প্রতিবেদন
আধার–ভোটার কার্ড সংযোগের ফলে শুধু নির্বাচনকেই প্রভাবিত করা হবে না, গণহত্যাও হতে পারে
Aadhaar-voter card

২০০১ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে গুজরাটের একটা ছোট কোম্পানি এক সাংবাদিককে ডেকে পাঠায় তাঁদের ব্যাঙ্গালোরের অফিসে। বলা হয় মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন সমস্ত গুজরাটবাসীর জন্য একটা চিপ লাগানো স্মার্টকার্ড তৈরি করতে, যারমধ্যে সেই ব্যক্তির সমস্ত তথ্য, মানে নাম, ঠিকানা, বয়স, রক্তের গ্রুপ ইত্যাদি থাকবে। এই কার্ডটি খুব তাড়াতাড়ি মানে আগামী দু’মাসের মধ্যে তৈরি করে ফেলতে হবে, সেইজন্যই এই মিটিং। তাঁরা সেই সাংবাদিককে আরও বলেন, গুজরাটের অফিসারেরাও দিনরাত এক করে কাজ করছেন। সরকারী সুযোগ-সুবিধা কীভাবে মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে এই কার্ডটির মাধ্যমে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাবে। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে মোদী মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন এবং তারপর তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এই কাজটা শুরু হয়েছে। এটা তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প।

এর ঠিক তিন মাস পর গোধরায় ট্রেনে অগ্নিকান্ড। তার কিছুদিন পর থেকে শুরু হয়ে যায় ‘গুজরাট গণহত্যা’। কিছু কিছু জায়গায় তাণ্ডব চলে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে। যে সমস্ত মিডিয়া এই বিষয়টা রিপোর্ট করেছে এবং যতগুলো তদন্ত কমিশন বসেছে প্রত্যেকেই বলেছে যে কীভাবে তালিকা ধরে ধরে মিলিয়ে, বাড়ি থেকে টেনে বার করে মারা হয়েছে। বাড়ি থেকে টেনে বের করে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং তারপর সেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে মুসলমানদের বাড়ির দরজায় ঢ্যাঁড়া চিহ্ন দেওয়া হয়, তার পরদিন সেই বাড়িগুলোকে ধরে ধরে আক্রমণ করা হয়। কিভাবে মানুষকে জ্যান্ত পোড়ানো হয়েছে তা আমরা দেখেছি। বাকিটা ইতিহাস। যে স্মার্ট কার্ডগুলো জরুরি ভিত্তিতে বানানো হয়েছিল, সেগুলো এই দাঙ্গা এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা সেটা কি বুঝতে অসুবিধা হয় আজ?

এই ইতিহাস হয়তো অনেকের জানা, আবার অনেকের কাছে এই তথ্য হয়তো নতুন। এর পাশাপাশি, আরও একটা তথ্য দেওয়া যাক। ২০০৯ সালে ইউপিএ সরকার একটি প্রকল্প আনে, যে মানুষদের কোনও পরিচয়পত্র নেই, সেই মানুষদের জন্য একটি পরিচয়পত্র আনা হয় ‘আধার’। দেখা গিয়েছিল সেই সময়ে ০.০৩ শতাংশ মানুষদের জন্য এই প্রকল্প আনা জরুরি। তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, এই আধার নামক বিষয়টির কোনও গুরুত্ব নেই। তারপর ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে, সেই নরেন্দ্র মোদীই ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে একজন মানুষের ফোন, ড্রাইভিং লাইসেন্স সহ সমস্ত কিছুর সঙ্গে আধারকে যুক্ত করার কাজে জোর দেন। বলা হয়, সরকারী সমস্ত সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য আধার বাধ্যতামূলক। ১০০ দিনের কাজ বা গ্যাসের ভর্তুকি বা অন্য যেকোনো প্রকল্প, যার মাধ্যমে সরকারী টাকা একজন সাধারণ নাগরিকের ব্যাঙ্কে পৌঁছবে, তার অন্যতম চাবি হচ্ছে আধার। ধীরে ধীরে আধার প্রায় সমস্ত নাগরিকের সমস্ত পরিচয়পত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, এমনকি যেসব ক্ষেত্রে সরকারি সুবিধা যুক্তও নয়, যেমন ব্যক্তিগত ট্যাক্স জমা দেওয়ার জন্য প্যান বা ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনেও আধারকে চাপ দিয়ে যুক্ত করা হয়। সর্বোচ্চ আদালত তাঁদের রায়ে যদিও বলেছেন, যে শুধুমাত্র সরকারি সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্র ছাড়া আর অন্য কোনও কিছুতে আধারকে যুক্ত করা যাবে না, তা সত্ত্বেও এই সংযুক্তির কাজ করা হয়। এই মুহূর্তে আইন করে আধার এবং ভোটার কার্ডের সংযোগের কথা বলা হয়েছে। সংসদের দু’কক্ষে, প্রায় কোনও আলোচনা ছাড়াই এই আইনকে পাশ করানো হয়েছে। এই সময়ে যাঁরা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করেন, তাঁদের বেশিরভাগ মানুষই তাঁদের ব্যক্তিগত ফোন থেকে তা ব্যবহার করেন। সেখানে অনেকেই সরকারের সমালোচনা করে থাকেন। ফলে ফোনের সঙ্গে যদি আধার যুক্ত করা থাকে, এবং সেই মানুষটির বাসস্থানও যেহেতু আধারের ডেমোগ্রাফিক তথ্যভান্ডারে সংরক্ষিত আছে, তাই একজন মানুষকে চিহ্নিত করা এখন অত্যন্ত সোজা কাজ। তাঁদের উদ্দেশ্য অত্যন্ত পরিষ্কার, আধার দিয়ে একটি কেন্দ্রীভূত তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা, এবং ভোটের কার্ডকে তারসঙ্গে যুক্ত করে যাঁরা সরকার বিরোধী, বা যে সমস্ত মানুষ এই সরকারকে ভোট নাও দিতে পারে, তাঁদের বাদ দেওয়া। নির্বাচকদের ধর্ম এবং জাতি দেখে দেখে চিহ্নিত করে, তারপর তাঁদের বাদ দেওয়া হবে, এটা আজকে আর কষ্টকল্পনা নয়।

