আমরা যারা পাঁচ মাস ধরে পথের ধুলোয় —
in the dust for five months

এবছর ৮ মার্চ সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ১১৩তম বার্ষিকী। নারীদের জন্য উৎসর্গীকৃত এই দিনটি পালিত হয় নারীদের কর্মকাণ্ড, তার কর্মদক্ষতাকে সম্মান-শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য, তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সম্মান জ্ঞাপনের জন্য। কিন্তু একটি বিশেষ দিন নারীদের জন্য উৎসর্গ করে সত্যিই কি নারী জাতির উত্তরণ সম্ভব? সত্যিই নারীকে যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব? বাকি ৩৬৪ দিনেও কী এই স্বীকৃতি, সম্মান নারীর প্রাপ্য নয় – পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের কাছে? নিজেদের কর্মস্থলে? এই প্রশ্নটাই নারীসমাজের কাছে বারবার ফিরে আসে। এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ জন্মলগ্ন থেকেই তাদের পদদলিত করে রাখতে সদাসচেষ্ট। বিশ্বের লক্ষ লক্ষ নারীর মরণপণ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের স্মারক এই দিনটিকে নিছক একটি ‘দিবস’ হিসাবে পালন করাটা যথেষ্ট নয়! নারীর জীবন জীবিকা, স্বাধীনতা মর্যাদা সমানাধিকার সুরক্ষিত না হলে, দিনটির প্রকৃত তাৎপর্য হারিয়ে যাবে।

একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে পৃথিবী যখন নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে চলেছে তখন সমাজের আনাচে-কানাচে বহু নারী আজও অবহেলিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত। যেখানে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা ব্যানার্জি স্বয়ং নারী উন্নয়নের পথের অগ্রদূত, সেখানে তার রাজ্যের নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আজও পথের ধূলায় দিনের পর দিন অতিবাহিত করতে বাধ্য হচ্ছে। ফার্স্ট এসএলএসটি (২০১৬)-র স্কুল সার্ভিস কমিশনের নবম থেকে দ্বাদশ স্তরের শিক্ষক নিয়োগে ঘটে চলা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সমাজ গড়ার প্রথম কারিগর, শিশুর প্রথম শিক্ষক সেই নারীরা এক নির্লজ্জ, বিবেকহীন অন্যায়ের প্রতিবাদে ও ন্যায় পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার রাজপথে (খোলা আকাশের নিচে ফুট পাথে) ২৯ দিনব‍্যাপী রক্তক্ষয়ী ঐতিহাসিক অনশন আন্দোলনে পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামিল হয়েছিল। শত সহস্র বছর ব‍্যাপী জীবিত থাকার, কাছের মানুষগুলোকে জীবিত রাখার সেই একরোখা অবিচল জেদ বয়ে নিয়ে চলা আকাঙ্খা নামক সেই অদৃশ‍্য অদ্ভুত বিচিত্র ইচ্ছেডানা তাদের ওপর যেন সেদিন ভর করেছিল। আগামীতে সাদামাটা জীবনকে একটু রঙিন করতে, জীবনের চরম সুখ অনুভব করতে সেইদিন তাদের বিসর্জন দিতে হয়েছিল পরিবারের প্রতি কর্তব‍্যকে, অগ্রাহ্য করতে হয়েছিল দুধের শিশুর হৃদয় বিদারী আর্তনাদকে। শিশুর কান্না যাতে মা’কে দুর্বল করতে না পারে তার জন‍্য ছিন্ন করতে হয়েছিল পরিবারের সাথে সমস্ত যোগাযোগ। বিসর্জন দিতে হয়েছিল নির্মম পুলিশী অত‍্যাচারের ভয়ভীতিকে, লাজলজ্জা, মান সম্মানকে। একদল যোগ্য অথচ বঞ্চিত ছেলেমেয়েদের সেদিন পথচলতি মানুষের কাছ থেকে নিক্ষিপ্ত তাচ্ছিল্য মাখতে হয়েছিল, ‘উদ্বাস্তু’, ‘ভিখারী’র তকমা মাথা পেতে নিতে হয়েছিল। ২০১৯ সালে অনশন আন্দোলনের ২৯ দিনের মাথায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজে অনশন মঞ্চে উপস্থিত হয়ে প্রয়োজনে ওয়ান টাইম রুলস পরিবর্তন করে সমস্ত অনশনকারীর চাকরি নিশ্চিতকরণের যে প্রতিশ্রুতি দেন তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। আজও তাই (২০২১ সালে সেন্ট্রাল পার্কে দ্বিতীয় দফায় ১৮৭ দিন) ২০২১ সালের ৮ অক্টোবর থেকে তৃতীয় দফা (সাড়ে পাঁচ মাস ধরে) শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভের মাধ্যমে সেই প্রতিবাদ অব্যাহত।

১৯০৯ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার নারীরা প্রথম রুটি ও শান্তির দাবিতে প্রতিবাদ জানায়। আজ ১১৩ বছর পরেও বাংলার নারীরা তাদের যোগ্য অধিকারের চাকরি আদায় করতে, নিজের উপার্জনে পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার তাগিদে কলকাতা মহানগরীর বুকে পথের ধারে (গান্ধীমূর্তির পাদদেশে) রোদ-ঝড়-জলে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।(১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আমেরিকায় নারী দিবস পালিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চ দিনটিকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মর্যাদা প্রদান করে।) সমস্ত আন্দোলনকারীর পক্ষ থেকে আমরা এই বছর নারী দিবসে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করছি, আশা রাখছি মুখ্যমন্ত্রী তার মমতার দৃষ্টি আমাদের উপর বর্ষণ করে এই বেকারত্বের মরণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়ে বাংলার নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন।

- জয়া খান

খণ্ড-29
সংখ্যা-10