তৃণমূলের ‘দুর্নীতিময়’ পশ্চিমবঙ্গ বনাম বিজেপির ‘ধর্ষকময়’ ভারত
BJP's rape India

চোর চোর রব উঠেছে দেশ জুড়ে। দুর্নীতি পাকড়াও করতে ৬ বছর আগে ১০০০ ও ৫০০ টাকার নোট বাতিল করা হয়েছিল। কালো টাকাও ধরা পড়েনি, কালো টাকার মালিকরাও বহাল তবিয়তে থেকে গেছে। বড় টাকার নোট বাতিল করে সব কালোকে ব্যাঙ্কে ঢুকিয়ে ফর্সা করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে সেগুলো সব ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে পার্থ, অর্পিতা, অনুব্রতদের ঘরে সেঁধিয়েছিল। ইডির ‘দক্ষ’ অফিসাররা সেসব বস্তাবন্দী নোটদের কারামুক্ত করছে, যেমনটা গুজরাট সরকার বিলকিস বানোকে ধর্ষণ ও তাঁর ৩ বছরের শিশুর হত্যাকারী ১১ জনকে রেহাই দিয়ে দায়মুক্ত করেছে, তেমনি। ওদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাধিক সোচ্চার দল ‘আপ’কেও কাঠগড়ায় তুলেছে সিবিআই, দিল্লীর উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ শিশোদিয়াকে অভিযুক্ত করা হয়েছে আবগারি দুর্নীতির দায়ে। মনে রাখা দরকার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই’এর মেসিয়া ‘আন্না হাজারে’র ইন্ডিয়া এগেইনস্ট করাপশনের কালো টাকা, ২-জি দুর্নীতি, কয়লা দুর্নীতির বিরোধী লড়াই’এর বিভিন্ন সেনাপতিরা দুটি ভাগে ভাগ হয়েছে; বিজেপি ও আপ। বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বাবা রামদেব, বুজরুকির ওষুধ বানিয়ে হাজারো কোটি টাকা লুটেছেন, কোভিডে তার পৌষমাস হয়েছে। শ্রীশ্রী রবিশঙ্কর’ও আছেন, যিনি যমুনার তটকে কলুষিত করেছিলেন। এছাড়া, কেজরিওয়াল গড়ে তুলেছে আপ, দখল করেছে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রীর তখত। আন্নাজি তার কাজ পুরো করে, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে সটকে পড়েছেন। মাঝে মাঝে অনশনের হুমকি দিলেও সেটি আর করা হয়ে ওঠেনি। পছন্দের দল ক্ষমতায় থাকলে দুর্নীতি হলেও কী আর যায় আসে।

মহারাষ্ট্রে এনসিপি’র নবাব মালিক, শিবসেনার সঞ্জয় রাউত, কর্ণাটকে কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতি ডিকে শিবকুমারদের ইডিকে দিয়ে জেলে পাঠানোর পরে এরাজ্যে পার্থ চ্যাটার্জীকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। সিবিআই কেষ্টকে হেফাজতে নিয়েছে, মনীশ শিশোদিয়াকেও নিতে চাইছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ওদিকে বিলকিস বানুর ধর্ষক ও তাঁর তিন বছরের মেয়ের হত্যাকারীদের সাজা মকুব করে জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছে গুজরাট সরকার, তারা নাকি সচ্চরিত্তির ব্রাহ্মণ। শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইন কানুন সর্বনেশে তো হবেই। বিজেপি করলে সাত খুন মাফ, গণধর্ষণ বা শিশু খুন তো তুচ্ছ ব্যাপার! এই যে, কাগজে মুড়ে শুভেন্দুকে নারদ মামলায় টাকা নিতে দেখা গেল, তাকে কি ধরা হয়েছে? ম্যাথু স্যামুয়েলের দেওয়া ওই টাকাটা পবিত্র ও আইনসঙ্গত ছিল! শুনছি বীরভূমের হাটে যে গরু বেচা হত, সেগুলি নাকি আসত রাজস্থান, হরিয়ানা থেকে। ওইসব রাজ্যে বিজেপি সরকার ছিল গত ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, রাজস্থানে পাল্টেছে তারপরে। গরু পাচার হচ্ছে জেনে বুঝেই সেসব পাঠানো হত। ওখানকার ‘প্রভাবশালী’দের কে ধরবে? না, ওরা বিজেপি, তাই গরু পাচারের সহযোগী হলেও ‘নির্দোষ’। বীরভূম থেকে গরু যেত মুর্শিদাবাদে, সেখান থেকে বাংলাদেশে, সীমান্ত পেরিয়ে। তেমনটাই জানতে পারা যাচ্ছে। কিছুকাল আগে পর্যন্ত তৃণমূলের কোন নেতা মুর্শিদাবাদের দায়িত্বে ছিলেন? মুর্শিদাবাদের পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে বহরমপুর পুরসভা পর্যন্ত জোর করে তৃণমূলের ক্ষমতা দখল করার কারিগর সেই নেতাটির অনুমোদন ছাড়া মুর্শিদাবাদ থেকে গরু পাচার হোত? এমনটা বললে তো ঘোড়াও হাসবে। তাহলে সেই প্রাক্তন তৃণমূলী বর্তমান বিজেপি দলপতিকে কেন ধরা হচ্ছেনা? তিনিইতো সিবিআই’এর সঙ্গে সহযোগিতা করে বহু তথ্য দিতে পারবেন। কিন্তু, তিনি যে বিজেপির জামা পরে নিয়েছেন। আর কি ধরা যায়!

