প্রতিবেদন
পূজো এবং ...

বহু মানুষের প্রায় সারা বছরের প্রতীক্ষা — নানা কারণে, নানাভাবে। অবশেষে দোরগোড়ায় এসে গেল পূজো। কিন্তু এবার পূজো নিয়ে বহু আগে থেকে ভাবনা চিন্তা শুরু করেছেন বাংলার বাইরের কিছু মানুষ একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে। কারা তারা? বাংলার মসনদ দখলকে যারা ‘পাখির চোখ’ করেছে। হ্যাঁ, বিজেপি’র শীর্ষনেতৃত্ব ! বঙ্গ বিজেপি’কে তাদের নির্দেশ — বাংলার পূজো কমিটিগুলো দখল করতে হবে। জনসংযোগের এটাও একটা কার্যকরী উপায়। ঠিকই, পূজো কমিটিগুলোতে থাকেন পাড়ার কেষ্ট বিষ্টুরা। থাকে যুবকেরা। কমিটি দখল মানে এলাকা দখল। পাড়ায় পাড়ায় একেবারে বাড়ির অন্দরমহলে, রান্নাঘরের চৌকাঠে পৌঁছে যাওয়া। এমনিতে রামনবমী, জন্মাষ্টমী এসব তো আছেই। কিন্তু এ হল গিয়ে বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব, প্রাণের উৎসব, শারদোৎসব!

ঠিকই, এলাকা দখল যেমন করা যাবে, তেমনই বাংলায় ‘বহিরাগত’ এই অপবাদটাও ঘুচবে। ‘পূজো’ মানে শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানই তো নয়! তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ড। আছে ‘সিঁদুরখেলা’, বিজয়া সম্মিলনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা, প্রদর্শনী আরও কত কিছু। সবেতেই ঢুকে পড়তে হবে! অক্লেশে! এইভাবে বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কিছু হস্তক্ষেপ ঘটানোর মাধ্যমে ‘বাঙালিয়ানা’ও প্রতিষ্ঠিত হবে! এসব কিছুর মধ্য দিয়ে আগামী বিধানসভা নির্বাচনের পথে অনেকটা নিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়া যাবে! এই-ই হল বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরিকল্পনা। কিন্তু রাজ্যের বর্তমান শাসকদলের খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’ —। বাঙালির উৎসব অঙ্গনের তথা বঙ্গজীবনের ‘দখলদারি’ নিয়ে শুরু হয়ে গেল তাল ঠোকা! এ তো গেল রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক চালচিত্রে দুই প্রধান শাসক দলের তরজা। কিন্তু আম জনতা কী ভাবছে,উৎসবকে আবাহন জানানোর কী প্রস্তুতিই বা থাকছে — এ সব নিয়ে কী ভাবনা আছে রাজনৈতিক দলগুলোর?

আকাশের মুখ ভার। পাড়ার মেয়ে-বৌদের মন ভার। ‘পূজো’র সেই রোদ্দুরই তো উঠছে না। কাচাকাচি ঘরঝাড়া আশপাশ পয়-পরিষ্কার করা — সবই তো বাকি! তা ছাড়া জুটমিলের অবস্থাও ভালো না, কখন বন্ধ হয় ঠিক নেই। জুটমিল নির্ভর পাড়া না! মহল্লার প্রাণভোমরা! — কুর্তি, লেগিংস, ম্যাক্সি বা চুড়ি-দুল-টিপ বিক্রি করতে আসা দিদিদের সমাদর করে বসানো, এটা ওটা কেনা। এ শিফ্টের ডিউটি শেষে ঘর ফিরতি শ্রমিকদের বোনাস নিয়ে চলমান টুকরো আলাপ, মিল প্রত্যেক বছর বন্ধ হয়ে যাওয়ার হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা পাড়ার পূজোর চাঁদার বিল নিয়ে জনা দুয়েকের কুণ্ঠিত আবদার “এবার কিন্তু একটু বাড়াতে হবে” — এসব কিছুর মধ্যে দিয়ে উদ্বাস্তু পল্লীতে, গরিব মহল্লায় ‘পূজো’ পা রাখে।

