সারা ভারত কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির বিবৃতি : গ্রামীণ চাহিদা ও ক্রয়ক্ষমতা যা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারতো তা বৃদ্ধিতে ব্যর্থ বাজেট

দিল্লী, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২০: গ্রামীণ চাহিদা ও ক্রয়ক্ষমতা যা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারতো তা বৃদ্ধিতে ব্যর্থ বাজেট- পরিবর্তে কেবল বড় কর্পোরেট ও বহুজাতিক সংস্থাগুলোর মুনাফা বাড়াচ্ছে। এই বক্তব্য এআইকেএসসিসি-র।

ভারতীয় অর্থনীতির আশু প্রয়োজন যখন গ্রামীণ চাহিদা ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো সুতরাং গ্রামীণ রোজগার বৃদ্ধি তখন এই বাজেট সেই ক্ষেত্রের কোনো বৃদ্ধিবিকাশের সুযোগ আনেনি। ২০১৯-২০-তে কৃষি, সেচ ও গ্রামোন্নয়নের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ২.৬৮ লক্ষ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে তা যৎসামান্য বেড়ে হয়েছে ২.৮৩ লক্ষ কোটি টাকা। মুদ্রাস্ফীতিকে হিসাবের মধ্যে ধরলে প্রকৃত অর্থে এই বৃদ্ধির পরিমাণ শূন্য।

এটা কৃষকদের আয়, সঞ্চয়, খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবিকার কোনো উন্নতি ঘটাবেনা—বর্তমান অতিমন্দা থেকে অর্থনীতিকে টেনে তুলতে যেগুলো অত্যাবশ্যক। গ্রামীণ জীবিকার সবথেকে বড় প্রকল্প মনরেগা-র অর্থবরাদ্দ ৭১০০১ কোটি (২০১৯-২০ সংশোধিত হিসাব) থেকে নেমে ২০২০-২১ এ ৬১৫০০ কোটি টাকা হয়েছে অর্থাৎ যখন রাজ্যগুলি থেকে এই খাতে মোট প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার চাহিদা ছিল তখন প্রায় ৯৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হল। গ্রামোন্নয়নের ধ্বজাধারী পিএম-কিষাণ প্রকল্পে ১২ কোটি কৃষকের উপকৃত হওয়ার কথা ছিল—অথচ মাত্র ৬০০০ টাকার বার্ষিক নিষ্ফলা অনুদানটুকুও এমনকি মাত্র ৬.১২ কোটি কৃষকের কাছে পৌঁছেছে। এমনকি ভাগচাষী ও ভূমিহীন কৃষিমজুররাও এই প্রকল্পের আওতাধীন নন। এদিকে কৃষিতে উৎপাদন খরচ বিগত পাঁচ বছরে প্রায় ৩৩—১০০ শতাংশ বেড়েছে আর জীবনধারণের খরচও দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।

বাজেট ২০২০ কৃষি উৎপাদন সামগ্রী সরবরাহ, ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বীমা ও বাজারজাত করার ক্ষেত্রে  আরো বেশি বহুজাতিক সংস্থা ও কর্পোরেট কুবেরদের হস্তক্ষেপের প্রস্তাব রেখেছে। উচ্চ উৎপাদন খরচ, নিম্ন বিক্রয়মূল্য, ফসলের সমস্যা জর্জরিত বিক্রি ও ক্ষয়ক্ষতি থেকে কৃষকদেরকে কোনোরকম নিষ্কৃতি দেয়নি এই বাজেট। কৃষকদের জমি লিজে নেওয়া, তাদেরকে ঋণভারে জর্জরিত করা, উৎপাদিত ফসল সস্তায় বিক্রি করা এবং খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণে ব্যাপক লাভ ওঠানোর মাধ্যমে কোম্পানিগুলির দ্বারা  কৃষকদেরকে কাজে লাগিয়ে নেওয়ার সংখ্যা বাড়বে।

বাজেট নথি এই সত্যি প্রকাশ করেছে যে, ঘোষণা আর প্রকৃত খরচের মধ্যে একটা বড় ফাঁক রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে প্রতিশ্রুতি ছিল ২২০০০ গ্রামীণ হাটকে গ্রামীণ কৃষিবাজারে (GrAM) উন্নীত করা হবে। কিন্তু দুইবছর পরেও এর বাস্তবায়ন শুরু হয়নি এবং এই তহবিলের মাত্র ০.৫% খরচ হয়েছে। ২০১৮-১৯ এ অর্থমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP) প্রত্যেক কৃষকের কাছে পৌঁছাবে এবং পিএম-আশা (PM-AASHA) প্রকল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৯-২০ তে মাত্র ১৫০০ কোটি টাকা এতে বরাদ্দ করা হয় এবং মাত্র ৩২১ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। সেই বরাদ্দ এবার কমে হল ৫০০ কোটি। বিগত দুইবছরে অধিকাংশ ফসলের ঘোষিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যই (MSP) কৃষকরা পাননি। এটাই ছিল বাজারে হস্তক্ষেপ ও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সময় কিন্তু সরকার এই কাজে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আরো একটি জ্বলন্ত উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ২০১৭-১৮ তে বাজেট বক্তৃতা ঘোষণা করেছিল যে, ‘ডেয়ারী পরিকাঠামো উন্নয়ন তহবিল’-এর ১০৮৮১ কোটি টাকা তিন বছরের মধ্যেই খরচ করা হবে। প্রকৃতপক্ষে খরচ হয়েছে মাত্র ৪৪০ কোটি টাকা। বর্তমান বাজেটে এই খাতে মাত্র ৬০ কোটি টাকা রয়েছে। একইভাবে ‘পিএম কৃষি সিঞ্চাই যোজনা’তে ক্ষুদ্র সেচের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৫০০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০-তে মাত্র ২০৩২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ২০২০-২১ এ এই বরাদ্দ কমে ২০০০ কোটি হয়েছে।

