খুনী পুলিশের কঠোর শাস্তির দাবিতে এককাট্টা আনিসের গ্রাম
demanding the punishment

লোক দেখানো তদন্তে আস্থা নেই

‘সিট’এর তদন্তে আমাদের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই! অত্যন্ত শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বরে জানালেন আনিসের বাবা সালেম খান। নেহাত আদালতের নির্দেশ, তাই তিনি সেটাকে মান্যতা দিয়েছেন। ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের প্রতিশ্রুতি কতটা রূপায়িত হয় সেটাই তিনি দেখতে চান। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের এক প্রতিনিধিদল নিহত আনিস খানের গ্রাম সারদা দক্ষিণ খানপাড়ায় গেলে তার বাবা ও পরিবার পরিজনেরা একথা জানালেন। গ্রামে ঢোকার পথে কারও কোনও কৌতুহল বা প্রশ্ন নয়, বরং প্রতিটি মানুষ আনিসের বাড়ির দিকনির্দেশ করে জানান দিচ্ছিলেন বাইরে থেকে যারাই আসুন, তারা স্বাগত! গ্রামবাসীরা সকলেরই সহযোগিতা চান। দেখা গেল গোটা গ্রাম ঐক্যবদ্ধভাবে আনিসের নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার চাইছে। তাদের বাড়ির নির্মীয়মান তিনতলার উপরে গিয়ে দেখা গেল, ঘরের জানালা করার জন্য তৈরি উন্মুক্ত জায়গা থেকে তাকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছিল বধ্যভূমিতে। না, সেখানে উপর থেকে নিচে আদৌ কোনও রেন পাইপ নেই। বোঝা গেল, পালাতে গিয়ে মৃত্যুর তথাকথিত আষাঢ়ে গল্পটা! শোনা গেল, বাবার চোখের সামনে তিনতলা থেকে ছেলেকে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে ফেলে হত্যার নির্মম পুলিশী বর্বরতার ঘটনা।

পার্টির প্রতিনিধিদলে ছিলেন, রাজ্য কমিটি সদস্য জয়তু দেশমুখ, হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, রাজ্য নেত্রী ইন্দ্রাণী দত্ত, ছাত্র নেতা স্বর্ণেন্দু মিত্র, শ্রমিক নেতা এলএন ব্যানার্জী প্রমুখ।

আমতা থানার পুলিশই যে আনিস খানের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এ বিষয়ে গোটা গ্রাম একশো শতাংশ নিশ্চিত। আমাদের গ্রামে বাইরের কোনও সমাজবিরোধী ঢুকে খুন করতেই পারে না — জানালেন গ্রামের ক্লাবে জড়ো হওয়া যুবকেরা। খানপাড়া আব্দুল আজিজ ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আলেফ সেখ বললেন, বড়ো মাছকে ছেড়ে ছোট মাছকে ধরা হলো! থানার ওসিকে ছুটিতে পাঠানো হলো। ওনার অর্ডারেই তো সিভিক পুলিশ এসেছিল, তাহলে ওসিকে এ্যারেস্ট করা হলো না কেন? পাঁচ সাত বছরের একটা বাচ্চা ছেলেও বলে দেবে তদন্তের নামে কি হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে সিভিক পুলিশ প্রীতম ভট্টাচার্য, হোমগার্ড কাশীনাথ বেরা। ক্লাবের সামনে উপস্থিত আরেকজন যুবক আফজেল বললেন, আর কারও প্রাণ যাতে কেড়ে নেওয়া না হয় সে জন্যই আমরা চাই এই খুনের পেছনে যারা রয়েছে সেই পরিকল্পনাকারী ও খুনীদের শাস্তি! সকলেই বললেন, গতকাল রাত দুটোর সময় কাউকে না জানিয়ে দেহ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয়বার ময়না তদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল কেন বলুন তো! আদালতের আদেশ মেনে যে কোনও একজন বিচারকের উপস্থিতিতে দেহ তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল না কেন? উলুবেড়িয়া সংশোধনাগারে টিআই প্যারেডে সাধারণ পোশাকে কয়েকজনকে সনাক্ত করার জন্য দাঁড় করানো হয়৷ অথচ আনিসের বাবার মাথায় যারা আগ্নেয়াস্ত্র ধরেছিল তারা পুলিশের পোশাক পরা ছিল। স্বভাবতই সনাক্ত করা আদৌ সম্ভব হয়নি, জানালেন সালেম খান। এসবের মধ্য দিয়েই বোঝা যায় তদন্তের নামে কী ঘটছে। সেই রাতে পুলিশ বাহিনী এলে গ্রামের মানুষ জেগে ওঠে, প্রবল বাধার মুখে পুলিশ ফিরে যেতে বাধ্য হয়। পরে উপস্থিত হয়ে যান স্থানীয় বিডিও, যার মুখে মদের গন্ধ পাওয়া যায় বলে গ্রামবাসীরা অনেকেই জানালেন।