বেশ কিছুদিন আগে আরটিআই করা হয়েছিল ইউআইডিএআইকে, তাতে দুটি প্রশ্ন করা হয়।

১) আধার দিয়ে কি ঠিকানা, জন্মতারিখ প্রমাণ করা যাবে? বা আধার কি কোনও পরিচয় বহন করে?
২) সিআইডিআর বা যেখানে আধার তথ্য সুরক্ষিত থাকে বলে জানা গেছে সেখানে যদি কোনও একজনের বায়োমেট্রিক্স দিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, যে এটা কি সেই ব্যক্তি? তাহলে তাঁরা কি সেই ব্যক্তির আধার নম্বর বার করে আনতে পারে?

এই দুটো প্রশ্নের উত্তরেই তাঁরা জানিয়েছে যে তাঁরা বলতে পারেন না আধার কোনও পরিচয়পত্র কিনা। তাঁরা এটাও বলেন যে কোনওভাবেই এটা বলা সম্ভব নয়, যে কোনও একজন মানুষের আধার নম্বর তাঁর বায়োমেট্রিক্স’এর সঙ্গেই যুক্ত করা আছে। তাহলে কি দাঁড়ালো আধার কোনও পরিচয়পত্র নয়, এবং এরমধ্যে কোনও অনন্যতা নেই।

গত নির্বাচনে এই বিষয়ে প্রথম পদক্ষেপ করা চালু হয়েছে, যাদের ভোটার লিস্টে নাম আছে কিন্তু ভোটার কার্ড নেই তাদের জন্য প্রথমবার অন্যান্য আরও দশটা পরিচয়পত্রের সঙ্গে আধারকেও মান্যতা দেওয়া হয়েছে। এতে কোথায় অসুবিধা? আধার কোনও পরিচয়পত্র নয় কারণ আধার মূলত তৈরি করা হয়েছে অন্তত দুটো প্রাথমিক পরিচয়পত্র দেখিয়ে। দ্বিতীয়ত আধারে কারুর সই নেই আধার কারুর দ্বারা প্রত্যয়িত নয়, আধার ডেটাবেস পরীক্ষিত নয় তাহলে এটা কেন করা হল? যেখানে কত ভুয়ো আধার আছে তাই জানা নেই, সেখানে তা দিয়ে কি করে ভুয়ো ভোটার কার্ড বাতিল করা হবে? তাহলে কি এই ভুয়ো আধার দিয়ে ভোটকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে না আরও গভীর কোনও উদ্দেশ্য আছে?

আসলে, যদি সমস্ত তথ্য একটি কেন্দ্রীভুত জায়গায় আনা যায়, তাহলে যার হাতে এই তথ্য থাকবে, সে কি শুধু চিহ্নিত করে গণহত্যা করবে, না ভোট নিয়ন্ত্রণ করবে সেটা সেই ঠিক করবে। একজন মানুষের সমস্ত তথ্য যদি এক জায়গায় আনা যায় এবং সেটা যদি একটি সংখ্যা হয় তাহলে সেই সংখ্যাকে মুছে ফেলা তো অত্যন্ত সাধারণ বিষয়। যদি খবর নেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের নির্বাচনের সময়ে ৩৮ লক্ষ এবং ২৩ লক্ষ মানুষের শুধু ডেমোগ্রাফিক তথ্য এবং বায়োমেট্রিক তথ্য দিয়ে তাঁদের ভোটার তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই আধার এবং ভোটার কার্ডের সংযোগের বিষয়টি যদি ছোট স্তরে এবং আঞ্চলিকভাবে প্রতিরোধ তৈরি করে আটকানো না যায়, তাহলে আগামীদিনে সমূহ বিপদ হবে। সেইখান থেকেই উদাহরণ তৈরি করে সারা রাজ্যব্যাপী এই আন্দোলন যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তবেই রাষ্ট্রকে মানুষের শক্তি সম্পর্কে জানান দেওয়া সম্ভব।

- সুমন সেনগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-36