দুর্নীতিবিরোধী লড়াই’এর জার্সি গায়ে দিয়ে ফ্যাসিবাদকে কায়েম করার চেষ্টা জারি আছে। এই ভারতে মূলধারার শক্তিশালী রাজনীতিবিদরা দুর্নীতি করে, ঘুষ খায়, ধর্ষণ করে, খুন করে ও করায়, তোলা তোলে এগুলো মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। সেই দুর্নীতি ও ঘুষের সরাসরি আঘাত দেশের সমস্ত ধরণের মানুষের উপরে লাগে, ধর্ম, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে। ফলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই’এর মেসিয়া সেজে বিজেপি ভোট কুড়োতে ব্যস্ত। পিএম কেয়ারের টাকা, নির্বাচনি বন্ড, মহারাষ্ট্র-মধ্যপ্রদেশ-কর্ণাটকে বিধায়ক কিনে সরকার ফেলার দুর্নীতি জায়েজ; মাসাধিক সময় ৫০ জন মহারাষ্ট্রের বিধায়ককে গৌহাটিতে পাঁচতারা হোটেলে ভরণ পোষণ করানো একদম নীতিনিষ্ঠ। সেই বিজেপি নাকি দেশের দুর্নীতিরাজকে উৎখাত করবে, যেমনটা তৃণমূল কংগ্রেস করেছে শিক্ষাক্ষেত্রে ‘অনিলায়ন’ নামক নিয়োগ দুর্নীতির অবসানের নামে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা জুড়ে ‘পার্থ’য়েনিয়ামের আগাছার জঙ্গল সৃষ্টি করে; যেমন মোদীজী নারীকে সম্মান দেন বিলকিস বানোর ধর্ষক ও তাঁর শিশুকন্যার হত্যাকারীদের সাজা মকুবে নীরব সম্মতি জানিয়ে।

গত এগারো বছরের তৃণমূল শাসন এটা জানিয়ে দিয়েছে তৃণমূল আর যাই করুক না কেন, দুর্নীতির বিষয়ে ‘আপস’ করবে না, দুর্নীতি করবেই করবে। খেয়াল করে দেখুন, ২০১৯ নির্বাচনের পরে ‘কাটমানি’ ফেরত দেওয়ার তৃণমূলী প্রক্রিয়া। এমন ভান যেন দুর্নীতিহীন রাজনীতি করবেন তারা। কিন্তু বিড়াল তপস্বী সাজলেও মাছ সে খাবেই। মাত্র ৩ বছর পরেই নিত্যনতুন দুর্নীতির ঢাকনা খুলছে। তবে, এটাও ভাবার, দুর্নীতি না করলে, তোলা না তুললে কেউ তৃণমূল করবে কেন? যাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনো ইতিহাস নেই, আজাদীর দৃষ্টিভঙ্গী নেই, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-অংশ-সম্প্রদায়-স্তরের প্রতি আনুগত্য নেই, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী কোনো নীতিগত দৃঢ় অবস্থান নেই, কোনো সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভাবনা নেই, তেমন দলের কর্মী সমর্থক নেতারা তোলা তুলবে না, ঘুষ খাবে না, সরকারি চাকরি পেতে বা দিতে অসদুপায় গ্রহণ করবে না — এমনটা তো হতে পারে না। বিরোধী তৃণমূল নেত্রীর ঘোষিত একমেবদ্বিতীয়ম কর্মসূচি ছিল সিপিআই(এম)-এর অপশাসনের ‘অবসান’ ঘটানো। অঘোষিত ছিল, তৃণমূলের ঘুষ-তোলাবাজির দুর্নীতিময় ‘সুশাসন’ চালু করা। রাজ্যে এখন সেটাই চলছে। সারদা-রোজভ্যালি-আইকোর-নারদটেট-এসএসসি-কয়লা পাচার-গরু পাচার একের পর এক দুর্নীতির উদঘাটন জানিয়ে দিচ্ছে যে, দুর্নীতি ছাড়া তৃণমূলের অস্তিত্বের অসম্ভবতা। কিন্তু, সময়টা এমনই ভয়ানক যে, এতদসত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী বিরোধী তৃণমূলকে অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না।

- অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-33