আজকের দেশব্রতী : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati_29 sept 2022

 Kisan Mahasabha

সারা ভারত কিষাণ মহাসভা (এআইকেএম)-র ৪র্থ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল ২৩-২৪ সেপ্টেম্বর বিহারের বিক্রমগঞ্জে। একদিকে ১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহের অন্যতম রূপকার বীর কুমার সিংহের জন্মস্থান ভোজপুরের জগদীশপুর গ্রাম অন্যদিকে কৃষক আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেতা তথা কিষাণ সভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সহজানন্দ সরস্বতীর কর্মস্থল পাটনা জেলার বিহটা গ্রাম, মধ্যস্থলে বিক্রমগঞ্জ। ঐতিহাসিক অনুষঙ্গের এই বিক্রমগঞ্জ সমসাময়িক কালেও প্রত্যক্ষ করেছে বিশাল বিশাল কৃষক অভ্যুত্থান। গত শতকের ৬০-এর দশকের শেষ থেকে ৭০ দশক অবধি ভোজপুর অঞ্চলে ভূমিহীন দরিদ্র কৃষক ও দলিত জাগরণের যে ঢেউ তা স্পর্শ করেছিল রোহতাস জেলার বিক্রমগঞ্জকেও। আর অতি সম্প্রতি ২৬ জানুয়ারি ২০২১ কৃষকদের ট্রাকটর মিছিলে দিল্লী যখন অবরুদ্ধ তখনও তাঁদের সমর্থনে আরা থেকে বিক্রমগঞ্জ হয়ে সারা বিহার জুড়ে সংগঠিত হয়েছিল হাজার কিলোমিটার লংমার্চ। সুতরাং বিক্রমগঞ্জ ছিল সম্মেলনের জন্য আদর্শ জায়গা এবং হাজার হাজার কৃষকের উপচে পড়া ভিড়ে ঠাসা কিষাণ মহাপঞ্চায়েতে সার্থকভাবে তুলে ধরা হল, “জমি, কৃষি, কৃষক বাঁচাও/ কর্পোরেট লুটের জমানাকে ধ্বংস কর” — এই আহ্বান।

Conference of Kisan Mahasabha

কৃপাল সিংহ বীর সভাগার (ইন্দু তপেশ্বর মহিলা কলেজ)-এর, পবন শর্মা নগর (বিক্রমগঞ্জ, রোহতাস)-এ অনুষ্ঠিত দু-দিনব্যাপী এই সম্মেলনে দেশের ১৯টি রাজ্য থেকে মোট ৫১৫ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। এদের মধ্যে ২৫ জন ছিলেন মহিলা। এছাড়াও ৬০ জন পর্যবেক্ষক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে কৃষকের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টির পাশাপাশি গরিব ভাগচাষি ও চুক্তিচাষিদের কৃষকের মর্যাদা ও স্বীকৃতির দাবি সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। সম্মেলনে সস্তায় কৃষি সরঞ্জাম সরবরাহের সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহারের দাবি সহ ছ-দফা দাবিসনদ গৃহীত হয়। রুলদু সিং ও রাজারাম সিং যথাক্রমে সর্বভারতীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে পুনর্নির্বাচিত হন।

monetization pipeline

গভীর আর্থিক সংকটের আবর্তে খাবি খাচ্ছে মমতার সরকার। রাজ্য সরকারের রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ হতে পারে ৬২,৩৯৭ কোটি টাকা আর চলতি অর্থবর্ষে আনুমানিক রাজস্ব ঘাটতি ২৮,২৭৯ কোটি টাকায় এসে দাঁড়াবে। এরমধ্যে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’, ‘স্বাস্থ্য সাথী’, ‘কন্যাশ্রী’ সহ নানা ধরনের কল্যাণকর প্রকল্পের জন্য রাজ্যের রাজকোষ থেকে প্রতি বছর খরচ হচ্ছে ২৮,০০০ কোটি টাকা। এরমধ্যে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’এর জন্য ব্যয় হচ্ছে ১৪,০০০ কোটি টাকা, ৭,০০০ কোটি টাকা চলে যাচ্ছে ‘কৃষক বন্ধু’ ও ৪,৫০০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে ‘খাদ্য সাথী’ প্রকল্পের জন্য। এ’ছাড়া, রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতি মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পের উপর বড্ড বেশি নির্ভরশীল। এই মরাপন্ন অবস্থায় এবার হাইকোর্টের রায় খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়াল। আদালতের রায় মেনে ৩১ শতাংশ ডিএ দিতে খরচ হতে পারে প্রায় ২৩,০০০ কোটি টাকা।

এই যখন হাঁড়ির হাল, তখন রাজ্য সরকার সস্তায় জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে পুজো-পার্বনে ক্লাবকে দরাজ হাতে অর্থবিতরণ বজায় রেখেই চলল শত সমালোচনাকে থোড়াই কেয়ার করে। এটা বাস্তব যে মমতা সরকারকে বিপাকে ফেলতে একশ দিনের প্রকল্প বাবদ যে তহবিল এই রাজ্যের জন্য ধার্য করার কথা তা নির্দয়ভাবে ছাঁটকাট করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই প্রকল্পটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে মোদী সরকারের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এই প্রকল্প খাতে অর্থবরাদ্দ না করায় ২০২১’র ডিসেম্বর থেকেই বেশ কিছু রাজ্যে ১০০ দিনের কাজ থমকে রয়েছে। আর, কেন্দ্রীয় গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রকের রিপোর্টথেকেই দেখা যাচ্ছে, এই একশ দিনের কাজ বাবদ সারা দেশে বিভিন্ন রাজ্যের জন্য যে বকেয়া রয়েছে, তার ৬৫ শতাংশই হল এ’রাজ্যের! কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যকে আরও নির্দেশ দিয়েছে, যে পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েতের হোমড়া-চোমড়া ওই বরাদ্দ টাকা নয়ছয় করেছে, তাদের কাছ থেকেই টাকা উদ্ধার করে বকেয়া খরচ মেটাতে হবে।

ঋণের ফাঁদে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো মমতা সরকার এবার নিল দ্বিমুখী কৌশল। এক, ফিসকাল রেসপন্সিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট’কে সংশোধন করে আরও বেশি ঋণ নেওয়ার রাস্তা পরিষ্কার করল, আর দুই, মোদীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজ্য সরকারের সম্পত্তি বেচে রাজকোষ ঘাটতি পূরণ করতে জমি বেচার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলল। জমি বেচার মধ্য দিয়ে রাজ্য সরকার ৮,০০০ কোটি টাকা নিজের কোষাগারে তুলে নেবে এমনই রয়েছে তার পরিকল্পনা। আর সেই টাকা দিয়ে মমতা সরকার তার কল্যাণমুখী প্রকল্পগুলো চালু রাখতে চাইছে।

গোটা রাজ্য জুড়ে এখন পর্যন্ত ৩২টি জমির খন্ড চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ স্তরে — মমতার আর্থিক উপদেষ্টা ও প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, মুখ্যসচিব, অর্থসচিব ও মুখ্যমন্ত্রী নিজে। এরআগে, আর্থিক সংকট যুজতে রাজ্য সরকার বাণিজ্যিক ও আবাসন ক্ষেত্রের জন্য লিজে জমি দেয় বেসরকারি সংস্থার হাতে। কিন্তু এ’বার সরাসরি রাজ্যের সম্পদকে বিক্রি করার মনিটাইজেশন পাইপলাইনের বঙ্গীয় সংস্করণ বেছে নেওয়া হল। ২০১৩ সালে রাজ্য পরিবহন দপ্তর বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য কলকাতা ট্রাম কোম্পানির ‘অব্যবহৃত’ জমি নিলামে চড়ায়। কিন্তু এই প্রথম এতো বিপুল পরিমাণ জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার।

কোথায় কোথায় এই সমস্ত জমিকে চিহ্নিত করা হয়েছে? কলকাতা কর্পোরেশনের ১০৮নং ওয়ার্ডেচৌবাগা রোডে ১০ একর জমি, আলিপুরে ৫.৫ একর প্রাইম ল্যান্ড, এছাড়া বেলুড়-দুর্গাপুর- বর্ধমান-ডানকুনি সহ রাজ্যের আরও নানা প্রান্তে জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে।

আকন্ঠ ঋণজর্জর রাজ্য সরকারের সমান্তরালে চলছে বিরাট এক ধূসর জগতের পঙ্কিল অর্থনীতি। যার, নেপথ্য নায়কেরা রাজ্যের মন্ত্রিসভা সহ ক্ষমতার অলিন্দে থাকা দাপুটে রাজনীতিবিদ সহ এক শক্তিশালী কায়েমী চক্র। পুলিশের নানা স্তরের কর্তাব্যক্তিরাও যারসাথে জড়িত। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দায় অস্বীকার করতে পারেন না।

সরকারি সম্পত্তি বেচে কোষাগার ভরানোর মোদীর অনুসৃত মনেটাইজেশন পাইপলাইনের এই বঙ্গীয় সংস্করণ আগামী দিনে কী ফল (নাকি বিষ ফল) ফলাবে তার অপেক্ষায় চোখ রাখা যাক।

Modi-Adani

নরেন্দ্র মোদীর ৭২তম জন্ম বার্ষিকীর আগের দিন ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁর ঘনিষ্ঠতম পুঁজিপতি বন্ধুগৌতম আদানি ফোর্বস-এর রিয়েল টাইম বিলিয়োনেয়ার তালিকা অনুসারে পৃথিবীর দ্বিতীয় ধনীতম ব্যক্তি হিসাবে আবির্ভূত হন।তবে, সেটা ছিল স্বল্প সময়ের জন্য এবং কিছু সময় পরই অবশ্য তাঁকে তৃতীয় স্থানে চলে যেতে হয়। তাঁর সম্পদের নীট মূল্য হল ১৫২.২ বিলিয়ন ডলার, আর বিশ্বে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন ফরাসি ব্যবসায়ী ধনপতি বার্নার্ড আরনল্ট এবং মার্কিন উদ্যোগপতি এবং ই-কমার্স সংস্থা অ্যামাজন-এর প্রতিষ্ঠাতা জেফ বোজেস। তবে, তালিকার সবচেয়ে ওপরে রয়েছেন আমেরিকার উদ্যোগপতি এবং বিদ্যুৎ চালিত মোটরগাড়ি টেলসার সিইও এলন মাস্ক, যাঁর সম্পদের নীট মূল্য ২৭৩.২ বিলিয়ন ডলার। আদানি এখন এশিয়ার ধনীতম ব্যক্তি এবং ভারতে তিনি মুকেশ আম্বানিকে অনেক পিছনে দ্বিতীয় স্থানে ঠেলে দিয়েছেন, এবং দুজনের সম্পদের ব্যবধান ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

