শাহিনবাগের পাশে দাঁড়ান, দিল্লীতে বিজেপির সাম্প্রদায়িক অভিযানকে পরাস্ত করুন

দিল্লী হল ভারতের রাজধানী, তা হল ক্ষমতার কেন্দ্র যেখানে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা বৈষম্যমূলক, বিভেদমূলক এবং বিপর্যয়কর সিএএ-এনআরসি-এনপিআর প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে সংবিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন। দিল্লী হল সেই স্থান যেখানে রয়েছে দেশের শীর্ষ বিচারালয় আর এই বিচারালয়েই চলছে এই ভয়ংকর চক্রান্তের বিরুদ্ধে এক আপিল। দিল্লী হল সেই নগর যেখানে রয়েছে শাহিনবাগ যার নাম এখন ঘরে-ঘরে পৌঁছেছে, যা এক অনুপ্রেরণা সঞ্চারি মডেল হয়ে উঠে সারা দেশে শত-শত শাহিনবাগের জন্ম দিয়েছে। শাহিনবাগ এক শান্তিপূর্ণ, সৃজনশীল এবং গঠনমূলক প্রতিবাদের অভূতপূর্ব ধরনের নিদর্শন হয়ে উঠেছে, যে প্রতিবাদ নারী ও শিশুদের অবিশ্বাস্য শক্তি ও উদ্দীপনায় উদ্বেলিত হচ্ছে। দিল্লী আবার সেই স্থান যেখানে এই সপ্তাহের শেষের দিকে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং যেখানে ভারতের শক্তিশালী শাসক দল এক কদর্য নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে ইসলামোফোবিয়া ভিত্তিক গরল উগরে চলেছে এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের প্রকাশ্যেই হুমকি দিচ্ছে এবং তাদের ওপর সহিংস হামলা চালাচ্ছে।

যে উদ্ধত এবং স্বৈরাচারী সরকার এখন ভারত শাসন করছে, শাহিনবাগ এবং চলমান আন্দোলনগুলো যে তাদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করেছে তা নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। এই সরকার ভারতের শিশু ও নারীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে বরাবরই বড়-বড় কথা বলেছে। সরকার বিশেষভাবে মুসলিম নারীদের জন্য কুমিরের কান্না কাঁদছে এবং তাদের ন্যায় ও প্রগতির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। আমাদের “বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও” শ্লোগান উপহার দেওয়া এবং তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ করে আইন তৈরির জন্য নিজেদের পিঠ চাপড়াতে এই সরকার কখনই ক্লান্ত হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে “কৃতজ্ঞ” মুসলিম নারীদের সমর্থন লাভের দাবি তারা করে থাকে। কিন্তু এই তরুণী ও নারীরাই যখন প্রতিবাদে অবস্থান করছে, তখন তাদের কলঙ্কিত করা এবং হিংসাতে উস্কানি দিয়ে তাদের কন্ঠকে দমন করা ছাড়া অন্য কিছু তারা ভাবতে পারে না। নির্বাচনের মরশুম বিজেপির কাছে ‘গালাগালি’ আর ‘গুলির’ মরশুম হয়ে উঠেছে। একের পর এক সভায় অনুরাগ ঠাকুর, আদিত্যনাথ এবং অমিত শাহর মতো বিজেপি নেতাদের আমরা বিদ্বেষপূর্ণ কথার ফুলঝুরি ফোটাতে দেখছি আর কোমল শর্মা, গোপাল শর্মা ও কপিল গুজ্জরের মতো লোকজনদের প্রতিবাদরত ছাত্রছাত্রী এবং মহিলাদের উপর হামলা চালিয়ে তাদের ঐ কথাগুলোকে বাস্তবে রূপায়িত করতে দেখছি।

saheen

 

