সম্পাদকীয়
নারী পাচারে বাংলা শীর্ষে!

পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ রাজ্যের অতীত গৌরব নিয়ে মাঝেমধ্যে সরব হন, কষ্টকল্পিত চেষ্টা চালান সেই ঐতিহ্য স্মরণের সাথে তৃণমূলী শাসনের ‘মহতী প্রয়াসে’র এক বিমূর্ত মেলবন্ধন দেখাতে, এসব করতে গিয়ে অনেক সময় নিজেদের অত্যন্ত হাস্যকর অবস্থায়ও পর্যবসিত করেন। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব উপলক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর সম্ভাষণেও সেই চেষ্টা অত্যন্ত স্থূলভাবে ধরা পড়ল। মুখ্যমন্ত্রী দেশ-বিদেশের অতিথিদের, বিশেষত বলিউড-টলিউডের কিছু ঘনিষ্ঠ তারাদের সাক্ষী রেখে পরোক্ষে বলে বসলেন তৃণমূল শাসনে বাংলার-বাঙালীর প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন যেন ধন্য ধন্য হচ্ছে! কিন্তু এটা কি কেবল নিন্দুকদের অভিযোগ যে, এখানে চলছে এক ধরনের রাজনৈতিক-সামাজিক সন্ত্রাস আর সাংস্কৃতিক স্বৈরাচার, যার মিশ্র ‘আশীর্বাদে’ সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়েছে সামাজিক নৈরাজ্য, বংশবিস্তার করেছে মাফিয়া গুন্ডাদল সহ চেনা-অচেনা জাল-বিস্তারের কারবারীরা, তাদের এক মারাত্মক ব্যবসা হল, নারী পাচার।

পশ্চিমবাংলা এখন নারী পাচারে মহারাষ্ট্রের সঙ্গে যুগ্মভাবে শীর্ষস্থানে। সম্প্রতি গোয়া ভিত্তিক এক এনজিও-র নারী-উদ্ধার সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে এই তথ্য প্রকাশ হয়েছে। এখন তৃণমূল সরকার একে সত্যকাহিনী হিসাবে মেনে নেবে কিনা সেটা তার ব্যাপার, তবে প্রকাশ্যে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা এখনও দেখাতে পারেনি। ইতিপূর্বে কখনও এনসিআরবি রিপোর্ট, কখনও কোনো এনজিও রিপোর্ট অনুসারে বাংলা চিহ্নিত হয়েছে নারী সমাজের ওপর সংঘটিত অপরাধের তালিকায় কখনও এক-দুই-তিন নম্বরে পৌঁছে গেছে। এই কলঙ্ক তৃণমূল স্বীকারও করে না, আড়ালও করতে পারে না।

