প্রতিবেদন
‘শরিয়া আদালত’ শব্দবন্ধটিই ভুল
[সম্পাদকের নোট : সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের মীরাটে স্থাপিত হয়েছে “হিন্দু কোর্ট”। অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা এই “হিন্দু কোর্ট” স্থাপন করেছে এবং আগামী ১৫ নভেম্বর দেশের আরও ৫টি শহরে এরকম আদালত প্রতিষ্ঠা করবে তাঁরা। ১৫ নভেম্বর তারিখে মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গোডসের ফাঁসি হয়েছিল বলে এই দিনটি বেছে নিয়েছে তাঁরা। খবর অনুযায়ি, দেশে যে “শরিয়া আদালত” আছে তা তুলে দেওয়ার জন্য হিন্দু মহাসভা মোদি সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েও ব্যর্থ হয়েছে বলেই “শরিয়া আদালতের মত হিন্দু আদালত” বানাচ্ছে হিন্দু মহাসভা। ১৬ আগস্ট টাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্ট ও এবিপি লাইভ হিন্দু মহাসভার কথার প্রতিধ্বনি করে বলে যে শরিয়া আদালতের ধারাতেই হিন্দু আদালত গঠিত হচ্ছে। কিন্তু, হিন্দু মহাসভার ন্যাশনাল সেক্রেটারি, যিনি এই আদালতের প্রথম জাজ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন, শ্রীমতী পূজা শকুন পান্ডে বলেন, “আমরা কেবল হিন্দুদের বিষয় নিয়েই ডীল করব। হিন্দু মহিলাদের হ্যারাসমেন্ট, বিবাহ ও সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয় তার মধ্যে পড়বে। যথোপযুক্ত জেলখানার ব্যবস্থা থাকবে এবং আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত দেব”। বলাই বাহুল্য জেলখানা ও মৃত্যুদন্ড দেওয়ার ক্ষমতা দাবি করা এই “হিন্দু আদালত” সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও বেআইনি। আর, ‘শরিয়া আদালত’ বিষয়ে জানতে এই লেখাটি।]

শরিয়া আদালত প্রতিষ্ঠা করছে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড, এই মর্মে আবার সংবাদ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে গণমাধ্যমে। প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল, এই ধরনের কোনও আদালত বসেনি, বসছেও না। মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড তা বসাচ্ছে না কারণ আদালত খোলার এক্তিয়ার তাদের নেই। সমান্তরাল আদালত বা কোর্ট ভারতীয় বিচারব্যবস্থা অনুমোদন করে না। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড আদতে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। মুসলমান ব্যক্তিগত আইন নিয়ে তারা কাজ করে। মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড যে একমাত্র এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত, তা নয়; অল ইন্ডিয়া শিয়া পার্সোনাল ল বোর্ড, অল ইন্ডিয়া মুসলিম ওমেন’স পার্সোনাল ল বোর্ডও একই ধরনের কাজ করে থাকে। হিন্দু পার্সোনাল ল বোর্ডও আছে। এগুলির কোনওটি সরকারি সংস্থা নয়।

অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড শরিয়া আদালত বসাচ্ছে, এই ‘খবর’-এর তাহলে ভিত্তি কী! পার্সোনাল ল বোর্ড যেটি প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়েছে তার নাম ‘দারুল কাজা’। মিডিয়া দারুল কাজার অনুবাদ করছে শরিয়া কোর্ট বা শরিয়ত আদালত। শরিয়া বা শরিয়ত এবং দারুল কাজা কী, সেটি জেনে নিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

ভারতে বিভিন্ন ধর্মের দেওয়ানি বিধি ভিন্ন ভিন্ন। ইসলামি আইন হল শরিয়া বা শরিয়ত আইন, কুরান ও হাদিস যার উৎস। ‘শরিয়ত’ শব্দের একটি অর্থ হল ধর্ম। যেমন, ‘শরিয়ত এ মুসা’ হল মুসার ধর্ম বা ইহুদি ধর্ম। কখনও কখনও শরিয়ত বলতে ন্যায়কেও বোঝানো হয়। শরিয়ত বিভিন্ন রকমের — ধর্মীয়, আইনি ও রাজনৈতিক। কেউ কেউ বিমূর্ত, ধ্রুপদী, ঐতিহাসিক, সমকালীন — এই ভাবেও শরিয়তকে ব্যাখ্যা করে থাকেন। আমাদের দেশে মুসলিম শরিয়া আইন হল সমকালীন ধর্মীয় আইন। ব্যক্তিগত আইন।

