাটক হাইকোর্টের রায়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সিপিআই(এমএল)।

এই রায় কর্ণাটক রাজ্য সরকারের স্বেচ্ছাচারী এবং বৈষম্যমূলক আদেশের খপ্পর থেকে হিজাব পরিধানকারী মেয়ে ও মহিলাদের শিক্ষার অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, কেননা স্রেফ হিন্দু-আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীগুলির চাপে কর্ণাটকের স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ এই নিয়ম প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়েছে।

কর্ণাটক হাইকোর্টের অন্তর্বর্তী আদেশ ইতিমধ্যে হিন্দু-আধিপত্যবাদী শক্তিগুলিকে উৎসাহিত করেছে, তাদের হাত শক্ত করেছে। শুধুমাত্র কর্ণাটকে নয়, এরা ইতিমধ্যেই সারা ভারতে স্কুল ও কলেজগুলিতে মুসলিম মেয়ে এবং মহিলাদের হিজাব পরে প্রবেশ করা চলবে না, এইরকম ফতোয়া চাপানোর চেষ্টা করছে৷ কর্ণাটকে হিজাব পরিধানকারী স্কুল ও কলেজ ছাত্রীরা একটি শিক্ষাবর্ষ সম্পূর্ণ বাদ পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে, কারণ তাদের পরীক্ষায় বসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। শুধু ছাত্রীরাই নয়, হিজাব পরিহিত শিক্ষিকারাও কলেজ ও স্কুল প্রাঙ্গণে প্রবেশের আগে প্রকাশ্যে তাদের হিজাব খুলতে বাধ্য করার মতো অসম্মানের সম্মুখীন হচ্ছেন। আদালতের রায়, বৈষম্যের শিকার এই নারীদের পরিত্রাণ দেওয়ার ন্যূনতম চেষ্টা করেনি বরং মুসলমান নিপীড়নের উদ্দেশ্যকে শক্তিশালী ও ক্ষমতায়িত করার পথে হাঁটলো।

এই রায় পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে ডঃ আম্বেদকরের মন্তব্যের অপব্যাখ্যা করেছে, যা নারীদের বলপূর্বক একঘরে বা বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং শিক্ষা বা বাইরের কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণকে ব্যাহত করে। আর স্কুল কলেজে হিজাব সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করার অর্থ মুসলিম নারীদের শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা।

শবরীমালা মন্দির সম্পর্কিত রায় যা একটি মন্দিরের কর্তৃপক্ষকে মন্দিরে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার অনুমতি দেয়নি, সেই রায়ের অপব্যাখ্যা করে স্কুল এবং কলেজগুলিকে ছাত্রী তথা মহিলাদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করার অনুমতি দিচ্ছে এই রায়। আমরা নাগরিকদের কাছে আবেদন করছি হিজাব পরিহিত শিক্ষার্থীদের সমর্থনে প্রতিবাদী আওয়াজ তুলুন যাতে এই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসতে পারে।

এখানে হিজাব কোথাও সাংবিধানিক নৈতিকতাকে আঘাত করছে না, বরং এটি হিন্দু-আধিপত্যবাদী গুন্ডামি যা ‘বেটি বাঁচাও’ এবং ‘নারী মুক্তি’ নামাঙ্কনের পর্দায় নিজেকে আড়াল করে। স্কুল এবং কলেজগুলির কাজ ‘অভিন্নতা’ চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং তারা শিক্ষার্থীদের বহুত্ববাদকে মূল্য দিতে শেখাবে।

এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল নিশ্চিতভাবেই সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছাবে, যেখানে অবশ্যই কর্ণাটক হাইকোর্টের রায় বাতিল করতে হবে এবং সুপ্রিম কোর্টকে নিশ্চিত করতে হবে যে হিজাব পরিহিত মেয়েরা তথা মহিলারা যেন কোনোভাবেই বৈষম্য ও গুন্ডামির শিকার না হন।

- সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, কেন্দ্রীয় কমিটি

example of hellishness

রাঢ়বঙ্গের এক অখ্যাত গ্রামে যে নারকীয়তার নয়া নজির তৈরি হল তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একদশক আগে শাসনের গোড়াপত্তনকালে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বদলা নয়, বদল চাই’! কিন্তু বগটুই গণহত্যা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, বদলা নেওয়ার শাসন নীতির কোনও বদল হয়নি। নতুন যা লক্ষ্যণীয়, পশ্চিমবাংলাকে কার্যত ‘বিরোধীশূন্য গণতান্ত্রিক’(!) করে তোলার স্বৈরাচারী উৎপীড়ন এমনকি নির্মম প্রহসনবশত শাসক তৃণমূলের অন্দরেও হরেক কায়েমী স্বার্থকে কেন্দ্র করে বদলার খুনোখুনি ও হাড়ে হিম ধরানো অরাজকতার মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনছে। জেলায় জেলায় এজাতীয় ঘটনাবলী ও সমাচার প্রায় প্রাত্যহিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এইসব নানা গোষ্ঠীসংঘাতে জড়িত থাকা ওপর থেকে নিচুতলা পর্যন্ত নেতা-মাথা বাছতে উজার হচ্ছে দল। তাই একই ঘটনায় পাঁচ নেতা পাঁচরকম সাফাই দেন। এর নমুনা মিলল বগটুই হত্যাকাণ্ডের প্রথম প্রতিক্রিয়ায়ও। নবান্ন থেকে ঘটনাস্থলে সপার্ষদ পাঠানো কলকাতার মেয়রের সাথে দলের মহাসচিবের, সংসদীয় দলনেতার সাথে সর্বেসর্বা দলনেত্রীর, দলের এক মুখপাত্রের সাথে বীরভূম জেলা সভাপতির — কারও সাথে কারুর বক্তব্যের ন্যূনতম সামঞ্জস্য নেই। একই দলের নানা মুনির নানা মত এই কারণেই যে, প্রকৃত তথ্য কিভাবে আড়াল করা হবে তার দিশা খুঁজে না পাওয়া, বোঝাবুঝিতে ঐকমত্য হতে না পারা। চোরামী ঢাকতে অগত্যা উগরে দিতে হয় দলবাণী — ‘সবার উপরে দলনেত্রী সত্য, তাহার উপরে নাই’! আর দলনেত্রীর মুখে সেই অতি পরিচিত ভাঙা রেকর্ডের কলকলানি। ‘যা ঘটেছে তা দুর্ভাগ্যজনক’, ‘নিন্দা করছি’, ‘কাউকে ছাড়া হবে না’, ‘অপরাধীদের রং দেখা হবে না’, ‘রাজ্যের বদনাম করতে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে! উৎস-কারণ এক, তার আড়াল খুঁজতে গল্প তৈরি হচ্ছে আরেক। পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের ‘ক্লোজ’ করার মধ্যে কোনও স্বচ্ছ নিরপেক্ষ তদন্তের সাধু অবস্থান নেই। ওসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তথ্য বেফাঁস হওয়ার মুখ বন্ধ করতে। কারণ, নির্দিষ্ট রাতের ঘটনাপ্রবাহের সময় টহলদার পুলিশের উপস্থিতি ছিল মাত্র তিন মিনিটের পথের ব্যবধানে, আর থানা আড়াই কিমির মধ্যে! তবু বোমা-গুলি-ঘরবাড়িতে আগুন লাগা ও আর্ত চিৎকারের তান্ডব চলা পরিবেশে পুলিশ অনুপস্থিত হয়ে রয়েছিল কেন? রাতভোর মূক-বধির হয়ে থাকল কেন? সকালে ঘটনাস্থলে পৌঁছে রাজ্য পুলিশের এক বড় কর্তা আগাম কী করে বলতে পারলেন এই ঘটনায় কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক নেই?

মুখ্যমন্ত্রীর অনড় অবস্থান — সব সামলাবে ‘সিট’! কিন্তু কেন? বিচারবিভাগীয় তদন্ত নয় কেন? রহস্যের প্রকৃত উন্মোচন হয়ে যাবে সেই ভয়ে? ‘সিট’ থাকলে অভয় নিশ্চিত! কেন্দ্রের তোতা যেমন ‘নিয়া’ (এনআইএ), সিবিআই; রাজ্যের তোতা তেমনি সিআইডি, ‘সিট’ (এসআইটি)। ‘সিট’ আনিস হত্যারহস্যকে ক্রমেই আরও জটরহস্যে পর্যবসিত করে রাখছে। খুনীদের দ্রুত স্বচ্ছ বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা হওয়া চাই। শুধু তাই নয়, নেপথ্যে থাকা দলের খুনে চূড়ামনিদের চেহারাও সামনে আসা প্রয়োজন। মা-সন্তান সহ সপরিবারে শাসক হিংসায় ভস্মীভূত হচ্ছেন, অন্যদিকে ‘সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে চোখের জল মুছে মায়ের আঁচল দিয়ে সন্তান আগলানোর মতো বাংলাকে রক্ষার’ ললিত বাণী শোনানো হচ্ছে! এই স্বৈরাচারী দ্বিচারিতার বিরোধিতায় সোচ্চার সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। পথে নামতে হবে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে, নাগরিক অধিকার রক্ষার শক্তিকে, সুশীল সমাজকে। এ সময়ে চুপ করে থাকা শব্দহীন পাপ। তবে গণতন্ত্রের ভেকধারী ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে সুযোগ দেওয়া যাবে না।

Results of Assembly Elections

ফেব্রুয়ারি-মার্চে যে পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন হয়ে গেল তারমধ্যে উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাব ছিল মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কারণ কৃষি আইন বাতিলের পর এই নির্বাচন। হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের সমর্থনের কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠেছিল যে আন্দোলন নরেন্দ্র মোদীকে আইনগুলি বাতিল করতে বাধ্য করে। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে — পাঞ্জাবে, কৃষক আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন মাত্র জানিয়েছিল যে দলটা সেই ‘আপ’কে এই আন্দোলন বিপুল জয়ের পথে চালিত করেছে এবং বিজেপি উত্তরপ্রদেশে আন্দোলনের প্রভাবকে খানিকটা নিয়ন্ত্রিত করে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতিকে পরিমিত মাত্রায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। আর তিনটি বিজেপি শাসিত রাজ্য উত্তরাখণ্ড, গোয়া, মণিপুরের নির্বাচনী ফলে তাদের নিজস্ব পরিস্থিতি কার্যকর হয়েছে। সব মিলিয়ে এই পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচন ২০২৪’র মহা সমরের দৌড়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হয়ে উঠেছিল।

উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, গোয়া ও মণিপুরে নিজের ক্ষমতা ধরে রেখে বিজেপি এই রাউন্ড বেশ স্বচ্ছন্দে জেতার দাবি করতেই পারে। কিন্তু একটু নিবিড় চোখে খুঁটিয়ে দেখলেই মোদী সরকার এবং বিজেপি-শাসিত রাজ্য সরকারগুলির বিরুদ্ধে ধূমায়িত গণঅসন্তোষ এবং একটি কার্যকরী বিরোধী শক্তি ও রাজনৈতিক বিকল্পের খোঁজ নজরে আসবে। উত্তরাখণ্ডে গণমেজাজের আঁচে সতর্ক বিজেপি নিজে থেকেই দু’বার মুখ্যমন্ত্রী বদল করেছে, কিন্তু তারপরেও পদাসীন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনে হেরেছেন, যদিও বিজেপি কংগ্রেসের দুর্বলতার সৌজন্যে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পেরেছে। গোয়াও একটি অ-বিজেপি সরকারের প্রত্যাশা জাগিয়েছিল, কিন্তু বিরোধী শক্তির বিভাজন আবারও একটি বিজেপি-মেয়াদের পথ প্রশস্ত করেছে। তবে এই রাউন্ডে বিজেপি’র বিপুল জয় সত্ত্বেও, বিরোধীশক্তির জন্য কিছু অর্জন আছে, এবং অবশ্যই আছে প্রচুর শিক্ষা, আর আছে বিশেষ করে জনতার পথের লড়াইয়ের শক্তি।

উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের ফলাফলকে আতস কাঁচের নিচে রাখার আগে আমাদের অবশ্যই ব্যাপক বিধিভঙ্গ, অনিয়মগুলি নজরে আনতে হবে যেগুলি এই রাজ্যের নির্বাচনকে চিহ্নিত করে রেখেছে। এটি স্পষ্টভাবেই ছিল ভারতের সবচেয়ে অসম নির্বাচনগুলির মধ্যে একটি। বিজেপি’র ঘৃণাবর্ষী ভাষণ ও রাজ্য প্রশাসনের ব্যাপক অপব্যবহার এবং নির্বাচন কমিশনের নীরব দর্শক হয়ে থাকার মধ্য দিয়ে বিজেপি এই নির্বাচনে নির্বাচনী বিধিগুলিকে সম্পূর্ণ পরিহাসে পরিণত করেছে। এরপর আছে স্ট্রংরুম বিধিভঙ্গের উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সংবাদ যা ইভিএম’এ কারচুপি এবং অদলবদলের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলেছে, এনিয়ে বাড়ছে অভিযোগ যেগুলো এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা বাঁচাতে, নির্বাচন কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টকে অবশ্যই বিচার করতে হবে। তবে বিজেপি’র কথা এবং ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল অবস্থার কথা জানা থাকলে এইসব বেনিয়ম ও বিশৃঙ্খলাগুলো অপ্রত্যাশিত নয়। তাই এর উত্তর নিহিত আছে এইসব নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়গুলিকে অতিক্রম করা বা সেগুলোকে অসম্ভব না হলেও, ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে রাস্তায় মানুষের আন্দোলনকেও শক্তিশালী করে তোলার মধ্যে।

উত্তরপ্রদেশের বেশ কয়েকটি আসনে খুব কম ভোটের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে। বিজেপি ও তার জোটসঙ্গীরা একত্রিশটি আসনে ৫,০০০ এরও কম ভোটের ব্যবধানে জিতেছে, তারমধ্যে সাতটিতে আবার ৫০০’রও কম ভোটে। আমাদের এটাও অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে বিজেপি ২১টি আসনে খুব কম মার্জিনে সমাজবাদী পার্টির কাছে হেরেছে। কম মার্জিনের প্রশ্নে, এই আসনগুলির অনেক গুলিতেই এআইএমআইএম এবং বিএসপি’র পাওয়া ভোট চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। এআইএমআইএম ২০১৭ সালে ৩৮টি আসনে লড়েছিল; এবার তারা ৯৫ জন প্রার্থী দিয়েছিল আর অন্তত সাতটি আসনে এআইএমআইএম প্রার্থীর পাওয়া ভোট এসপি-আরএলডি জোটের জেতার সম্ভাবনাকে নষ্ট করেছে। বিএসপি’র ভোট শেয়ার অন্তত দশ শতাংশ কমেছে আর সমস্ত সংকেত থেকে এটা স্পষ্ট যে বিএসপি’র এই ক্ষতির সিংহভাগটাই সরাসরি ঢুকেছে বিজেপি’র লাভের ঝুলিতে। বিএসপি’র প্রচার ছিল মূলত সমাজবাদী পার্টির বিরুদ্ধে আর এতাবৎকালে নিকৃষ্টতম এই ফলের পরও, মায়াবতী তার পার্টির এই পরিত্যক্ত দশার জন্য মুসলিমদের জোরালোভাবে দোষারোপ করছেন। অথচ এই মুহূর্তে, পাঁচবছর নিষ্ঠুর যোগী-রাজ এবং দলিতদের উপর ক্রমবর্ধমান উৎপীড়নের পরও বিজেপি’কে উৎখাত করার প্রশ্নে তার পার্টির ব্যর্থতা নিয়ে তার আত্মসমীক্ষা করার দরকার ছিল!

এসপি-আরএলডি জোটের নির্বাচনী ফলে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ, বিশেষ করে লখিমপুর গণহত্যায় কৃষক-রোষ এবং বেকারি-বিরোধী যুব-বিক্ষোভ অবশ্যই যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কৃষক আন্দোলনে মুজাফ্ফরনগর-শামলি অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ধার ভোঁতা হয়ে গেছে। বিষয়টি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সেখান ২০১৩’র মুসলিম বিরোধী হিংসা-তাণ্ডবের বেশ কয়েক জন ‘মাথা’ ভোটে পরাস্ত হয়েছে। কিন্তু অতিমারী আর লকডাউনের জোড়া ফলায় বিদ্ধ মানুষ যখন কষ্টে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েছিল, তখন বিরোধীদের তাদের পাশে খুব একটা দাঁড়াতে দেখা যায়নি। বিজেপি’র ‘উপকারভোগী রাজনীতি’ এবং কল্যাণমূলক প্রকল্পের ‘উপকারভোগী’দের বিজেপি’র অনুগত ভোটদাতায় পরিণত করার ব্যবস্থা বাড়তি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই ‘মুচলেকাবদ্ধ ভোটার’ ব্যবস্থা গ্রামীণ যুব ও মহিলাদের সামাজিক রূপান্তরণের রাজনীতির স্তম্ভ হিসাবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গ্রামীণ দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে প্রচণ্ড জোরালো পাল্টা-সমাবেশ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছে। দেশে বাম আন্দোলনের জন্য এই নির্বাচনের এটাই হয়তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

নির্বাচনে সবচেয়ে চমকপ্রদ ফল এসেছে পাঞ্জাব থেকে। ২০১২-তে ‘আপ’এর আত্মপ্রকাশের পর থেকে, পাঞ্জাব আগাগোড়াই এই নতুন দলটির জন্য এক সহায়ক ক্ষেত্র ছিল। ২০১৪তে লোকসভা নির্বাচনে এই দলটি পাঞ্জাব থেকে ৪টি আসনে জিততে সক্ষম হয়, যদিও পাঁচবছর পরে তা কমে দাঁড়ায় একটিতে। ২০১৭-তে ‘আপ’ কংগ্রেস ও আকালি দলের পর একটি গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০১৭-তে জয়ী কুড়িজন প্রার্থীর মধ্যে দশজনই ‘আপ’ ছেড়ে যায় আর দলটিকেও রাজ্যের সক্রিয় বিরোধী দলের ভূমিকায় ক্বচিৎ দেখা গেছে। কিন্তু দিল্লীতে আপ’এর বিদ্যুৎ ও জলের বিল কমিয়ে দেওয়া, সরকারি স্কুলের মানোন্নয়ন আর ভাগোয়ান্ত্ মান’কে ‘মুখ্যমন্ত্রী’ হিসাবে প্রচার মানুষের মনে আকাঙ্ক্ষা জাগায়। আর পাঞ্জাবে কংগ্রেস-আকালি আধিপত্যকে বিদায় দিয়ে ‘আপ’কে বিপুল জনাদেশে স্বাগত জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, কৃষকনেতাদের এক অংশ এই নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করলেও, জনসমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়।

পাঞ্জাব জনাদেশ ‘আপ’ এবং ভারতীয় রাজনীতির ভবিষ্যতের জন্য নিয়ে এসেছে এক বৃহত্তর শ্রেণিবিন্যাস। দিল্লীতে আপ মূলত, মধ্য-ডান নরম হিন্দুত্বের কাঠামোর মধ্যে পৌর শাসনের রাজনীতির স্পষ্ট অনুশীলন করে চলেছে। এই রাজনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দিল্লী আলোড়িত করা ছাত্র নাগরিক এবং কৃষকদের অত্যন্ত বলিষ্ঠ আন্দোলন থেকে অনেক দূরে থেকেছে। এমনকি বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক হিংসার আক্রমণাত্মক প্রচার এবং রাষ্ট্রীয় পীড়ন — যার বলি হয়েছেন, জীবিকা হারিয়েছেন বহু মানুষ, সাজানো মামলায় কারারুদ্ধ হয়েছেন বহু আন্দোলনকর্মী ও নিরীহ নাগরিক — তার বিরুদ্ধে শান্তি ও ন্যায়ের দাবিতে কণ্ঠ পর্যন্ত তুলতে অস্বীকার করেছে। পাঞ্জাব হবে একটি ভিন্ন বাস্তবতার প্রেক্ষিত যেখানে আপ’কে এবার পরীক্ষা দিতে হবে। এটি শুধু একটি পূর্ণ রাজ্যই নয়, এর রাজনৈতিক মেজাজও আলাদা। কারণ পাঞ্জাব ক্রমবিকাশমান ফ্যাসি-বিরোধী প্রতিরোধের একেবারে সামনের সারিতে রয়েছে — সে কর্পোরেট-বিরোধী কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হোক বা ৩৭০ ধারা বাতিলের বিরুদ্ধে বা যুক্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সংবিধানের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে গণবিরোধিতার মধ্য দিয়েই হোক।

পাঞ্জাবে আপ তার মেয়াদ শুরু করতে চাইছে ভগৎ সিং এবং আম্বেদকরের উত্তরাধিকারকে বেশ জোরালো আবাহন জানিয়ে। তার মন্ত্রীসভার শপথ নেওয়ার কথা ভগৎ সিং’এর জন্মস্থান খাটকর কালানে। স্পষ্টতই পাঞ্জাবের আপ সরকারের অভিজ্ঞতার একটা বড়-সড় প্রভাব থাকবে আপের রাজনৈতিক ভবিষ্যতে উপর। আপ’এর উত্থানের পাশাপাশি পাঞ্জাবে বিজেপি’রও উদ্বেগজনক বৃদ্ধি ঘটেছে। প্রভাবশালী আকালি দলের ছায়ায় থেকে গৌণ ভূমিকা পালনের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হয়ে বিজেপি পাঞ্জাবে নিজের উপস্থিতিকে আরও শক্তিশালী করে নিজের অ্যাজেন্ডা নিয়ে এগোনোর জন্য নতুন পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। পাঞ্জাবের বামশক্তি ভগৎ সিং এবং আম্বেদকরের প্রগতিশীল উত্তরাধিকারের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। তাদের পাঞ্জাবের মানুষের রাজনীতি ও শাসনের প্রগতিশীল উত্তরণের আকাঙ্ক্ষাকে রক্ষা করার জন্য পরিস্থিতির যথাযথ মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে। আর ভারত জুড়ে বিরোধী শক্তিগুলিকে, এই সব বিধানসভা নির্বাচনের শিক্ষার আলোকে ২০২৪’র প্রস্তুতিকে ত্বরান্বিত করতে হবে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৫ মার্চ ২০২২)

 Baliganj Assembly and Asansol Lok Sabha by-elections

২২ মার্চ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার এক প্রেস বিবৃতিতে ঘোষণা করেন –

আগামী ১২ এপ্রিল বালিগঞ্জ বিধানসভা ও আসানসোল লোকসভা কেন্দ্র দুটিতে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা লক্ষ্য করলাম ২০২১’র বিজেপি বিরোধী নির্বাচনী গণরায়কে অস্বীকার করে আসানসোল দাঙ্গায় অভিযুক্ত প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে বালিগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই ব্যক্তিই এনআরসি-এনপিআর’এর সপক্ষে বক্তব্য রাখার নামে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এনআরসি-এনপিআর-সিএএ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের উপর হামলা চালিয়ে ছিল। অস্ত্রধারী ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের পর্যন্ত ছাত্র ছাত্রীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিল। ছাত্র সংসদের অফিস ভাঙচুর করা, পরিকল্পিত ভাবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির চক্রান্ত চালিয়ে ছিল। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে এই ধরনের প্রার্থীকে বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ জনগণ কখনই সমর্থন করতে পারে না। এই ধরনের ব্যক্তিবর্গই রাজনীতিকে কলুষিত করে। আমরা বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বামফ্রন্ট সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থী সায়রা শাহ হালিমকে ভোট দেবার আবেদন জানাচ্ছি।

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরও রাজ্যজুড়ে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি কায়েম করছে। রাজ্যের শাসকদল প্রতিবাদী ছাত্র-যুব-মহিলা কর্মীদের উপর হামলা চালাচ্ছে, মাঝরাতে পুলিশী অভিযান চালিয়ে প্রতিবাদী যুবককে হত্যা করেছে, পৌরসভা ও অন্যান্য উপনির্বাচনে ভোটলুঠ ও সন্ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করার চেষ্টা করছে, দেউচা-পাঁচামীতে আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও দরিদ্র জনগণকে উচ্ছেদ করে কয়লাখনি খনন, উন্নয়নের নামে আদানি আম্বানির লুঠের রাজত্ব কায়েম করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

এইসব জনবিরোধী কার্যকলাপকে প্রতিহত করতে এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিক কৃষকদের বুনিয়াদি দাবিগুলোতে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে আমরা সিপিআই(এম) প্রার্থী পার্থ মুখার্জিকে ভোট দেবার আবেদন জানাচ্ছি।

রাজ্যের গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ জনগণকে বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা, নির্বাচনী বিধিভঙ্গ করে প্রচার ও অর্থের বিনিময়ে নির্বাচন কলুষিত করার সমস্ত অপচেষ্টা প্রতিহত করতে হবে। গণতন্ত্রের উপর যেকোন দমন পীড়ন, হামলা ও লুঠের রাজনীতির বিরুদ্ধে বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ জনগণকে সোচ্চার হতে হবে।

