প্রতিবেদন
বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জলবায়ু ধর্মঘট স্কুল ছাত্রদের

মুম্বইয়ের জাতীয় সড়কের উপর প্ল্যাকার্ডহাতে দাঁড়িয়ে পূজা ডোরমাডিয়া। বয়স বছর ২৯। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে জনা ৫০ শিশু। সকলেই স্কুল পড়ুয়া। বৃষ্টি মাথায় কেউ ছাতা, কেউ রেনকোট জড়িয়ে কচি গলায় স্লোগান তুলেছে, “পরিবেশ বাঁচাও।” তাদের সঙ্গেই গলা মেলালেন পুজা, ‘ফ্রাইডে ফর ফিউচার’। সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গের ডাকে এই শুক্রবার স্মরণীয় হয়ে থাক। পোশাকি নাম বিশ্ব জলবায়ু ধর্মঘট (Global Climate Strike)। আদতে ২০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার এক মহামিলনের উৎসব দেখল গোটা বিশ্ব। বর্ণবিদ্বেষের বেড়াজাল নয়, দেশকালের গণ্ডিও নয়, জাতি-ধর্মের বর্ম সরিয়ে মুম্বই থেকে মেলবোর্ন, ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক, পায়ে পায়ে পথে নামল বিশ্বের ৪০০-৫০০ শহর। জলবায়ু বাঁচানোর অঙ্গীকার নিয়ে হাত মেলাল কয়েক কোটি মানুষ। ঘুচে গেল সীমান্তের বাধা।

মুম্বইয়ের রাস্তায় স্কুল-কলেজ-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে জলবায়ু ধর্মঘটে সামিল হলেন অগণিত মানুষ। কচিকাঁচা থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বয়সের সীমারেখা উৎসাহে ঘাটতি ফেলতে পারেনি। পূজা বলেছেন, “আমরা জানি জলবায়ুর বদল কতটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে পরিবেশে। তাও আমরা মুখ বন্ধ করে রয়েছি। এই আন্দোলন আমাদের রাষ্ট্রনেতাদের জন্য, তাঁদের বোঝানো, কতটা বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের সভ্যতা।”

সারা পৃথিবীর ২০০০-এর বেশি শহর জুড়ে ‘ফ্রাইডে ফর ফিউচার’ আন্দোলনে শামিল হয়েছেন ছাত্রছাত্রীরা, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে তাঁদের এই আন্দোলন। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন প্রাপ্তবয়স্করাও, লাখে লাখে, তাঁদের আন্দোলন #ClimateStrike। ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসরুম ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন, প্রাপ্তবয়সকরা কর্মক্ষেত্র ও বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসবেন। শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এ আন্দোলন চলবে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।

del

আন্তর্জাতিক জলবায়ু ধর্মঘট কী?

সেদিনও ছিল এক শুক্রবার। ২০ সেপ্টেম্বর। ২০১৮ সাল। হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে সুইডিশ পার্লামেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে বছর পনেরোর এক কিশোরী। গ্রেটা থুনবার্গ। স্কুলে যাওয়ার বদলে প্রতিদিন সে দেশের পার্লামেন্টের সামনে, পাথরের পথের উপরে চুপচাপ বসে থাকত। তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল, চলতি গ্রীষ্মে সুইডেনের তাপমাত্রা। প্ল্যাকার্ডে ‘বোল্ড ক্লাইমেট অ্যাকশন’ লিখে এক নীরব প্রতিবাদ শুরু করল সে। ধীরে ধীরে সঙ্গী জুটল। সুইডেন থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু সামিটেও একই ভাবে প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠল কিশোরী। তখন বয়স ১৬। গ্রেটার দাবি ছিল, রাজনৈতিক নেতাদের এ বিষয়ে দ্রুত সক্রিয় হতে হবে। একটা লিফলেট বিলি করত গ্রেটা, যাতে লেখা থাকত, ‘আই অ্যাম ডুইং দিস বিকজ ইউ অ্যাডালটস আর শিটিং অন মাই ফিউচার’। কড়া কথা সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্যও।

এর পর, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে থুনবার্গ প্রতিশুক্রবার ধর্মঘটের ডাক দিতে থাকে। এর জেরে সুইডিশ পার্লামেন্ট জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত তাদের নীতি পরিবর্তন করে। এর পর ধীরে ধীরে ছাত্র ও প্রাপ্তবয়স্করা সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংসদের সামনে, স্থানীয় সিটি হলগুলির সামনে এ ইস্যুতে সমাবেশ ও বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। তৈরি হয় দুনিয়াভর আন্দোলন, যা একই সঙ্গে স্থানিকও বটে।

climate

‘ফ্রাইডে ফর ফিউচার’ লক্ষ লক্ষ গ্রেটা থুনবার্গের জন্ম দিয়েছে, জাগিয়ে তুলেছে বিশ্বকে