দারুল কাজা হল মধ্যস্থতাকারী একটি এজেন্সি। যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যে সে আলাপ-আলোচনার ব্যবস্থা করে। তার পরিধি হল ব্যক্তিগত আইনের চৌহদ্দি। কীসের মধ্যস্থতা করে দারুল কাজা? সম্পত্তির বণ্টনে, বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদে, মা-বাবার, স্ত্রীর ও অন্যান্য নির্ভরশীল ব্যক্তিদের খোরপোশ সম্পর্কিত বিষয়ে — এক কথায় ব্যক্তিগত আইন নিয়ে তাঁরা পরামর্শ দেন। দারুল কাজার পরামর্শদাতা কারা? উলেমা বা শাস্ত্রজ্ঞদের উপদেশ মেনে কাজিরা সেই পরামর্শ দেন। আমরা জানি, ‘কাজি’ মানে ধর্মীয় আইনের মীমাংসাকারী, যিনি মুসলিম শরিয়া আইন বা ব্যক্তিগত আইন অনুসারে গোলমাল মেটানোর রাস্তা বলে দেন। কাজির দেখানো সেই পথ কেউ মানতে পারেন, নাও মানতে পারেন। এমনকি কাজির কাছে, মানে, দারুল কাজায় নাও যেতে পারেন কোনও পক্ষ। পিতা বা মাতা মারা যাওয়ার পর সম্পত্তির বণ্টনের জন্য পুত্রকন্যারা আদালতে ছোটে না। আত্মীয়স্বজন, ঘনিষ্ঠ মানুষজন বা পাড়ার লোক সে সবের মীমাংসা করে দেন। সেই মীমাংসা কারও অপছন্দ হলে তিনি আদালতে যান। দারুল কাজা সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চায়।

দারুল কাজা এমন একটি এজেন্সি যে স্বতোপ্রণোদিত হয়ে এমন পরামর্শ দিতে চায়। কেন তারা এমন পরামর্শ দেবে, এমন প্রশ্ন কেউ তুলতেই পারেন। নানা ধরনের পরামর্শ দেওয়ার জন্য ভারতে বহু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আছে। সে সব নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়, আদালতে যাওয়া যায়। অনেকেই যান। দারুল কাজা নিয়েও মামলা হয়েছে। সে মামলার রায়ও দিয়েছে রাষ্ট্রের আদালত

দারুল কাজার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আদালতে যাওয়া হয়েছিল ২০১৪ সালে। দিল্লির বিশ্বলোচন মদন নামে একজন আইনজীবী এই প্রশ্ন তোলেন। তিনি মামলায় বলেন, দারুল কাজা আসলে একটি উপ-আদালত। ফলে এগুলি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দেয়, দারুল কাজার পরামর্শ কোনও রায় নয়, তা উপদেশ মাত্র।

সম্প্রতি কেবলমাত্র মুসলমান দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদকে ফৌজদারি আইনের (নতুন তালাক আইন) আওতায় আনার পরে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড বিভিন্ন জায়গায় দারুল কাজা খোলার উদ্যোগ নিয়েছে জোর কদমে। যাতে এই ধরণের ঘটনা স্বামী-স্ত্রী নিজেরাই মিটিয়ে নিতে পারেন। একজন স্বামী তিন বার তালাক উচ্চারণের পর তার তিন বছর কারাবাস হলে স্ত্রী মানে মহিলাটির এবং তার সন্তানদের খোরপোশ কে দেবে, এই কথা এই আইনে লেখা নেই। এমন অনভিপ্রেত ঘটনায় দরিদ্র মুসলিম পরিবারে স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড দারুল কাজা খোলার পক্ষপাতী। ইচ্ছে হলে কেউ তাদের পরামর্শ নিতে পারেন, অনিচ্ছেয় আদালতে চলে যেতে পারেন। দারুল কাজার কাছে উপদেশ চাইতে গেলে সে উপদেশ দেয়, না চাইতে গেলে দেয় না। তার উপদেশ যে মানতেই হবে, এমন কথাও দারুল কাজার নিয়মাবলীতে লেখা নেই।

সুতরাং দারুল কাজা অবৈধ নয়, সমান্তরাল আদালতও নয়। সর্বোচ্চ আদালতের রায় পড়লে সে কথা বিলক্ষণ বোঝা যায়।

খণ্ড-26
সংখ্যা-28