প্রতিটি গণতন্ত্রেরই কেন্দ্রে থাকে প্রতিবাদ। আমাদের জনগণের ক্লান্তিহীন প্রতিবাদ ও লড়াই ব্রিটিশ শাসন থেকে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। জনগণের লাগাতার প্রতিবাদ কয়েকটি রাজ্যে এবং কেন্দ্রে জনগণের আস্থা হারানো সরকারগুলোকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। প্রতিবাদ আবার বেশ কিছু সরকারকে জনবিরোধী আইন ও পদক্ষেপ প্রত্যাহারে বাধ্য করেছে। এমনকি প্রথম পর্বের মোদী সরকারকেও দেশব্যাপী কৃষকদের প্রতিবাদের মুখে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন ছাড়াই জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসতে হয়েছিল, আর দ্বিতীয় দফার মোদী সরকারকে ঝাড়খণ্ড নির্বাচনের আগে আদিবাসীদের ক্রমবর্ধমান ক্রোধকে প্রশমিত করার জন্য আদিবাসী ও বনে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনাকে মুলতুবি রাখতে হয়েছিল, এবং এখন তাদের আবার সিএএ-এনআরসি-এনপিআর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সারা ভারতে এনআরসি চালু করার পরিকল্পনা সম্পর্কে মিথ্যাচার করতে হচ্ছে। যে নেতা প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পুলিশকে প্ররোচিত করেন এবং যিনি ‘আজাদি’র শ্লোগান অথবা জাতীয় পতাকা এবং সংবিধানের প্রস্তাবনার মধ্যে ‘দেশদ্রোহ’ দেখতে পান তিনি গণতন্ত্রের কলঙ্ক, এই ধরনের নেতারা আসলে দুর্বৃত্ত  এবং যে কোনো নির্বাচনী পদের পক্ষেই সম্পূর্ণ রূপে অযোগ্য।

এই প্রতিবাদগুলো যখন চলছে তখন আমরা এমন একটা বাজেট পেলাম যা অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কায় টলমল করা জনগণের দুর্ভোগ-যন্ত্রণায় চূড়ান্ত রূপে অসংবেদী এবং যাকে কথা এবং পরিসংখ্যানের আমলাতান্ত্রিক খেলা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। সাধারণ জনগণের দুর্দশার উপশমের কোনো উদ্যোগ বাজেটে নেই, কর্মসংস্থান সৃষ্টি অথবা ন্যূনতম মজুরি এবং সামাজিক নিরাপত্তার কোনো সংস্থানও তাতে নেই এবং ফসলের ন্যায্য মূল্য ও ঋণ থেকে মুক্তির কৃষকদের দাবিকে  তা আরো একবার উপেক্ষা করেছে। সরকারী সম্পদকে বেসরকারী হাতে হস্তান্তরিত করার উপর তীব্র গুরুত্ব প্রদানই বাজেটে দেখা গেছে। রেল, তেল কোম্পানি এবং এয়ার ইন্ডিয়ার পর বেসরকারীকরণের নজর সরকারের এবার পড়েছে ভারতের বীমা শিল্পে সবচেয়ে বিশ্বস্ত নাম লাইফ ইনসিওরেন্স কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার উপর।

কিছু মানুষ মনে করেন, সিএএ-এনআরসি-এনপিআর-এর ধাঁধাটা বর্তমানের জরুরী অর্থনৈতিক ইস্যুগুলো থেকে জনগণের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়া এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের চরম ব্যর্থতা ও বিশ্বাসঘাতকতাকে আড়াল করার একটা কৌশল। এটা একেবারেই ঠিক নয়। সংবিধান এবং নাগরিকত্বের ওপর আক্রমণটা অর্থনৈতিক সংকটের মতোই বাস্তব এবং মারাত্মক। এই দুটি বিষয় নিয়ে প্রতিবাদকে আলাদা করা এবং একটিকে অন্যটির বিরুদ্ধে দাঁড় করানোটা আমাদের কাজ নয়, দরকার উভয় বিষয় নিয়ে প্রতিবাদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করা এবং প্রতিটি ব্যর্থতা ও দুরভিসন্ধিমূলক পদক্ষেপের জন্য সরকারকে দায়বদ্ধ করা। আমাদের জাতীয় ঐক্য, সাংবিধানিক অঙ্গীকার এবং নাগরিকত্বের উপর সিএএ-এনআরসি-এনপিআর-এর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং বেকারি ও বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, এই দুই ধরনের প্রতিবাদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করা যায় এবং তা অবশ্যই করতে হবে। বাস্তবিকই, ‘আজাদি’র শ্লোগান এবং সংবিধান ও গণতন্ত্রের সুরক্ষার জন্য লড়াই আমাদের সবাইকে ক্রমেই বেশি করে ঐক্যবদ্ধ করছে।

