ত্রিপুরায় গ্রামীণ জনসংযোগের প্রচার কর্মসূচী

সিপিআই(এমএল) ত্রিপুরা রাজ্য কমিটির ১৭- ১৮ আগষ্টের অধিবেশনে গৃহীত জনসংযােগ কর্মসূচী ও কর্মপরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে ৪ সেপ্টেম্বর উদয়পুরে ও ১৫ সেপ্টেম্বর ধর্মনগরে জেলাভিত্তিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।

কর্মশালা করার উদ্দেশ্য হল জনসংযোগ কর্মসূচী সফল করে তোলা।

এই লক্ষ্য থেকে গৃহীত ১৫ দফা দাবি নিয়ে গ্রামে কিছু ঘরােয়া সভা করা হয়। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর গত ১৮ মাসে এই প্রথমবার গ্রামে পথসভা করার জন্য উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়। জনগণ ও কর্মীসমর্থকরা গ্রামে গ্রামে সভা করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর উদয়পুরে খিলপাড়া বাজারে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২০০ থেকে ২৫০ মানুষ ভীড় করে দাঁড়িয়ে থেকে বক্তব্য শোনেন। ভালো সাড়া পড়ে। ১৯ সেপ্টেম্বর বিলােনীয়ায় চিত্তামারা গ্রামে জাতি ও উপজাতি মিশ্রবসতি গ্রামে বাজার সভা করা হয়। এখানেও ভালো সাড়া লক্ষ্য করা যায়। সভা শেষ হওয়ার পর কিছু দুস্কৃতি উত্তেজনা সৃষ্টি করার ও হামলা করার চেষ্টা করে। কিন্তু জনগণের কাছ থেকে কোনও সাড়া না পাওয়ায় তা ব্যর্থহয়। ইতিমধ্যে ধর্মনগৱে দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

১৫ দফা দাবি —
(১) রান্নার গ্যাসের দাম, বিদ্যুৎ মাশুল বৃদ্ধি, শহরে সম্পদ কর বৃদ্ধি, ট্রেড লাইসেন্স ফি বৃদ্ধি প্রত্যাহার কর। নিত্য প্রয়ােজনীয় ও খাদ্যপন্যের মূল্যবৃদ্ধি রদ কর।

(২) আইনসভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন যে, গত ১৮মাসে পৌনে ৫ লক্ষ নথীভূক্ত বেকারকে প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনায় ঋণদান কর্মসূচীর মাধ্যমে স্ব-নির্ভর করা হয়েছে, অন্যান্য যোজনায় আরো লক্ষাধিক কর্মসংস্থান হয়েছে। তাই নথীভূক্ত বেকারের সংখ্যা কমে আর মাত্র ১ লক্ষ ৫৬ হাজার রয়েছে। বাস্তবে এই তথ্য সম্পূর্ণ অবাস্তব ও হাস্যকর। “ভিশন ডকুমেন্ট’’ অনুসারে অবিলম্বে সমস্ত সরকারী শূণ্যপদ (৫০০০০) পূরণ কর, সমস্ত অনিয়মিতদের নিয়মিত কর, ৭ম পে-কমিশন অনুসারে সমস্ত শ্রমিক কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা মিটিয়ে দাও, ন্যূনতম মজুরি মাসে ১৮০০০ টাকা ও দৈনিক মজুরি ৬০০ টাকা করতে হবে।

(৩) ১০৩২৩ জন চাকুরিচ্যুত শিক্ষকদের জন্য সরকারী উদ্যোগে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। ১২০০০ অশিক্ষক শূণ্যপদ অবিলম্বে পূরণ করতে হবে।

(৪) ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের কোথাও এনআরসি নয়।

(৫) ধর্মের ভিত্তিতে অসাংবিধানিক নাগরিকত্ব সংশােধনী বিল, ২০১৬ বাতিল করতে হবে।

(৬) সংবিধান সংশােধন করে এডিসি-র হাতে কেন্দ্র সরাসরি বাজেট বরাদ্দ, ভূমির অধিকার সহ অধিক স্বশাসন ক্ষমতা অর্পন করতে হবে। সংবিধানের অষ্টম তপশীলে ককবরক ভাষাকে অর্ন্তভূক্ত করতে হবে।

(৭) কেন্দ্রীয় বনাধিকার আইন, ২০০৬-এর মাধ্যমে বনভূমির উপর জনজাতিদের অর্জিত জন্মগত অধিকারের স্বীকৃতি কোনওভাবেই খর্ব করা চলবে না। রাজ্যে বনভূমি হতে কোনো জনজাতি আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা যাবে না।

(৮) এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে বছরে ২০০দিনের কাজ ও দৈনিক ৩৪০টাকা মজুরি করতে হবে। জিও ট্রেকিং এর নামে এই প্রকল্পকে সংকোচিত করা চলবে না। কৃষিক্ষেত্রে রেগা প্রকল্পকে সম্প্রসারিত করতে হবে।

(৯) রাজ্য সরকার গত ১৮ মাস ধরে সামাজিক পেনশন প্রকল্পগুলিতে নতুন কোনও সুফলভোগী নির্বাচন করার কাজ বন্ধ করে রেখেছে কেন, জবাব চাই। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মাসে ২০০০ টাকা করে পেনশন বৃদ্ধি করা দূরের কথা, ২৪টি প্রকল্পে নতুন করে সুফলভোগী নির্বাচন করতে হবে। মাসে ৩০০০ টাকা করে প্রতিটি প্রকল্পে পেনশন দিতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।