আচমকা আঘাতে মাথাটা অসাড় হয়ে গেল। বন্ধ গোন্দলপাড়া জুট মিল শ্রমিকের আবার আত্মহত্যা — কয়েক দিনের ব্যবধানে দু’দুটো তাজা প্রাণ চলে গেল। একই মিলে! কী অতলান্ত বিপন্নতা, কী দুর্জয় অভিমান নিয়ে মধ্য তিরিশেই ওরা চলে গেল। অষ্টমীর সকালে যখন কাঁঠাল গাছের ফাঁক দিয়ে আকুলি বিকুলি স্মৃতির রোদ লুটিয়ে পড়বে দাওয়ায়, যখন জমাট বোবা কান্নায় সদ্য স্বামীহারার ভিতরটা ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে, তখন কি ঐ পূজোর দখলদাররা বায়বীয় নয়, সত্যিকারের আশ্বাস নিয়ে পৌঁছাতে পারবেন তার আঙিনায়?

মাত্রই কয়েকদিন হল, মেট্রো রেলের সৌজন্যে, বৌবাজারের স্যাকরাপাড়া, দুর্গা পিতুরি লেনের বাসিন্দারা রাতারাতি ঘরছাড়া, গৃহহারা হলেন। চোখের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল সাত পুরুষের না হোক, কয়েক পুরুষের আবাস! এই মানুষগুলো যে কী হারালেন অন্য কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। কেন আরও যত্নবান মনোযোগী হলেন না মেট্রো কর্তৃপক্ষ সুড়ঙ্গ খোঁড়ার আগে? কেন মানুষের জীবন নিয়ে তারা ছিনিমিনি খেললেন? ‘দুর্গতিনাশিনীর বরাভয় থেকে বঞ্চিত এই মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ ঝুলে রইল অজানা অন্ধকারে। শুধু তাই নয়,এই বাসিন্দাদের অনেকেই পোস্ট ট্রমাটিক ডিসঅর্ডারে (নিউরোলজিক্যাল মিসম্যাচ) ভুগছেন। এ তো গেল বিপর্যয়। কিন্তু অনেক দূরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে আমার বাংলা। ‘কল্যাণী’র কি তা অজানা?

এই সেদিন পাশ হল ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রিভেনশন অব লিঞ্চিং বিল ২০১৯’। অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু কুছ পরোয়া নেই। বহরমপুরে ভর দুপুরে গত ৫ সেপ্টেম্বর ওষুধ কিনতে আসা খারিব শেখকে ডাক্তারের চেম্বারের মধ্যেই পিটিয়ে মেরে ফেলা হল। তার অপরাধ, এসি চালাতে বলেছিল। সম্ভবত সে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিল। ‘ছেলেধরা’ বলে পেটাতে শুরু করার আগে কারও সেটা মনে হল না! এক ডাক্তারের চেম্বারে! উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে দু’জন এবং ডালখোলায় তিনজন ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়েছে। এই পাঁচজনই মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা। প্রথমোক্ত দুই যুবক কাপড় বিক্রি করতে গিয়েছিল। পরবর্তী তিনজন সাপুড়ে, তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে। গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। মানুষ কেন এত অসহিষ্ণু উন্মত্ত হয়ে উঠছে?

এর থেকেও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতায় তাঁতিচুয়া গ্রামে। ৬ সেপ্টেম্বর এক বৃদ্ধাকে ‘ডাইনি’ সন্দেহে খুন করেছে তার ভাইপো এবং জ্ঞাতিরা। এক বছর আগে ঐ লোকটির ছেলে সাপের কামড়ে মারা গেলে গুণিন জানায় তার পিসিই ছেলের মৃত্যুর কারণ এবং ঐ বৃদ্ধাকে ‘ডাইনি’ অপবাদ দেয়। তার জেরে, নিছক কুসংস্কারের বশে একটি প্রাণ চলে গেল!

