প্রতিবেদন
এমনটা কি ঘটতেই হবে? রুখে দেওয়া যায় না?

১৯৩৬ সাল নাগাদ তোলা একটি সাদা-কালো ছবি। জার্মানীর এক জাহাজ তৈরির কারখানায় শয়ে শয়ে শ্রমিক দাঁড়িয়ে সারি বেঁধে। প্রত্যেকের ডান হাতটি ‘হেইল হিটলার’ বলার ভঙ্গিতে সামনে বাড়ানো। ব্যাতিক্রম একজন।

অগাস্ট ল্যান্ডমেসারের গল্প বলি শুনুন। বলা দরকার।

সেদিন হিটলার স্বয়ং এসেছিলেন সেই শিপইয়ার্ডে। কিন্তু ... জুম ইন, আবার জুম ইন, আরও জুম ইন ... একী! একজন পুরুষকে দেখা যাচ্ছে, যিনি দক্ষিণহস্ত প্রসারিত করেন নি। ‘হেইল হিটলার’ বলছেন না তিনি। ইনিই অগাস্ট ল্যান্ডমেসার। তিনি কি কোনো বিপ্লবী বীর?

নাঃ। ল্যান্ডমেসার প্রথম জীবনে নাজি পার্টিরই সদস্য হয়েছিলেন, যাতে একটা চাকরি পান। ক্ষমতাসীন পার্টির গা ঘেঁষে চললে চাকরি পাবে বা নিদেনপক্ষে সুরক্ষিত থাকবে, এই ভেবে পার্টি অফিসের সামনে ঘুরঘুর করে আমার-আপনার পাড়ার ছেলেপুলেরাও। তেমনই আর কী! ছাপোষা মানুষ। ছোট চাওয়া, ছোট ভয়, ছোট ছোট স্বার্থপরতা। এই সামান্য জীবনে একটি অসামান্য কাজ করেছিলেন ল্যান্ডমেসার। একজনকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিলেন। তাঁর নাম ইরমা একলার। একসঙ্গে থাকতে চেয়েছিলেন তাঁরা। বিয়ে, সন্তান ইত্যাদি সামান্য স্বপ্ন। অবৈপ্লবিক কিন্তু প্রেমে- মাখামাখি চাহিদা। যা পূরণ হয়নি।

ইরমা একলার ছিলেন ইহুদী। ১৯৩৫ সালে তাঁদের এনগেজমেন্ট হল। নেতাদের কানে সে খবর উঠতেই পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হলেন ল্যান্ডমেসার। তাতে অবশ্য তাঁর ভ্রুক্ষেপ ছিল না। বিয়েটা করেই ফেললেন । এক মাস পরে নতুন আইন চালু হল, যার মাধ্যমে জার্মান-ইহুদী অসবর্ণ বিবাহ-সকল নাকচ করার নির্দেশ এল। অগাস্ট আর ইরমা ভয় পেলেন, কিন্তু একে অন্যকে বর্জন করতে পারলেন না। ১৯৩৫ সালেই প্রথম কন্যা, ইনগ্রিদ, জন্মালো।

১৯৩৭ সালে পরিবারটি চেষ্টা করল ডেনমার্কে পালাতে। তখন ইরমা দ্বিতীয়বার অন্তঃসত্ত্বা। তাঁরা ধরা পড়ে গেলেন। বিচারে ল্যান্ডমেসার দোষী চিহ্নিত হলেন। দোষ হল, ‘নিজ জাতির অবমাননা’ (disgracing the race)।

সে যাত্রায় কোনোরকমে ছাড়া পেলেন, তবু স্ত্রীকে ছাড়তে পারলেন না। ১৯৩৮ সালে আবার গ্রেফতার হলেন ল্যান্ডমেসার। এবারে বিচারের রায়ে তাঁকে এক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হল আড়াই বছরের জন্য। অন্যদিকে গর্ভবতী ইরমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল প্রথমে জেলখানায়, তারপর একে একে তিনটে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বদলি হল তাঁর। ১৯৪২ সাল পর্যন্ত তাঁর চিঠি পেতেন ল্যান্ডমেসার। ক্রমে চিঠিও বন্ধ হল। ইরমার দ্বিতীয় সন্তান জন্মেছিল। আরেক মেয়ে, আইরিন। যাকে বাবা কোনোদিন দেখতে পেলেন না, যে শুধু বাবার ছবি দেখে বেড়ে উঠল। আনুমানিক ১৯৪২ সালে আরও ১৪০০০ জনের সঙ্গে হত্যা করা হয় ইরমাকে। ১৯৪৯ সালে সেই মৃত্যু ‘ঘোষিত’ হয়। ততদিনে নাজি বাহিনীর পরাজয় ঘটেছে। অন্যদিকে, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অগাস্ট ল্যান্ডমেসারকে পাঠানো হয়েছিল ‘স্ট্র্যাফ ব্যাটেলিয়নে’। ইংরিজি নাম ‘পিনাল ব্যাটেলিয়ন’৷ মানে ‘শাস্তিমূলক ব্যাটেলিয়ন’। এমন এক সৈন্যবাহিনী, যা রাষ্ট্রের চোখে ‘অপরাধী’দের নিয়ে গঠিত। অপ্রতুল অস্ত্রশস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে ‘স্ট্র্যাফ ব্যাটেলিয়ন’কে ভয়ংকর সব সামরিক মিশনে পাঠানো হত, যেখান থেকে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। এভাবেই রাষ্ট্র হত্যা করত তাদের।

assam

 

