বিচারাধীন বন্দী : প্রধানমন্ত্রীর কথা ও কাজ
Prisoner under trial

সুসংবাদ! বুলডোজার রাজনীতির বাজারে এরকম সুসংবাদ মরুভূমিতে জল পাওয়ার মতো! গত ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও হাইকোর্টের প্রধান বিচারকদের একটি সভায় দেশের ৩,৫০,০০০ বিচারাধীন বন্দীদের সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এঁরা অনেকেই গরীব ও সাধারণ ঘরের মানুষ তাই এঁদের বিষয়টা আমাদের সহানুভুতির সাথে দেখা উচিত, তিনি বলেন। একজন বিচারকের অধীনে জেলাস্তরে কমিটি করে এঁদের জামিনের আবেদন খতিয়ে দেখার তিনি নির্দেশ দেন। এছাড়াও তিনি আদালতে স্থানীয় ভাষা ব্যবহারের ওপর জোর দেন।

বেশি দিন নয়, সভার মাত্র তিন দিন পরেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অসাড়তা প্রমাণ হয়ে যায়। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত ভারভারা রাও, অরুণ ফেরেরা ও ভার্নন গঞ্জালভেস বোম্বে হাইকোর্টে আবেদন করেন, নির্ধারিত সময়ে পুলিশ চার্জশীট না দিতে পারার জন্য তাঁদের জামিন যেন না আটকায়। আদালত তাঁদের আবেদন নাকচ করে দেয়; অথচ এই একই যুক্তিতে প্রখ্যাত আইনজীবী ও সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজকে কিন্তু জামিন দেওয়া হয়েছিল। এই মামলায় এখনো ১৪ জন বিনাবিচারে গ্রেপ্তার আছেন। তাঁরা ২০১৮’র ৬ জুন থেকে ২০২০’র ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কম্পিউটার হ্যাক করে, ভুয়ো নথিপত্র তাতে প্রতিস্থাপন করে, সম্পূর্ণ মনগড়া অভিযোগে তাঁদের বছরের পর বছর গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছে। বারবার তাঁদের জামিনের আবেদন নাকচ হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী যাঁদের জামিন দেওয়ার কথা বলেছেন তাঁদের মধ্যে এই বরেণ্য অধ্যাপক, গবেষক, সমাজকর্মীরা আছেন তো?

কিংবা দিল্লী ‘দাঙ্গা’য় গ্রেপ্তার হওয়া উজ্জ্বল যুবক যুবতীরা? ২৮ আগস্ট আবার উমর খালেদের জামিনের আবেদন মুলতুবি হয়ে গেল। এবার নিয়ে যে কতোবার, কতো বিচিত্র কারণে তাঁর আবেদন খারিজ হয়েছে তার কোনও হিসাব নেই। এবার বিচারপতি জিজ্ঞাসা করেছেন, প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে জুমলা শব্দটা ব্যবহার করা কি ঠিক? এটা করে তিনি নাকি বাক স্বাধীনতার লক্ষণরেখা অতিক্রম করেছেন! মাননীয় বিচারপতি ‘ক্রান্তিকারি’, ‘ইনকিলাব’ ইত্যাদি শব্দের অর্থও জানতে চেয়েছেন! কী বিড়ম্বনা! খালেদের আইনজীবী ত্রিদিব পাইস বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, এই শব্দগুলোর ব্যবহার যদি ঠিক নাও হয়ে থাকে তবুও তারজন্য কাউকে কি ৫৮৩ দিন ইউএপিএ’র অধীনে বন্দী রাখা যায়! প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই বিচারাধীন বন্দীর মধ্যে উমর, গুলফিশা, শার্জিল ইমাম ইত্যাদিদের অন্তর্ভুক্ত করেননি।

তাহলে কারা আছেন তাঁর উল্লেখিত ঐ ৩,৫০,০০০ বন্দীদের মধ্যে? এদের মধ্যে রয়েছেন হতদরিদ্র, আদিবাসী, জনজাতি, দলিত মানুষ; এঁদের মুক্তি ত্বরান্বিত হবে? ঘটনা হচ্ছে, এঁদের মুক্তির জন্য যাঁরাই সরব হয়েছেন তাঁদেরকেই তো রাষ্ট্র ‘আর্বান নকশাল’ নাম দিয়ে বছরের পর বছর বিনাবিচারে জেলবন্দী করে রেখেছে। প্রয়াত ফাদার স্ট্যানস্বামী ২০১৫ সালে ঝাড়খণ্ড, ছত্তিসগড়, ওডিশা রাজ্যে ভুয়ো অভিযোগে হাজারো বন্দীদের মুক্তির জন্য ‘পারসিকিউটেড প্রিজনার্স সলিডারিটি কমিটি’ (পিপিএসসি) গঠন করেন। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় আরেকজন অভিযুক্ত সুধা ভরদ্বাজ যিনি সম্প্রতি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন তিনিও এই সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। পিপিএসসি সংগঠনটিকে এনআইএ ‘মাওবাদী’ বলে তকমা মেরে দেয় এবং ফাদার ও সুধা ভরদ্বাজকে ‘মাওবাদী’ আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তার করে।