(১০) ৮২০টি সরকারী স্কুল, স্বাস্থ্য, মিড-মে-মিল, অঙ্গনওয়ারী প্রকল্পকে বেসরকারী সংস্থার হাতে হস্তান্তর করা চলবে না। সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে।

(১১) সরকারী হাসপাতালগুলিতে টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা অমানবিক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে। সর্বজনীন করমুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য কেন্দ্রীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে।

(১২) যুগ-যুগ ধরে সামাজিক জীবনে তথা শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমাজের পশ্চাৎপদ অংশ তথা তপশীলি জাতি, তপশীলি উপজাতি ও ওবিসিদের জন্য সংবিধান প্রদত্ত সংরক্ষণের অধিকার কোনওভাবে খর্ব করা চলবে না। যেকোনও মূল্যে এক দেশ এক আইনের নামে আসলে বর্ণ আধিপত্য চাপিয়ে দেওয়া চলবে না।

(১৩) গত ১৮ মাসে রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। প্রতিমাসে গড়ে ৯-১০ জন করে খুন, গত জুন মাসে ১৬ জন খুন হয়েছে। ১৬ মাসে অস্বাভাবিক মৃত্যু ১৮৭২ জন, অর্থাৎ মাসে গড়ে ১০৪ জন করে অস্বাভাবিক মৃত্যুর পথ বেছে নিচ্ছেন। আত্মহত্যার সংখ্যা ৯৮২ জন। অর্থাৎ প্রতিমাসে ৬৫জন করে আত্মহত্যা করছেন। যা আশ্চৰ্য্য রকমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে সবচেয়ে উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে নারীর উপর হিংসা ও অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি। প্রতিমাসে গড়ে ৫১ জন নারীর উপর অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। গত ১৬ মাসে ২৩ জন বধূ হত্যা, ৩১ জন পণ সংক্রান্ত মৃত্যু সম্মুখীন হয়েছেন। ৩ জনকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। অপহরণ ২২২জন, মােট ঘটনা ৮০৯টি। প্রতিমাসে গড়ে ১৬-২০টি ধর্ষণের ঘটনা ও ১৯.৩টি করে শ্লীলতাহানির ঘটনা নথীভূত হয়েছে। এর মধ্যে নাবালিকা ও শিশু কন্যার উপর গড়ে প্রতিমাসে ৮টি করে অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। খোদ এমএলএ নারীর উপর শ্লীলতাহানির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। আজকের সম্মেলন আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে ও নারীর উপর অপরাধমূলক ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি হওয়ার ফলে গভীর চিন্তা প্রকাশ করছে। অবিলম্বে সরকারকে আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করার দাবী করছে। রাজ্যব্যাপী খুনসন্ত্রাস, নারীদের উপর ক্রমবর্ধমান হিংসা ও অপরাধ বন্ধ কর। দােষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাও।

(১৪) উৎপাদন খরচের সাথে ৫০ শতাংশ যুক্ত করে সহায়ক মূল্য নির্ধারন করার জন্য স্বামিনাথন কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে রাজ্যে ২৭৫০টাকার বদলে কুইন্টাল প্রতি ধানের মূল্য ১৭৫০ টাকা নির্ধারণ করার ফলে ধান চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়েনি। এবার ৪ লক্ষ হেক্টর আমন ধান লাগানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী কৃষক সহায়ক যোজনায় বাস্তবে এই সংকট নিরসনে ফল দায়ক হয়নি। সরকারী গুদামে ইউরিয়া সারের সংকট এই মরশুমে কৃষকদের সংকটগ্রস্ত করে তুলেছে। অবিলম্বে সরকারকে পর্যাপ্ত ইউরিয়া সার সরবরাহ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ফসলের লাভজনক নাম ও ঋণমুক্তির জন্য সংসদে আইন প্রণয়ন করতে হবে।

(১৫) ১৯৬২টি জিআরএস পদে ওএমআর ভিত্তিক লিখিত পরীক্ষা, কম্পিউটার দক্ষতার পরীক্ষা এবং ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে নিয়ােগের জনা গ্রামােন্নয়ন দপ্তরের বিজ্ঞপ্তি আসলে ২০০৭ থেকে যারা এই পদে কর্মরত আছেন তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ারই প্রচেষ্টা মাত্র। তাই জিআরএস পদে এই ইন্টারভিউর বিজ্ঞপ্তি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। বিধানসভায় জনস্বার্থে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা অব্যাহত রাখার নাম করে আসলে শ্রমিক-কর্মচারিরা যাতে ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করতে না পারে, তার জন্য তাদের ভয় দেখানো এবং তাদের পায়ে বেড়ি পরানাের জন্য ‘এসমা” আইন সংখ্যাধিক্যের জোরে পাশ করানো মানছি না। অবিলম্বে এই ‘এসমা ও ‘নাসা’র মতো কালা আইন বাতিল করতে হবে। রাজ্যে সর্বত্র ভয়মুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। সাংবিধানিক গণতন্ত্র, মত প্রকাশের অধিকারের উপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণ বন্ধ কর।

সরকারের লোক দেখানো নেশা মুক্ত ত্রিপুরা গড়ার ডাক দিয়ে অতিরিক্ত কর আদায় করার জন্য রাজ্যের সর্বত্র আরো বেশি করে বিলিতি ও দেশী মদের লাইসেন্স, এই প্রথম ‘মদের বার’-এর লাইসেন্স সহ সারাদিন ও রাত্রি ১০টা পর্যন্ত মদের দোকান খোলা রাখার জন্য রাজ্য বিধানসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।

- পার্থ কর্মকার

 

খণ্ড-26
সংখ্যা-30