সম্পাদকীয় : কেন্দ্রের ফরমান
decree of the center

কেন্দ্রের মোদী সরকার ‘দুয়ারে রেশন’ নিয়ে আইনগত পরিপন্থীর অভিযোগ তুলতে শুরু করেছে। ‘দুয়ারে’ প্রকল্প প্রথমে চালু করে দিল্লীর আপ সরকার, তারপরে চালু হয় অন্ধ্রপ্রদেশে, আর সেই ধারায় ‘পিকে’-র ভাবনাগত কৌশলগত প্রয়োগে চালু করেছে এরাজ্যের মমতা সরকার। কারণ দুর্নীতি-দলতন্ত্র-সন্ত্রাসের কলঙ্ক থেকে গণদেবতার মনোভাব ঘুরিয়ে কিভাবে ক্ষমতায় ফিরে আসার রাস্তা করা যায় সেটা ছিল তৃণমূলের কাছে এক কঠিন প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই তৃণমূল বাজি ধরে ‘দুয়ারে সরকার’ থেকে ‘দুয়ারে রেশন’। এই পলিসি ও কৌশলের চাপের মুখে বিজেপিকে ‘জনপ্রিয়তাবাদে’ পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে — এটাই হল মোদীবাবুদের গাত্রদাহের আসল কারণ। সেটা আড়ালে রেখে কেন্দ্র আইনি আপত্তি তুলছে। এজন্য কেন্দ্র ইতিমধ্যে একটা ক্যাবিনেট নোট তৈরি করেছে। নোটটি অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে নীতি আয়োগ, অর্থমন্ত্রক, আইন মন্ত্রক, নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক, শিক্ষা মন্ত্রক সামাজিক ন্যায় বিচার মন্ত্রকের কাছে। গরিষ্ঠতার জোরে চাপিয়ে দেওয়াই মতলব। বলছে, জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের ১২ ও ২৪ নম্বর ধারা মোতাবেক রেশন দোকান থেকে খাদ্যশস্য বাইরে বের করা যায় না, করলে সেটা নাকি হবে আইনত দন্ডনীয় অপরাধ! সত্যিই কি ওই আইনের মর্মার্থ তাই! নাকি তার অন্তর্নিহিত অর্থ হল, যাতে দ্রব্যাদি হিসাব বহির্ভূত অসুরক্ষিত হয়ে না থাকে। দুয়ারে রেশন বলতে পাড়ায়-পল্লীতে বণ্টনের আরও কেন্দ্র খুলে উপভোক্তাদের সরবরাহ করা হলে তার তো হিসাব থাকে, শুধু তাই নয়, এখন বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে চেক করে প্রাপ্য মেটানো হয়। কোনও লুঠ-পাট-ডাকাতির তো খবর নেই। তাহলে আইনত নিষেধাজ্ঞার কথা আসছে কেন? যুক্তিতে এঁটে উঠতে না পেরে কেন্দ্র ঢাল করছে রেশন ডিলারদেরকে। ‘দুয়ারে’ পৌঁছে দেওয়ার পরিকাঠামোগত খরচ বেড়ে যাওয়া নিয়ে ডিলারদের ক্ষোভ রয়েছে। সেটা যুক্তিসঙ্গত। এই খরচ পুষিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দুই স্তরের সরকারপক্ষের, কেন্দ্র-রাজ্য মিলে বোঝাবুঝি করে সেই দায়ভাগ মেটাক। তা না করে কেন্দ্রের অভিলাষে ধরা পড়ছে ডিলারদের বোড়ে বানানোর উদ্দেশ্য। কেন্দ্রের আরেকটি কূটযুক্তি হল, রাজ্যগুলির যদিও অধিকার আছে কেন্দ্রের কোটার চেয়ে বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য দেওয়ার, কিন্তু সেটা দিলে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের যে নির্যাস ‘এক দেশ, এক দাম, এক রেশন’ ভাবমূর্তি মার খায়। রাজ্য ভিত্তিতে একেক জায়গায় দাম দাঁড়াবে একেকরকম, প্রকৃত মূল্যমান নিয়ে বিভ্রান্তি বৈষম্য ছড়াবে। এহেন যুক্তি তুলে কেন্দ্র বলছে রাজ্য সরকারের তরফে অতিরিক্ত রেশন যদি দেওয়ার থাকে, তবে কেন্দ্রের কোটার সঙ্গে জুড়ে না দিয়ে উপভোক্তাদের ব্যাঙ্কে একাউন্টে জমা করে দেওয়া হোক। কিন্তু এভাবে একটা চালাকির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে, তা হল ওই ভর্তুকির টাকায় বাজার থেকে খাদ্যশস্য কেনার দিকে ঠেলে দেওয়া — যা কিছুতেই রেশনের মতো সুলভে মেলার নয়। খুব ‘এক দেশ এক রেশন’, ‘মেলাবে মিলিবে’ বড় বড় কথা বলা হয়, কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্যের কোটার রেশন একসাথে বিলি করা সহ্য হচ্ছে না।