১৯৮৮ সালে পণ্য কেনাবেচার সংস্থা থেকে শুরু করে আদানি গোষ্ঠী আজ পরিণত হয়েছে ভারতে পরিকাঠামোর বৃহত্তম কংলোমারেটে, যাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে বন্দর, সেজ, রাস্তা নির্মাণ ও বিমান বন্দর থেকে বিদ্যুৎ, গ্যাস, কৃষি বাণিজ্য, গুদাম ব্যবসা পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্রে এবং কিসে নয়। আদানির এই অভাবনীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির তুলনা একমাত্র চলতে পারে নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে এবং দুটোই ঘটেছে একই সময়কাল ধরে এবং ক্রমেই বেড়েচলা ঘনিষ্ঠতর সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে। মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন ২০০১- এর ভূমিকম্পর পর এবং আদানি ভূমিকম্পের পর গুজরাটের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সম্পদ ও আয়ের উৎসগুলোকে কব্জা করার মধ্যে দিয়ে বড় হতে শুরু করেন। ২০০২-এর গুজরাট গণহত্যার পর সিআইআই নেতৃবৃন্দ যখন মোদীর সমালোচনা করেন, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্ৰেট ব্রিটেনে ঢোকা তাঁর নিষিদ্ধ হয়, আদানি সে সময় ২০০৩-এর ভাইব্রান্ট গুজরাট সম্মেলনে বিপুল মাত্রায় বিনিয়োগ করেন এবং ঐ সম্মেলনে কর্পোরেট সংস্থাগুলো মোদীর পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটায় এবং ‘ভারতের সিইও রূপে’ তাঁর মহিমাকীর্তন করে। এটাই আদানির এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ রূপে বর্ণিত হয়েছে এবং তিনি গুজরাট সরকারের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে এবং একচেটিয়াভাবে সুবিধা পেতে শুরু করেন। মুন্দ্রা বন্দরকে কেন্দ্র করে আদানি সাম্রাজ্যের বিপুল বিস্তার ঘটতে থাকে, যেটা এখন ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক বন্দর।

মোদী ২০১৪-র নির্বাচনী প্রচারে আদানির একগুচ্ছ জেট বিমান ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন এবং নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আদানির জেট বিমানে চেপে আহমেদাবাদ থেকে তাঁর দিল্লী পৌঁছানোটা সারা দুনিয়াকেই জানিয়ে দিল যে, ভারতে স্যাঙাতি পুঁজিবাদ এক সম্পূর্ণ নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। তারপর থেকে আদানির আগ্ৰাসি সম্প্রসারণে অর্থজোগাতে ব্যাঙ্কগুলো টাকা ঢালতে থেকেছে আর সরকার কী ভারতে কী বিদেশে আদানির সম্প্রসারণে মদত জোগাতে সম্ভাব্য সবকিছুই করেছে। আদানি এখন ভারতের ব্যাঙ্কগুলো থেকে লোন নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার খনি থেকে কয়লা তোলেন এবং সেই কয়লা আবার ভারতে নিয়ে এসে বিক্রি করেন। আমরা এখন জানি আদানি গোষ্ঠী কীভাবে শ্রীলঙ্কায় বায়ু চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বরাত পেয়েছিল। মোদী যুগ শুরু হওয়ার আগে ২০১৪ সালের ৩০ মার্চ আদানির সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪.৫ বিলিয়ন ডলার, যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে২০২০র জানুয়ারিতে হয় ১১ বিলিয়ন ডলার এবং অতিমারি পর্বে লাফ দিয়ে বেড়ে ২০২১-এর জানুয়ারিতে গিয়ে দাঁড়ায় ৭৬.৭ বিলিয়ন ডলারে, এবং ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে তার সম্পদের পরিমাণ এখন হল ১৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

আট বছরে সম্পদের এই ত্রিশ গুণ বৃদ্ধি স্যাঙাতি পুঁজিবাদের একেবারে চক্ষুলজ্জাহীন প্রয়োগের ফসল যেখানে রাষ্ট্র লোকচক্ষুর মাথা খেয়ে সরকারি সম্পদ ও আয়ের উৎসগুলোকে আদানি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিচ্ছে। এর ফলে তারা পরিকাঠামোর মূল ক্ষেত্রগুলোতে বিশাল আকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর বজ্রদৃঢ় কব্জা হাসিল করতে পারছে, আর সেটা সম্ভব হচ্ছে ভারতের বন্দর, বিমান বন্দর এবং রাস্তা ও রেল সংযোগ ক্রমেই বেশি করে তাদের নিয়ন্ত্রণে আসার ফলে। সংঘ-বিজেপি শিবির আদানিকে বড় মাপের সম্পদ স্রষ্টা এবং কর্মসংস্থানের জনক হিসাবে তুলে ধরে এই বিষয়টাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইবে, এবং এইভাবে আদানির সম্প্রসারণের বৃত্তান্তকে মোদীর নেতৃত্বাধীনে ভারতের বৃদ্ধির আখ্যান রূপেই চালাতে চাইবে। কিন্তু ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির ক্রমহ্রাসমানতা থেকে বেকারি, দারিদ্র, ক্ষুধা ও অপুষ্টির ভয়াবহ বৃদ্ধি –এই প্রতিটি সূচকই ঐ প্রচারটাকে একটা নির্ভেজাল মিথ্যা এবং ভারতের জনগণের প্রতি চরম অপমান রূপেই উন্মোচিত করে দেয়।

কর্পোরেটদের বৃদ্ধি এসেছে বিপুল সামাজিক ও পরিবেশগত মূল্যের বিনিময়ে। এখন আমরা তাই আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পৃথিবীর নানা স্থানেই আদানি ঠেকাও প্রতিবাদকে বেড়ে উঠতে দেখছি – যে প্রতিবাদগুলো চালিত হচ্ছে তার লুটতরাজের প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে, দেশীয় জনগণের জমি জবরদখলের বিরুদ্ধে, নিজেকে পুনর্নবীকরণ যোগ্য শক্তি এবং দেশীয় জনগণের শিল্প ও সংস্কৃতির মদতদাতা হিসাবে তুলে ধরে নিজের চালানো লুন্ঠনকে ধামাচাপা দেওয়ার ভণ্ডামিভরা প্রচেষ্টাগুলোর বিরুদ্ধে। ক্রমে এটা আরই সুস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, আদানির বিস্ময়কর বৃদ্ধি হল ঋণের মাধ্যমে অর্থ জোগানো একট বুদবুদ এবং সেই বুদবুদটা যখন ফাটবে তখন তা ভারতে সৃষ্টি করতেই পারে একটা বিপুল আকারের আর্থিক সংকট যেটা হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক ক্ষেত্রের দৈত্যাকার সংস্থাগুলোর পতন সৃষ্ট সংকটের মতো। আদানি গোষ্ঠীর সম্পদের নীট মূল্যের পিছনে মূলত রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঋণ চালিত আগ্ৰাসি অধিগ্ৰহণ এবং গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যের বৃদ্ধি যার সঙ্গে গোষ্ঠীর রাজস্ব আয়ের তেমন সরাসরি সম্পর্কনেই। উদাহরণস্বরূপ, অ্যামাজন ও আদানি গোষ্ঠীর মধ্যে তুলনা দেখাচ্ছে যে দুই গোষ্ঠীরই সম্পদের নীট মূল্য যেখানে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশে, দুয়ের মধ্যে রাজস্বের ব্যবধান সেখানে দুস্তর, যথাক্রমে ৪৮৬ বিলিয়ন ডলার এবং ২৯.২ বিলিয়ন ডলার।

আজ মোদী সরকার ক্ষমতার লাগামহীন কেন্দ্রীকরণের প্রতিনিধিত্ব করছে, আর আদানি গোষ্ঠী হল সম্পদের অভূতপূর্ব মাত্রার কেন্দ্রীভবনের প্রতিরূপ। স্যাঙাতি পুঁজিবাদকে জনপ্রিয় ভাষায় আদানি-আম্বানি কোম্পানি রাজ বলে বর্ণনা করা হয় এবং তা যথাযথ ভাবে সংক্ষেপে মোদী সরকারের প্রকৃত চরিত্রকে অতি ধনীদের, অতি-ধনীদের দ্বারা, অতি-ধনীদের জন্য সরকার রূপে তুলে ধরে। গণতন্ত্রকে বাঁচতে হলে ভারতের জনগণকে মোদী সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করতে হবে এবং ভারতের অর্থনীতি ও রাষ্ট্র কাঠামোর ওপর কর্পোরেটদের এই ক্রমবর্ধমান নাগপাশকে চূর্ণ করতে হবে।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২)

Siliguri against Purnigam

শিলিগুড়ি শহরে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ডেঙ্গি। মৃত্যু বাড়ছে। শহরে যত্রতত্র জঞ্জাল। আবর্জনায় ভর্তি। পুর প্রশাসন উদাসীন। বেহাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। পুর নিগমের ব্যর্থতাকে দায়ী করে দ্রত প্রতিরোধী ও সরকারী চিকিৎসা কাঠামো প্রশস্ত করার দাবি, মৃত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে আজ শিলিগুড়ি শহরে হাসমি চকে বিক্ষোভ জানানো হয়। বিক্ষোভ সভায় উপস্থিত থাকেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার। বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বসু। উপস্থিত থাকেন দার্জিলিং জেলা কমিটির সদস্য শরৎ সিংহ, মীরা চতুর্বেদী, শাশ্বতী সেনগুপ্ত, বর্ষীয়ান মহিলা নেত্রী গৌরী দে প্রমুখ।

