পরের ধনে পোদ্দারি
next coriander poddari

আম জনতার পকেট মেরে মোদী সরকার সেই ‘লুঠের’ টাকা দিয়ে তাঁর বহু বিজ্ঞাপিত কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো রূপায়িত করছে গত কয়েক বছর ধরে! ২০২০-২১ সালে দেশের কোটি কোটি নাগরিক কেন্দ্রীয় কোষাগারে শুধুমাত্র জ্বালানি খাতে কর বাবদ ৪ লক্ষ ৫৫ হাজার ৬৯ কোটি টাকা (এরসাথে যুক্ত হবে বিভিন্ন রাজ্য সরকারগুলোকে দেওয়া ওই একই খাতে ২ লক্ষ ১৭ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা) দিতে বাধ্য হয়েছে। আর, ওই একই সময়কালে ভারতের ১৪২ অর্বুদপতির সম্পত্তির পরিমান ২৩ লক্ষ ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫৩ লক্ষ ১৬ হাজার কোটি টাকা! অর্থাৎ, ওই স্বল্প সময়ে তাঁরা তাঁদের সম্পত্তির পরিমান বাড়িয়েছে ৩০ লক্ষ কোটি টাকা!

নানান ধরনের কল্যাণমূলক প্রকল্প চলুক আম জনতার পকেটের টাকায়। আর, অতি ধনীদের জন্য যেমন ঢালাও আর্থিক ছাড় ছিল, তা বজায় থাকুক — এই হল মোদী সরকারের আর্থিক দর্শন। তাই, কর্পোরেটদের স্বার্থে প্রথমেই কর্পোরেট কর ২২-২৫ শতাংশ হারে ছেঁটে দেওয়া হল, নতুন বিনিয়োগগুলোর ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে চালু করা হল এক উদার কর ব্যবস্থা। ৩০ শতাংশ হারে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত আয়কর আর তার সাথে ওই করের উপর ৪ শতাংশ হারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সারচার্জ বজায় রাখা হল। সম্পত্তি কর বাতিল করা হল, উত্তরাধিকার কর বসানোর চিন্তা মাথায় রাখাই হল না।

জিএসটি ও জ্বালানির উপর কর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যেন আলিবাবার সেই আশ্চর্য গুপ্তধন। আর, সেই গুপ্তধন থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে তাকে বিন্দুমাত্র মেহনত করতে হল না। আম জনতা প্রতিদিন প্রতি মিনিটে সেই বিপুল ধন তুলে দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। শুধু একবার চোখ বোলানো যাক পেট্রোল-ডিজেলের উপর আবগারি শুল্কের হারের ওপর, ক্ষমতায় আসার পর মোদী সরকার যা প্রবর্তন করে।

মে ২০১৪ — পেট্রোল-ডিজেলের উপর আবগারি শুল্ক ছিল লিটার পিছু যথাক্রমে ৯.২০ টাকা এবং ৩.৪৬ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ২৬.৯০ টাকা এবং ২১.৮০ টাকা।

মে ২০১৪ — পেট্রোল-ডিজেলের উপর দাম ছিল লিটার পিছু যথাক্রমে ৭১.৪১ টাকা এবং ৫৫.৪৯ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০১.৮১-১১৬.৭২ টাকা এবং ৯৬.০৭-১০০.১০ টাকা। কপালে চোখ তুলে দেওয়া মতো বেড়েছে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম — ৪১০ টাকা (মে ২০১৪ সালের দাম) থেকে এখন প্রায় ৯৪৯.৫০-১০০০.০০ টাকায়!

পকেটে ছুরি চালিয়ে মোদী সরকার এই টাকা আম নাগরিকের কাছ থেকে আদায় করেছে যখন কিনা অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেল পিছু ১০৮ ডলার, আর এই দামটাই বজায় ছিল মে ২০১৪ সাল থেকে। ২০১৯-২০২১ ব্যারেল পিছু গড় দাম ঘোরাফেরা করেছিল ৬০ ডলার।

পেট্রলিয়ামখাতে জমা পড়া কেন্দ্রীয় রাজস্বের হার যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে, তা দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।

২০১৪-১৫ সালে এই খাতে জমা রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ৭২ হাজার ৬৫ কোটি টাকা।

২০১৫-১৬তে — ২লক্ষ ৫৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা।
২০১৬-১৭তে — ৩ লক্ষ ৩৫ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা।
২০১৭-১৮তে — ৩ লক্ষ ৩৬ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা।
২০১৮-১৯তে — ৩ লক্ষ ৪৮ হাজার ৪১ কোটি টাকা
২০১৯-২০তে — ৩ লক্ষ ৩৪ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।
২০২০-২১তে — ৪ লক্ষ ৫৫ হাজার ৬৯ কোটি টাকা।
২০২১-২২তে — (আনুমানিক) ৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা।

মোট — ২৬ লক্ষ ৫১ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা!