The village of Anis is united

অন্যান্য আরও যে বিষয়গুলি জানা গেল তা হল, আনিস সমগ্র আমতা ও পার্শ্ববর্তী বাগনান এলাকায় তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানুষকে সমাবেশিত করতে শুরু করেছিল। কিছুদিন আগে বাগনান এলাকায় একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। ঘটনাক্রমে সংখ্যালঘু মানুষেরা বড় সংখ্যায় ঘর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আনিস সেসময় সাহসের সাথে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়। তাদের বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসে। তখন শাসক দলের পক্ষ থেকে তাকে জানে মেরে ফেলা হবে বলে জানানো হয়। গতমাসে ২৩ জানুয়ারি গ্রামে নিজের পাড়ার ক্লাবে আনিস একটি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে। সেটাকেও তৃণমূল ভেঙ্গে দেয়। তখনও আনিসকে খুনের হুমকি দেওয়া হয়। দুবারই আনিস এবিষয়ে স্থানীয় থানায় লিখিতভাবে অভিযোগ জানায়। অর্থাৎ ঐ এলাকায় রাজনৈতিক জমি হারিয়ে তৃণমূল জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একজন সংখ্যালঘু যুবক আনিসকে টার্গেট করে। বলাবাহুল্য, সংখ্যালঘু প্রাধান্যের এই এলাকায় কোনও জনপ্রিয় সংখ্যালঘু যুবক রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে এটা শাসকদলের মাতব্বরদের আতঙ্কিত করে তুলেছিল। তাই আনিসের হত্যা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে জানা গেল। হাওড়া জেলা গ্রামীণ পুলিশ সুপারের কাছে গ্রামবাসীরা ডেপুটেশনে গেলে তিনি প্রথমে বলেন, ওসিকে যে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে সেটা নাকি তিনি জানতেন না। পরক্ষণেই তিনি আমতা আমতা করে উল্টোসুরে বলে ওঠেন তিনি জানতেন।

রাজ্যের বুকে স্বৈরশাসনে গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরা, বিরোধীপক্ষকে নিকেশ করে দেওয়ার যে নীতি তৃণমূল নিয়েছে, আনিস খানের হত্যা তারই ফলশ্রুতি বলেই প্রতিনিধি দলের দৃঢ় অভিমত।

প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে এইদিন এক প্রেস বিবৃতিতে দাবি তোলা হয়,

• আনিস খানের হত্যাকান্ডের বিচারবিভাগীয় তদন্ত চাই।
• অভিযুক্ত আমতা থানার ওসিকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে।
• রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে জনপ্রিয় যুবনেতা আনিস খানকে পরিকল্পিতভাবে পুলিশ দিয়ে হত্যা করা হল কেন, তৃণমূল জবাব দাও।

খণ্ড-29
সংখ্যা-9