সমমানের শিক্ষার অন্যতম বা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হল প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা
One of the most important i

প্রাথমিক উচ্চ-প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার মাধ্যম ও শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উচ্চ মধ্যবিত্ত তথা বিত্তবানদের জগতে ধরেই নেওয়া হয়েছে ইংরেজিতে দক্ষ না হলে জগৎ সভায় উচ্চাসনে বসা যাবে না। ফলে সেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করাই উচিৎ। পুঁজিবাদি কাঠামোয় ধনীর ইচ্ছাই ইচ্ছা, তা নির্ধনকে যতই কোণঠাসা করুক না কেন। বরং নির্ধন কোণঠাসা হলেই সুবিধে। রাষ্ট্র বা সরকার যদি সত্যিই সকলের জন্য সমমানের শিক্ষা প্রদানে আগ্রহী হয়, তাহলে বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার মাধ্যম, ভাষা শিক্ষা ও শিক্ষক বাছার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কুশলী বন্দোবস্ত করতে হবে ও নিয়োগ করতে হবে। এই নিবন্ধের লেখক পড়ুয়াদের সমস্যা অনুধাবন করতে সক্ষম হলেও তার সমাধানের পথ বাতলাতে সক্ষম নয়। ভারতে সংবিধানের অষ্টম তালিকায় ২২টি ভাষা আছে, যার মধ্যে ইংরেজি নেই। কিন্তু ইংরেজির গুরুত্বকেই অভিজাত সমাজ সব থেকে বেশি দিয়ে থাকে। ফলে তালিকায় থাকলেই তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও নয়। যেমন সান্তালি বা মৈথিলি ভাষা ওই তালিকায় থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ডে সান্তালি ভাষার মাধ্যমে কিংবা বিহারে মৈথিলি ভাষায় পড়াশোনা করা প্রায় অসম্ভব। ওই ভাষায় পড়ানোর শিক্ষক তৈরি করার কোনো প্রচেষ্টাই সরকারগুলি গ্রহণ করে না। ফলে ওই সমস্ত ভাষাভাষী পড়ুয়ারা অন্য ভাষায়, বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে পড়তে বাধ্য হয় ও অসুবিধেয় পড়ে।

অষ্টম তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য আরো ৩৮ টি ভাষার (ইংরেজি সমেত) দাবি রয়েছে, যেমন ভোজপুরি, কামতাপুরি, কার্বি, লেপচা প্রভৃতি। ভোজপুরি ভাষার ফিল্মি জনপ্রিয়তা থাকলেও পড়াশোনার মাধ্যম হিসেবে তা গণ্য হয় না। লেপচা ভাষা পশ্চিমবঙ্গের পাহাড় অঞ্চলে যথেষ্টই গ্রাহ্য, কিন্তু সেই মাধ্যমের বিদ্যালয় নেই। কামতাপুর বা কার্বিতে স্বায়ত্বশাসন নিয়ে প্রবল আন্দোলন হলেও ওই ভাষাগুলি ব্রাত্যই থেকেছে। সীতাকে নিয়ে যতই উন্মাদনা তৈরি করা হোক না কেন মৈথিলী নিয়ে কোনো হেলদোল নেই। বর্তমান শাসক তো ‘ওয়ান ইন্ডিয়া’ করতে গিয়ে আঞ্চলিক ভাষাকে চুলোয় পাঠাতে চাইছে।

education in one's own language

উচ্চবিত্তরাও মনে করেন যে দেশে একটা সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা থাকা দরকার, সেটাকেই মূল শিক্ষার মাধ্যম করতে হবে। তাঁদের ইতিহাস ভূগোল জ্ঞানের দরকার পড়ে না। ইউরোপে ৪৪টা দেশ আছে যাদের রয়েছে প্রায় অর্ধশত ভাষা। প্রায় সব দেশ বা অঞ্চলই নিজ নিজ ভাষায় বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭টি দেশের ২৪টি ভাষা আছে। ইইউ সুসংবদ্ধ একটি ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে, যেখানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলাচল, কাজ খোঁজা অবাধ। তাঁরা কেউই নিজেদের ভাষাকে বিসর্জন দেয়নি। মনে রাখা দরকার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জনসংখ্যা ৪৫ কোটি, ভারতের তিন ভাগের এক ভাগেরও কম; সামগ্রিক ইউরোপের জনসংখ্যা ভারতের জনসংখ্যার অর্ধেকের থেকে ৫ কোটি বেশি।

ফলে ভারতের সমস্ত শিশুকে যদি যথাযথ ভাবে শিক্ষিত করে তুলতে হয়, শিক্ষার মাধ্যমকে সেই শিশুর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে, যাতে শিশু ঘরে যেই ভাষায় বাক্যালাপ করে, বিলাপ করে, আনন্দ করে, খেতে চায় সেই ভাষাতেই সে পড়তে পারে। তার জন্য শিক্ষকের বন্দোবস্ত করতে হবে।  যারা সর্বত্র লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের প্রচারক তারা নিজেদের সন্তানকে নিজস্ব পছন্দের মাধ্যমে পড়ার বন্দোবস্ত করে, কিন্তু দরিদ্র অন্য ভাষাভাষী পড়ুয়াদের অজানা অচেনা ভাষায় পড়তে বাধ্য করে। সকলের জন্য সমমানের শিক্ষার অন্যতম বা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হল প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা।

- অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-36