রোগ তো আরও অনেক। সম্প্রতি চেন্নাই পুলিশ, ‘ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস মিশন’ নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতায় বাংলার ৬১টি শিশুকে উদ্ধার করেছে। ওদের বাবা মা ওদের বেচে দিয়েছিল। চেন্নাইয়ের বিভিন্ন গয়নার কারখানায় এই উদোম-গা শিশুরা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঘাড় গুঁজে কাজ করতে বাধ্য হোত। চান খাওয়ার সময়টুকুও পেত না। গয়না শিল্পে বিপজ্জনক রাসায়নিক নিয়ে কাজ করতে করতে তাদের স্বাস্থ্যেরও মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। দেশে শিশু-শ্রম রুখতে আইন আছে, আইনরক্ষক আছে। মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়কদের লম্বা-চওড়া ভাষণ আছে। শিশু সুরক্ষা দেখভাল করার জন্য উচ্চ বেতনভোগী আমলারা আছেন। শুধুমাত্র ‘শিশু সুরক্ষা’টাই নেই! শহর-গ্রামে মানুষের আয়ের সংস্থান তলানিতে ঠেকেছে। এখন সর্বাত্মক মন্দায় অবস্থা আরও খারাপ। দেওয়ালে পিঠ-ঠেকে যাওয়া মানুষ অভাবের তাড়নায় সন্তান বেচে দিচ্ছে!

৮ সেপ্টেম্বর কাঁকিনাড়া স্টেশনে ঘটে গেল আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা। নেশাগ্রস্ত ছিনতাইবাজদের হাতে পুলিশের নাকের ডগায় প্রাণ গেল নদীয়ার এক তরুণের। তার বড় ভাই সম্পর্কের টানাপোড়েনের জেরে মাত্র এক সপ্তাহ আগে আত্মহত্যা করেছিল। বিড়ি বেঁধে দিন গুজরান করা, তিল তিল পরিশ্রমে বড় করে তোলা সন্তানদের একসঙ্গে হারানো মাকে কী সান্ত্বনা দেবে সমাজ, প্রশাসন? বঙ্গজীবনের দখলদারেরা?

সমাজ, পরিবার নারীর শ্রমের যথাযথ মূল্য দেয় না। কিন্তু সরকার কীভাবে নারীর সংবিধান স্বীকৃত অধিকার লঙ্ঘন করে তাদের নির্মম শোষণের চরম অমানবিক নজির সৃষ্টি করে চলেছে — তা বুঝতে হলে স্কুলের রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পকর্মীদের অবস্থা। অকথ্য পরিশ্রমের বিনিময়ে মাসিক যৎসামান্য ভাতা, যখন তখন ‘চোর’ অপবাদ ও ‘বসিয়ে দেওয়ার’ ভয় দেখিয়ে সন্ত্রস্ত রাখা। শিশুর পুষ্টি নিয়ে প্রতারণা তো চলছেই। কেজি কেজি সোনা রূপো দিয়ে প্রতিমা তৈরি করে যারা কয়েক কোটি টাকা বাজেটের পূজো করছে তাদের ২৫০০০ টাকা করে সরকারি ‘সাহায্য’ দেওয়া যায়, অসুস্থ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাকে উ‌ৎসব বাবদ ভর্তুকি দিতে বাধ্য করা যায় — কিন্তু হতদরিদ্র প্রকল্পকর্মীদের পূজো অনুদানের ঘোষণাটুকু করা যায় না! বহু অসঙ্গতি, বহু নতুন নতুন সামাজিক ব্যাধির সংক্রমণ ঘটেছে, ঘটছে বঙ্গজীবনের দেহে। সৌজন্যে বিভিন্ন শাসকদল! অবহেলা, অসম্মান, উৎপীড়ন — এবার মুখের জবান, মাতৃভাষার অধিকারটুকু কেড়ে নেওয়ার হুঙ্কার শোনা গেল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অমিত শাহের মুখে!

বাংলার মানুষ যাদের বেশিরভাগই অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের সমস্যায় জর্জরিত, দিন গুজরানই যাদের সমস্যা, তাদের মুহুর্মুহু সন্ত্রস্ত করে চলেছেন অমিত শাহ, দিলীপ ঘোষ, রাহুল সিন‌্হার মতো নানা স্তরের, নানা পদের নেতারা — ‘‘বাংলায় এনআরসি হবেই” আর তারা ঘাড় ধরে বার করে দেবেন তাদের অপছন্দের লোকজনকে। এই তবে ‘দখলদারির’ উদ্দেশ্য! সাধু সাবধান!!

খণ্ড-26
সংখ্যা-29