শাহিনবাগে এবং সিএএ-এনআরসি-এনপিআর নকশার বিরুদ্ধে চলমান প্রতিবাদে অভূতপূর্ব মাত্রায় মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ দেখা গেছে। বর্তমানের রাজনীতিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের কন্ঠস্বর এবং প্রতিনিধিত্বকে দমন করার প্রণালীবদ্ধ প্রয়াসকে তুচ্ছ করে ঐ সম্প্রদায় অভূতপূর্ব প্রতিবাদ আন্দোলনে ফেটে পড়েছে, এমন মাত্রায় তাদের অংশগ্রহণ হয়েছে যা ভারতে এর আগে দেখা যায়নি। এটা উল্লেখ্য যে, তাৎক্ষণিক তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধ বলে বিবেচনা করে সংসদ যখন দানবীয় আইন পাশ করে, মুসলিম সম্প্রদায়কে তখন এই মাত্রায় প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়নি; সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে ফৌজদারি অপরাধ বলে সাব্যস্ত করে এবং ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে গোপনে মসজিদের ভিতর রামলালার মূর্তি স্থাপনকে মসজিদ কলুষিত করে মুসলিম সম্প্রদায়কে মসজিদে প্রার্থনা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রয়াস বলে অভিহিত করে—এ সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্ট যখন বাবরি মসজিদ ইস্যুতে এক অসন্তোষজনক রায় দেয়, তখনও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিবাদের ব্যাপ্তি এই মাত্রায় হয়নি। মুসলিমদের বর্তমান প্রতিবাদগুলো তাদের এক আত্মঘোষণা, এবং তা কোনো ধর্মীয় ইস্যুতে ভারতীয় মুসলিমদের ধর্মীয় পরিচিতির অথবা সম্প্রদায়ের নিজস্ব কোনো উদ্বেগের আত্মঘোষণা নয় – তা বরং হল সংবিধান-বিরোধী প্রবল আক্রমণের মুখে ভারতীয় সংবিধান এবং ভারতের মিশ্র সংস্কৃতির উপর এবং সেগুলির প্রতি অঙ্গীকারের সমান এবং সম্মিলিত অংশীদারিত্বের দাবির নতুন করে আত্মঘোষণা। এই আক্রমণ ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য এবং ব্যাপক আকারে দরিদ্রদের অধিকারের বঞ্চনাকে নিয়ে আসছে। ভারতীয় মুসলিমদের এই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আত্মঘোষণা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও হিন্দুদের জোটবদ্ধ করার বিজেপির চক্রান্তে সহায়তা যোগাতে পারে, এমন ভাবনায় উদ্বিগ্ন হলে চলবে না; বিপরীতে, আজ প্রতিটি গণতন্ত্রীর সামনে যে কর্তব্যকর্ম হাজির হয়েছে তা হল, সিএএ-এনআরসি-এনপিআর-এর ভয়াবহ তাৎপর্য সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে অবহিত ও শিক্ষিত করা এবং জনগণের এই ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থানে তাদের সবাইকে সমাবেশিত করা। আমাদের উচিৎ, মুসলিম সম্প্রদায়কে অভিনন্দন জানানো, কেননা, এত প্ররোচনা, কুৎসা ও দমন সত্ত্বেও তাঁরা এত জোরে ও এত লক্ষণীয় রূপে এবং অমন অবিচলতা ও দৃঢ়তার সাথে বিপদটাকে জানান দিয়েছেন, এবং জনগণের এই ঐক্যবদ্ধ ও ক্রমবর্ধমান অভ্যুত্থানে জনগণের সমস্ত অংশকে শামিল করাটাও আমাদের কর্তব্য। দিল্লীর সাধারণ জনগণের ওপর আমাদের এই আস্থা রয়েছে যে, চলমান প্রতিবাদগুলো এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দিল্লীর নির্বাচনে মেরুভবন ঘটানোর বিজেপির দুরভিসন্ধিমূলক চক্রান্তকে তাঁরা প্রত্যাখ্যান করবেন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাংবিধানিক অধিকারের পক্ষে এক জোরালো রায় দেবেন।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০)

খণ্ড-27
সংখ্যা-3