এআরজেড (‘অন্যায় রহিত জিন্দেগী’) সংস্থাটি রিপোর্ট তৈরি করেছে উদ্ধার করা মেয়েদের ওপর এক অধ্যয়ন চালিয়ে। দেখা গেছে, বাংলার প্রায় সব জেলা থেকেই মেয়ে পাচার হয়, তবে কয়েকটি জেলা সবচেয়ে পাচারপ্রবণ। শেষোক্ত জেলাগুলি হল, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, কলকাতা। এআরজেড-এর দাবি এই সংস্থা গোয়া পুলিশের সাহায্য নিয়ে উদ্ধার কাজ চালায়। ২০১৪ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে উদ্ধার হওয়া মেয়েদের সংখ্যা ৩৫৩। এদের মধ্যে শহুরে ৬৬ ও গ্রামীণ ৩৪ শতাংশ; কখনও স্কুলে না যাওয়া ২০, নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়া ৩০.৫, দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ১৫.৬ শতাংশ; অবিবাহিত ৩৫.৭, বিবাহিত ২৪, বিবাহিত অথচ আলাদা থাকা ২০.৩, বিবাহ বিচ্ছিন্ন ১০.৬, লিভ ইন রিলেশনশিপ ৫.৪ ও বিধবা ৪ শতাংশ। পাচারকারীদের মধ্যে অচেনা ২৩.৩, সহকর্মী ১০.৯ ও পার্টনার ৫.৫ শতাংশ। ৬৫.২ শতাংশ জানিয়েছে এ ফাঁদে পা দেওয়ার পেছনে কারণ হল, ঘরে তীব্র আর্থিক অনটন। এছাড়া ভরসা পাওয়ার মতো কর্মসংস্থান না থাকা, অপরিণত বয়সে ‘বন্ধুত্বে’র হাতছানিতে পা দিয়ে, সাজানো বিয়েতে ফেঁসে গিয়ে, একেবারে পরিবারের কাছের আত্মীয় বা পাড়া-পড়শীর দ্বারা প্রতারিত হয়ে, হোটেল-ক্যাটারিং-এর কাজ করতে গিয়ে বা মেলায় ঘুরতে গিয়ে পাচার হতে হয়েছে। বিশেষত শহর থেকে পাচার হয়ে যাওয়ার পিছনে এক অদ্ভুত কারণ হল, একদল ছেলের সাথে মেয়েরা ঘুরতে কলকাতা থেকে গোয়া পাড়ি দেয়, বাড়িতে হয়ত বলে যায় বেড়াতে বা নাচগানের বরাতে যাচ্ছে, তারপরে সেখান থেকে হারিয়ে যায় অজানা বড়শিতে আটকে গিয়ে। মেয়ে পাচারের পিছনে এসবই বৃত্তান্ত।

রাজ্যের তৃণমূল সরকার নারী পাচারের ভয়াবহ বৃদ্ধির তথ্য পরিসংখ্যান প্রথমত এত বড় মাত্রায় মানতে রাজি নয়, আর দ্বিতীয়ত নিজেরা কোনো সমীক্ষা করেনই না। যদি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোয়, মুখ পোড়ার ভয় সেখানেই। কিন্তু এত ধামাচাপা দিয়ে, মুখে কুলুপ এঁটেও পারছে না পাচারের তথ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়া এবং সরকারের প্রতি সমালোচনার মুখ বন্ধ করতে। কিছু প্রশ্ন-তর্ক-বিতর্ক তুললেই মুখ্যমন্ত্রী মহাশয়া ঝাঁপি খোলেন মহিলাদের জন্য কত কী করা হয়েছে বা হচ্ছে বলে। ‘কন্যাশ্রী’-‘রূপশ্রী’-‘যুবশ্রী’ প্রকল্প তৈরি ও সেসবের সুবাদে মেয়েদের উপকৃত হওয়ার কথা। বা থানায় মহিলা সেল তৈরির উদাহরণ দেন। কিন্তু প্রকল্প-সুবিধা মানে তো শুধু এককালীন কিছু অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ মাত্র, কোনো স্থায়ী আর্থিক নিরাপত্তার উপায় নয়, যেটা হতে পারতো যদি মেয়েদের অবস্থা বা যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানে ছেয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিত। তার উপর নারী কমিশন, মানবাধিকার কমিশন লাটে তুলে দিয়েছেন। একটু গুরুত্ব দিয়ে নারীপাচার প্রবণ এলাকাগুলোতে বিশেষ মোকাবিলার নজীর স্থাপন তো করা যায়, দোষীদের গ্রেপ্তার করে যাতে সহজে বের হতে না পারে সেরকম কঠিন সাজা দেওয়া যায়, যা দেখে দাগীদের মনে ভয় ঢুকবে আর মেয়েদের সাহস-সচেতনতা বাড়বে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তৃণমূলের শাসনে পাচারকারীরা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে চাঙ্গা থাকছে, বেপরোয়া হচ্ছে। কোথাও কোথাও শাসক দাদা আর থানার অফিসারবাবুদের সহায়তাও মেলে, মেলাচ্ছেন, তাঁরা মেলাচ্ছেন।

খণ্ড-26
সংখ্যা-36