Karnataka HC Hijab Verdict

কর্ণাটক হাইকোর্ট আজ তার আদেশে বলেছে যে হিজাব পরা ইসলাম ধর্ম পালনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নয়, কলেজ ডেভেলপমেন্ট কমিটির (সিডিসি) একটি ইউনিফর্ম বা নির্দিষ্ট পোশাক নির্ধারণ করার অধিকার আছে এবং মুসলিম মেয়েদের অবশ্যই তাদের কলেজের দ্বারা নির্ধারিত ইউনিফর্ম মেনে চলতে হবে।

১) আমরা, মহিলাদের অধিকার এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য কাজ করা নিম্নস্বাক্ষরিত সংগঠনগুলি মনে করি যে সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যেই বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত। আমরা নিশ্চিত যে স্কুল বা কলেজ ইউনিফর্মের নামে হিজাব পরা মুসলিম মেয়ে এবং মহিলাদের প্রতি বৈষম্য এবং বঞ্চনা থেকে সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের রক্ষা করবে।

২) কর্ণাটক হাইকোর্টের রায়ে কলেজের সিডিসি’র ইউনিফর্ম সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে৷ এই কর্ণাটকেই অনেক কলেজ তাদের বিধিতে সংযোজনী এনে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে ইউনিফর্মের সাথে হিজাব পরা যেতে পারে। একইভাবে আমরা কর্ণাটকের সমস্ত সিডিসি’র কাছে আবেদন জানাই মেয়েদের এবং মহিলাদের ইউনিফর্মের সাথে হিজাব পরার অনুমতি দেওয়া হোক ঠিক যেমন শিখ ছেলেরা এবং পুরুষরা পাগড়ি পরতে পারে এবং হিন্দুরা বিন্দি, তিলক, সুতো, সিঁদুর ইত্যাদি পরতে পারে।

৩) আমরা সিডিসি সমূহকে মনে করিয়ে দিতে চাই, আদতে কর্ণাটকের কোনো কলেজেই হিজাব পরা নিষিদ্ধ করার কোনো নিয়ম ছিল না; এমনকি একটি কলেজের নিয়মবিধিতে নির্দিষ্ট করে এও বলা ছিল যে ছাত্রীরা ইউনিফর্মের রঙের সাথে মিল রেখে হিজাব পরতে পারে। তাই হিজাব পরা মেয়েরা কোনোভাবেই নির্ধারিত ইউনিফর্ম বিধিকে ভঙ্গ করেনি। বস্তুত বেশ কিছু হিন্দু-আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীরাই কলেজগুলিতে অরাজকতা সৃষ্টি করে তাদের নিয়ম সংশোধন করিয়ে নির্দিষ্টভাবে হিজাব নিষিদ্ধ করতে বাধ্য করেছে। কর্ণাটক হাইকোর্টের কাছে সুযোগ ছিল স্কুল, কলেজ এবং উভয় প্রতিষ্ঠানে চলা এই গুন্ডামি মোকাবিলা করার, কিন্তু কোর্ট তা করতে ব্যর্থ হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে আসা বা সংখ্যালঘু পরিচয়ের বহু মানুষ যাদের পোশাক হয়তো অন্যদের থেকে দেখতে আলাদা তাঁদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে।

৪) কর্ণাটক হাইকোর্টের রায়ের উপর অবিলম্বে স্থগিতাদেশ দেওয়ার জন্য আমরা সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করছি। এই রায় মুসলিম মেয়ে ও মহিলাদের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং শিক্ষার অধিকারের উপর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমরা লক্ষ্য করেছি যে কর্ণাটক হাইকোর্টের অন্তর্বর্তী রায়ের ফলে শুধুমাত্র মুসলিম ছাত্রীদেরকেই নয়, এমনকি মুসলিম মহিলা শিক্ষকদেরও স্কুল/কলেজ প্রাঙ্গণে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই রায়কে অজুহাত করে ভিতরে ঢোকার শর্ত হিসেবে স্কুল/কলেজের গেটে প্রকাশ্যে মুসলিম মেয়েদের এবং মহিলাদেরকে হিজাব খুলিয়ে তাদের প্রকাশ্যে অপমান করা হয়েছে। এই রায়ের ফলে হিজাব পরিহিত শিক্ষার্থীরা ক্লাস এমনকি পরীক্ষা মিস করতে বাধ্য হয়েছে; এবং কিছু মুসলিম মহিলা পোশাকের একটি অংশ খুলে ফেলতে বাধ্য করার অসম্মানের প্রতিবাদে শিক্ষক হিসাবে পদত্যাগ করেছেন। এছাড়াও, কর্ণাটক হাইকোর্টের আদেশটি সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কর্তৃপক্ষকে হিজাব পরিহিত ছাত্র এবং শিক্ষকদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে উত্সাহিত করেছে। এমনকি হিজাব পরিহিত মহিলাদের বিভিন্ন পাবলিক স্পেসে হেনস্থা ও হয়রানির ঘটনা ঘটে চলছে — যেমনটি ঘটেছে বিহারের একটি ব্যাঙ্কে। তাই হিজাব পরা মুসলিম মেয়ে এবং মহিলাদেরকে আরও যে কোনও গুরুতর বৈষম্য, বঞ্চনা, প্রকাশ্যে অপমান এবং হয়রানির থেকে রক্ষা করার জন্য, আমরা সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করছি বিন্দুমাত্র সময় না নষ্ট করে অবিলম্বে কর্ণাটক হাইকোর্টের আদেশের উপর স্থগিতাদেশ জারি করা হোক।

৫) কর্ণাটক হাইকোর্টের রায়ের যুক্তি বহু ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর এবং অসন্তোষজনক।
ক) রায়টি তার বেশিরভাগ সময় এই যুক্তিতে ব্যয় করেছে যে হিজাব (হেডস্কার্ফ) পরা ইসলামে একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুশীলন নয়। কিন্তু এটা যে মূল প্রশ্নের সমাধান করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে তা হল, হিজাব পরার কারণে কোনো মুসলিম মেয়ে বা মহিলাকে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা কি বৈষম্যমূলক এবং অসাংবিধানিক নয়?

খ) রায়টিতে ডক্টর আম্বেদকরের লেখার একটি অনুচ্ছেদ কীভাবে ‘বাধ্যতামূলক পর্দা প্রথা’র ফলে মুসলিম মহিলাদের বিচ্ছিন্নতা এবং একাকিত্বের মধ্যে পড়তে হয়, উদ্ধৃত করে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে হিজাব/বোরখা ইত্যাদি মুসলিম মেয়ে এবং মহিলাদের মুক্তি, জনসমক্ষে অংশগ্রহণ এবং শিক্ষার অধিকারের পথে বাধা হয়ে উঠতে পারে। এটি ডঃ আম্বেদকরের বক্তব্যের দিশা এবং উদ্দেশ্যের একটি মর্মান্তিক বিকৃতি। ডঃ আম্বেদকরের মন্তব্য পোশাকের কোনো অংশ সম্পর্কে ছিল না। ডঃ আম্বেদকর নির্দিষ্টভাবে বাধ্যতামূলক পর্দা প্রথার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন যা মেয়েদের এবং মহিলাদের প্রকাশ্যে বাইরে উপস্থিত হতে বাধা দেয়; এক প্রকার জোরপূর্বক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে তাদেরকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং ‘বাইরের জগতের কার্যকলাপ’ করতে বাধা দেয়। ডঃ আম্বেদকর কখনোই বলেননি যেমনটা হাইকোর্টের রায়ে বোঝানো হয়েছে যে, স্বেচ্ছায় হেডস্কার্ফ (হিজাব) পরা মুসলিম মেয়ে বা মহিলাদের শিক্ষার জগতে প্রবেশ করা থেকে বিরত করে রেখে তাকে বাড়ির ভিতরে বন্দীদশায় ফিরে যেতে বাধ্য করা হবে বা আলাদা মুসলিম স্কুল বা কলেজে পড়াশোনা করতে বাধ্য করা হবে!

গ) রায়টিতে ইন্ডিয়ান ইয়ং লইয়ারস অ্যাসোসিয়েশন বনাম কেরালা রাজ্যের জাজমেন্ট (জনপ্রিয়ভাবে ‘শবরিমালা রায়’ নামে পরিচিত) উদ্ধৃত করে দাবি করা হয়েছে, সংবিধান প্রদত্ত ‘ধর্মের স্বাধীনতার অধিকার’ সমস্ত ধর্মাচরণকে সুরক্ষিত করতে অপারগ; এবং তাই হিজাব পরার প্রচলনকে সুরক্ষিত করা সম্ভব নয়! মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে শবরিমালার রায়কে কীভাবে স্কুল বা কলেজে হিজাব পরা মেয়ে এবং মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে?

ঘ) রায়টিতে ইউনিফর্মের সাথে ‘ইউনিফর্মিটি’ (অভিন্নতা)-কে এক করে দেখানোর ভুল করা হয়েছে। ভারতবর্ষে স্কুল/কলেজের ইউনিফর্ম সর্বদা সামাজিক এবং ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে আত্তীকৃত করে নিয়েই বাছা হয়েছে, উদাহরণস্বরূপ, শিখ ছেলে এবং মেয়েদের পাগড়ি পরতে দেওয়া। এই বৈচিত্র্য যা পাগড়ি বা হিজাবকে অঙ্গাঙ্গী করে নেয় তা কখনই ইউনিফর্মের সাথে বিরোধপূর্ণ নয়। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ‘অভিন্নতা’ কখনই ভারতীয় স্কুল এবং কলেজগুলির বৈশিষ্ট্য ছিল না। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে ‘MEC EDUCATION: KWAZULU-NATAL’ রায় যা দক্ষিণ আফ্রিকার একটি স্কুলের একজন হিন্দু মেয়েকে তার ইউনিফর্মের সাথে নাকের নথ পরার অনুমতি দেওয়ার অস্বীকৃতিকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছিল। বলা হয় এই কেসটি হিজাবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না যেহেতু নাকের নথ ‘নজরে পরার ক্ষেত্রে অত্যন্ত নগণ্য’! একটি আদালতের নৈতিক এবং সাংবিধানিক যুক্তিগুলি এই ধরনের বিষয়গত পক্ষপাতের উপর কখনই নির্ভর করা উচিত নয় যেখানে একটি হিন্দু মেয়ের নাকের নথ নজরে বিরক্তির উদ্রেক করে না, কিন্তু একটি মুসলিম মেয়ের মাথার স্কার্ফ তা করে!

ঙ) যেমনটি আমরা উল্লেখ করেছি, কর্ণাটক হাইকোর্টের রায়ে নারীদের বলপূর্বক বিচ্ছিন্ন করা প্রসঙ্গে আম্বেদকরের উদ্বেগকে ঐচ্ছিকভাবে মেয়েদের হিজাব পরিধানের উপরে ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এটা প্রকারান্তরে বলতে চাওয়া হয়েছে যে হিজাব পরার আচার মেয়েদের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং তাই স্কুল ও কলেজে এটা অনুমোদন করা উচিত নয়। রায়টি মহিলাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের উপর জোরপূর্বক ধর্মীয় বিধি আরোপ করা ও মহিলাদের স্বাধীন ইচ্ছার উপর ভিত্তি করে কিছু বিধি বেছে নেওয়ার মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনি; এবং বস্তুত এই রায় নারীর স্বাধীকার এবং সম্মতির ধারণাটিই বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। রায় প্রদানের ক্ষেত্রে শবরীমালা রায়’এর উদাহরণে এই বিষয়টি আরো পরিষ্কার করে দেয়। মহিলারা শবরীমালায় প্রবেশের অধিকারের জন্য আদালতে আবেদন করেছিলেন কারণ মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা তাদের অধিকার ও সমতার দাবিকে খর্ব করছিল। মন্দির কর্তৃপক্ষের ‘ধর্মীয় রীতি পালনের স্বাধীনতা’র দোহাই দিয়ে নারীদের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে আদালত কোনোভাবেই শবরীমালায় প্রবেশ করা উচিত নয় বলে বিশ্বাস করেন এমন মহিলাদেরকে ‘মুক্তি’র নামে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে মন্দিরে প্রবেশ করতে বাধ্য করেনি। একইভাবে ‘মুক্তি’র নাম করে হিজাব পরা মেয়ে বা নারীদের স্কুল বা কলেজে ঢুকতে বাধা দেওয়া এক অতিব জঘন্য বিষয়। নারীমুক্তি মহিলাদের স্বাধীকারকে সম্মান করার মধ্যে নিহিত আছে, ধর্ম বা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে তাদের ওপর জোরপূর্বক বিধি চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে নয়।

