টিকাব্যবস্থার ভয়াবহ পরিস্থিতি
Immunization situation dire_0

এবছর জানুয়ারি মাসের কর্ণাটকের বেলাগাভি জেলার রামদুর্গতালুকের তিনটি শিশু মিসলস রুবেলা বা হামের টিকা নেওয়ার পর মারা যায়, সেখানকার প্রজনন ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (আরসিএইচও) ঈশ্বরাপ্পা গোদ্দা স্বীকার করেছেন যে এই তিনজন শিশু নিশ্চিতভাবেই স্বাস্থ্যকর্মীদের অবহেলার শিকার, এবং যা প্রাথমিক টিকা নির্দেশিকা লঙ্ঘনকারী অপরাধ। এই ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টে একটি পিআইএল পর্যন্ত দাখিল হয়। এর আগের অন্যসব তথ্যের মধ্যে উল্লেখ্য ২০১০ সালের এপ্রিল থেকে অন্ধ্র প্রদেশ (খাম্মাম জেলা) এবং গুজরাটের (ভদোদরা জেলা) শিশুদের উপর এইচপিভি ট্রায়ালের বিষয়টি, যার ফলে সাতজন শিশুর মৃত্যু হয়েছিল, ফলত দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রীয় ও রাজ্য উভয় সরকারের টিকা ব্যবস্থায় ব্যর্থতা, অনিয়ম এবং দুর্নীতি উন্মোচিত হয়ে চলেছে।

প্রসঙ্গত ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকে, বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা গুটিবসন্ত নির্মূলের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে অনেক আলোচনার পর, বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদ (ডব্লুএইচএ) গুটিবসন্ত নির্মূল করার জন্য একটি প্রস্তাব পাস করে, যা আগামী বছরগুলিতে সমগ্র বিশ্বে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারগুলির এক্টিভিটির গতানুগতিক অভ্যাস বদলে দেয়। এর প্রভাবে ভারত সরকার ১৯৬২ নাগাদ ভারত পাক ও ভারত চীন যুদ্ধের আবহে ন্যাশনাল গুটিবসন্ত নির্মূল কর্মসূচি (এনএসইপি) শুরু করে, মূলত যার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল পরের তিন বছরের মধ্যে সফলভাবে সমগ্র জনসংখ্যাকে টিকা দেওয়া।

১৯৭৭ সালে ইমার্জেন্সির ঠিক পরে ভারতকে গুটিবসন্ত মুক্ত ঘোষণা করার সাথে সাথে, ভারত সরকার ১৯৭৮ সালে বিসিজি, ওপিভি, ডিপিটি এবং টাইফয়েড-প্যারাটাইফয়েড টিকা চালুর মাধ্যমে বর্ধিত বা এক্সপ্যান্ডেড প্রোগ্রাম অফ ইমিউনাইজেশন (ইপিআই) নামে জাতীয় স্তরের টিকাদান কর্মসূচি চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটাকে জাতীয় স্তরে প্রথম কেন্দ্রীয়ভাবে প্ল্যানড পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়।

এর পরেই ১৯৮৫ সালে, প্রোগ্রামটি ‘ইউনিভার্সাল ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রাম’ (ইউআইপি) হিসাবে সংশোধন ও পুনঃসজ্জিত করা হয়েছিল যাতে ১৯৮৯-৯০ সালের মধ্যে দেশের সমস্ত জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পর্যায়ক্রমে কাজ করার কথা ছিল। বহু বছর ধরে চালু থাকা সত্ত্বেও, ইউআইপি কেবলমাত্র প্রথম বছরে মাত্র ৬৫ শতাংশ শিশুকে সম্পূর্ণরূপে টিকা দিতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া তেমন কোনো সদর্থক উদাহরন পাওয়া যায় না।

মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মিশন ইন্দ্রধনু চালু হয়েছিল যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হল দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশু এবং গর্ভবতী মহিলাদের জন্য সমস্ত উপলব্ধ টিকা দিয়ে সম্পূর্ণ টিকাকরণ নিশ্চিত করা। সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে টিকা বণ্টন ও প্রয়োগে মোদী সরকারের ব্যর্থতা প্রকাশ হওয়া স্বত্বেও মোদী সরকার এখন প্রচার করে যে তাদের সরকারে আসার আগে পূর্ণ টিকাকরণের কভারেজের বৃদ্ধি ছিল বছরে ১শতাংশ যা মিশন ইন্দ্রধনুর প্রথম দুটি ধাপের মাধ্যমে প্রতি বছর ৬.৭শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মোদী সরকারের দাবি মিশন ইন্দ্রধনুর চারটি পর্যায় ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছিল এবং ২.৫৩ কোটিরও বেশি শিশু এবং ৬৮ লক্ষ গর্ভবতী মহিলাকে টিকা দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এবছর ফেব্রুয়ারি মাসে, সরকার আইএমআই-এর চতুর্থ পর্যায় চালু করে এবং টীকা প্রদানে ভারতের অভূতপুর্ব সাফল্য প্রচার করতে থাকে। কিন্তু সত্যি কথা হল যে ইউনিসেফ এবং ডব্লিউএইচও ভারত সরকারকে একটি সতর্ক বার্তা দিয়েছে কারণ দেখা গেছে ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী টিকা কভারেজ হ্রাস পেতে থাকে, ভারতে এই হ্রাসের মান বিশ্বে সর্বাধিক এবং সবথেকে বিপদজ্জনকভাবে চোখে পড়ার মতো, তথ্য অনুযায়ী ২৫ মিলিয়ন শিশু জীবনরক্ষাকারী টিকা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

ডব্লিউএইচও এবং ইউনিসেফের প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে প্রায় ৩০ বছরের মধ্যে শৈশবে টিকা দানের গ্যাপ সবচেয়ে বেশি মোদীর জমানাতেই।

২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ডিপথেরিয়া, টিটেনাস এবং পার্টুসিস (ডিটিপি) এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের তিনটি ডোজ গ্রহণকারী শিশুদের শতকরা হার ৫ শতাংশ পয়েন্ট কমে ৮১ শতাংশে নেমে এসেছে এবং শুধু ২০২১ সালেই নিয়মিত টিকাদানের হিসাবে আড়াই কোটি শিশু ডিটিপির এক বা একাধিক ডোজ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক অপর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ভারতে ডিপথেরিয়া-টিটেনাস-পার্টুসিস (ডিটিপি) যৌথ ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজটি টিকা না নেওয়া বা না পাওয়া শিশুদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এই সংখ্যা ২০১৯ সালের ১৪ লাখ থেকে বেড়ে ২০২১ সালে ২৭ লাখে দাঁড়িয়েছে।

কাজেই মোদী সরকারের গাল ভরা আত্মপ্রচার ও আত্মপ্রচারের প্রতিযোগিতায় থাকা রাজ্যসরকারী ট্র্যাপ এড়িয়ে টিকাব্যবস্থার ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে জনমত সংগঠিত করতে হবে আমাদের, কারন বিনামূল্যে ও নিঃশর্তে সময় অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জীবনদায়ী টীকা পাওয়া নাগরিকের ন্যূনতম অধিকার।

- সংগ্রাম মন্ডল

খণ্ড-29
সংখ্যা-33