স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও স্কুলের শিশুদের পুষ্টির দিকটি অবহেলিত
school children is neglected

সেটা ছিল ১৯২০ সাল। চেন্নাই এর মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন স্থির করল যে সেখানকার একটি স্কুলের বাচ্চাদের তারা বিনামূল্যে টিফিন দেবে। কিছুদিন পর দ্য হিন্দু পত্রিকায় এই নিয়ে একটা রিপোর্টবেরোল। ১৭ নভেম্বর ১৯২০-র সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে এই উদ্যোগের ফলে স্কুলে আসার প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

স্বাধীন ভারতে বাচ্চাদের বিনামূল্যে স্কুলে খাবার দেওয়ার সূচনা হয় তামিলনাড়ুতেই। সেটা ১৯৫৬-৫৭ শিক্ষাবর্ষ। তখন মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী কামরাজ। তামিলনাড়ুর সরকার সিদ্ধান্ত নিল সমস্ত পঞ্চায়েত ও সরকার পরিচালিত প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হবে। সরকার ছাত্রপিছু নিজেরা দেড় আনা দিত। বাকি টাকার একটা অংশ স্থানীয় উদ্যোগে সংগৃহীত হত। আর একটা অংশ দিত কেয়ার নামের একটি মার্কিন এনজিও। ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টি ও স্কুলে উপস্থিতি দুটো বাড়ানোর ব্যাপারেই এই স্কিম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিল।

১৯৮২ সালে এম জি রামচন্দ্রন যখন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী তখন প্রাথমিক স্কুলের পাশাপাশি অঙ্গনওয়ারির ছাত্রছাত্রীদেরও বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা শুরু হল। ১৯৮৪ সালে তামিলনাড়ুর সমস্ত স্কুলকেই এর আওতায় নিয়ে আসা হল। ১৯৮৪ সালে এই স্কিম সীমিত পরিসরে শুরু হল কেরালাতেও। ক্রমশ সেখানে এর পরিসর বাড়ানো হল।

তামিলনাড়ুতে এই স্কিমের নামকরণ নিয়ে রাজনীতির জগতে কিছু বিতর্কও উঠল। এম জি রামচন্দ্রনের নামে এই প্রকল্পের নাম রাখায় কংগ্রেস আপত্তি তুলল। তারা বলল এর শুরুটা করেছিলেন কামরাজ। তাই এই প্রকল্পর সঙ্গে কামরাজের নামকেই যুক্ত করা দরকার। কিন্তু এডিএমকে এই দাবি মানল না।

পরে যাঁরা তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন – করুণানিধি, জয়ললিতা বা স্ট্যালিন – সবাই এই স্কিমকে উন্নত করার ও বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। ২০২২ সালে মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন মিড ডে মিলের পাশাপাশি সমস্ত সরকারি স্কুলে বিনামূল্যে সকালের টিফিন বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন।

পাশের রাজ্য কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনরাই বিজয়ন সপ্তাহে দুদিন করে সমস্ত সরকারী স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ডিম ও দুধের বন্দোবস্ত করেছেন, যা রাজ্যজোড়া শিশুদের পুষ্টির বিকাশে যথেষ্ট সহায়ক হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

২০০২ সালের পর থেকে সারা ভারতের সমস্ত সরকারি স্কুলেই মিড ডে মিল স্কিম চলে। এখন এর নাম হয়েছে প্রধানমন্ত্রী পোষণ শক্তি নির্মাণ। ২০১৩ সালে ভারতে যে খাদ্য নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন করা হয়, মিড ডে মিল স্কিমকে তার মধ্যে নিয়ে আসা হয়। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়ারা এর আওতাভুক্ত। তবে এর পরিসরকে আরো বাড়িয়ে প্রাক প্রাথমিক স্তরের শিশু পড়ুয়াদেরও এর মধ্যে আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় বারো লক্ষ সত্তর হাজার স্কুলের বারো কোটি শিশু মিড ডে মিল স্কিমের দ্বারা উপকৃত। কিন্তু যে টাকা বরাদ্দ করা হয়, এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে তা ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর জন্য একেবারেই যথেষ্ট নয় বলে নানা মহল থেকে বারবার অভিযোগ ওঠে। যারা রান্নার কাজ করেন তাদের সাম্মানিকও সামান্য।

এই স্কিমের সামগ্রিক ব্যয়ভারের ৬০ শতাংশ কেন্দ্রীয় সরকারের ও ৪০ শতাংশ রাজ্য সরকারের দেবার কথা। কিছু রাজ্য সরকার নির্দিষ্ট বরাদ্দের পাশাপাশি অতিরিক্ত টাকার জোগান দিয়ে চেষ্টা করেন সমস্যা কিছুটা মেটানোর, খাবারের মান উন্নত করার, মিড ডে মিল কর্মীদের ভাতা বাড়ানোর। তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে অনীহা দেখিয়ে চলেছেন। অনেক দাবি দাওয়ার পর এখন এই রাজ্যের মিড ডে মিল কর্মীদের ভাতা হাজার টাকা থেকে সামান্য বাড়িয়ে এখন দেড় হাজার টাকা করা হয়েছে। ভাতার অঙ্কটা আরো বেশ কিছুটা বাড়ানোর দাবিতে কর্মীরা প্রায়ই আন্দোলন ডেপুটেশন সহ নানা কর্মসূচিতে সামিল হন। কিন্তু সরকারি তরফে না দেখা যায় ভাতা বাড়ানোর উদ্যোগ, না দেখা যায় মিড ডে মিল স্কিমের খাবারের গুণমান বাড়ানোর জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর আয়োজন।

অথচ বাজারে শাক-সব্জি, তেল, মশলাপাতি, গ্যাস, পরিবহণের খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় মিড ডে মিলের খাবার তৈরির খরচ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। মিড ডে মিল চালাতে সরকার যে টাকা দেয় তা দিয়ে মান বৃদ্ধি দূরে থাক, ছাত্রছাত্রীদের মুখে আর আগের মতো খাবারও তুলে দিতে পারছে না অনেক স্কুলই। নানা কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে। খাবারের গুণমানের সঙ্গে সমঝোতা করতেও বাধ্য হচ্ছে অনেক স্কুল। খরচ কমাতে অনেক জায়গায় মিড ডে মিলে খাবারের পরিমাণ কমাতে হচ্ছে। একটু কমদামি সব্জি কিনে রান্না করা হচ্ছে। গ্যাসের বদলে কাঠ অথবা কয়লার উনুনও ব্যবহার হচ্ছে অনেক জায়গায়। সব থেকে বেশি সঙ্কটে পড়েছে ছোট স্কুলগুলো। বড় স্কুলে ছাত্রসংখ্যা বেশি হওয়ায় তাদের আর্থিক বরাদ্দ বেশি। সব ছাত্র প্রতিদিন স্কুলে আসে না। তাতে কিছুটা সুবিধা। ছাত্রসংখ্যা কম হওয়ায় ছোট স্কুলের সে সুযোগ নেই। সে জন্যে ছোট স্কুলগুলো মিড ডে মিল চালাতে বেশি পরিমাণে হিমসিম খাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে সরকার যাতে নজর দিতে বাধ্য হয়, তা নাগরিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের বিষয় হওয়া দরকার।

- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-29
সংখ্যা-33