#FFF ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে সপ্তাহভরের এ আন্দোলনে শামিল হবেন ১৮৫টি দেশের ছাত্রছাত্রী ও প্রাপ্তবয়স্করা। ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, “সেপ্টেম্বরের ২০ থেকে ২৭ তারিখের মধ্যে হাজার হাজার ইভেন্ট হবে, আমরা লাখে লাখে মানুষ ক্লাসরুম ছেড়ে, কাজের জায়গা ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় নেমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরিবেশ সংক্রান্ত পদক্ষেপের দাবি তুলব, দাবি তুলব পরিবেশ নিয়ে ন্যায়বিচারের।”

ভারতে দিল্লি, চেন্নাই, পুনে বা মুম্বইয়ের মতো শহর ছাড়া ধর্মঘটে শামিল পাঞ্জাবের ফাগওয়ারা, তামিলনাড়ুর নাগের কয়েল, রাজস্থানের কিষাণগড়, মহারাষ্ট্রের শোলাপুর, কেরালার আলুভা, কর্নাটকের হোন্নালি, উত্তর প্রদেশের গৌরীগঞ্জ, ছত্তিসগড়ের অম্বিকাপুর, মেঘালয়ের পূর্ব খাসি পাহাড় এবং আসামের মঙ্গলদইও।

গত মার্চে যুব পরিবেশ ধর্মঘটে ১০০-র বেশি শহরের কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী শামিল হয়েছিলেন। এর পরই অস্ট্রেলিয়া প্রত্যক্ষ করে এ যাবৎকালের প্রখরতম গ্রীষ্ম। মে মাসে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে ধর্মঘট হয়।

এই পর্যায়ের ধর্মঘটে ছাত্রছাত্রীদের দাবি, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রির কম রাখার জন্য দ্রুত ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দুনিয়া জোড়া এই ধর্মঘটের মধ্যেই শুরু হতে চলেছে রাষ্ট্রসংঘের ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিট, ২০১৯। সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে গ্রেটা থুনবার্গকেও।

বিশ্বজোড়া ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরাও। মার্চ মাসে বিজ্ঞানীদের একটি গ্রুপ খোলা চিঠি লিখে ছাত্রছাত্রীদের ও তাদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি ঘোষণা করেন। “ছাত্রছাত্রীরা দৃঢ় ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ চায় যা সমর্থন করছে এ যাবতের সেরা বিজ্ঞান। ওরা আমাদের সমর্থন চায়, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ওরা চায় আমাদের কার্যকরী ভূমিকা। ওদের ভবিষ্যৎ এর উপর দাঁড়িয়ে, আমাদেরও তাই।” এ চিঠিতে পিটার কালমুস, কেট মার্ভেল, মাইকেল মান সহ বিভিন্ন জলবায়ু বিজ্ঞানীরা স্বাক্ষর করেছিলেন।

অন্যদের মধ্যে থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিলেছিল। ব্রিটেনে লেবার পার্টির মেতা জেরেমি করবিন অল্ববয়সী ছেলেমেয়েদের এ উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন টুইট করে। ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ছাত্রছাত্রীদের সমালোচনা করে বলেছিলেন এ সমস্যা সমাধানের যোগ্য পেশাদার হয়ে ওঠার ব্যাপারে তাদের মনোনিবেশ করা উচিত।

new yark

দুনিয়া জুড়ে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন শুরু হল কেন?

২০১৫ সালে বিশ্বজোড়া স্কুল আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে জলবায়ু ধর্মঘট সংগঠিত হয়, যার ধারণা এসেছিল ২০১৫ সালের গ্লোবাল ইয়ুথ সামিটের সংগঠকদের কাছ থেকে। এই ধর্মঘটে ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ছেড়ে অন্য সংগঠকদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেবার আহ্বান জানানো হয়েছিল। যুবসমাজের কাছে ওই ধর্মঘট ছিল ওয়েক আপ কল। সে সময়ে দাবি ছিল ফসিল থেকে জ্বালানি নিষ্কাশন বন্ধ করতে হবে এবং ১০০ শতাংশ দূষণমুক্ত শক্তিতে রূপান্তর ঘটাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সকলকে সামলাতে হলেও, আগামী দশকগুলিতে ভুক্তভোগী হতে চলেছে এখন যারা ছোট, তারা। স্কুল ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের পিছনে যে আবেগ সবচেয়ে বেশি কাজ করছে তা হল পুরনো প্রজন্মের ব্যর্থ প্রতিশ্রুতি — যারা এখনও ফসিল থেকে জ্বালানি নিষ্কাশন করে চলেছে, যার ফলে কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরণ বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রাও। ছাত্রছাত্রীরা এর অবসান চায় তাদের ভবিষ্যৎ, মানব সমাজের ভবিষ্যৎ এবং এই গ্রহের ভবিষ্যতকে রক্ষা করার তাগিদে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-30