অথচ ওনারা দুজনেই দীর্ঘদিন ধরে ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিসগড়ে সাধারণ মানুষকে পুলিশী হেনস্থা থেকে বাঁচানোর জন্য কাজ করেছেন। ফাদার স্ট্যানস্বামী গ্রেপ্তার হওয়ার আগে অবধি ভুয়ো অভিযোগে বন্দী মানুষদের নাম নথিভুক্ত করেছেন। তাঁর হিসাবে ৩,০০০ আদিবাসী, ২,০০০ দলিত ভুয়ো অভিযোগে রাজ্যের জেলে বছরের পর বছর হাজতবাস করছেন। এঁদের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য তিনি হাইকোর্টে পিআইএল করেন। আদালত প্রতিটি জেল থেকে তথ্য চেয়ে পাঠায়; ব্যস ঐ পর্যন্তই। ফাদার ১০২ জন বিচারাধীন ‘নকশাল’ বন্দীদের সাথে কথা বলেছেন। বলছেন এঁদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ নিরীহ এবং তাঁরা এতো হতদরিদ্র যে তাঁদের পক্ষে সঠিক বিচার পাওয়া অসম্ভব।

ছত্তিসগড়ে কংগ্রেস সরকার গঠিত হওয়ার পর মানুষের অন্যতম দাবি ছিল, বন্দী মুক্তি। বিজেপি শাসনের দীর্ঘ দেড় দশকে প্রায় ৬,০০০ গ্রামবাসীকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে, বিভিন্ন ভুয়ো মামলায় ফাঁসিয়ে বিনাবিচারে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। এঁদের মুক্তির জন্য সোনি সোরি, হিড়মে মার্কম এবং অন্যান্য কর্মীরা ‘জেলবন্দী রিহাই মঞ্চ’ গঠন করেন। মুখ্যমন্ত্রী বাঘেল অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এ কে পট্টনায়েকের অধীনে একটি কমিটি করেন যাঁরা বিভিন্ন কেস যাচাই করে তাঁদের মুক্তির জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবেন। তিনি এও বলেন যে ‘মঞ্চ’ জেল বন্দীদের তালিকা তৈরি করতে এই কমিটিকে সাহায্য করবে। সেই মতো হিড়মে মার্কম অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বন্দীদের তালিকা প্রস্তুত করা শুরু করেন। কিন্তু বছর গড়িয়ে যায় কমিটির কাজ আর এগোয় না। ২০২০’র ১৭ সেপ্টেম্বর ‘মঞ্চ’ বন্দীমুক্তির দাবিতে দান্তেওয়াড়ায় একটি বড় জমায়েতের ডাক দেয়। অরবিন্দ নেতম, ভূতপূর্ব কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আদিবাসীদের দাবি সমর্থন করেন। তিনি বলেন, অনেকেই যাঁরা জেলে তাঁরা যুবক এবং তাঁদের পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মানুষ। কংগ্রেস ৩০০ জনকে মুক্তি দেয়। সোনি এঁদের মুক্তিকে স্বাগত জানান। সাথে সাথে এটাও জানান যে, এঁদেরকে অন্য অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ‘নকশাল’ অভিযোগে নয়। ২০২১’র ৯ মার্চ মার্কম আন্তর্জাতিক মহিলা দিবস উদযাপনের জন্য মহিলাদের একটি সমাবেশ করেন। সেখানে তাঁরা বন্দীমুক্তির দাবিও উত্থাপন করেন। আধা সামরিক বাহিনী এই সমাবেশ ভেঙে দেয়, মার্কমকে গ্রেপ্তার করে এবং তাঁকে ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করে। হিড়মে মার্কম গ্রেপ্তার হওয়ার ফলে কারাবন্দীদের তালিকা প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া ব্যহত হয়। এখন সরকার এই ‘মঞ্চ’কেই ‘মাওবাদী’ স্ট্যাম্প মারা শুরু করে দিয়েছে। সংগঠনের সম্পাদক সুজিত কর্মাকে চূড়ান্ত হেনস্থা করা হচ্ছে। পুলিশ খোলাখুলি বলছে হিড়মে মার্কম আর কোনও দিনও জেলের বাইরে আসতে পারবেন না, তাঁকে একটার পর একটা কেসে অভিযুক্ত করা হবে। অদম্য সোনি সোরির ওপরেও সরকারের চাপ অব্যাহত। ভিমা কোরেগাঁও মামলাতেও তাঁর ওপর পুলিশের কড়া নজর।

তাই ৩,৫০,০০০ বিচারাধীনদের জামিন দেওয়া একটা কথার কথা মাত্র, আদপে আরও একটি জুমলা।

- সোমনাথ গুহ

খণ্ড-29
সংখ্যা-19