মনে করা হয়, ক্রোয়েশিয়ার যুদ্ধে মারা যান ল্যান্ডমেসার। তাঁর মৃত্যুও ঘোষিত হয় অনেক পরে, সেই ১৯৪৯ সালেই। বাচ্চা দুটি বড় হতে থাকে অনাথালয়ে। পরে ইনগ্রিদ মাতামহীর কাছে আশ্রয় পান। তিনি বাবার পদবী নিয়ে ইনগ্রিদ ল্যান্ডমেসার হন। আইরিনকে দত্তক নেয় এক পরিবার। তিনি বড় হয়ে মায়ের পদবী গ্রহণ করে হয়েছিলেন আইরিন একলার। ইনগ্রিদ আর আইরিনের বাবা-মার যে বিয়েকে রাষ্ট্র নাকচ করেছিল, তাকে রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত মানল বটে। কিন্তু বড় দেরি করে। ১৯৫১ সালে, তাঁদের মৃত্যুর পর। ১৯৯১ সালে সেই আশ্চর্য ছবি যখন প্রকাশিত হল, ইনগ্রিদ-আইরিনের চেনা ঠেকেছিল সেই ‘হেইল হিটলার’ না বলা অবাধ্য লোকটাকে। ১৯৯৬ সালে আইরিন লিখেছিলেন একটি বই। “গার্ডিয়ানশিপ ডকুমেন্টসঃ পারজিক্যুশন অফ আ ফ্যামিলি ফর রেশিয়াল ডিসগ্রেস”। সেখানে সংযুক্ত ছিল তার মায়ের চিঠিগুলিও। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বসে এক নারী চিঠি লিখছেন তাঁর পুরুষকে, যিনি বন্দী আরেক জেলখানায়। দুজনেই নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছেন। ভালোবাসা তবু মরে না! রাষ্ট্র পরিবার ভেঙে দেয়, সম্পর্কভেঙে দেয়। অনুভূতিরা অবিনশ্বর।

মেঘচ্ছায়াহীন এই দিনে অগাস্ট ল্যান্ডমেসারের গল্প মনে পড়ছিল। সাড়ে আটটায় ট্রেন ধরতে বেরোই রোজ। আমার পরিবার ঘুম জড়ানো চোখে ‘সাবধানে যেও’ বলে, বলে ‘টা টা মা’। ল্যান্ডমেসারের গল্পও এক পরিবারের অকিঞ্চিৎকর গল্প, যা বড় মানুষদের ইতিহাসে স্থান পায় না। আজ যখন ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হচ্ছে ভারতে, সাতটি ফুটবল মাঠের সমান, তখন খর রোদের দিনে ল্যান্ডমেসারের গল্প মনে পড়ল। ইতিহাসের পুনরাবৃত্ত হচ্ছে। এনআরসিতে মা-র নাম ওঠেনি, সন্তানের নাম আছে। স্বামীর নাম ওঠেনি, স্ত্রীর নাম আছে। কিংবা ধরুন বর-বউ দুজনেরই নাম নেই, কিন্তু ডিটেনশন ক্যাম্পে গেলে তাদের থাকতে হবে নারী ও পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট আলাদা আলাদা ক্যাম্পে। ভেঙে যাবে সম্পর্ক, সহযাপন, গেরস্তালি। রাষ্ট্র মানবসম্পর্কের তোয়াক্কা করে না। এমনকী আমরা যারা বামপন্থায় দীক্ষিত হয়েছিলাম, তাদেরও এঙ্গেলসের ‘ওরিজিন অফ ফ্যামিলি এন্ড প্রাইভেট প্রপার্টি’-নির্ভর এক পরিবার-বিরোধী তত্ত্ব শেখানো হয়েছিল, যেখানে পরিবার শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, যার মাধ্যমে ব্যক্তিগত সম্পত্তি কুক্ষিগত রাখা যায়। আমরাও কি পুরোপুরি বুঝব ল্যান্ডমেসারের মতো সাধারণ মানুষের স্বজনহারানোর দুঃখ, তজ্জনিত প্রতিস্পর্ধা? মানবসম্পর্কের সবটুকুকেই কি ইকনকমিক ডিটারমিনিজম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়?

আমার ডিপ্রেশন হয়, অসমে বা পশ্চিমবঙ্গে বা ত্রিপুরায় মানুষ তার ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলবে ভাবলে। একান্ত ব্যক্তিগত অবৈপ্লবিক ডিপ্রেশন। তা স্বীকার করতে কুণ্ঠা নেই এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে। কমরেডরা বলেন, কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তিই পৃথিবীতে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, ফ্যাসিবাদের পতন হবেই। তাঁদের ইতিহাসচেতনাকে শ্রদ্ধা করি। তবু ভাবি, সেই সময়ের মধ্যে এরকম স্বজন হারানোর আখ্যান গড়ে উঠবে আরও কত হাজার?

এমনটা কি ঘটতেই হবে? রুখে দেওয়া যায় না?

খণ্ড-26
সংখ্যা-37