হিজাব পরিহিত সকল মুসলিম শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, মর্যাদা এবং স্বাধীকারের লড়াইয়ে সাথে আমাদের পূর্ণ সংহতি আছে।

স্বাক্ষর করেছেন,

সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি — ডাঃ রতি রাও, মীনা তেওয়ারি, কবিতা কৃষ্ণান।
সহেলি, উওমেন্স রিসোর্স সেন্টার — শতনাম কৌর, সবিতা শর্মা, অসীমা রায় চৌধুরী।
ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান উওমেন — অ্যানি রাজা, রুশদা সিদ্দিকি।
প্রগতিশীল মহিলা সংগঠন — পুনম কৌশিক।
পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিস — লারা জেসানি, কবিতা শ্রীবাস্তব, সীমা আজাদ, শালিনী গেরা।
ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অফ পিপলস মুভমেন্টস — অরুন্ধতী ধুরু, মীরা সঙ্ঘমিত্রা।
উওমেন এগেইন্সট সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স অ্যান্ড স্টেট রিপ্রেশন — নিশা বিশ্বাস।
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি — মারিয়ম ধাওয়ালে, মৈমুনা মোল্লা।
ফোরাম এগেইন্সট অপ্রেশন অফ উওমেন — আম্মু, অমৃতা, চয়নিকা, স্বাতিজা।
ফেমিনিস্টস ইন রেজিস্টেন্স — পৌষালি বসাক।
বেবাক কালেক্টিভ — হাসিনা খান।
নভশরন সিং, স্মিতা গুপ্তা, কানিজ ফাথিমা, ফারহা নাকভি, বানি সুব্রাহ্মনিয়ম, মানসী আশার, অনুরাধা ব্যানার্জি।

karjan park_bhagat singh

কার্জন পার্কে ভগৎ সিং-এর শহীদ বেদীতে মাল্যদান

AISA’s Arvind Bhavan campaign
  • ১) যে সব পড়ুয়ারা হোস্টেল পায়নি, তাদের জন্য অবিলম্বে হোস্টেলের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • ২) অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া যে সব পড়ুয়ারা হোস্টেল পায়নি, তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে, অর্থনৈতিক সাহায্য সুনিশ্চিত করতে হবে।
  • ৩) পড়ুয়াদের সুবিধার্থে অবিলম্বে সংস্কৃত বিভাগের রেমেডিয়াল ক্লাস চালু করতে হবে।
  • ৪) লিঙ্গুইস্টিক্স এবং ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগে ইউজি কোর্স চালু করতে হবে।
  • ৫) পড়ুয়াদের পঠনপাঠনের সুবিধার্থে এবং ভাষাবৈষম্য দূর করতে, প্রত্যেকটি বিভাগে অবিলম্বে “ল্যাঙ্গুয়েজ সেল” তৈরি করতে হবে।
  • ৬) আর্টস ফ্যাকাল্টিতে প্রতিটি বিল্ডিংয়ে জেন্ডার নিউট্রাল টয়লেট বানাতে হবে এবং যে টয়লেট গুলো রয়েছে, সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করানোর ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষকে করতে হবে।
  • ৭) কগনিটিভ সায়েন্স, সোসিওলজি, লিঙ্গুইস্টিকস সহ বিভিন্ন বিভাগের জন্য পর্যাপ্ত ক্লাসরুমের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • ৮) পিএইচডি সিট সংখ্যা প্রত্যেকটি বিভাগে বৃদ্ধি করতে হবে।
  • ৯) বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নন-নেট ফেলোশিপ চালু করতে হবে।
  • ১০) প্রত্যেকটি বিভাগে, পর্যাপ্ত এবং কার্যকারি স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিনের বন্দোবস্ত করতে হবে।

আরও কিছু দাবি সহ ২৩ মার্চ, ভগৎ সিং-শুকদেব-রাজগুরুর শহীদ দিবসে আইসা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪নং গেট থেকে অরবিন্দ ভবন অবধি মিছিল, অবস্থান বিক্ষোভ সংগঠিত করা হয় এবং ডেপুটেশন দেওয়া হয়।

on Bhagat Singh Day

২৩ মার্চ ভগৎ সিং, রাজগুরু ও শুকদেবের ৯১ তম শহীদ দিবসে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন বেলঘরিয়া আঞ্চলিক কমিটির কার্যালয় উদ্বোধন হল। বেলঘরিয়া স্টেশনের পূর্বদিকে ফ্লাই ওভারের নিচে দীর্ঘ চল্লিশ বছরের পুরোনো পার্টি অফিসটি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। কার্যালয়টি শহীদ কমরেড তপন শূর, শহীদ কমরেড বকুল সেন এবং প্রয়াত কমরেড নান্টু দে-র স্মৃতিতে উৎসর্গ করা হল। উদ্বোধন করেন পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য পার্থ ঘোষ। বক্তব্য রাখেন মিতালি বিশ্বাস, মাজাহার খান, পার্থ ঘোষ, বাসুদেব বসু এবং নবেন্দু দাশগুপ্ত। সুমেলি, মেহুলি, অয়ন্তিকা, বাবুনি ও সরিৎদের গান সমগ্র অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করে তোলে। বক্তারা রামপুরহাট গণহত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি দাবি করেন। দেউচা-পাঁচামী কয়লাখনি প্রকল্প বাতিলের দাবি করা হয়। ২৮-২৯ মার্চ ধর্মঘট সফল করার আবেদন করা হয়।

স্থানীয় মানুষের উপস্থিতি ভালো ছিল। আশা করা যায় দ্রুত পার্টির কাজের বিস্তার ঘটাতে এই কার্যালয় এক কার্যকরি কেন্দ্র হয়ে উঠবে।

on the occasion of Women's Day in Hooghly

ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে হুগলিতে এক বৈঠকে মিলিত হন কয়েকজন মহিলা, যাদের মধ্যে গৃহবধূ যেমন ছিলেন তেমনি ছিলেন শিক্ষিকা, ছাত্রী এবং শিক্ষান্তে কর্ম প্রচেষ্টায় রত মহিলারা। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় সকলের সুবিধা অসুবিধে দেখে মার্চের কোনো একদিন তাঁরা নারী দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি উদযাপন করবেন। সেইমতো ১৯ মার্চ হুগলির ব্যান্ডেল চার্চের মোড়ে প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে কর্মসূচী নেওয়া হয়। গানে কথায় কবিতায় পালিত এই কর্মসূচিতে সকলেই উৎসাহের সাথে অংশ নেন। আবৃত্তি করেন শুক্লা চক্রবর্তী ও চন্দ্রানী ব্যানার্জী, গান গেয়ে শোনান সতী সেন ও গীতালী ব্যানার্জী, তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর একটি গান ও কবিতা বলেন ঋতা ব্যানার্জি। আয়োজকদের অনুরোধে বাচিক শিল্পী কিশোর চক্রবর্তী কবিতা পাঠ করেন। সমিতির নেত্রী চৈতালি সেন হুগলির নতুন এই জায়গায় মহিলা সমিতির কাজ শুরু করার জন্য সকলকে ধন্যবাদ জানান, তাঁর কথায় উঠে আসে দেউচা-পাঁচামী থেকে নরেন্দ্রপুরে মহিলাদের ওপর রাষ্ট্রের হামলা এবং আগামী ধর্মঘটে মহিলাদের লড়াই’এর কথা। মহিলাদের ওপর নির্যাতন, তাদের ওপর ঘটে চলা বৈষম্যে এবং লড়াইয়ের ছোট ছোট উদাহরণ তুলে ধরে সমগ্র অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে সঞ্চালনা করেন ছাত্রী তিয়াসা রায়।

Nadia District Conference

২১ মার্চ চাকদহ শহরের সম্প্রীতি মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পঞ্চদশ নদীয়া জেলা সম্মেলন। শুরুতে রথতলা মোড়ে কমরেড বিধান মজুমদারের শহীদ বেদীতে মাল্যদান, পতাকা উত্তোলন সহকারে শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানের পর প্রতিনিধিরা মিছিল করে সম্মেলনস্থলে আসেন। ’৭০ দশকে নকশালবাড়ি আন্দোলনে যুক্ত চাকদহের যুবক বিধান মজুমদারের এই শহীদ বেদী নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। এই মহৎ কাজে এলাকার মানুষের ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। স্মরণ অনুষ্ঠানে শহীদ পরিবারের সদস্যরা ও এলাকার বেশ কয়েকজন মানুষও অংশগ্রহণ করেন। বেদীর পাশে এক স্মরণিকা বোর্ডে লেখা হয়েছিল “কমরেড বিধানের নির্মম হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ঘাতকেরা ছিল লাল জামা গায়। পরে রাজ্যজুড়ে তাদেরও নিধন করে আধা ফ্যাসিবাদী শাসকেরা”। এই কর্মসূচি এলাকার মানুষের মধ্যে ভালো ছাপ ফেলে।

সুবিমল সেনগুপ্ত নগর, বানের সেখ সভাগৃহ ও বিধান মজুমদার মঞ্চ নামাঙ্কিত হলে সম্মেলনের শুরুতে শোক প্রস্তাব এবং বাবুনি মজুমদারের গানের পর প্রতিবেদন পেশ করা হয়। এরপর রাজ্য পর্যবেক্ষক সজল অধিকারী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য সম্ভাবনার জায়গাগুলো খুলছে। কিন্তু গণকাজ বা গণরাজনৈতিক কাজের অনুশীলন গড়ে তুলতে না পারলে আমরা সেটা ধরতে পারব না, তাই একে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নদীয়া জেলায় ভৌগলিকভাবে দুই অংশের একদিকে বিজেপি’র আধিপত্য অপর দিকে তৃণমূলের প্রভাব বিগত বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছিল। বিজেপি মতুয়া ও উদ্বাস্তু মানুষদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সেটা পাল্টাচ্ছে। বামপন্থীরা একটি পুরসভায় তাদের ক্ষমতা ধরে রেখেছে। সেখানে তৃণমূলের সন্ত্রাস মোকাবিলায় জনগণের প্রতিরোধ লক্ষ্য করা গেছে, যা ইতিবাচক।

প্রতিবেদনে তৃণমূল সরকারের সংস্কারমূলক প্রকল্পগুলি সম্পর্কে বলা হয় এগুলিকে সম্পূর্ণ নাকচ করা বা ‘ভিক্ষা’ ইত্যাদি বলার পরিবর্তে সেগুলিকে মানুষের অধিকার হিসাবে তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি প্রকল্পগুলির সীমাবদ্ধতা, পরিমাণে স্বল্পতা এবং ব্যাপক সংখ্যক মানুষের বঞ্চিত থেকে যাওয়ার দিকগুলিকে সামনে নিয়ে এসে জনগণের মধ্যে প্রতিবাদের মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। উপর থেকে তৃণমূলের জয়জয়কার মনে হলেও একটু গভীরে গেলে দেখা যাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে বহু মানুষ ঘুরছে, দলবাজির ফলে বহুসংখ্যক মানুষ বঞ্চিত। জনগণের মধ্যে যে প্রশ্নগুলি উঠে আসছে তা হল ইতিপূর্বেই চালু থাকা বিভিন্ন প্রকল্পগুলিকে বন্ধ করা হলো কেন? যাদের পাওয়ার কথা নয় সেই কায়েমী স্বার্থান্বেষীরা সুযোগ সুবিধাগুলি আত্মসাৎ করছে কেন? দুর্নীতি রোধ করতে গণতদারকি বা হিসাবের বিভিন্ন তথ্য জনগণকে জানানো হচ্ছে না কেন? এই প্রশ্নগুলি তুলে ধরে আমরা প্রকল্পগুলির স্বরূপ জনপ্রিয়ভাবে সামনে নিয়ে আসতে পারি। এগুলির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আরও গভীর অনুসন্ধানের করার কথা প্রতিনিধিরা বলেন। কেউ বলেন, কেবল কাগজে কলমে লিখলেই চলবে না। লেখাটা সহজ, আসল কাজ হল হাতে কলমে আন্দোলন গড়ে তুলে বিরোধী পক্ষের ভূমিকা নেওয়া। কেউ বলেন, মানুষ আমাদের চাইছে কিন্ত আমাদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা ও কাজের একতা গড়ে তুলতে হবে। ১০০ দিনের কাজে দুর্নীতি, ভাগচাষি-লিজচাষিদের অধিকার আদায় প্রভৃতি ইস্যু নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রসঙ্গ, তৃণমূলের শাসনে সন্ত্রাস ও সংস্কার উভয়কে একসাথে মোকাবিলা করে গণউদ্যোগ বিকাশ ঘটানো, নেতৃত্বের অগ্রণী ভূমিকা, জনগণের বিভিন্ন রকম সমস্যায় তাদের পাশে নেতৃত্বের দাঁড়ানো প্রভৃতি প্রশ্নগুলিতে বিভিন্ন প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন। নেতৃত্বের কাজের ধারা নিয়ে, কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে তীব্র সমালোচনা-আত্মসমালোচনা সম্মেলনকে প্রাণবন্ত করে তোলে।

Fifteenth Nadia Conference

বিগত দিনে আন্দোলনের কয়েকটি অভিজ্ঞতার কথা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। যথা ধুবুলিয়ার নওপাড়া অঞ্চলে ১০০ দিনের কাজ, ধান কেনায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে তৃণমূল পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে শতাধিক জমায়েত করে আক্রমণাত্মক প্রচার গড়ে তোলা, বেথুয়াডহরীতে লকআপ হত্যার বিরুদ্ধে তৎপরতা ও সাহসের সাথে রুখে দাঁড়ানো। শালিগ্রামে জনপ্রিয় ইস্যুতে নানাধরনের গণউদ্যোগে তৃণমূলকে চাপে ফেলে দেওয়া, একটি বুথে উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে শাসকদের চ্যালেঞ্জ জানানো ইত্যাদি ইত্যাদি এই অনুশীলনগুলিকে শ্রদ্ধা করতে হবে, শিক্ষা নিতে হবে। ভুক্তভোগী মানুষ বিভিন্ন প্রশ্নে প্রতিবাদ করছেন, সেখানে আমরা উপস্থিত থাকতে পারছি কিনা সেটা দেখতে হবে।

সাংগঠনিক প্রশ্নে নিচুতলায় পার্টি ব্রাঞ্চ গঠনের উদ্যোগ, সদস্য সংখ্যার অনুপাতে একটি গ্রামে দুটি ব্রাঞ্চ করা এই ধরনের বিষয়গুলি রিপোর্ট রেখে বলা হয়, সদস্যদের ব্রাঞ্চভুক্ত করার কাজ কিছুটা এগোলেও এখনও অনেকটাই বাকি। সদস্যপদ পুনর্নবীকরণ প্রক্রিয়ায় এক ধরনের স্ক্রুটিনি করার কাজ হাতে নিতে হবে। নিচুতলা থেকে পার্টির ভিত্তি শক্তিশালী করে তুলতে হবে। জমায়েত ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্বকে দুই তিনজন সক্রিয় কর্মীদের নিয়ে চলার অভ্যাস পরিহার করা, কমিটি কাঠামোগুলির বারংবার বৈঠক করে সমস্ত সদস্যদের সাথে একাত্মতা বাড়িয়ে তোলার কাজের রীতি আয়ত্ব করতে হবে।

সম্মেলনের সভাপতি মন্ডলীতে ছিলেন ধনঞ্জয় গাঙ্গুলি, আলতাফ হোসেন, সালেমা বিবি, পরিক্ষিৎ পাল, অমল তরফদার। বক্তব্য রাখেন পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল, রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বসু, রণজয় সেনগুপ্ত। শুরুতে শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন রাজ্য কমিটি সদস্য দিবাকর ভট্টাচার্য। পরিশেষে ২৫ জনের জেলা কমিটি নির্বাচিত হয়। জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হন জয়তু দেশমুখ। ৪টি আশু কর্মসূচি গৃহীত হয় তার অন্যতম হল — ২৮-২৯ মার্চ দেশজুড়ে সাধারণ ধর্মঘট সফল করে তোলা। ধর্মঘটের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার জন্য তৃণমূল সরকার যদি আক্রমণ নামিয়ে আনে তার বিরোধিতা করে ধর্মঘটের দিন সিপিআই(এমএল) তার শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনের সাথে মিলে পথে নামবে।

তৃণমূল সরকারের বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের পোশাক নিয়ে ফতোয়া জারি করা, সমাজের সর্বস্তরে ক্ষমতার আধিপত্য চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করে প্রচার গড়ে তুলবে।

conference of Murshidabad district

১৫ মার্চ মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরের লিয়াকত ভবনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশনের বিংশতম জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন স্থল নামাঙ্কিত করা হয় প্রয়াত কমরেড তাজউদ্দীন বিশ্বাস নগর, কমরেড স্বপন স্যানাল ও জামসেদ সেখ মঞ্চ এবং কমরেড মালেক সেখ সভাগৃহ। সম্মেলন শুরু হয় শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও শ্রদ্ধা নিবেদন করার মধ্যে দিয়ে। জেলা সম্পাদক রাজীব রায় উপস্থিত রাজ্য কমিটির পর্যবেক্ষক, অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও প্রতিনিধি কমরেডদের অভিনন্দন জানিয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক সুচনা করেন। তিনজনের সভাপতিমন্ডলীর আসন গ্রহণ করেন সৈয়দ ফজলে আলম, সোরাবুদ্দিন সরকার ও পঙ্কজ কুন্ডু, সঞ্চালন সহযোগিতায় ছিলেন আবুল কাসেম সেখ ও মনভোলা চৌধুরী। রাজ্য পর্যবেক্ষক বাসুদেব বসু উদ্বোধনী ভাষণ রাখেন। তিনি জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও রাজ্য রাজনীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরার সাথে সাথে কেন্দ্রের ফ্যাসিস্ট বিজেপি-আরএসএস নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারের শ্রমিক-বিরোধী ও জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ট্রেডইউনিয়ন ও কর্মচারী সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ দেশজুড়ে ২৮-২৯ মার্চের সাধারণ ধর্মঘট এবং কৃষক সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের উদ্দেশে লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়া দাবিগুলো পূরণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশ্বাস ঘাতকতার বিরুদ্ধে গ্রামীণ ভারত বনধ্ সফল করার জন্য আহ্বান জানান। তিনি আগামী ১৩-১৫ মে কলকাতায় পার্টির রাজ্য সম্মেলন সফল করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বান রাখেন। তারপর বিদায়ী সম্পাদক রাজীব রায় সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পাঠ করেন। প্রতিবেদনের ওপর ১৫ জন প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন। এছাড়া বক্তব্য রাখেন রাজ্য কমিটি সদস্য ধীরেশ গোস্বামী ও রণজয় সেনগুপ্ত সহ অন্যান্য কমরেড। জবাবী ভাষণে রাজীব রায় বিভিন্ন বক্তাদের মতামতের সংযোজন করেন। সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবেদন পাশ হয়। পর্যবেক্ষক বাসুদেব বসু কমিটি নির্বাচনের কাজ পরিচালনা করেন। সর্বসম্মতিক্রমে ১১ জনের জেলা কমিটি নির্বাচিত হন। রাজীব রায় সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন। উৎসাহের সাথে শ্লোগান ও আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

As the debt burden increases

প্রায় ২ সপ্তাহ আগে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বাজেট পেশ করেছেন অর্থ দফতরের স্বাধীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীমতি চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। গতবছর বাজেট পেশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। তাঁর কাঁধে অনেক বোঝা থাকায় তিনি এবার বাজেট পেশের দায়িত্ব চন্দ্রিমা দেবীকে ন্যস্ত করেছেন বোধহয়। যেহেতু, গতবছরের বাজেট বক্তৃতা মুখ্যমন্ত্রী নিজেই করেছিলেন তাই নিজের পক্ষে নিজের গুণকীর্তন করা যায়নি। এবারের বাজেট বক্তৃতার তাই যথাবিহিত বারম্বার চন্দ্রিমাদেবী মাননীয়ার অনুপ্রেরণাকে স্মরণ করেছেন। ফলে বাজেটে অন্তত ১১ বার মুখ্যমন্ত্রীর কথা উল্লেখিত হয়েছে। এই ব্যক্তিপুজো এরাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যতদিন যাচ্ছে ততই বেড়ে চলেছে। মনে পড়ে যাচ্ছে গ্যালিলেও নাটকের সেই কথা, যে জাতির সবসময় বীরের দরকার পড়ে সে জাতি বড়ই দুর্ভাগা। জানিনা আমরা ভারতীয় ও পশ্চিমবঙ্গবাসীরা কবে এই বীর পূজা থেকে নিজেদের নিষ্কৃতি দিতে পারব।

গত বছরের বাজেট ও সংশোধিত বাজেট দেখলেই বোঝা যাবে রাজ্য বাজেট প্রায় অবান্তর। প্রায় সমস্ত খরচের ক্ষেত্রেই ২০২১-২২’র বাজেট বরাদ্দের তুলনায় প্রকৃত (বা সংশোধিত) খরচ কম হয়েছে। এমনটা ২০২০-২১’র বাজেটের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। সেক্ষেত্রে লকডাউনের প্রভাবের কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু ২০২১-২২ সালে যখন স্বাস্থ্য শিক্ষা সামাজিক সুরক্ষার প্রবল প্রয়োজন ছিল তখন কেন এই সমস্ত খাতে খরচ করা গেল না, কেন অর্থ সংস্থান হল না? এসব প্রশ্ন এই বাজেট পেশের সময়ে পাওয়া ২০২১-২২ এর সংশোধিত বাজেট তুলে ধরেছে।

তালিকা - বিভিন্ন খাতে বাজেট বরাদ্দ (কোটি টাকায়)

debt of Rs 60,000 on newborns

উপরের তালিকা থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে, প্রায় প্রতিটি খাতে ২০২১-২২ সালে বাজেট বরাদ্দের তুলনায় সংশোধিত অনুমান অনেকটাই কম। আরো প্রকট যে, মূলধনী খাতে ব্যয় ১৩,৪১৯ কোটি টাকা কম যা বাজেট বরাদ্দের তুলনায় ৪১ শতাংশ কম। মূলধনী খাতে ব্যয় কম হওয়ার অর্থ রাজ্যের পরিকাঠামো তৈরিতে কাজ কম হয়েছে। খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে শিক্ষা-ক্রীড়া-শিল্প ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মূলধনী ব্যয় বাজেট বরাদ্দ ১,০১২ কোটি টাকার তুলনায় ৬৬৫ কোটি টাকা কমে ৩৪৭ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ তিনভাগের একভাগ। চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যে তা ১,৫৯৯ কোটি টাকা বরাদ্দের থেকে ৪৫৫ কোটি টাকা কম হয়েছে। তফশিলি জাতি-উপজাতি-পশ্চাদপদ জাতি কল্যাণের ক্ষেত্রেও মূলধনী ব্যয় ১,৬১০ কোটির বরাদ্দের থেকে ১,২৭০ কোটি টাকা কমে ৩৪০ কোটি হয়েছে। অর্থাৎ ৫ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। নগরোন্নয়নের ক্ষেত্রেও বাজেট বরাদ্দের তুলনায় সংশোধিত খরচ ৫৩ শতাংশ কম। ফলে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই মূলধনী বিনিয়োগ সরকারের তরফে অত্যন্ত হতাশাজনক।

লক্ষ্যণীয়, রাজস্বখাতে খরচের ক্ষেত্রেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দের তুলনায় সংশোধিত ব্যয়ের অনুমান কম হলেও পুলিশ ও জেলখানার খাতে বাজেটের তুলনায় সংশোধিত খরচ বেশি। পুলিশের ক্ষেত্রে তা প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। সরকারের অগ্রাধিকার বোঝাই যায়। জমার দিক থেকে রাজ্য সরকারের ভবিষ্যনিধি থেকে প্রাপ্ত অর্থকে দেখলে সরকারি নিয়োগ ও সরকারি কর্মীদের বেতনের অবস্থা আঁচ পাওয়া যায়। বাজেট অনুমান ৫,৫৮২ কোটির থেকে ৩৬০ কোটি টাকা কম জমা পড়েছে। অর্থাৎ সরকারের হিসেবের থেকে কর্মীদের বেতনে ব্যয় বেশ কম হয়েছে। রাজ্যে নিয়োগের দুরবস্থা এথেকে প্রকট। ২০২১-২২’র বাজেটের তুলনায় ২০২২-২৩ সালে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ১৬৩ কোটি বা ৩ শতাংশের কম বৃদ্ধি। মনে রাখা দরকার সরকারি কর্মচারীদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। ফলে নতুন কর্মী নিয়োগ তো দূরস্থান, গত বাজেটের কর্মী সংখ্যার অনুমানকেও এবছর ছোঁয়া যাবে না।

২০২০-২১’র বাজেট প্রস্তাবে রাজস্ব ঘাটতি ছিল ২৭ হাজার কোটি টাকা যা প্রকৃত প্রস্তাবে ২৯ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছিল। ২০২১-২২ সালের বাজেট প্রস্তাবে রাজস্ব ঘাটতি ছিল ২৬ হাজার কোটি টাকা, সংশোধিত প্রস্তাবে যা দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। মনে রাখা দরকার উপরের হিসেব অনুযায়ী ২০২১-২২ সালে রাজস্ব খাতে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা কম ব্যয় করা সত্ত্বেও রাজস্ব ঘাটতি বাজেটের তুলনায় ৬ হাজার কোটি টাকা বাড়ছে। ফলে এই ক্রমবর্ধমান রাজস্ব ঘাটতি কোথায পৌঁছাবে তা বলা দুস্কর, যদিও তাকে এই বাজেটে ২৮ হাজার কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে।

তালিকা থেকে কয়েকটি বিষয় হিসেব করা যায়। রাজস্বখাতে মোট ব্যয়বৃদ্ধি গত বাজেটের তুলনায় ৬ শতাংশের মতো। যে মুদ্রাস্ফীতির হার তাতে প্রকৃত অর্থে কোন বৃদ্ধিই তো ঘটছে না, কমছেই বলা যায়। মূলধনী খাতে ব্যয় বরাদ্দ বেড়েছে ৩৭০ কোটি টাকা যা গত বাজেটের তুলনায় ১ শতাংশের একটু বেশি। ফলে মূলধনী খাতে প্রকৃত ব্যয় যে কমছে তা বলাই বাহুল্য। গত বাজেটের তুলনায় সংশোধিত হিসেবে ব্যয় কমেছিল ৪১ শতাংশ। এই বাজেটেও তা বাড়ছেনা। ফলে রাজ্যে পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে।

তালিকায় প্রদত্ত বিভিন্ন খাতেই বাজেট বরাদ্দ গত বাজেটের তুলনায় ৬-৭ শতাংশের বেশি বাড়েনি। সমাজকল্যাণ ও পুষ্টির ক্ষেত্রে তা ৩ শতাংশের মত কমেছে। ফলে এ প্রশ্ন স্বাভাবিক যে সরকার কি সমাজকল্যাণের জন্য ব্যয় কম করতে চাইছে? ওদিকে রাজস্ব সংগ্রহে সরকার বাজেটে যতই নিজস্ব তৎপরতার কথা বলুক না কেন আদতে বছর বছর ঋণের বোঝা বাড়ছে। এবছরের বাজেটেও ৭৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ঋণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। ঋণ ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে ৬ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছচ্ছে। ফলে এরাজ্যের অধিবাসীদের মাথাপিছু ঋণ ৬০ হাজার টাকায় পৌঁছবে।

এই বাজেট বক্তৃতায় দাবি করা হয়েছে যে গতবছরে, ২০২১-২২ সালে ৩০ লক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে রাজ্যে, এবং আগামী ৪ বছরে আরো ১ কোটি ২০ লক্ষ কর্মসংস্থান হবে। ওই সংখ্যাটিতে পৌঁছাতেই হবে চন্দ্রিমা দেবীকে, কারণ গত বাজেটে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন আগামী ৫ বছরে দেড়কোটি কর্মসংস্থান করা হবে। তারমধ্যে ২০২১-২২’র ৩০ লক্ষ বাদ দিলে ১ কোটি ২০ লক্ষ থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে কোথায় সেই সব কর্মসংস্থান হয়েছে? আগেও বলা হয়েছিল, সরকারের দশবছরে ১ কোটি ১২ লক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে। ওই দশবছরে কিন্তু কোভিড ছিলনা। বর্তমান সময়ে কোভিডের সময়ে কীভাবে গত দশবছরের তুলনায় দ্বিগুণের থেকে বেশি হারে কাজ তৈরি হবে এরাজ্যে সে ব্যাপারে কোনো দলিল কিন্তু সরকার দেয়নি। ফলে কৃষিতে তিনগুণ আয়, শিল্পে উন্নতি জাতীয় ফাঁকা আওয়াজের মতো ওই এককোটি কুড়িলক্ষ বা দেড়কোটি সংখ্যাগুলি বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়াই কাজ এই সরকারের।

সব মিলিয়ে বলা যায়, বাজেটে এই সরকারের কাছ থেকে নতুন কিছুই পাওয়া যায়নি।

- অমিত দাশগুপ্ত

Women workers

বিগত অর্থবর্ষ শেষের সাথে সাথে ভারতবর্ষ বিগত সাত দশকের মধ্যে সবথেকে করুণতম অর্থনৈতিক অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ আশা করেছিলেন চলতি অর্থবর্ষ অর্থাৎ মার্চ ২০২২’র মধ্যে দেশ এই বিপর্যয়কর মন্দা থেকে হয়তো ঘুরে দাঁড়াতেও পারে, হয়তো গড়ে বার্ষিক ৮-৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেতে পারে সদর্থকতা। এমনকি সদ্য পেশ হওয়া কেন্দ্রীয় অর্থবাজেটের আগে অর্থমন্ত্রী (যিনি পেঁয়াজ খান না, তাই পেঁয়াজের দাম বাড়লে তার অসুবিধা নেই) এমনও বিজ্ঞাপন দিয়েছেন যে ভারতের বৃদ্ধির হার ৯.২ শতাংশ! কিন্তু কই, এহেন বিজ্ঞাপনে গবেষকরা তো বটেই, ভারতের মুটে-মজুর, খেটে খাওয়া মানুষের দল তো স্বস্তির অবকাশ পেলেন না। নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না, শ্রম বাজারের সবথেকে বঞ্ছিত ও লাঞ্ছিত, মহিলা শ্রমিকরা, জটিল অঙ্কের আড়ালে তাদের জীবনের নাগরিক অধিকার ও উন্নয়ন সূচকতার অবনমন আরও পিছনের সারির ইস্যু হয়ে দাঁড়াল। উল্লেখ্য, গতবছরেই কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যোগদানের হার নেমে গেছিল ১৬.১ শতাংশে এবং এখনও তার কোনও উত্তরণ ঘটেনি।

বিশ্ব শ্রম সংস্থার সাম্প্রতিক হিসাব বলছে, কোভিডের দরুন ২০১৯’র পরে যে কর্মহীনতা, বেতনহীনতা ইত্যাদি ঘাটতি তৈরি হয়েছে তা পুরুষ শ্রমিকরা হয়তো ভবিষ্যতে কখনও না কখনও পুষিয়ে নিতে পারবেন, কিন্তু যে ঘাটতি মহিলাদের এমনকি শ্রমিকের অধিকারের ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে তা কবে মিটবে বা আদৌ মিটবে কিনা তা জোর দিয়ে বলা যায় না। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে কর্মক্ষম মহিলাদের মাত্র ৪৮ শতাংশ কোনরকম কাজে যুক্ত রয়েছেন। যদিও এই ধরনের আন্তর্জাতিক হিসাবগুলিতে শুধুমাত্র যে কোনোরকম বেতনভুক কর্মচারীদের কথাই বলা হয়। ভারতবর্ষে গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ মহিলাদের ক্ষেত্রেই বিনা বেতনের কর্মী বা সাহায্যকারী হিসাবে কাজের একটা রেওয়াজ আছে, টাকার বদলে খাওয়া, বাচ্চাদের জন্য উপহার, চাল ইত্যাদি নানারকম বন্দোবস্ত। অবশ্য পরে সরকার প্রণীত নানারকমের প্রকল্পে এদের ঠিকাশ্রমিক হিসাবে কর্মনিযুক্তি হয়েছে। সেখানেও বেতন ও মাসোহারা অত্যন্ত কম, তাই লড়ছেন আশা ও অঙ্গনওয়ারী কর্মীরা, লড়ছেন ঠিকা শ্রমিকরা বছরে ২০০ দিনের কাজ ও দৈনিক ৬০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে। মহিলাদের সাথে সাথে পুরুষরাও সরকারি কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পে নিযুক্ত হয়ে থাকেন, কিন্তু সেইসব বেশিরভাগ কায়িক পরিশ্রমে খাটনির তুলনায় রোজগার কম হওয়ায় পুরুষেরা দূর জায়গায় কাজে চলে যাচ্ছেন। ঘর গেরস্থালীর দায়িত্ব তখন আরও বেশি করে চেপে বসছে মহিলাদের উপর, তখন মহিলারা বাইরের কাজের থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছেন। ভারতে এমন মহিলাদের অংশ মোট শ্রমিক গোষ্ঠীর প্রায় ৪১ শতাংশ।

Women workers are being easily targeted

কাজ হারানোর লিস্টে মেয়েদের নামই বেশি, কর্মী ছাঁটাই করে মুনাফা বজায় রাখতে চাওয়া কর্মনিয়োগকারীর কাছে সহজ ও অগ্রাধিকার অপশন হিসাবে নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদ মহিলাদেরকেই নিশানা করছে। কারণ আজকের পুঁজিবাদ চায় মহিলারা বাইরে নয়, বিনা বেতনের গৃহকর্ম করুক, আর নানা ক্ষেত্রে মহিলাদের যা কিছু টোকেন রিপ্রেজেন্টেশন থাকবে তা হবে পুঁজিবাদেরই পরিচালিত। এমনকি মহিলাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো পর্যন্ত এই পর্বে মহিলা কর্মচারীদের ছাঁটাই করেছে, তাদের ছুটির দিনে কাজ করতে বাধ্য করেছে। কাজেই, কোভিড জনিত দুরাবস্থা মহিলা শ্রমিকদের আগে থেকেই অবনমন হতে থাকা অবস্থানকে আরও তীব্র গতিতে আরও অনেক গভীরে অবনমিত করে চলছে। তবুও মহিলারা লড়ছেন ন্যূনতম মজুরি সহ, মাতৃত্বকালীন ছুটি, ঋতুকালীন ছুটি, কর্মস্থলে শিশুকে স্তন্যপান করার অধিকার চেয়ে, কর্মস্থলে যৌনহেনস্থার প্রতিকার চেয়ে, সমকাজে সম-মজুরির দাবিতে।

- সংগ্রাম মন্ডল

Modi government's excessive activism

গোদি মিডিয়া, অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদী সরকার ও বিজেপি’র ধামাধরা সংবাদ মাধ্যম যদি আজকের বাস্তব পরিস্থিতির একটা দিক হয়ে থাকে, তবে সরকারের হুমকি ও ভীতি প্রদর্শনকে উপেক্ষা করে স্বাধীন ধারায় সংবাদ সম্প্রচারের প্রতি অনুগত থাকা মিডিয়ার বিদ্যমানতাও অনস্বীকার্য। মূল ধারার মিডিয়ার এক বড় অংশ মোদী সরকার অনুসৃত নীতিমালার প্রচারে যেমন সক্রিয়, এরসাথে হিন্দুত্বের প্রতি সমর্থনেও তারা কুণ্ঠাহীন। তবে, এরই পাশাপাশি মোদী সরকারের কার্যধারার, সংখ্যাগুরুবাদী পন্থার সমালোচক মিডিয়ার একটা অংশও — সেটা আকারে ছোট হলেও — নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করে চলেছে। ফলে তারা সরকারের বিষ নজরে পড়ে, তাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার প্রতি বিপজ্জনক হওয়ার ও দেশদ্রোহের অভিযোগ এনে, মানহানির মামলা করে তাদের সম্প্রচারকে আটকানোর চেষ্টা হয়। সরকারের সমালোচক সাংবাদিকদেরও জেলে পোরা হয়, তাঁরা দৈহিক হিংসার শিকার হন, এবং শাসক দলের অপ্রিয় কিছু সাংবাদিককে হত্যা করাও হয়েছে। সরকার যেমন চায় সেরকম সংবাদ সম্প্রচারের প্রতি অনুগত ছিল না কেরলের মালায়ালাম ভাষার চ্যানেল মিডিয়া ওয়ান, যার মালিক মধ্যমা ব্রডকাস্টিং লিমিটেড। নরেন্দ্র মোদী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক এবছরের ৩১ জানুয়ারি এক আদেশ বলে তাদের সম্প্রচার লাইসেন্স নবীকরণ করতে অস্বীকার করে, ফলে ঐ চ্যানেলের খবর সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক লাইসেন্স নবীকরণ না করার যুক্তি হিসাবে বলে এই চ্যানেল ‘জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক’, এবং ‘বিপজ্জনক’ হওয়ার এই সংবাদ তারা পেয়েছে অমিত শাহর নেতৃত্বাধীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছ থেকে। কিন্তু ‘বিপজ্জনক’ হওয়ার মত কি কাজ ঐ চ্যানেল করেছে তা তাদের জানানো হয় না। চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে ফলে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়।

সরকার নিরাপত্তার কথা উত্থাপন করলে সবাই যেন কুঁকড়ে যায়, নির্দিষ্ট প্রসঙ্গের বিচার-বিবেচনা, সরকার গৃহীত অবস্থানের যৌক্তিকতার মূল্যায়ন চাপা পড়ে যায় ‘নিরাপত্তার বিপদের’ গুরুভার’এর নিচে। সুপ্রিম কোর্ট মনোহরলাল শর্মা বনাম কেন্দ্রীয় সরকার মামলায় বলেছিল যে, জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে পর্যালোচনার সুযোগ বিচারবিভাগের কাছে সীমিত, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, যতবার নিরাপত্তার জুজু দেখানো হবে ততবারই তারা ফ্রী পাস বা অবাধ ছাড়পত্র পেয়ে যাবে। অর্থাৎ, সরকার যা বলছে সেটাকেই ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেওয়া হবে। কিন্তু মিডিয়া ওয়ান’এর ক্ষেত্রে কেরল হাইকোর্টের বিচারপতি এন নাগারেশ ‘নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক’এর কথা শুনেই সরকারের জারি করা নিষেধাজ্ঞাতেই সায় দিলেন, খবরের চ্যানেলটি জাতীয় নিরাপত্তাকে বিপন্ন করার মতো কাজ করেছে কিনা তার বিচারেই গেলেন না। তিনি তাঁর রায়ে বললেন, “যেহেতু জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে, আমি তাই অন্তর্বর্তী আদেশটিকে এক ঘন্টা সম্প্রসারিত করতেও রাজি নই”। এরপর ডিভিসন বেঞ্চে আবেদনেও ভিন্ন কোনো ফল ফলল না। বিচারপতিরা তাঁদের কাছে মুখবন্ধ খামে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পেশ করা ফাইলগুলো পরীক্ষা করে বললেন — খবরের চ্যানেলের মালিক মধ্যমা ব্রডকাস্টিং লিমিটেড’এর সঙ্গে কিছু শক্তির যোগ রয়েছে বলে বলা হয়েছে যে শক্তিগুলো বিপজ্জনক। ডিভিসন বেঞ্চ তাদের রায়ে এই কথাটারও উল্লেখ করে যে, মধ্যমা ব্রডকাস্টিং ও তার প্রধান পরিচালকের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরোর কিছু সমালোচনামূলক রিপোর্টও রয়েছে। কিন্তু যে ফাইলগুলো আদালতের কাছে পেশ করা হল, সেগুলো পরীক্ষা করে আদালত কি মধ্যমা ব্রডকাস্টিং’এর দেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক হওয়া সম্পর্কে সুনিশ্চিত হয়েছিল? ডিভিসন বেঞ্চ তাদের উপলব্ধির কথা জানিয়ে বলেছে, “একথা ঠিকই যে, ফাইলগুলো থেকে বিষয়টার প্রকৃতি, প্রভাব এবং গুরুত্ব ও গভীরতা সম্পর্কে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে, এরই সাথে জনজীবনে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার ওপর প্রভাব বিস্তারের সুস্পষ্ট ও তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে। …” অর্থাৎ, নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক হওয়ার যে অভিযোগ আনা হল, ফাইলগুলো পড়ে বিচারপতিরা সেই অভিযোগের সারবত্তাকে অনুধাবন করতে পারলেন না। কিন্তু, যেহেতু বিপজ্জনক হওয়ার ‘সুস্পষ্ট ও তাৎপর্যপূর্ণ’ ইঙ্গিত রয়েছে, তাঁরা তাই চ্যানেলটির সম্প্রচার বন্ধ রাখার পক্ষেই মত দিলেন। এইভাবে অভিযোগটির যৌক্তিকতার বিচারের পরিবর্তে নিরাপত্তার প্রতি বিপজ্জনক হওয়ার যে সংকেত কেন্দ্রীয় সরকারের ফাইলে দেওয়া হয়েছে, সেটাই তাঁদের রায়ের পক্ষে নির্ধারক হয়ে উঠল।

এরপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আবেদন হল সুপ্রিম কোর্টে এবং বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, সুর্যকান্ত ও বিক্রম নাথের বেঞ্চ তাঁদের কাছে মুখবন্ধ খামে পেশ করা কেন্দ্রের ফাইলগুলো পরীক্ষা করলেন। এবং ১৫ মার্চ তাঁদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বললেন, “পেশ করা ফাইলগুলোকে অধ্যয়ন করে ও সেগুলোর বিষয়বস্তুর যথাযোগ্য বিবেচনা করে বর্তমান পর্যায়ে আমাদের অভিমত হল, আবেদনকারীদের পক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সুরাহা লাভের অনুকূলে যুক্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আমরা অতএব আদেশ করছি এবং নির্দেশ দিচ্ছি যে, কেন্দ্রীয় সরকার নিরাপত্তার ছাড়পত্র প্রত্যাহার করে নিয়ে — যেটা আবেদনকারী মধ্যমা ব্রডকাস্টিংকে দেওয়া হয়েছিল — ২০২২’র ২১ জানুয়ারি যে আদেশ দিয়েছিল, পুনরায় আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেই আদেশ স্থগিত থাকবে।” কেরল হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চের রায় প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট একটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্যও করে — “ডিভিসন বেঞ্চ বলেছে যে ফাইলগুলো থেকে বিস্তারিত কিছু জানা যাচ্ছেনা। এটাই হল বিপদ।” অতএব, অভিযুক্তর অপরাধ সম্বন্ধে সুনিশ্চিত না হয়েও কেরল হাইকোর্টের সিঙ্গল ও ডিভিসন বেঞ্চ সরকারের জারি করা নিষেধাজ্ঞায় সমর্থন জানিয়েছে।

খবরের চ্যানেল মিডিয়া ওয়ানকে যেভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তা সামগ্ৰিক গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির গুরুতর অবনতিরই নির্দেশক। এরমধ্যে অবশীভূত চ্যানেলের প্রতি সরকারের প্রতিহিংসার মনোভাবের সুস্পষ্ট সংকেত ধরা পড়ছে। সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, মিডিয়া ওয়ান’এর মালিকানা যাদের, সেই মধ্যমা ব্রডকাস্টিং’এর পরিচালকরা মুসলিম। চ্যানেলটিতে মুসলিমদের ইস্যুগুলি নিয়ে প্রচার প্রধান্য পায়। আর সেই প্রচার অনেক সময়ই সরকারের অভিলাষিত ধারায় হয়না, এবং অনেক ইস্যুতে সরকারের সমালোচনাও ব্যক্ত হয়। এটাই কি তবে ঐ চ্যানেলের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের রক্তচক্ষু প্রর্দশনের কারণ? এরআগে, ২০২০ সালের মার্চ মাসে দিল্লী দাঙ্গার খবর সঞ্চার নিয়েও চ্যানেলটির সম্প্রচার ৪৮ ঘন্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সরকারের মতে, সেই সম্প্রচারে “উপাসনাস্থলে আক্রমণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল এবং সম্প্রচার একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের দিকে ঝোঁকা ছিল।” ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা নিউজক্লিক সংবাদ মাধ্যমের বিভিন্ন অফিসে আয়কর দপ্তরকে হানা দিতে এবং সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদকদের ১০০ ঘন্টা ধরে জেরা করতে দেখেছিলাম। সরকার মুখে আয়কর ফাঁকির কথা বললেও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ঐ চ্যানেলে কৃষক আন্দোলন এবং সিএএ বিরোধী আন্দোলনের প্রচারে গুরুত্ব প্রদানই সরকারের বিদ্বেষ আকর্ষণ করেছিল। দৈনিক ভাস্কর এবং ভাস্কর সমাচার ছিল উত্তরপ্রদেশের সংবাদপত্র ও খবরের চ্যানেল। এই দুটো সংবাদ মাধ্যমেই কোভিড অতিমারীর ছড়িয়ে পড়া ও তার মোকাবিলায় মোদী-যোগী সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। এই দুটোতেই ২০২১’র জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে আয়কর দপ্তরকে হানা দিতে দেখা গিয়েছিল। সরকারের সমালোচক হলে সরকারের রোষে পড়তে হবে — এই ব্যাপারটাকে জাহির করতে মোদী সরকারের কোনো রাখঢাক নেই, বুক ফুলিয়ে ঔদ্ধত্য জাহির করেই তারা হুমকিবাজি চালায়।

মিডিয়া ওয়ান মামলা আর একটি লক্ষণীয় বিষয়কেও সামনে নিয়ে এসেছে — আর সেটা হল অভিযুক্তর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তাকে জানতে না দেওয়ার অন্যায্যতা সম্পর্কে। বিষয়টা উঠেছে মুখবন্ধ খামে বিচারপতিদের কাছে রিপোর্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে। বিচারপতিরা মুখবন্ধ খামের রিপোর্ট পড়লেন, কিন্তু অভিযুক্তকে — আলোচ্য ক্ষেত্রে মধ্যমা ব্রডকাস্টিং লিমিটেডকে — মুখবন্ধ খামে তার বিরুদ্ধে বিধৃত অভিযোগ জানতে দেওয়া হল না। ফলে অভিযোগ খণ্ডনের সুযোগ থেকেও সে বঞ্চিত হল। এটা কি ন্যায়বিচার লাভের সঙ্গে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ? সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা মুখবন্ধ খামে রিপোর্ট পেশের সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচারণ করেছেন। বিহার সরকার জড়িত ছিল এমন একটা মামলায় বিচারপতি রামানা বিহারের কৌঁসুলিকে বলেন, “অনুগ্ৰহ করে আমাদের মুখবন্ধ খাম দেবেন না, এখানে আমরা ওগুলো চাই না।” তাঁর অভিমত অতএব এটাই যে, আদালতের কাছে যা পেশ করা হচ্ছে তা জানার অধিকার অভিযুক্ত সহ সকলেরই আছে। বর্তমান বিচারপতি মুখবন্ধ খামে রিপোর্ট পেশের বিরোধিতা করলেও সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন এক প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ মুখবন্ধ খামে রিপোর্ট পেশের এই রীতিটি চালু করেন (রাফাল যুদ্ধ বিমান ক্রয় দুর্নীতি মামলা ও অন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় তিনিই সংশ্লিষ্ট পক্ষকে মুখবন্ধ খামে রিপোর্ট পেশের নির্দেশ দেন) এবং তারপর থেকে সর্বোচ্চ আদালত সহ নিম্ন আদালতগুলিতেও মুখবন্ধ খাম একটি চালু রীতি হয়ে ওঠে। আলোচ্য মামলাটিতে বিচারপতিরা অভিযুক্তকে মুখবন্ধ খামে পেশ করা রিপোর্ট এখনও দেখতে দেননি, তবে তাঁরা বিষয়টিকে খোলা রেখেছেন, এবং মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার আগে বিষয়টার ইতিবাচক ফয়সালা হবে বলেই মনে হয়।

মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনও বাকি থাকলেও সংবাদ সম্প্রচার শুরু করার নির্দেশ দিয়ে যে অন্তর্বর্তীকালীন সুরাহা বাদীপক্ষ মধ্যমা ব্রডকাস্টিং’এর করা হল তা কয়েকটি বিষয়ের গুরুত্বকে প্রশ্নহীন করে তুলেছে — প্রথমত, সরকার কারুর বিরুদ্ধে নিরাপত্তা হানির অভিযোগ আনলে তাতে সায় দেওয়াটাই ন্যায়বিচারের নিদর্শন হতে পারে না। অভিযোগের যৌক্তিকতা বিচারের পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এবং নিম্ন আদালতগুলিও এই নিয়মকে এড়িয়ে যেতে পারে না। দ্বিতীয়ত, অভিযুক্তর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অভিযুক্তকে জানতে দিতে হবে যাতে সে অভিযোগ খণ্ডনের সুযোগ পায়। অভিযোগকে মুখবন্ধ খামে শুধুই বিচারপতিদের অধ্যয়নের মধ্যে আটকে রাখলে চলবে না। তৃতীয়ত, নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ হাজির না করে এবং অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধের অধিকার সরকারের থাকতে পারে না। চতুর্থত, সমালোচনা বা বিরোধী স্বর যেমন গণতন্ত্রের পক্ষে, তেমনই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষেও অপরিহার্য।

মধ্যমা ব্রডকাস্টিং আইনি লড়াইয়ে সর্বোচ্চ আদালতের কাছ থেকে কিছুটা সুবিধা পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু অপছন্দের সংবাদ মাধ্যম এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হামলা যে হারে বাড়ছে তাতে সংবাদ জগতের স্বাধীনতাকে অপ্রতিহত রাখতে বৃহত্তর রাজনৈতিক ও গণপ্রতিরোধই যে আবশ্যক তার উল্লেখ বোধকরি নিষ্প্রয়োজন।

- জয়দীপ মিত্র

deprived farmers in government projects

কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে ২০১৯ লোকসভা ভোটের পর থেকে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য/অনুদান প্রকল্প চালু হয়েছে। গ্রামবাংলার গরিব জনগণও এসব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। এসব সংস্কার কার্যক্রম তৃণমূল সরকারের আপন খেয়ালবশত চালু হয়নি। একে নিছক সরকারের গরিবের দুর্দশা দেখে বিচলিত হয়ে দয়ার দান মনে করার কারণ নেই। সংকটের চাপ সামলানোর ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এইসব নানা খয়রাতি প্রকল্প চালু হয়েছে। অন্যদিক থেকে দেখলে এরফলে অভাবগ্রস্ত জনগণের মধ্যে কিছুটা উপকৃত হওয়ার ভাব সৃষ্টি হচ্ছে, রাজ্য সরকারের প্রতি কোনো না কোনো ধরনের আশায় আশায় থাকার মনোভাব তৈরি হচ্ছে। মানুষের ওপর সরকার তার এক ধরনের প্রভাব ফেলতে সফল হচ্ছে। বড় সংখ্যক মানুষ সুযোগ-সুবিধা হারানোর কল্পিত ভয়ে শাসকদলের শত অনাচার-দুর্নীতি দেখেও সরকার বিরোধী হতে চাইছে না।

বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বর্গা আইন হয়েছিল, বর্গার অধিকার ছিল, সেই আইনের কড়াকড়ির ফলে উচ্চবর্ণের মানুষ কষ্ট স্বীকার করে নিজেরা জমি চাষ করতো। এখন এই আইন হিমঘরে চলে যাওয়ার ফলে আবাদী জমি মালিকরা বর্গা হওয়ার ভয় থেকে বেরিয়ে এসে ব্যাপকভাবে জমি লিজ/ভাড়া দিচ্ছে। এতে এদের লাভ বেশি। জমি লিজ দেওয়ার বিনিময়ে টাকা বা সমমূল্যের ফসলের ভাগ পাচ্ছে, সরকারের আইন মোতাবেক এদের জমির কাগজপত্র থাকার ফলে এরা সরকারি অনুদানের টাকা পাচ্ছে, ফড়ে বা দালালদের কাছে নিজের জমির কাগজপত্র ভাড়া দিয়ে তাদের সরকারি দরে ফসল বিক্রির টাকা থেকেও একটা কমিশন পাচ্ছে এবং আবার নিজেরা অন্য কাজ করে রোজগার করছে। এরপর এদের বাড়ীর মেয়েরা লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রী ইত্যাদির মাধ্যমে অনুদান পাওয়ার ফলে এই মুহূর্তে এই শ্রেণীর মানুষজনকে সরকার বিরোধী কৃষক আন্দোলনে নামানো যাচ্ছে না। বিপরীতে ব্যাপক ভুমিহীন কৃষিমজুর যারা কাজের জন্য বাইরে চলে যেতে বাধ্য হোত, কোভিডের কারণে তারা ভিনরাজ্যে বিভুঁইয়ে হয়রানির শিকার হয়ে গ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হল। গ্রামে ফিরে এসে রুজি-রোজগারের অন্য কোনো উপায় না দেখে ফের জমির প্রতি স্বভাবজাত টান অনুভব করতে দলে দলে জমি ভাগ বা লিজ নিতে শুরু করল। তবে এদের কাছে কোনো জমির কাগজপত্র না থাকায় এরা সরকারি সমস্ত ধরনের অনুদান পাওয়া এবং সরকারের মান্ডিতে ফসল বেচার অধিকার থেকে বঞ্চিত। নিজেদের শ্রম মুল্য হিসেবে ধরলে এই ব্যবস্থায় তাদের প্রচুর আর্থিক-মানসিক ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতি তারা সবক্ষেত্রে বুঝতে পারছেন না বা অন্য কোনো উপায় না থাকার ফলে বুঝতে পারলেও কিছু করার থাকছে না। গ্রামাঞ্চলে এই শ্রেণীটিকে সচেতন ও সংগঠিত করতে সর্বাত্বক সক্রিয় উদ্যোগ দরকার।

সরকারি প্রকল্প নীতির মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে, সে সম্পর্কে চেতনা জাগিয়ে তুলে আন্দোলনে সামিল করাতে হবে। ধারাবাহিকভাবে এই কাজ চালাতে হবে। আওয়াজ তুলতে হবে — কাগজ নয়, কৃষিদপ্তরের কোনো অফিসারকে দিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে প্রকৃত চাষিদের মরশুমি ভিত্তিতে কৃষক অনুদান, ফসলের বীমা এবং সরকারি মান্ডিতে ফসল বিক্রী করার অধিকার দিতে হবে। গ্রামাঞ্চলে এই গরিব-ভূমিহীন কৃষকশ্রেণীকেই নতুন সংগ্রাম ও সংগঠনের ভিত্তি করে তুলতে হবে। এদের দাবিসমূহকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। চাষাবাদে সরকারি আর্থিক সহায়তা, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মুল্য নিশ্চয়তা আইন লাগু করার সাথে সাথে চাষের খরচ কমানোর দাবিতে জোর দিতে হবে। এজন্য দাবি তুলতে হবে সস্তার চাল-গম পাওয়ার রেশন কার্ডের মতো চাষিদের সুলভে কৃষি উপকরণ সংগ্রহের কার্ড দেওয়া হোক, যে কার্ড দেখিয়ে সরকারের দোকান থেকে কম দামে চাষি পরিমাণ মতো সার-বীজ-ওষুধ কিনতে পারবেন। সেচের খরচ বেড়ে গেছে বহুগুণ। এরজন্য দাবি তুলতে পারি সেচের জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুৎ/ডিজেল দিতে হবে। নিয়মতান্ত্রিকতার থেকে বেরিয়ে এসে এই দাবিগুচ্ছ নিয়ে যদি লাগাতার সচেতন ও সংগঠিত করা যায়, ছোট-বড় সংগ্রাম-সমাবেশে সামিল করা যায়, তবে অনুদান নির্ভরতাজনিত ভয়-ভীতি কাটিয়ে সন্ত্রাস মোকাবিলা করে সরকার বিরোধী আন্দোলনে নামানো সম্ভব।

- বাবলু ব্যানার্জী

Sarada Prasad

সাঁওতালি সাহিত্যে সারদা প্রসাদ কিস্কু ছিলেন এক অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ২ ফেব্রুয়ারি ১৯২৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ান থানার অন্তর্গত (বর্তমানে মানবাজার ব্লক-২’র অন্তর্গত) দাঁড়িকাডোবা গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন চরণ কিস্কু এবং মাতা ছিলেন ধনমনি কিস্কু। তাঁর জীবন অবসান হয় ১৮ মার্চ ১৯৯৬ সালে।

তিনি ১৯৩৮ সালে জরবারি নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বড়গড়িয়া উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৪০ সালে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি বাঁকুড়া জেলার রানিবাঁধ মিডল ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৪৮ সালে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি বিষ্ণুপুর রামানন্দ কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন আইএসসি’তে পড়ার জন্য। কিন্তু দারিদ্রের জন্য তা সম্পূর্ণ করতে পারেননি। তখনকার সময়ে শিক্ষাজগতে জীবিকা অর্জনের জন্য হিন্দি প্রশিক্ষণের আবশ্যকতা থাকায় তিনি ১৯৫০ সালে বান্দোয়ান হিন্দি শিক্ষণ কেন্দ্র থেকে হিন্দি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর তিনি জামতোড়িয়া সেনিয়ার বেসিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি ১৯৬২ সালে বিধানসভা নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন যার জন্য চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁর পরাজয় হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি আবার শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন এবং তাঁর শিক্ষকতাকে এক উচ্চতম আদর্শে উন্নীত করেছিলেন, যার জন্য ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি তাঁকে ‘আদর্শ শিক্ষক’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। তিনিই হলেন প্রথম সাঁওতাল শিক্ষক যিনি আদর্শ শিক্ষক রূপে রাষ্ট্রপতি দ্বারা পুরষ্কৃত হয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘কবিরত্ন’ পুরষ্কারে পুরষ্কৃত হয়েছিলন ১৯৮৩ সালে। তিনি ১৯৮৯ সালে শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

হাই স্কুলে পড়ার সময় সারদা প্রসাদ কিস্কুর হাতে নরসিংহ হেম্ব্রমের লেখা ‘নাহাঃ সেরেঞ পুঁথি’ (আধুনিক গানের বই) তাঁকে মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে তোলে এবং এর থেকেই তিনি কবিতা লেখা লিখি শুরু করেন। পরে তিনি সাধু রামচাঁদ মুরমুর লেখা গানের বই ‘সারিধরম সেরেঞ পুঁথি’ (সারিধরম গানের পুস্তক) দ্বারা গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। তিনি নিজের লেখাতে লিখেছেন যে, সাধু রামচাঁদ মুরমু হলেন তাঁর গুরু যিনি গানের মাধ্যমে সকল সাঁওতাল তথা আদিবাসীদের জাগরণের বার্তা দিচ্ছিলেন গানের মাধ্যমে। সাধু রামচাঁদ মুরমু ছিলেন কবি, শিল্পী, সমাজ সংস্কারক, কাব্যিক, সাহিত্যিক ও মহান দার্শনিক। তিনি সারিধরম সেরেঞ পুঁথি দ্বারা সমস্ত সাঁওতালদেরকে নিজেদের প্রাচীন ধর্ম সারিধরম (সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ধর্ম) দ্বারা অনুপ্রাণিত করছিলেন। তিনি সারিধরম’এর প্রবক্তা নন, পূর্বপুরুষগণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে সারিধরম সেই সারিধরম প্রচার ও প্রসার কার্যে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। গুরুর লেখনীতে তথা পদ্যে ও কবিতায় যেরূপ ছন্দমিল ছিল তার দ্বারা নতুনভাবে সারদা প্রসাদ কিস্কুকে ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এছাড়া, ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি সাধু রামচাঁদের পথ তথা সাঁওতালদের প্রাচীন পথ সারিধরম’এর অনুগামী ছিলেন। গুরু-শিষ্য উভয়েই উজ্জ্বল কবি হিসেবে সাঁওতালি সাহিত্যে স্থান দখল করেছেন। তবে, সাধু রামচাঁদ মহাকবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। যাই হোক, সাধু রামচাঁদের মতই কবি সারদা প্রসাদ কিস্কুও ছিলেন কবি, শিল্পী, সমাজ সংস্কারক, কাব্যিক, কথা সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক। তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধগুলি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হত যথা — ‘হড় সম্বাদ’, ‘সুসৗর ডাহার’, ‘তেতরে’, ‘জিরি হিরি’, ‘এভেন’, ‘হৗরয়ৗড় সাকাম’, ‘পছিমবাংলা’, ‘খেরওয়াল জারপা’ ইত্যাদি। এছাড়া তিনি ‘খেরওয়াল আড়াং’ (১৯৫৮) ‘সুসৗর ডাহার’ (১৯৭২) মাসিক পত্রিকা দুটির সম্পাদক ছিলেন। তিনি দুটি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। একটি হল ‘টটকো মলং’ (উঁচু কপালধারী) এবং ‘পাতাং সুরৗই’ (পাতার পোকা)। তেতরে পত্রিকায় তিনি পাতাং সুরৗই ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন।

কবি সারদা প্রসাদ কিস্কু রচিত পুঁথিগুলি হল — ভূরকৗ ইপিল (শুক তারা) ১৯৫৩, কুহুবৗউ (কোকিল/লুকোচুরি) ১৯৬০, গাম গঁদার (মধুর বাণী) ১৯৬৭, লাহাঃ হররে (এগিয়ে চলার পথে) ১৯৮৫, সলম লটম (তালগোল) ১৯৮৮, জুডৗসি অনল মালা (মনোরম প্রবন্ধ সংকলন) ১৯৯৪, বিদৗঃ বেড়া (বিদায় বেলা) ১৯৯৭।

- সুব্রত টুডু

rya porgramme in barddhaman

ভগৎ সিং দিবসে বর্ধমানে আরওয়াইএ

strike on 28-29 march

 

খণ্ড-29
সংখ্যা-12