২০১৩ সালে প্রণীত জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুসারে গ্রামীণ ৭৫ শতাংশ ও শহুরে ৫০ শতাংশ মানুষকে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনায় সুলভে রেশন দেওয়ার প্রচলন হয়। তারপরে ২০১৯-২১ অতিমারীতে রুজি-রোজগারের সমস্ত দিক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিনামূল্যে সর্বজনীন রেশন ও নগদ অর্থ দেওয়ার দাবি জ্বলন্ত হয়ে ওঠে। মোদী সরকার বাধ্য হয় রেশন দেওয়া শুরু করতে এবং সেটা ২০২১-২২-এ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের চাপ সামলানো পর্যন্ত বজায় রাখতে। এর মাঝে উত্তর-পশ্চিম ভারতের দীর্ঘস্থায়ী কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি মোদী সরকারের দরদ কেমন! দেখেছি কী মারাত্মক শয়তানি, বেইমানি। আর, অতিমারীর ক্ষত উপশমে নগদ অর্থ দেওয়ার দাবি আজ অবধি কানে তোলা হয়নি। পরে নির্বাচনী চাপ পর্ব মিটে যেতে মোদী সরকার ঘোষণা করে বসে বিনামূল্যে রেশনের ঝাঁপ ২০২২-এর মার্চের শেষে বন্ধ করে দেওয়া হবে। তারপর পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনের মোট ফলাফল হিসাবে রেখে কী ভেবে বিনামূল্যে রেশন সরবরাহের সময় আরও ছয়মাস বাড়িয়ে দিল। আসলে বিরোধী শাসিত সরকারগুলির এই বণ্টন প্রকল্প বজায় রাখা কেন্দ্রের ঘাড়ের ওপর গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। তাছাড়া কর্মক্ষেত্রের সুযোগ এখনও প্রাক অতিমারী পরিস্থিতির মতো পুনরুদ্ধার হয়নি, মূল্যবৃদ্ধির বাজার আগুন। এসব দেখে আর ২০২৩-এর পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ভোট, ২০২৪-এর লোকসভা ভোট মাথায় রেখে বিনামূল্যে রেশন চালু রাখছে মোদী সরকার। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে একই প্রকল্প আরও তিন মাস বাড়িয়েছে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার। একইসাথে সাম্প্রদায়িক ও জাতিবাদী ঘৃণার-বিদ্বেষ-বিভাজনের আগুন এবং বিনামূল্যের রেশনের যুগল হাতিয়ারে ফ্যাসিবাদী মেরুকরণ চালিয়ে যাওয়াই উদ্দেশ্য।

‘দুয়ারে রেশন’ সংস্কার প্রকল্পটির বাস্তবোচিত গণদাবির ভিত্তি হল, কেন্দ্র-রাজ্যের যুগ্ম দায় পালনের দায়িত্ব থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ ও বিনামূল্যে বণ্টন প্রণালীর যতবেশি বিকেন্দ্রীকরণ ও গণতান্ত্রিকীকরণ করা যায় সেটাই। এপ্রশ্নে পরিকাঠামোগত ব্যবস্থাপনায় এরাজ্যের মমতা সরকারের যে কোনও ত্রুটি থাকছে না তা নয়। কিন্তু কেন্দ্রের ফরমান কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না।

খণ্ড-29
সংখ্যা-16