কারা দিয়েছেন এই টাকা?

দেশে আনুমানিক ২৬ কোটি পরিবার রয়েছে। অর্থাৎ, পরিবার পিছু ১ লক্ষ টাকা মোদী সরকার এই বাবদ রাজস্ব আদায় করেছে।

যে চাষিরা ডিজেল চালিত পাম্প সেট চালায়, দু’চাকা-চার চাকা গাড়ির মালিক, অটো-ট্যাক্সি চালক, নিত্যযাত্রী, গৃহিনী, তাঁরাই এই টাকা ভরেছেন মোদীর সিন্দুকে। এই রাজস্ব আদায় করে এবার কোভিডকালীন ‘কল্যাণমূলক প্যাকেজ’ বাজারে ছেড়েছে মোদী সরকার। দেখা যাক, ২০২০ সাল থেকে সরাসরি কী কী বাড়তি সুযোগ সুবিধা হস্তান্তর করা হয়েছে?

দু’বছর নিখরচায় খাদ্যদ্রব্য সামগ্রী বিতরণ খাতে খরচ হয়েছে ২ লক্ষ ৬৮ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। মহিলাদের ব্যাঙ্কে সরাসরি নগদ হস্তান্তর বাবদ ৩০ হাজার কোটি টাকা, বছরে কৃষকদের ৬,০০০ টাকা প্রদান বাবদ বাৎসরিক খরচ ৫০,০০০ কোটি টাকা, আর এছাড়াও ছোটখাটো কিছু অনুদান রয়েছে। সব মিলিয়ে এই খাতে বাৎসরিক খরচ ২ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি নয়। আর, যা কেন্দ্র কর্তৃক আদায় করা শুধুমাত্র বাৎসরিক জ্বালানি বাবদ রাজস্ব থেকে বেশ খানিকটা কম!

কিছুদিন আগে, সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই) এক সমীক্ষা প্রকাশ করে। তাতে জানানো হয়েছে, গত পাঁচ বছরে ভারতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা বেশ অনেকটাই কমেছে — জানুয়ারি ২০১৭-তে যা ছিল ৪০.১ কোটি তা মার্চ ২০২২এ এসে দাঁড়িয়েছে ৩৯.৬ কোটি। যদিও ওই একই সময়ে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ১৩০.৫ কোটি থেকে ১৩৭.৪ কোটি পর্যন্ত। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হল, পরিবারগুলোর আর্থিক সঙ্গতি ক্রমেই নিম্নমুখী। প্রায় ৫৭ শতাংশ পরিবার, এই সমীক্ষা অনুযায়ী, মাসে মাত্র ১৬,৬৬৬ টাকা উপার্জন করে। আবার ১৭ শতাংশ পরিবারকে মাসে মাত্র ৮,৩৩৩ টাকা উপার্জন করেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। গড়পড়তা মজুরি হল মাসে প্রায় ১৪,০০০ টাকা। দীর্ঘ সময় ধরে, অনেক কম মজুরির বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন শুধু গরিব খেটে খাওয়া মানুষেরাই নন, বরং বিরাট সংখ্যক মধ্যবর্গের মানুষও। কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা জানুয়ারির ২০১৭ সালে ছিল ৪৫ শতাংশ, যা মার্চ ২০২২এ হয়েছে ৪০ শতাংশ। আকস্মিকভাবে এটা কমে যাওয়া গুরুতর যে সমস্যাকে চিহ্নিত করে তা হল, কাজ না পেয়ে বা হন্যে হয়ে ঘুরেও মনমতো কাজের সন্ধান না পেয়ে অনেকেই কাজের বাজার থেকে সরে আসছেন হতাশায়, অন্য কিছু করার কথা ভাবতে শুরু করেছেন।

আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির কোপে সাধারণ মানুষ বেসামাল। চার রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে জেতার পর মোদী সরকার আরও বেপরোয়া। গভীর সংকটের আবর্তে দেশ, দেশবাসী। প্রতিরোধ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-29
সংখ্যা-16