সম্পাদকীয়
‘ক্যাব’-এর সাম্প্রদায়িক চক্রান্তের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেই ‘এনআরসি’ প্রতিরোধ করতে হবে

ভারতের গৃহমন্ত্রী কলকাতায় এসে যে হুঙ্কার দিয়ে গেছেন তা মোটেই হাল্কা বিষয় নয়। একথা ঠিক যে কয়েকদিন ধরে এনারসি প্রশ্নে বাংলার সাধারণ মানুষের উৎকন্ঠা বিজেপির স্থানীয় সংগঠনকে চাপে ফেলে। কিন্তু এই উদ্বেগ ও আশঙ্কা বিজেপি নেতৃত্বের কাঙ্খিতই ছিল। এখান থেকে কীভাবে সাম্প্রদায়িক ফসল তুলতে হবে তা তাদের অজানা নয়। ফলত বিজেপি সভাপতি তথা দেশের গৃহমন্ত্রী কলকাতা ছুটে আসেন হিন্দুদের আশ্বস্ত করতে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বুঝিয়ে দিতে যে এনারসি করা হচ্ছে আসলে মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের তাড়ানোর জন্য। প্রস্তাবিত “সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট বিল, ২০১৬” বা ক্যাব-কে সামনে তুলে ধরে এই উদ্দেশ্য সাধন করতে চায় তারা।

কিন্তু এটা বিজেপির তরফে কোনও ফাঁকা আওয়াজ নয়, বরং অনেক আগে থেকে তারা এই বিভাজন ঘটাতে আটঘাট বেঁধে নামে। অনেক আগেই তারা ব্যাপক গণসাধারণকে এই বিপন্নতায় ধরার জাল বিছিয়ে রেখেছিল। ২০০৩ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার সময়ই নাগরিকত্ব সংক্রান্ত মূল আইনে সংশোধনী আনে তারা। দেশান্তরিত সব মানুষকে বেআইনী অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয় এবং বলা হয় যে সরকার বাধ্যতামূলক নাগরিক তালিকা তৈরি করতে পারবে। ঐতিহাসিক কারণে যারা বিভিন্ন সময়ে দেশান্তরিত হয়ে ভারতে এসেছে, থেকেছে, সন্তানের জন্ম দিয়েছে, মেধায় শ্রমে বিকাশ ঘটিয়েছে অনেক গ্রামগঞ্জের, ধীরে ধীরে মিশে গেছে, ভোটার হয়েছে, বাকি সকলের মতোই কর্তব্য পালন আর অধিকার ভোগ করে এসেছে -- এরা সকলেই এক ধাক্কায় বেআইনী অনুপ্রবেশকারী হিসেবে পরিগণিত হবে এই সংশোধনীতে। সংসদে প্রায় বিরোধিতাহীনভাবে নিঃশব্দে এই সংশোধনী পাশ করাতে পেরেছিল বিজেপি। এ ছিল বাজপেয়ি জমানায় এক নিপুন সার্জিকাল স্ট্রাইক।

এখন বিজেপি হাজির হয়েছে তার পরের চাল নিয়ে। ‘সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট বিল, ২০১৬’ বা ক্যাব। নতুন এই সংশোধনী প্রস্তাব ভারতের সমাজে এক সুগভীর প্রভাব ফেলবে। কে আইনী ও কে বে-আইনী সে বিচার ধর্মের ভিত্তিতে করা হবে। যে সমস্ত মুসলমান তাঁদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবেন না তাঁরা বংশ পরম্পরায় বেআইনী অনুপ্রবেশকারী হিসেবে পরিগণিত হবেন। আদিবাসী বা অন্যান্য যে সমস্ত জনগোষ্ঠি নিজেদের “হিন্দু” হিসেবে নথীভুক্ত করতে চান না তাঁদেরকেও আইন একইরকম বৈরিতার চোখে দেখবে, ফলত তাঁরাও বাধ্য হয়ে “হিন্দু” হবেন। আর সংখ্যাগুরু হিন্দুরা নিজেদের বিপন্মুক্ত করতে বিজেপির সমর্থনে দাঁড়াবে। ২০০৩ সালের ক্যাবে যাদের বিপন্ন করা গেছিল তাঁরা এবার হাতের মুঠোয় এসে যাবে। এমনটাই ছক।

কিন্তু হিন্দুদের আশ্বস্ত করার দিকটিও একটি ধোঁকা মাত্র। যারা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক নাগরিক হয়ে উঠেছেন তাদের সকলকে নতুন সংশোধনী আরও এক ধাক্কায় বহিরাগত শরণার্থী বানিয়ে দেবে। সাধারণ মানুষকে ক্রমাগত বিপদগ্রস্ত না করে বিজেপি এগোতে পারে না। নতুন এই সংশোধনী বিল সম্পর্কে জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি(জেপিসি) ৮ জানুয়ারি ২০১৯ তাঁদের রিপোর্ট পেশ করে। সেখানে তাঁরা স্পষ্ট জানিয়েছেন যে এই সংশোধনী পাস হলে মোট ৩১,৩১৩ জন, যারা ইতিমধ্যেই আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন এবং লং টার্মভিসা গ্রান্ট করা হয়েছে, তাঁরাই উপকৃত হবেন।জেপিসির প্রশ্নের উত্তরে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) স্পষ্ট ভাষায় লিখে জানিয়েছে যে এই ৩১,৩১৩ জন ছাড়া “বাকি সকলকে এই ক্যাটেগরিতে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হলে তাঁদের প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা ধর্মীয় নিপীড়নের ফলে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন। ভারতে ঢোকার সময় যদি তারা একথা ঘোষণা করে না থাকেন তাহলে এখন সেরকম দাবি করাটা সহজ হবে না। ভবিষ্যতে এরকম দাবি এলে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে অবশ্যই তাকে RAW (র) সহ বিভিন্ন সংস্থার স্ক্রুটিনির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে”। আই বি আরও জানায় যে যাঁরা ইতিমধ্যেই ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, ইত্যাদি পেয়ে গেছেন তাঁরা এই ‘ক্যাব’ ক্যাটেগরিতে পড়বেন না এবং তাঁদের ওইসব কার্ড অবৈধভাবে করা কি না তা খতিয়ে দেখা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয় এবং তা করার জন্য ফরেনার্স ট্রাইবুনাল আছে (জেপিসি রিপোর্ট, ২ দাগের ১৭-১৯ পয়েন্ট, পৃষ্ঠা ৩৯)।

ক্যাব বা এনআরসি হওয়ার আগেই রাজ্যে রাজ্যে এমনকি জেলাগুলিতে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল চালু করার নির্দেশ জারি করে রেখেছে বিজেপি সরকার। প্রতিটি রাজ্যে অন্তত একটি করে ডিটেনশন ক্যাম্প নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছে। যারা বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে উপেক্ষা করে ক্যাবের আশ্রয় খুঁজবেন তারা নিজেদের আরও বিপদগ্রস্তই করে তুলবেন। বরং সাধারণ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে জোট বেঁধে ক্যাব, এনআরসি তথা বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা বিশেষ দরকার।

খণ্ড-26
সংখ্যা-32