এই বাজেট রাজ্যগুলোকে জমির লিজ, কৃষকদের উৎপাদন ও পশুসম্পদ এবং চুক্তিচাষ ও বাজারজাতকরণ, খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ, ফসল সংরক্ষণ ও পরিবহণে বিনিয়োগ সংক্রান্ত তিনটি মডেল আইন কার্যকর করার ব্যাপারে সহযোগিতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। ফসলের বাজারজাতকরণ ও রপ্তানির জন্য প্রতি জেলায় একটি করে শস্যগুচ্ছের (ক্রপ ক্লাস্টার) প্রস্তাব রেখেছে এবারের বাজেট। যদিও এই মহাপ্রকল্পের জন্য আদতে কোনো অর্থবরাদ্দ হয়নি।

মনরেগা, গ্রামীণ মজুরি, পেনশন, সেচ ও ডিজেল, বিদ্যুৎ, বীজ, সারে ভর্তুকি অথবা ভূমিহীন কৃষক, ক্ষেতমজুর, ভাগচাষিদের সঙ্কটের বিষয়ে কোনো মজবুত প্রস্তাব নেই এবারের বাজেটে। যদিও অর্থমন্ত্রী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ভারতের যত্নের বিষয়ে বারংবার বলেছেন, তা সত্ত্বেও তিনি বেকারত্বের ক্রমবর্ধমান সমস্যা নিয়ে কিছুই বলেননি।

সরকার কৃষিঋণের পরিমাণ ১৫ লক্ষ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে কিন্তু এটা কেন্দ্রীয় বাজেটের কোনো অংশ নয়-- এটা ব্যাঙ্কগুলোর জন্য একটা লক্ষ্যমাত্রা। এই ব্যাঙ্কগুলো তাদেরকেই লোন দেয় যাদের উপর তারা সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু এমন কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন হয়নি যার দ্বারা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, ভাগচাষি, আদিবাসী কৃষকরা ঋণ পেতে পারেন, যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক অর্থলগ্নি ব্যবস্থার বাইরে পড়ে থাকেন এবং ঋণের বোঝার চাপে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। সুতরাং এই ঋণের অধিকাংশটাই যাবে বৃহৎ কৃষি-ব্যবসায় ও কোম্পানিগুলোর ব্যয়বহুল কৃষিসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি বিক্রিতে উৎসাহ দিতে। কৃষকদের জমি বন্ধক রাখা ঠেকাতে বাজেটে কোনো সহায়তা বা পদক্ষেপ নেই। অথচ এই সময়েই সরকার কর্পোরেটদের ২ লক্ষ কোটি টাকা অপরিশোধিত ঋণ মুকুব করেছে এবং তাদেরকে অতিরিক্ত ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা কর ছাড় দিয়েছে।

এটা প্রত্যাশিত ছিল যে, কৃষির ব্যাপক উৎপাদন খরচ C2-র উপর অন্তত ৫০ শতাংশ লভ্যাংশের সাম্মানিক এমএসপি (MSP) নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাজেট থেকে সহায়তা দেওয়া হবে এবং PM-AASHA প্রকল্প আরো কার্যকরী হবে। ঋণমুক্তি, শস্যহানির ক্ষতিপূরণ, হারিয়ে যাওয়া পশুর সুরক্ষা ও ফসলবীমার জন্য ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল। কৃষকদের সঙ্কটে বিগত তিন বছরে বেসরকারী কোম্পানিগুলো শস্যের বীমা থেকে ১৮৮৩০ কোটি টাকা লাভ করেছে।

সারা ভারত কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটি (AIKSCC) বাজেট সম্পর্কে সরকারের উপর ব্যাপক ক্ষোভ ব্যক্ত করছে এবং বলছে, “আমরা অত্যন্ত হতাশ। এই বাজেটে আমাদের দেশের কৃষকদের কোনো জায়গা নেই। মোদী সরকার এখনও পর্যন্ত কৃষকদের সাথে সেভাবে সম্পর্ক তৈরি করছেনা যেভাবে কোম্পানিগুলোর সাথে করেছে।”

বাজেটের কর্পোরেটমুখী প্রস্তাব, ক্রমবর্ধমান কৃষিঋণভার, উৎপাদন খরচকে নির্দেশ করতে ব্যর্থতা এবং ফসল বিক্রি থেকে সাম্মানিক মূল্য সুরক্ষিত করতে ব্যর্থতার প্রতিবাদে আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারী AIKSCC দেশব্যাপী প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে।

খণ্ড-27
সংখ্যা-3