Left-wing trade unions

দক্ষিণ বঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণের অস্থায়ী শ্রমিকরা গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে বেতন বৃদ্ধি, সমকাজে সমমজুরি, চাকরির স্থায়ীত্বকরণ ও মাসে ২৬ দিন কাজের দাবিতে যে লড়াই চালাচ্ছেন তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আজ দুর্গাপুরের এসবিএসটিসি নিগমের সদর দপ্তরের সামনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সিআইটিইউ-এর পরিবহন শিল্পের নেতা জীবন সাহা, এআইসিসিটিইউ-এর রাজ্য নেতা সোমনাথ চ্যাটাজী সহ বিভিন্ন নেতৃত্ব বক্তব্য রাখেন।

এআইসিসিটিইউ নেতা দিবাকর ভট্টাচার্য জানালেন পরিবহন মন্ত্রী কিছু মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দাবি জানানো হয়েছে যে অবিলম্বে লিখিতভাবে পরিবহন দপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। শ্রমিকেরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করবেন কিনা সেই সিদ্ধান্ত তারপরই নেওয়া হবে।

Adivasi Bikash Manch

বকেয়া একশো দিনের কাজের মজুরি প্রদান সহ কয়েক দফা দাবিতে গঙ্গাজলঘাঁটির বিডিও’র কাছে স্মারকলিপি দিল বাঁকুড়া জেলা আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ। ল্যাম্প অফিসের সামনে থেকে আদিবাসী মানুষজন মিছিল করে বিডিও অফিসে আসেন। তাদের মূল দাবি, “কেন্দ্র- রাজ্য বুঝি না, কাজ করেছি তার বকেয়া মজুরি অবিলম্বে মিটিয়ে দাও”, “কাজ চাই কাজ দাও।” যেসব দাবি তুলে ধরা হয় তা হল –

১) অবিলম্বে ১০০ দিনের কাজের বকেয়া মজুরি প্রদান করে সব গ্রামে কাজ চালু কর।
২) দখলিকৃত বনের চাষ জমির পাট্টা ও পরচা ব্যবস্থা করতে হবে।
৩) উখরাডিহি হাইস্কুল থেকে বেলাবনী সহ অন্যান্য কাঁচা রাস্তা পাকা করতে হবে।
৪) আদিবাসীদের ধর্মীয় স্থানগুলো প্রাচীর দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫) প্রতিটি গরিব আদিবাসীদের ‘পাকা বাড়ির’ ব্যবস্থা দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।
৬) আদিবাসীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে (বাহা, সহরা, কারাম) সরকারী অনুদান দিতে হবে।
৭) অগভীর নলকূপের মাধ্যমে প্রতিটি আদিবাসী গ্রামে পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮) আদিবাসী সমাজের সামাজিক ব্যবস্থার পঞ্চভদ্রদের মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে।
৯) আধার কার্ড সংযুক্তির নামে কোন আদিবাসীদের বঞ্চিত করা যাবে না।

Struggle for road demands

অবিলম্বে বেহাল রাস্তা সংস্কারের দাবিতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর হিন্দমোটরে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়েছিল। আজ সেই স্বাক্ষর সম্বলিত ডেপুটেশন সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের উত্তরপাড়া থানা এরিয়া কমিটির তরফ থেকে জমা দেওয়া হল উত্তরপাড়া-কোতরং পুরসভার চেয়ারম্যান দিলীপ যাদবের হাতে। চেয়ারম্যান পার্টি নেতৃত্বকে জানালেন যে এই সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ অর্থ রাজ্য সরকারের তরফ থেকে অতি সম্প্রতি পৌরসভার হাতে এসে পৌঁছেছে তাই শারদোৎসবের আগে জরুরি ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো সংস্কারের কাজ করা হবে। কিছু কাজ অসমাপ্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে যা পুজোর পরেই হবে। কিছু জায়গায় পাইপলাইন বসানোয় ত্রুটি থেকে যাওয়ার জন্য সেই কাজ পুনরায় করার দরকার। অর্থাৎ এই বিষয়ে পৌরসভার যথাযথ তদারকি ছিল না সেই কথাও ক্ষোভের সঙ্গে পুরপ্রধানকে বলেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। পুরপ্রধান যত দ্রুত ও পরিকল্পিতভাবে এই কাজ সমাপ্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পার্টি নেতৃত্ব জানিয়েছেন এই কাজের অগ্রগতির উপর দল অবশ্যই নজর রাখবে। অন্যথায় আবার রাস্তায় নামতে হবে।

All India Agricultural and Rural Labor

১৭-১৮ সেপ্টেম্বর পাটনায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কার্যকরী কমিটির বৈঠকের বৈঠকের সারসংক্ষেপ

আয়ারলা জাতীয় কার্যকরী কমিটির বৈঠক গত ১৭-১৮ সেপ্টেম্বর পাটনা রাজ্য দপ্তরে অনুষ্ঠিত হয়। শহীদ স্মরণ দিয়ে বৈঠক শুরু হয়। উত্তর প্রদেশের সীতাপুরের কমরেড অর্জুন লাল সহ অন্যান্য কমরেডদের গ্রেপ্তারি ও নির্যাতনের ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করা হয়। কমরেড অর্জুন একজন জনপ্রিয় দলিত নেতা এবং আয়ারলা জাতীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য। দলিত নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্যই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই গ্রেপ্তারির প্রতিবাদ এখনও চলছে। জানা গেছে, আজ অন্যান্য কমরেডরা সহ কমরেড অর্জুনও জামিন পেয়েছেন। ৫৫টি দলিত পরিবারের ঘর ভেঙ্গে দিয়ে উচ্ছেদের ঘটনার প্রতিবাদ করার জন্য সাথী পাপ্পু খানের গ্রেপ্তারির ঘটনারও তীব্র নিন্দা করা হয়। তিনি একজন তরুণ সিপিআই(এমএল) নেতা এবং ইনসাফ মঞ্চের দ্বারভাঙ্গা জেলা সম্পাদক।

আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের কারণে গ্রাম ও পঞ্চায়েতগুলিতে অপুষ্টি ও ক্ষুধার বেড়েচলা ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে বৈঠক উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং এই প্রসঙ্গে গরিব বিরোধী অম্বানি- আদানিমুখি মোদী সরকারের অপদার্থতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে।

দাবি করা হয় যে, মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা ছাড়াও সরকার অবিলম্বে রান্নার গ্যাসের দাম অর্ধেক করুক, গরিবদের বিদ্যুৎ বিল মকুব করুক। খাদ্যদ্রব্য সহ পড়াশোনা সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধাগুলি ও সামগ্রীকে জিএসটির আওতার বাইরে রাখুক। সরকার যেভাবে গণবণ্টন ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিচ্ছে এবং রেশন ছাঁটাই করছে তার বিরোধিতা করা হয় এবং এই বিষয়ে গ্রামস্তর থেকে রাজধানী পর্যন্ত প্রতিবাদ করার ডাক দেওয়া হয়। দলিত-গরিবদের বাড়ি ভেঙ্গে দেওয়ার পরিঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘আবাস অধিকার’কে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করার দাবি ওঠে। সংবিধান, গণতন্ত্র ও দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে বদলে দিতে যে আঘাত নেমে আসছে, গ্রামীণ দরিদ্র সহ গ্রামবাসীদের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার কর্মসূচির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রেল, সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে যাঁরা লড়াই করছেন তাঁদের প্রতি বৈঠক থেকে সংহতি প্রকাশ করা হয়। দলিত-সংখ্যালঘুদের উপর ঘটে চলা ধারাবাহিক সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা-দাঙ্গার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধ ছড়িয়ে দেওয়ার সংকল্প গ্রহণ করা হয়।

Statement of Tripura

বিশালগড়ে, বিশ্রামগঞ্জে, সাব্রুমে ও উদয়পুরে বিরোধী দলের কর্মীদের উপর আক্রমণ, ভয়-ভীতি ও সন্ত্রাস সংগঠিত করে বিজেপি সারা দেশের সাথে ত্রিপুরা রাজ্যকে বিরোধী মুক্ত করার ফ্যাসিবাদী ব্লুপ্রিন্ট রচনা করেছে। একে নাকাম করতে একটি ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে বিরোধীদের মধ্যে রাজনৈতিক মহাজোট গড়েতোলার আহ্বান জানায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশন। গত ২২ সেপ্টেম্বর এক প্রেস বিবৃতিতে রাজ্য সম্পাদক পার্থ কর্মকার বলেন –

সাব্রুমে ও গতকাল উদয়পুরে বিরোধী দলের মিছিল ও সভা সমাবেশে অংশগ্রহণকারী কর্মীদের উপর পরিকল্পিতভাবে বিজেপি তার দলীয় বাইক বাহিনীর দ্বারা নৃশংসভাবে আক্রমণ সংগঠিত করেছে। রাতের বেলায় বিরোধীদের বাড়ি-ঘর, জিনিসপত্র ভাঙচুর করেছে। বৈধ অনুমতি প্রাপ্ত সভা ও সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের উপর কর্তব্যরত পুলিশের সামনেই এই আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ নীরব ও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে এবং শাসক দলের বাইক বাহিনীকে পরোক্ষভাবে মদত যুগিয়েছে। গণতন্ত্র নিধনের পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে ত্রিপুরা। সংবিধান ও আইনের শাসন আজও বিপন্ন। এখন ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচনের লক্ষ্য সামনে রেখে বিজেপি সারা দেশের সাথে ত্রিপুরা রাজ্যকেও আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী মুক্ত করার ফ্যাসিবাদী ব্লু-প্রিন্ট রচনা করেছে। এরই অঙ্গ হিসেবে বিধানসভা নির্বাচনের ৫ মাস পূর্ব হতে আরএসএস ও বিজেপি পরিকল্পিতভাবে বিরোধীদের উপর নতুনভাবে আক্রমণ ও সন্ত্রাস নামিয়ে এনেছে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে এই সন্ত্রাস ও ভয়ভীতি বেশিদিন মানুষ সহ্য করবে না। প্রতিটি ক্রিয়ার বিপরীতে যেমন প্রতিক্রিয়া থাকে। ঠিক তেমনি দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ কিন্তু রুখে দাঁড়াবেই। যেমনটা ত্রিপুরার জনজাতিরা মথা-র নেতৃত্বে গত এডিসি নির্বাচনে প্রথম থেকেই বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ খাড়া করেছে। তার সাথে সমাজের অল্পসংখ্যক অন্যান্য অংশও প্রতিরোধে সামিল হয়েছে। তাই অতি সম্প্রতি শাসক বিজেপির আক্রমণ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধের ঘটনাও ঘটতে শুরু করেছে। বিরোধী দলগুলো আলাদা আলাদা থাকার কারণে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ শক্তিশালী হয়ে উঠছে না। বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হলে তা দানা বাঁধবে ও শক্তিশালী প্রবনতা হয়ে উঠবে। এটাই হচ্ছে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার উপযুক্ত সময়। কিন্তু তার জন্য রাজনৈতিক রণকৌশল হিসেবে বিরোধীদের যেকোন মূল্যে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মহাজোট গড়তে হবে। ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ৭ম কংগ্রেসে ইউরোপে ও পৃথিবীতে কিছু দেশে ক্ষমতাসীন বিপর্যয়কারী শক্তি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর যুক্তফ্রন্ট, ফ্যাসিবিরোধী জনগণের মোর্চা গড়েতোলার জন্য সর্বসম্মতভাবে নীতিমালা গৃহীত হয়েছে। যা আজও মার্কসবাদী মহলে সর্বজন স্বীকৃত এবং সবাই তা মেনে চলেন।

The Fight Is On

উত্তর ২৪ পরগণা

২৪ সেপ্টেম্বর, বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের শহীদ দিবসে আইপোয়ার উদ্যোগে আগরপাড়া অফিসে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার শুরুতে আমার মুক্তি আলোয় আলোয় গেয়ে শোনান মিঠু চক্রবর্তী। প্রীতিলতা-কল্পনা দত্ত-বীনা দাস সহ স্বাধীনতা সংগ্রামের মেয়েদের ভুমিকা নিয়ে বক্তব্য রাখেন মৈত্রেয়ী বিশ্বাস। মিতালি বিশ্বাস বলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদাররা যে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন আজ সেই দেশে ক্রমশ মেয়েদের অধিকার ও স্বাধীনতার উপর আঘাত নেমে আসছে। ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার ঘটনায় বিলকিস বানোর গণধর্ষণ ও তাঁর পরিবারের সদস্যের খুনে দোষী ১১ জনকে সাজা মকুবের আগেই মুক্তি ও মালা দিয়ে সম্বর্ধনা জানানো হচ্ছে। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের গলা টিপে, বিজেপি-আরএসএস কিভাবে মানুষের মনে হিংসা বিদ্বেষের রাজনীতির বীজ বপন করছে সেই প্রেক্ষাপট নিয়েও আলোচনা হয়। সভায় উপস্থিত আইপোয়ার সদস্যরা জানান কিভাবে ঘরে মেয়েদের পুজো ও আচার বিচারের মধ্যে আটক রাখা হয়। কদম্বগাছি থেকে আসা ১৯ বছরের খুসবু জানান, কিভাবে তাদের পাড়ায় মেয়েদের পোশাকের উপর নজরদারি চালানো হয়। নিজের জীবনের লড়াই এবং প্রতিবাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে সমগ্র দেশে কিভাবে মেয়েরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনে এগিয়ে আসছে তা আইসার অন্বেষা বর্ণনা করেন। ইরানের মেয়েদের লড়াইয়ের কথা আলোচনায় উঠে আসে। ইরানের মুসলিম মৌলবাদ মেয়েদের হিজাব পরতে বাধ্য করছে, আর আমাদের দেশের হিন্দু-মৌলবাদ মুসলিম মেয়েদের হিজাব খুলে ফেলতে বাধ্য করছে। সমস্ত মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অধিকারের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কবি সুবোধ সরকারের ‘আমি কৃষ্ণকলি মাহাতো’ কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে আলোচনা সভা শেষ করেন তপতি দে।

কলকাতা কলকাতা

জেলা আইপোয়ার উদ্যোগে গাঙ্গুলিপুকুরের “স্বপ্না সভাঘরে” এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার শুরুতে “সংকোচের বিহ্বলতায় হোয়ো না ম্রীয়মান” রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনান সাধনা গোলদার। সম্প্রীতি মুখার্জি তাঁর বক্তব্যে বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে মেয়েদের অনুপ্রাণিত করতে প্রীতিলতা আত্মাহুতির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এছাড়া সড়শিবালা দাস ও সত্যবতীর মতো বিপ্লবী নারীদের কথাও তুলে ধরেন। আজ সেই দেশে মেয়েদের অধিকার ও নারী আন্দোলনকারীদের উপর আঘাত নেমে আসছে। বিলকিস বানোর গণধর্ষণ ও তাঁর পরিবারের সদস্যের খুনিদের সাজা মকুব করা হচ্ছে। শীর্ষা সেনগুপ্ত বর্তমানে বহু আলোচিত নারী স্বশক্তিকরণ নিয়ে নিজের উপলব্ধি ব্যক্ত করেন। তাঁর মতে যেখানে নাবালিকা বিবাহ বাড়ছে, সেখানে বিয়ের বিরুদ্ধে নিজের মত দেওয়াটাই, কিংবা অল্পবয়সে সন্তান-ধারণে বাধ্য হওয়ার বিরুদ্ধে মত দেওয়াটাই মেয়েদের স্বশক্তিকরন।

নিখিলবঙ্গ মহিলা সংঘের নেত্রী সর্বানি ভট্টাচার্য স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, বীণা বসু সহ স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের ভূমিকা তুলে ধরেন। স্বাধীনতার পরেও মেয়েদের সামাজিক বাধা ও পারিবারিক-পারিপার্শ্বিক চাপকে উপেক্ষা করে নিজস্ব চিন্তাকে উন্নত করার, হিংসার ও পাচারের বিরুদ্ধে মহিলাদের উদ্যোগ বাড়ানোর ওপর জোর দেন।

অধ্যাপিকা সংঘোমিত্রা চক্রবর্তী বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েরা আজ এগোলেও শিক্ষা ও কর্মজগতে যোগ্যতার স্বীকৃতি আসেনি। এজন্য অনেক লড়াই দরকার।

রাজ্য সম্পাদক ইন্দ্রাণী দত্ত বলেন, প্রীতিলতা, মাতঙ্গিনি, কল্পনা দত্ত, ভগৎ সিং, আদিবাসী বিদ্রোহী নেত্রী ফুলো, ঝানো-র মতো বহু বিপ্লবীর আত্মোৎসর্গের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও আজকে সংকীর্ণ জাত ধর্ম, সাম্প্রদায়িক বিভাজন, বৈষম্য, হিংসার গ্রাসে দেশকে এক চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বিজেপি সরকার। আজও গড়ে ১০ জন দলিত নারী প্রতিদিন ধর্ষণের শিকার হন, এর ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী উচ্চবর্ণের মানুষেরা। স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চাকুরী, মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আজ গণতন্ত্র-মর্যাদা ও নির্ভয় স্বাধীনতার জন্য মেয়েদের লড়াই আরো ব্যাপক ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা তিনি তুলে ধরেন।

অমিত দাশগুপ্ত বলেন, আগের তুলনায় মহিলারা কর্ম জগতে অনেক বেশি সংখ্যায় যুক্ত হচ্ছেন, উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশ করছেন, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার ক্ষেত্রে তাদের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সেই অনুপাতে সমাজে ও সর্বত্র নারীদের উপর বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতন করার কাজ হচ্ছে কম। এই কাজে সচেতন ও সংগঠিত মহিলাদের উদ্যোগ বাড়াতে হবে। সব শেষে আলোচনা সভার সঞ্চালিকা ও জেলা সভানেত্রী মমতা ঘোষ সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

দক্ষিণ ২৪ পরগণা

বজবজে আইপোয়ার উদ্যোগে সভা সংগঠিত হয়। সেখানে মহিলা নেত্রী দেবযানী গোস্বামী, অনিন্দিতা মালিক এবং ইন্দ্রজিৎ দত্ত বক্তব্য রাখেন। ছাত্রী অনন্যা মালিক একটি লেখা পাঠ করেন।

Bangla is vocal

২০২২-২৩’র মধ্যে মোদী কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার যে কান ঝালাপালা করার সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন, তা দেশের মানুষ এখনো ভুলে যায়নি। ঠিক যেমন রাজ্যবাসী ভুলে যায়নি, “ইতিমধ্যেই রাজ্যের কৃষকদের আয়কে তিনগুণ করে ফেলার” মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা। ক্ষমতার অলিন্দে রাজ্য-কেন্দ্র বা রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান কর্ণধারেরা এই সমস্ত নির্জলা মিথ্যাভাষণ যতই দিক না কেন, কিছু অপ্রিয় তেতো তথ্য এই সমস্ত দাবির অসাড়তাকেই নির্মমভাবে বে-আব্রু করে দিল।

বাস্তব কি বলে?

মূল্যস্ফীতির হার বেশ উঁচুতে থাকলেও ২০২১-২২এ কৃষিক্ষেত্রে মজুরি বেড়েছে ৩ শতাংশেরও কম। ২০১৯-এ ভারতে কৃষির সাথে যুক্ত একটি পরিবারের গড় মাসিক আয় ছিল ১০,২১৩ টাকা। (সূত্র: ইকনমিক সার্ভে, ২০২১-২২)। এই যৎসামান্য আয়ের উপর ৪-৫ জনের এক কৃষক পরিবারকে সামাল দিতে হয় যাবতীয় অত্যাবশক প্রয়োজনগুলো।

পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভের বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ২০২২’র জুন মাসে। তাতে দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ এলাকায় বৃহত্তম রোজগেরে বর্গটাই হল স্বনিযুক্ত কর্মী। আর, তাঁরা হলেন কৃষক। কৃষিকাজে একজন পুরুষ যদি মাসে ১০,২২৮ টাকা পেয়ে থাকেন, মহিলারা ওই একই কাজে পান অর্ধেকেরও কম — মাত্র ৪,৫৬১ টাকা! ওই রিপোর্ট দেখাল, গ্রাম ও শহরের মধ্যে আয়ের ক্ষেত্রে বিরাট তারতম্য, পুরুষ ও মহিলাদের আয়ে বিরাট বৈষম্য, নিয়মিত বেতনভুক কর্মী ও ক্যাজুয়াল বা স্বনিযুক্ত কর্মীদের মধ্যে আয়ের অনেক ফারাক।

পরিবার পিছু মজুরি বৃদ্ধির হার বছরের পর বছর ক্রমেই নিচের দিকে নামছে। ২০১২- ২০১৬-তে মজুরির হার ৮.২ শতাংশ থেকে কমে ২০১৭-২১এ ৫.৭ শতাংশে নেমে গেছে। বিভিন্ন রেটিং সংস্থার রিপোর্ট থেকেই তা দেখা যাচ্ছে। আর, মূল্যস্ফীতিকে যুক্ত করলে এই বৃদ্ধির হার আরও কমে ১ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। মজুরির এই মন্থর বৃদ্ধি গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চলে একই সাথেই ঘটেছে। গ্রামীণ এলাকায় মজুরি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেড়েছে ২.৮ শতাংশ, আর শহরাঞ্চলে ৫.৫ শতাংশ, কিন্তু মূল্যস্ফীতির সাথে তা যুক্ত করলে বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হবে।

ইতিমধ্যে যে চর্চাটা খুব সামনে এসেছে, তা হল, বিগত ত্রৈমাসিকে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি যুক্তরাজ্যকে (ইউকে) টেক্কা দিয়ে এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু, বাস্তব এটাই যে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি রূপায়ন মন্ত্রকের প্রকাশ করা তথ্য দেখাচ্ছে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়েনি, বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে কর্মসংস্থানের হার সবচেয়ে নিচে নেমে গেছে, লাফ দিয়ে বেড়েছে অল্প বয়সী তরুণ ও বেকার দিনমজুরদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা। স্বনিযুক্ত, কর্মহীন, কৃষক, দিনমজুর — সব মিলিয়ে এই বর্গের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ৫২.৮৫ শতাংশ ! ২০২০’র সাপেক্ষে ২০২১-এ পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত আত্মহত্যার হার বেড়েছে ৭.২ শতাংশ। দিনমজুরদের আত্মহত্যার সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ২০২০’র তুলনায় গতবছর তা বৃদ্ধি পেয়েছে ১১.৫২ শতাংশ হারে। কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার দাবি যে কতবড় প্রবঞ্চনা তা এই তথ্যই উন্মোচিত করল।

আমাদের রাজ্য — মজুরির হাল

রিজার্ভব্যাঙ্ক কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্ট (২০২১) বলছে, এই রাজ্যে গ্রামীণ জনসংখ্যার দৈনিক মজুরির হার মাত্র ২৮৮.৬০ টাকা, যা জাতীয় হার ৩০৯.৯০ টাকা থেকে কম। অ-কৃষিকাজের সাথে যুক্ত মজুরদের মজুরি এ’রাজ্যে বেশ কম। এ’রাজ্যে এই মজুরির হার ৩০৭.৫০ টাকা, যেখানে জাতীয় হার হল ৩০৯.১০ টাকা।

একশ দিন কাজের প্রকল্প এই রাজ্যে মুখ থুবড়ে পড়ায় রাজ্য সরকার আরেকটা বেআইনি ও অন্যায্য পথ অবলম্বন করতে শুরু করেছে। একশ দিনের প্রকল্পে কাজ দিতে না পারায় এবার শ্রমের অবমূল্যায়ন করতে শুরু করল মমতা সরকার। এখন, সরকারি দফতরে জব কার্ডধারী শ্রমিকদের নিযুক্ত করা হচ্ছে সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরির অর্ধেক অঙ্কের বিনিময়ে! খবরে প্রকাশ, রাজ্যের এগারোটি জেলায় রাজ্য সরকারের নানা দফতরের প্রকল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি মেলেনি, অন্তত দু’টি জেলায় মিলেছে সরকার নির্দিষ্ট মজুরির অর্ধেকেরও কম। এই মজুরি প্রদানেও বেশ তারতম্য রয়েছে। জলপাইগুড়িতে তাঁরা পাচ্ছেন দৈনিক ৫৮ টাকা, আর মালদহে ৯৯ টাকা। আরও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কলকাতার আশপাশের জেলাগুলিতে মজুরির হার বেশি, আর প্রান্তিক জেলাগুলিতে কম। বোঝাই যাচ্ছে, সরকার এখানে শ্রমের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ না করে বাজারের অন্যায্য অন্ধ বিধির কাছেই আত্মসমর্পণ করেছে। গোটা এই ব্যবস্থাই এখন ঠিকাদারদের কব্জায়। সরকারের অন্যান্য দফতরগুলো এখানে শুধু মৌন মূক দর্শকই নয়, ঘোরতর এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে।

রাজ্যে একশ দিনের কাজ — গভীর সংকটে

“যত ধর্ম বাদ দাও, ভুখা পেটে ভাত দাও” — এই স্লোগানকে সামনে রেখে কয়েকশ আদিবাসী বিক্ষোভকারী, যাদের মধ্যে বেশিরভাগটাই মহিলা, পুরুলিয়ার পুঞ্চা ব্লকে বিক্ষোভ দেখালেন ২৫ জুলাই, ঠিক যেদিন দেশের প্রথম আদিবাসী মহিলা দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হলেন। তাঁরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন একশ দিনের কাজে তাঁদের বহু মাস বকেয়া মজুরির দাবিতে।

মজুরির দাবিতে। গোটা রাজ্যেই একশ দিনের কাজ এখন প্রায় থমকে। কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে উতর-চাপান খেলায় অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য সুরক্ষা সংক্রান্ত একাধিক প্রকল্প, সেচ, বাঁধ নির্মাণের মতো জরুরি কাজগুলো সবই থমকে রয়েছে। দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে রুটি রুজি জোটানোর জন্য ভিনরাজ্যে পাড়ি দেওয়ার দৈনন্দিন আখ্যান।

একশ দিনের কাজের মর্মান্তিক পরিণতির দিকে একবার চোখ ফেরানো যাক। কেন্দ্রীয় সরকারের একশ দিনের কাজ সংক্রান্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, এ’রাজ্যে রয়েছে ৩.৪২ কোটি নথিভুক্ত শ্রমিক আর ১.৫৭ কোটি জবকার্ড ধারী পরিবার। ২০২১-২২এ তৈরি হয়েছিল ৩৬.৪২ কোটি কর্মদিবস, যা রাজস্থানের পর দেশের মধ্যে ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম। এরমধ্যে ২০২১- ২২এ সমগ্র শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেকই (৪৬.৬৯ শতাংশ) ছিলেন মহিলা, আর ২০২২-২৩-এ ৪৮ শতাংশ মহিলা। কিন্তু, মজুরি দিতে না পারায় ২০২২-২৩’র ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কর্মদিবস একেবারে নিচে নেমে দাঁড়ায় ৩.৪৩ কোটিতে। অর্থাৎ মাত্র একবছরের মাথায় কর্মদিবস হ্রাস প্রাপ্ত হল ৩৩.৩৯ কোটি! যা রীতিমতো অভাবনীয়। ২০ জুলাই রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রক জানায়, একশ দিনের প্রকল্পে গোটা দেশে বকেয়া মজুরির পরিমাণ ৩,৯৮৯.৫৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে শুধু এ’রাজ্যের বকেয়া হল ২,৬০৫.৮২ কোটি, অর্থাৎ সমগ্র বকেয়ার প্রায় ৬৫ শতাংশই পশ্চিমবাংলার! এ’রাজ্যে কেন বকেয়া টাকা দেওয়া বন্ধ করল কেন্দ্রীয় সরকার, এই প্রশ্নের জবাবে রাজ্যসভায় মন্ত্রী বলেন, মনরেগা আইনের ২৭নং ধারায় বলা আছে, “কেন্দ্রের নির্দেশ ঠিক মতো অনুসৃত না হলে এই প্রকল্পের জন্য ধার্য তহবিল থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া হবে। বিবেচনাযোগ্য সময়সীমার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার তার ঠিকঠাক রূপায়নের লক্ষ্যে যথাযথ সংশোধনী পদক্ষেপ নেবে।” এখন, এই সমস্ত শব্দবন্ধ “বিবেচনাযোগ্য সময়সীমা”, বা “যথাযথ সংশোধনী পদক্ষেপ”এর অন্তর্নিহিত অর্থ একমাত্র আমলাতন্ত্রের কাছেই বোধগম্য, কিন্তু এই সার কথাটার উত্তর মেলে না — যারা কাজ করলেন, শ্রম দিলেন, তাঁদের শ্রমের মূল্য কেন দেওয়া হবে না সময় মতো।

করে ১০০ দিনের শ্রমিকদের মজুরি ঠিক সময়ে প্রদানের জন্য ঝাড়খন্ড সরকার ৫০০ কোটি টাকার এক বাফার তহবিল তৈরি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, আমাদের রাজ্য সরকার কেন সেই পথ অবলম্বন করতে পারে না? যে দুর্নীতির কারণ দেখিয়ে এই কেন্দ্রীয় তহবিল বন্ধ রয়েছে, সেই দুর্নীতি ঠেকাতে সোশ্যাল অডিটের পদক্ষেপ এ’রাজ্যে বন্ধ রাখা হয়েছে। রাজ্যের সোশ্যাল অডিট নির্দেশক বা ডিরেক্টর জানিয়েছেন, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩এ একশ দিনের সোশ্যাল অডিটের জন্য কোনও বাজেট বরাদ্দ করা হয়নি। দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া সত্ত্বেও সিএজি কেন ২০১১-১২’র পর কোন অডিট করলনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসার ও অভিযুক্ত পঞ্চায়েতদের কাছ থেকে আত্মসাৎ হওয়া টাকা পুনরুদ্ধার করার কেন্দ্রীয় নির্দেশ অনুযায়ী রাজ্য সরকার বেশ কিছু ক্ষেত্রে এফআইআর দায়ের করলেও টাকা আদৌ উদ্ধার করা যাবে কিনা তা নিয়ে রীতিমতো সন্দেহ রয়েছে। (তথ্যসূত্র: ডিলে, ডেট অ্যান্ড ডিস্ট্রেস ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল, দ্য হিন্দু)।

এনসিআরবি’র রিপোর্ট উল্লেখ করেছে যে পশ্চিমবাংলা সহ একাধিক রাজ্য জানিয়েছে, তাদের রাজ্যে কৃষক বা কৃষি মজুরের আত্মহত্যার ঘটনা নাকি শূন্য! শুধু উক্ত সংস্থাকেই নয়, রাজ্য বিধানসভা থেকে প্রায় সমস্ত মঞ্চে মমতা সরকার জানিয়েছে এ’রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি। এদিকে, কিছুদিন আগে তথ্য জানার অধিকার আইনের সাহায্যে জানা গেল, ২০২১ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ১২২ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এরমধ্যে, ২০২১ সালে ঘাটাল থানার অধীনে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা সর্বাধিক (৬৩), তারপর রয়েছে গোয়ালতোড়ের নাম। সেখানে আত্মহত্যার সংখ্যা ১৪।

শ্রমের ন্যায্য মূল্য না দেওয়া অপরাধ, শ্রমের মূল্য বকেয়া রেখে না প্রদান করা আরও বড় অপরাধ! আর এই দু’টো অপরাধে সমান দুষ্ট মোদী-মমতা সরকার। তাই, ন্যায়সঙ্গত ভাবে আজ গ্রাম বাংলায় দাবি উঠেছে — কেন্দ্র রাজ্য বুঝিনা। কাজ করেছি, মজুরি দাও।

- অতনু চক্রবর্তী

war against starvation

এই বাংলায় ১৯৪৩ সালে ৩০ লক্ষ মানুষের অনাহারে মৃত্যু হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকের নিষ্ঠুর ক্রূরতা, নির্মম অবহেলা আর বর্ণবিদ্বেষের কারণে সৃষ্ট সেই ‘দুর্ভিক্ষের’ জন্য কোনও ফসলহানি দায়ী ছিল না। সেই মৃত্যু প্রসঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, “I hate Indians. Beastly people with a beastly religion. The famine was their own fault for breeding like rabbits.” না খেতে পেয়ে মরা মানুষদের সম্পর্কেবোধ হয় সাদা, কালো, বাদামি সব শাসকদেরই এই অভিমত। ভাষাটা শুধু আলাদা। নিজেদের অপরাধ ঝেড়ে ফেলার মোক্ষম যুক্তি!

‘দুর্ভিক্ষ’-আধুনিক অর্থনীতির বা সমাজতত্ত্বের পরিভাষায় ‘খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা’র অবস্থা। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কালজয়ী গবেষণা দেখিয়ে দিয়েছে — মানুষের চাহিদা পূরণের মতো যথেষ্ট খাদ্যশস্য মজুদ থাকা সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষ হয় যদি মানুষের সেই খাদ্যের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা না থাকে। অর্থাৎ সেই খাদ্য সংগ্রহের মতো সংস্থান বা আয় না থাকে। খাদ্য বন্টনে বৈষম্য ও অসাম্য থেকেও দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হতে পারে।

কেউ স্বপ্ন দ্যাখেন – কীভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ ভূখণ্ডকে নিজের দখলে আনবেন। কেউ – কীভাবে ধনকুবেরের তালিকায় এক নম্বরে আসবেন। কেউ আবার ভাবেন কীভাবে বন জঙ্গল ঝর্ণা নদী বন্যজীবন খনিজসমৃদ্ধ বনাঞ্চলকে কর্পোরেটদের ভোগের থালায় তুলে দেবেন। আর পৃথিবীর ‘দুর্ভাগা’ সাড়ে ৩৪ কোটি মানুষ এই মুহূর্তে শুধু একমুঠো ‘ভাত’ চায়, আর কিচ্ছু না। না পেয়ে প্রতি ৪ সেকেন্ডে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে তাদের মধ্যে একজন করে মানুষ। প্রতিদিন ২০,০০০ মানুষ মরছে অনাহারে। ‘বিশিষ্ট’ মানুষদের মহার্ঘ স্বপ্ন পূরণের বলি তারা। যদিও এটা গণতন্ত্রের যুগ। যদিও রাষ্ট্রসঙ্ঘ স্বপ্ন দেখেছিল ২০৩০ সালের মধ্যে ‘ক্ষুধামুক্ত’ পৃথিবীর!

কোভিড ১৯-এর প্রভাবে গোটা পৃথিবীর জনজীবন, অর্থনীতি, উৎপাদন ব্যবস্থা চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সেই ধাক্কা সামলাতে মানুষ যখন নাজেহাল, তার মধ্যেই শুরু হয়ে গেল রাশিয়ার ইউক্রেন-হামলা। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো ঘন ঘন হানা দিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে : যুদ্ধ-সংঘর্ষের জন্য তীব্র খাদ্য সংকটে রয়েছে ২৪টি দেশের ১৩ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ; জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৮টি দেশের ২ কোটি মানুষ চরম খাদ্য সংকটে আছেন; অর্থনৈতিক সংকটের দরুণ ২১ টি দেশের ৩ কোটি মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীন।

ইউক্রেন ও রাশিয়া পৃথিবীর খাদ্য চাহিদার ১০ ভাগের ১ ভাগ পূরণ করে। এর মধ্যে ৩০% গম, ৬০% সূর্যমুখী তেল, ১৩% ভুট্টা রয়েছে। এছাড়া রাশিয়া পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক সার উৎপাদন ও রপ্তানিকারী দেশ। যুদ্ধের শুরুতেই রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের বন্দরগুলি অবরোধ করে রেখেছে। ফলে ওডেসায় বড় গুদামগুলিতে রফতানিযোগ্য ৫০ লক্ষ টন গম মজুত থাকা সত্ত্বেও ইউক্রেন রপ্তানি করতে পারছে না। বহুদিন ধরেই ‘অনাহার’কে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে যুদ্ধবাজরা। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

অন্যদিকে রাশিয়ার ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ওপর পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া থেকে খাদ্যশস্য, সার ইত্যাদির রপ্তানি বন্ধ আছে। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে ২০২২-এর চাষ- মরশুমে ২০- ৩০% কৃষিজমি অনাবাদী থেকে যাবে। তাছাড়া ইউক্রেনের গম উৎপাদন রপ্তানির উদ্দেশ্যে; সেই রপ্তানি বন্ধ থাকায় চাষেও অনীহা দেখা দেবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন ছাড়াও আরও ২৩টি দেশ যুদ্ধ শুরুর পর থেকে খাদ্যশস্যের রপ্তানির ওপর কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে।

এদিকে বিশ্বের ২৬টি দেশ তাদের খাদ্যশস্যের প্রয়োজনের ৫০%-এর জন্যে নির্ভর করে রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর। যেমন ইয়েমেন ৯০% আমদানি- নির্ভর। ইরাক ইউক্রেন যুদ্ধে তেল বেচে লাভবান হলেও ৫২ লাখ টন চাহিদার অর্ধেকেরও কম তার নিজস্ব খাদ্য শস্য উৎপাদন। খরা ও জলের অভাবে সেখানকার ক্ষুদ্র চাষিদের জীবিকাও বিপন্ন হয়েছ। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বন্যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় চাষের ক্ষতি হয়েছে। গমের আমদানি কমে যাওয়ায় সংকট দেখা দিতে পারে। ভয়াবহ বন্যায় পাকিস্তানে ক্ষতির পরিমাণ ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি জলের তলায়। পাঁচ লক্ষ মানুষ গৃহহীন। মারা গেছেন সরকারি হিসেবেই প্রায় দেড় হাজার মানুষ। মূল্যস্তর ৩০%-এর বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আবহাওয়ার প্রতিকূলতায়, বিশেষ করে যুদ্ধে খাদ্যশস্যের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় নাইজেরিয়া, সুদান, মালির মতো আফ্রিকান দেশগুলোর খাদ্য পরিস্থিতি ভয়াবহ। চাদ ইতিমধ্যেই সরকারিভাবে খাদ্যসঙ্কটের কথা ঘোষণা করেছে। যুদ্ধ-সংঘর্ষে বিধ্বস্ত দেশগুলোতে, যেমন ইয়েমেন, আফগানিস্তান, ভেনেজুয়েলা, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়ায় কোভিডএর আগে থেকেই খাদ্য সামগ্রী দুর্মূল্য হয়ে উঠেছিল।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও জানিয়েছে ‘২১মে-২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বে খাদ্য মূল্য ৫৫% বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে অন্তত ৪৫%। এই ভয়ঙ্কর মূল্য বৃদ্ধির চাপে বিধ্বস্ত যুদ্ধ সংঘর্ষতে থাকা এশিয়া আফ্রিকা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর মানুষ আজ খাদ্য নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। একবেলা খেয়ে আরেক বেলা খাবার জুটবে কিনা অনিশ্চিত এমন মানুষের সংখ্যা এখন ১৬০ কোটি (দি ইকোনমিস্ট)।

অক্সফ্যামের গত বছর জুলাইয়ের রিপোর্ট ‘দি হাঙ্গার ভাইরাস মাল্টিপ্লাইস’-এ সক্ষোভে বলা হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বিশ্বে সামরিক ব্যয় পাঁচ হাজার কোটি ডলার বেড়েছে। যেটা ক্ষুধা নিরসনে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের ব্যয়ের বহুগুণ বেশি।

আমাদের দেশ অন্যকে গম রপ্তানি করে (আপাতত ইউক্রেন — হামলার জন্যে বন্ধ) কিন্তু তবুও ভারত বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১০১তম অবস্থানে রয়েছে (২০২১-এ ১১৬টি দেশের মধ্যে) — প্রতিবেশী নেপাল বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এখানে অনাহারের হার বেশি। মোদী ক্ষমতায় আসার সময় অর্থাৎ ২০১৪-তে অনাহার তালিকায় ভারতের অবস্থান ছিল ৫৫তম। দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের অনাহারে দিন কাটে যখন সরকারি গুদামে টন টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে যায়। কারণ, সরকারের নির্মম ঔদাসীন্য। এই দেশ অর্থনৈতিক বৈষম্যে পৃথিবীতে শীর্ষে এবং তা বেড়েই চলেছে। এ দেশে ক্রমশ মজুরি কমছে, প্রতিদিন বহু মানুষ কাজ হারাচ্ছে, বলা বাহুল্য ক্রয়ক্ষমতাও হারাচ্ছে। এই বৈষম্য নিরসনে, এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগ নেই। ২০০০ সাল থেকেই অনাহার মোকাবিলায় ভারতের অবনতি ঘটছে। ২০০০ সালে এ বিষয়ে ভারতের প্রাপ্ত নম্বর ছিল — ৩৮•৮; ২০১২-তে- ২৮•৮; আর ২০২১- এ ২৭•৫; বিশ্বের যে ৪৭টি দেশ অতিমারীর সময়ে অনাহারে থাকা মানুষের অন্নসংস্থানে ব্যর্থ হয়েছে, তার মধ্যে ভারতও ছিল।

জাতিসংঘের সাধারণ বৈঠকে বিশ্বের ৭৫টি দেশের ২৩৮টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এক খোলা চিঠিতে ‘দুর্ভিক্ষ’ পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদেরই অন্যতম ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এক মর্মান্তিক তথা দিয়ে জানিয়েছে, বিশ্বে প্রতিদিন ১৬০০ শিশু অনাহারে মারা যায়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকায় পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪৫ লক্ষ শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। ৫ লক্ষ ৯০ হাজার শিশু ইতিমধ্যেই মারা গেছে।

‘এ পৃথিবীকে এ শিশুর বাসযোগ্য’ করার পরিবর্তে কর্পোরেট পুঁজির লালসার কাছে সব কিছু বিকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নদী মাটি জল বায়ু ক্ষুধার অন্ন, বিবেক মনুষ্যত্ব – সব কিছু ! যারা শিরদাঁড়া সোজা রেখে নিজের জন্য, আগামী প্রজন্মের জন্য লড়েছেন, লড়ে চলেছেন তাদের একজোট হয়ে বলার সময় এসেছে – আজ একটাই যুদ্ধ ! আর সেটা ‘ক্ষুধার’ বিরুদ্ধে !

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

against moonlighting

লেখার শুরুতে আসুন জেনে নিই, ‘মুনলাইটিং’ কী! একটি সংস্থায় নিয়মিত স্থায়ী কাজ করার পরের ফাঁকা সময় অন্য কোনও সংস্থায় অস্থায়ী কাজ করাকে কর্পোরেট ভাষায় বলা হয় মুনলাইটিং। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মীরা অনেকেই এই পদ্ধতিতে একইসাথে দুটো কোম্পানিতে কাজ করছেন। অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে অতি দ্রুত এই পদ্ধতির বিস্তার ঘটেছে। বর্তমানে কর্মসংস্থাগুলো থেকে মুনলাইটিং নিয়ে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ ফ্রিল্যান্সিং’এর গল্প ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োলো। ধরা যাক, পাঁচজনের পরিবারে আপনিই একমাত্র রোজগেরে। আপনার মাইনের টাকায় টেনেটুনে গোটা সংসার চলে। আর সেই সংসারের দোসরের নাম অভাব। আপনি ভাবছেন অভাবের দরুন ছুটির দিনে বা অফিসের পর অন্য কোনও প্রোজেক্টে কাজ করে, বাড়তি দু’ঘণ্টা খেটে দু’চার পয়সা ঘরে আনবেন? সে’গুড়ে বালি! তাতেও মালিকপক্ষ নারাজ।

সম্প্রতি উইপ্রো কোম্পানির মালিক ঋষদ প্রেমজি প্রায় ৩০০ জন শ্রমিককে মুনলাইটিং’এর অভিযোগে রাতারাতি ছাঁটাই করেছেন। ইনফোসিস’এর পক্ষ থেকে কর্মীদের প্রতি কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ইনফোসিস’এ কাজ করাকালীন অন্য কোনও সংস্থায় কাজ করা যাবেনা। এতে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের সম্ভাবনা থাকে। মুনলাইটিং’এর পদ্ধতিকে আইবিএম বলেছে অনৈতিক। কারণ মুনলাইটিং কালচারে কোম্পানির সাথে প্রতারণা করা কর্মীদের পক্ষে সহজ। সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে ইনফোসিস’এর পক্ষ থেকে মেইল পাঠিয়ে কর্মীদের সতর্ক করা হয়, যদি কেউ ইনফোসিস বাদে দ্বিতীয় কোনও সংস্থার সাথে যুক্ত থাকে, তাহলে তাকে ইনফোসিস থেকে বরখাস্ত করা হবে। দেশের সর্ববৃহৎ আইটি সংস্থা টাটা কন্সালটেন্সি সার্ভিস মুনলাইটিং নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। টেক মাহিন্দ্রার পক্ষ থেকেও আনন্দ মাহিন্দ্রা মুনলাইটিং পদ্ধতির বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন৷

কর্পোরেট সংস্থার বেশিরভাগ মালিকেরা মনে করেন, মুনলাইটিং পদ্ধতি অনুসরণ করলে কর্মীদের শ্রমশক্তি, কর্মদক্ষতা ও উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাবে। সুতরাং, একইসঙ্গে একাধিক সংস্থায় কাজ করার অধিকার পাবে না শ্রমিকেরা। অন্যদিকে, কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্বে আর্থিক মন্দা এক ভয়ানক রূপ নিয়েছে। ফলত তথপ্রযুক্তি সংস্থাগুলিতেও তার প্রভাব পড়েছে। ভারতে ১২ হাজারের বেশি আইটি কর্মী কাজ হারিয়েছেন। আমেরিকায় সংখ্যাটা প্রায় এর দ্বিগুণ। ইতিমধ্যেই ভারতে ওলা, বাইজু’স, বেদান্ত, আনঅ্যাকাডেমির মতো সংস্থাগুলোতে নিয়োগ কমানো হয়েছে। বিনা নোটিসে কাজ হারিয়েছেন লক্ষ লক্ষ যুব। দেশের যুবক-যুবতীরা বাধ্য হয়ে পড়াশোনা মাঝপথে স্থগিত করে গিগ ওয়ার্কারে পরিণত হয়েছে। কর্পোরেট সংস্থাগুলোতে কর্মীদের আট ঘণ্টার বদলে দশ-বারো ঘণ্টা ধরে কাজ করানো হয়। যার ফলে দিনের পর দিন শ্রমিকের স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে। জোম্যাটো, সুইগির ডেলিভারি দিতে গিয়ে দুর্ঘটনায় আহত, এমনকি মৃত্যুর খবরও প্রায়শই আমাদের কাছে পৌঁছোয়। অর্থাৎ বলাবাহুল্য, দেশের তরুণ প্রজন্ম এভাবেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে।

সংগঠিত ক্ষেত্রগুলোব্যয় কমাতে স্থায়ী শ্রমিক নেওয়া কমাচ্ছে। পাশাপাশি, অসংগঠিত ক্ষেত্রে অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অস্থায়ী শ্রমিকদের স্বল্পমূল্যের শ্রমে বড় বড় সংস্থাগুলো চললেও তাদের শ্রমিকের স্বীকৃতিটুকু দেওয়া হয় না। সুরক্ষা ও আইনি অধিকার তো দূরস্থ!

মোদী জামানায় ভারত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ বেকারত্বের রেকর্ড গড়েছে। নতুন শ্রম আইন কর্পোরেটদের ঠোঁটে হাসি এনে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ট্রেড ইউনিয়নগুলো একজোট হয়ে শ্রমিকের ন্যায্য দাবিসমূহ সুনিশ্চিত করতে নয়া শ্রম আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন জারি রেখেছে। মুনলাইটিং পদ্ধতিতে শ্রমিকেরা স্বেচ্ছায় একাধিক সংস্থায় কাজ করে না। পেটের দায়ে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে তারা বাধ্য হয়৷ দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও মুদ্রাস্ফীতি তার অন্যতম কারণ। শ্রমিকের নূন্যতম চাহিদা পূরণে ব্যর্থ কর্পোরেট সংস্থার মালিকেরা যেভাবে কর্মী ছাঁটাই করছে, সেই ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বরতার সুস্পষ্ট উদাহরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ যেন এক নতুন দাসপ্রথার উত্থান!

পরিশেষে বলা যায়, এই সুবিধাভোগী পুঁজিপতিদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এখনও সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে আগামীদিনে শ্রমিক শ্রেণীর ভবিষ্যৎ কালের গভীরে তলিয়ে যাবে। কৃষক-শ্রমিকেরা দেশের সম্পদ। তাদের ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ঠেলতে থাকলে এরপর দেশ চালাবে কারা? নতুন প্রজন্মের প্রশ্নের মুখে পড়ে আপনি-আমি কী জবাব দেব, ভেবেছেন?

- ত্রিয়াশা

PSC's recruitment

রাজ্য জুড়ে যখন প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষক নিয়োগে অবাধ দুর্নীতি, উৎকোচ গ্রহণ, টাকার বিনিময়ে চাকুরি নিয়ে তুমুল গন্ডগোল চলছে, মন্ত্রী ও তার পরিচিত নারী, মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রমূখ জেল খাটছেন; সাথে জুড়েছে গরু পাচার, কয়লা পাচারের বেআইনি লেনদেনের কোটিকোটি টাকা, তখন এরাজ্যের অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলে সাধারণ মানুষজন বা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি টানা প্রায় দুস্কর হয়ে পড়েছে। ফলে এরাজ্যের বেকার কর্মপ্রার্থী যুবতী যুবকের অন্যতম আশার আলো পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) কীভাবে বছরের পর বছর কর্মপ্রার্থীদের হতাশার মুখে ঠেলে দিচ্ছে তা নিয়ে কোনো হেলদোল মুখ্যধারার প্রচার মাধ্যমের দেখা যাচ্ছে না। প্রতি বছর পিএসসির ক্লার্কশিপ পরীক্ষা নেওয়া ও নিয়োগের কথা। তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসার পরে দুবার ওই নিয়োগের পরীক্ষা হয়েছে, ২০১৬ সালে ও ২০১৯ সালে। ২০১৬ সালের পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় তৃণমূল দ্বারা গঠিত স্টাফ সিলেকশন কমিশন। সেই নিয়োগও যথাবিহিত দেরি হয়। সেখানে কোনো ঘোটালা হয়েছে কিনা কে জানে?

এখনো ২০১৯ সালের নিয়োগ শেষ করা যায়নি। অনেক গড়িমসির পরে নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে জুলাই, ২০২২-এ, কিন্তু প্রায় আড়াইমাস অতিক্রান্ত হলেও নির্বাচিত প্রার্থীদের কারুরই প্রায় নিয়োগ চূড়ান্ত হয়নি।

২০১৯ সালের নিয়োগ সংক্রান্ত কাজকর্মের গতিবিধি লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় যে কর্মপ্রার্থীদের কাজ সম্পর্কে রাজ্য সরকার কতটা নির্বিকার।

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯-এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়, রাজ্যের সরকারি দফতরে কেরাণী নিয়োগের জন্য।

২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ মার্চ, ২০১৯ দরখাস্ত গ্রহণ করা হয়।

প্রাথমিক পরীক্ষা (পার্ট-১) হয় ১০ মাস পরে, ২৫ জানুয়ারি, ২০২০।

প্রাথমিক পরীক্ষার উত্তর প্রকাশ করা হয় ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০।

প্রাথমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় ৬ মাস বাদে, ২৪ জুলাই, ২০২০।

মূল পরীক্ষার (পার্ট-২) দিন নির্ধারিত হয় ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ও তা বাতিল হয়।

পরবর্তীতে মূল পরীক্ষার দিন নির্দারিত হয় ৬ ডিসেম্বর, ২০২০, এবং তা হয়।

ফল প্রকাশিত হয় সাড়ে নয় মাস বাদে, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১।

কারচুপির অভিযোগ থাকায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই ফল প্রত্যাহৃত হয় ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১।

সংশোধিত ফল প্রকাশিত হয় ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১।

অনলাইন কাগজপত্র যাচাইয়ের জন্য নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশিত হয় আরো আড়াই মাস বাদে, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১।

কাগজপত্র আপলোড করার সময় দেওযা হয় ২২ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি, ২০২২ পর্যন্ত।

কম্পিউটার টাইপ টেস্টের জন্য সময়, স্থান সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ১৫ মার্চ, ২০২২।

টাইপ টেস্টের দিন হয় ২৬ মার্চ ও ২৭ মার্চ ২০২২।

সেক্রেটারিয়েট ও ডিরেক্টোরেটে নিয়োগের জন্য নির্বাচিত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ হয় ১৫ জুন, ২০২২।

আঞ্চলিক দফতরগুলিতে নিয়োগের জন্য নির্বাচিতের তালিকা প্রকাশিত হয় ৬ জুলাই, ২০২২।

নির্বাচিত বিশেষভাবে যোগ্য প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশিত হয় ২৬ জুলাই, ২০২২।


এখনো পুলিশ ভেরিফিকেশন ও স্বাস্থ্য যাচাই হয়নি। ফলে নির্বাচিত প্রার্থীদের নিয়োগও সম্পূর্ণ হয়নি।

একটি নিয়োগ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরে ৪৩ মাস কেটে গেছে। যদি কোভিডের জন্য ৮ মাস ছাড় দেওয়াও হয়, তাহলেও প্রায় ৩ বছর অতিক্রান্ত। প্রতি পদে ঢিলেঢালা ভাব, অনীহা কর্মপ্রার্থী যুবকদের কতটা অসহায় ও হতাশ করে তোলে সে বিষয়ে কোনো ধারণা এই শাসকদের আছে বলে মনে হয় না। নিয়োগের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পরেও কেটে গেছে ২ মাস, কেন পুলিশ ভেরিফিকেশন বা মেডিক্যাল ভেরফিকেশনে এতদিন লাগবে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। অতি দ্রুত নিয়োগ করতে হবে নির্বাচিতদের।

- অমিত দাশগুপ্ত

Pre-Primary Education

জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে প্রথম তিন বছরের শিক্ষা বা তিন থেকে ছয় বছর পর্যন্ত শিক্ষা হবে অঙ্গনওয়ারিগুলিতে। বর্তমান অঙ্গনওয়ারি কর্মীরা এই শিক্ষাদানের কাজ করবেন। অঙ্গনওয়ারির কর্মীরা এরজন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ পাবেন। প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হলেই তারা শিক্ষক হিসাবে কাজ করবেন। পরবর্তী দু’বছরের ভিস্তিস্থাপক স্তরে অর্থাৎ ছয় থেকে আট বছরের শিশুদের ক্ষেত্রেও এরাই শিক্ষকতা করবেন অর্থাৎ পুরো পাঁচ বছর এরা শিশুদের শিক্ষার দেখভাল করবেন। এদের বলা হবে আর্লি চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড এডুকেশন বা ‘ইসিসিই’ শিক্ষক।

ভারতবর্ষে প্রতিবছর মোটামুটি আড়াই কোটি শিশু জন্মায়। খুব কমপক্ষে যদি দু’কোটি শিশুও প্রতিবছর বেঁচে থাকে, তাহলেও পাঁচ বছরে অন্তত দশ কোটি শিশুকে ইসিসিই শিক্ষকরা শিক্ষা দেবেন। এই ধরনের উচ্চমানের শিক্ষা দিতে হলে ছাত্র শিক্ষকের অনুপাত রাখতে হবে ৩০:১ (ধারা ২.৩)। এই হিসাব অনুযায়ী ত্রিশ লক্ষের ওপর ইসিসিই-প্রশক্ষিত শিক্ষক লাগবেই। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে নতুন শিক্ষানীতির সবকটা দিকই ২০৩০ সালের মধ্যে রূপায়ণ করতে হবে। যদি ধরা যায় যে শিক্ষানীতি সামনে আসার পর থেকে দশ বছর সময় হাতে আছে, তাহলেও প্রতিবছর তিন লক্ষ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কোথায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, তার ব্যয়ভার কে বহন করবে?

সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে অঙ্গনওয়ারির বর্তমান শিক্ষকদের মধ্যে যারা ১০+২ পাশ করে এসেছে, তাদের ৬ মাসের একটা অনলাইন কোর্স পড়িয়ে নিলেই তারা উচ্চমানের শিক্ষক হয়ে উঠবে (ধারা ১.৭)। আর যারা পাশ করা নয়, তাদের জন্য লাগবে একবছরের অনলাইন কোর্স। এই কোর্সগুলি তারা স্মার্টফোনের সাহায্যে তাদের বর্তমান কাজ করার সাথে সাথে পড়ে নিতে পারবে। শুধু তাদের পরীক্ষা নেবে একটি কেন্দ্রীয় টিম। শিশুশিক্ষায় উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি করার প্রণালী নিয়ে যখন সারা পৃথিবী তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, তখন কী সুন্দর সহজ সমাধান আমরা দিয়ে দিলাম। বলা হয়েছে এই ধরনের উচ্চমানের ইসিসিই ক্যাডার তৈরির দায়িত্ব রাজ্য সরকারের (ধারা ১.৭)। সামান্য হিসাব করলেই বোঝা যাবে যে উচ্চমানের ইসিসিই ক্যাডার তৈরির জন্য আর্থিক সঙ্গতি কোনও রাজ্য সরকারের নেই। ফলে শিক্ষক তৈরি হবে না, রাইট টু এডুকেশনও কার্যকরী হবে না।

কিছুদিনের মধ্যেই টের পাওয়া যাবে যে ১০+২ যারা পাশ করেছে তাদের ছয় মাসের অনলাইন কোর্স পড়িয়ে বা যারা কিছুই পাশ করেনি তাদের এক বছরের কোর্স পড়িয়ে কোনও উচ্চমান কেন নিম্নমানের শিক্ষকও তৈরি করা সম্ভব নয়। একমাত্র সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের অন্তত দু’বছরের কোনও কোর্স পড়িয়ে হয়তো উচ্চমানের শিক্ষক সৃষ্টি তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। এত শিক্ষক শিক্ষণ একমাত্র সম্ভবপর যদি প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টাকার বিনিময়ে আগ্রহীদের একটা কোর্স পড়িয়ে দেয়। যদি দু’এক লাখ টাকা কোর্সফি হয়, তাতেও অসংখ্য শিক্ষার্থী ছুটে আসবে। এমনিতেই এখন স্কুলের একটা কাজ পাবার জন্য কয়েক লাখ টাকা তোলা দেওয়ার নিয়ম চালু আছে। এখানে তো পাশ করলেই চাকরি। সারা ভারতে লক্ষ লক্ষ ইসিসিই-ক্যাডারের প্রয়োজন হবে। এই ব্যবসায়ে লাভ অচিন্তনীয়।

অনেক ব্যবসায়ী ইতিমধ্যেই ইসিসিই’র সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা ইত্যাদি দেবার প্রতিষ্ঠান খুলে ফেলেছেন। না এটা আমার কল্পনাপ্রসূত কথা নয়। এই মুহূর্তে ইন্টারনেট খুলে ‘ecce training institutes in india’ বলে সার্চ করলেই অন্তত ২৪টি বিজ্ঞাপন পাওয়া যাচ্ছে, যেখান থেকে এই শিক্ষা দেওয়া হবে। তালিকায় আছে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়। আশ্চর্য হবার কিছু নেই, কারণ তাদের উপাচার্য অনুরাগ বেহার ‘খসড়া এনইপি’ তৈরির কমিটিতে ছিলেন। এরা অবশ্য দেড় লাখ টাকা নেবে পড়ানোর জন্য। এছাড়া আছে মুম্বাই মন্তেসরি টিচার ট্রেইনিং ইন্সটিটিউট/ইসিসিই (এক্রেডিটেড বাই ইউএসএ), মিরাটের এপিএস কলেজ (এরা নেবে এক লাখ একাত্তর হাজার টাকা), জলন্ধরের এলপিইউ নেবে এক লাখ আঠারো হাজার টাকা। কলকাতার এপি টিচার ট্রেইনিং ইন্সটিটিউট (কোলাবরেশন উইথ লামার ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ) এবং মুম্বাইয়ের বিদ্যানিধি এডুকেশন ট্রাস্ট — এই দুই জায়গায় কিন্তু সরাসরি দেখা করা যাবেনা। প্রথমে চ্যাট করে দরাদরি ঠিক হয়ে গেলে তবে দেখা করতে পারবে। যেসব কলেজ শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত ঘরে স্মার্টবোর্ডে পড়াবে, তাদের ফি নাকি দশ লাখ অবধি উঠতে পারে। অতএব বুনিয়াদি শিক্ষার ভিত্তিস্থাপনের স্তরেই একটা বড় রকম ব্যবসার ভিত্তি স্থাপিত হয়ে গেছে।

- কমলেশ ভৌমিক
(লেখাটি লেখকের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ সম্পর্কিত একটি বড় লেখা থেকে গৃহীত ও সম্পাদিত)

HDR 2021-22

মানব উন্নয়ন সূচকের গঠনে তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত : জন্মের সময়ে প্রত্যাশিত গড় আয়ু (একসপেকটেড লাইফ এক্সপেকট্যান্সি এ্যাট বার্থ), শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয় (প্রত্যাশিত গড় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সময়কাল, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গড় সময়কাল) ও মাথাপিছু জাতীয় আয় (ক্রয়মূল্যের সমতার ভিত্তিতে)। কিন্তু ওই সূচক লিঙ্গ বