নরেন্দ্রপুর থানায় নির্যাতনের অভিযোগপত্র দেওয়া হল রাজ্য মহিলা কমিশনে
The charge sheet was handed over

নরেন্দ্রপুর থানায় নৃশংস অত্যাচারের অভিযোগপত্র ২৮ ফেব্রুয়ারি মহিলা কমিশনে দেওয়া হল সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেতৃত্বে। অভিযোগের ভিত্তিতে কমিশন বারুইপুর এসপি’কে ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে এবং নরেন্দ্রপুর ওসি’র সঙ্গে মুখোমুখি সমস্ত কথোপকথন ও অভিযোগের উত্তর চাওয়ার জন্য বৈঠক ডাকা হবে বলে জানিয়েছে। প্রত্যেকটা অত্যাচারের হিসেব চাওয়া হয়েছে সমিতির পক্ষ থেকে। মহিলা কমিশনে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে — ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ নরেন্দ্রপুর থানায় পুলিশের সংগঠিত নৃশংস অত‍্যাচারের ও মেয়েদের যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে প্রতিকারের দাবিতে এই চিঠি।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী নারী ও পুরুষদের নৃশংসভাবে মারধর করে মিথ‍্যা মামলা দিয়েছে। পুলিশ সম্পূর্ণ বেআইনি ও অপরাধমূলক কাজ করেছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। পুলিশ যে অপরাধগুলি সংগঠিত করেছে তা হল,

১) থানা হেফাজতে নিয়ে তিনজন মহিলাকে (চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি, সৌমি জানা ও বর্ষা বড়াল) শারীরিক অত‍্যাচার ও যৌন হেনস্থা করে পুলিশ। অত‍্যন্ত নারীবিদ্বেষী গালি দিতে দিতে কয়েকজন পুরুষ পুলিশ এঁদের মেঝেতে ফেলে বুকে ও তলপেটে বারবার লাথি মারে এবং ‘খানকি’ বলে সম্বোধন করে ‘তোদের দেখাচ্ছি’ বলে হুমকি দেয়। হুমকি দেওয়ার সময় পুরুষ পুলিশেরা নিজেদের জামা তুলে ধর্ষণের ইঙ্গিত করছিল।

২) ঋতুস্রাবের জন‍্য স‍্যানিটারি ন‍্যাপকিন দিতে অস্বীকার করে পুলিশ। প্রথমবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরির ঋতুস্রাব শুরু হয়েছিল। তিনি মহিলা পুলিশের কাছে স‍্যানিটারি প‍্যাড চাইলেও তা দিতে অস্বীকার করে পুলিশ। রাত্রি সাড়ে নটা নাগাদ মুক্তি পেয়ে বাইরে বেরনোর সাথে সাথে পুলিশ আবার মারতে মারতে থানার ভেতর নিয়ে যায়। এই সময়ও তিনি স‍্যানিটারি ন‍্যাপকিন চেয়ে পাননি। রক্তক্ষরণের কথা বলে পুলিশের কাছে আকুতি জানানোর পরও তাঁকে গালিগালাজ সহ লাথি মারে পুলিশ।

৩) থানার বাইরে মারার সময়ও মেয়েদের রেপ-থ্রেট দেয় পুলিশ। উপরোক্ত তিন মহিলাকে লাথি মারার সময় বারবার যৌন হেনস্থামূলক গালি ও ভেতরে নিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিল পুলিশ। থানায় তোলার আগে মারধর চলাকালীন সেকেন্ড অফিসারের বারংবার নির্দেশ ছিল মহিলাদের পা টেনে ‘মাঝে’ মানে যৌনাঙ্গে মারতে। উপরোক্ত তিনজন মহিলা ছাড়াও আরেকজন ছাত্রী সায়নি সাহাকে মারার সময় একজন পুরুষ পুলিশ নির্দেশ দিচ্ছিল ছাত্রীটির নিম্নাঙ্গে লাঠি চালোনোর। পুলিশ সায়নির নিম্নাঙ্গে লাঠি চালায়।

৪) থানায় তোলার আগে বারংবার মহিলাদের শরীর নিয়ে কটুক্তি করা হয়, চুল ছোট বলে সৌমি জানাকে বলা হয় — ‘ছেলে না মেয়ে, বুকে মারব না নিচে’! মহিলাবিদ্বেষী ভাষায় বারংবার উক্তি করা হয়।

৫) থানার বাইরে এবং হেফাজতে নিয়ে মহিলা ও পুরুষদের নৃশংসভাবে মারে পুলিশ। প্রতিনিয়ত হুমকি দেওয়া হতে থাকে ‘গুলি করে দেব’। সমস্তটা করে পুরুষ পুলিশ। বারংবার সৌমি জানা অনুরোধ করেন তার ইউটিআই আছে, বুকে পেটে যৌনাঙ্গে না মারতে, কিন্তু প্রতিনিয়ত চলে আক্রমণ, লাঠি, লাথি যৌনাঙ্গ, তলপেট, বুক লক্ষ্য করে। ফোনের পাসওয়ার্ড দিতে না চাওয়ায় মুখে পেটে ক্রমাগত চলে লাথি। প্রসঙ্গত মহিলাদের প্রত্যেককে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে তিন তলায় থানায় তোলা হয়েছিল। পুরুষ পুলিশ অফিসারদের অত্যাচারের পর আসেন মহিলা অফিসার নেহা। ক্রমাগত মহিলাদের মারতে মারতে বলতে থাকেন “কি করতে পারবি, মানুষই নয় তোরা, কোনও অধিকার নেই তোদের”।

৬) অকথ্য নির্যাতনের পর ইউটিআই’এর ব্যাথা শুরু হলে পুলিশরা বলে, এরা নেশা করে, নেশা করতে পাচ্ছে না বলে এরকম করছে। অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ চলে, হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার পথে নির্দেশ দেওয়া হয় সারা রাস্তা জোর করে বসিয়ে রাখতে। সেল থেকে বেরও করেন ২ জন পুরুষ অফিসার। দায়িত্বে থাকা মহিলা অফিসার কোথায় ছিলেন জানা যায়নি।

৭) রাতে কয়েকজন ছাড়া কর্তব্যরত প্রত্যেক পুলিশ অফিসার হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরেছিলেন এবং প্রতিনিয়ত গালিগালাজ চলতে থাকে।

৮) মহিলা সেলের মধ্যে সিসিটিভি লাগানো ছিল এবং মহিলাদের বাধ্য করা হয় ইউরিন করতে ওভাবেই।

৯) ‘মেডিক‍্যাল ফিট’এর জাল সার্টিফিকেট বানায় পুলিশ। চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরিকে গভীর রাতে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু কোনরকম পরীক্ষা না করে আগে থেকে লেখা ফিট সার্টিফিকেটে নাম বসিয়ে পুলিশকে দেওয়া হয়। আহত ব‍্যক্তি এর প্রতিবাদ করায় ওখানেই তাকে মেরে দেওয়ার হুমকি দেয় পুলিশ। বাকিদের কারও মেডিক‍্যাল টেস্ট করায়নি পুলিশ। সৌমি জানার ইউরিনারি ট্র‍্যাক ইনফেকশন হয়। বারবার সেকথা বলায় তাঁকে পুলিশ হেনস্থা করে এবং শেষে হাসপাতালে নিয়ে জোর করে কোভিড ওয়ার্ডে ঢুকিয়ে দেয়। শারীরিক অবস্থার এতই অবনতি হয় তার যে স্যালাইন দিতে হয়, কোর্টে পেশ করার সময় অজ্ঞান হয়ে যান তিনি।

১০) সকলের স্মার্ট ফোনের সমস্ত ভিডিও ও ছবি জোর করে মুছে দেয় পুলিশ। পাসওয়ার্ড দিতে অস্বীকার করায় একজন মেয়ের বুকে লাথি মারে পুলিশ।

নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ যা করেছে তা এই রাজ্যের পুলিশী ব‍্যবস্থার অত‍্যন্ত উদ্বেগজনক চেহারা তুলে ধরেছে। মেয়েদের বার বার যৌনাঙ্গে, বুকে, তলপেটে আঘাত করা, ধর্ষনের হুমকি দেওয়া, গালাগালি দেওয়া হয়। গণআন্দোলনের কর্মীদের ওপর এই ধরনের অত্যাচার চালালো এই রাজ্যের পুলিশ।

পুলিশের এই ধরনের ব্যবহারের আমরা তীব্র বিরোধিতা করছি। আমরা দাবি করছি মহিলা কমিশন এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিক। ভারপ্রাপ্ত অফিসার ও সেকেন্ড অফিসার সহ সমস্ত দোষী পুলিশদের অবিলম্বে শাস্তি হওয়া উচিত। থানায় জেন্ডার সেন্সিটাইজেশন চালাতে হবে, মহিলাদের জন্য স‍্যানিটারি ন‍্যাপকিনের ব্যবস্থা রাখতে হবে, মহিলা বন্দীদের জন্য পরিস্কার শৌচালয় রাখতে হবে। থানার শৌচালয়কে সিসিটিভি’র আওতায় রাখা চলবে না।

মহিলা সমিতির এই ডেপুটেশনে প্রতিনিধি দলে ছিলেন ইন্দ্রাণী দত্ত, অর্চনা ঘটক, মিতালি বিশ্বাস, চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী ও সৌমি জানা।

খণ্ড-29
সংখ্যা-9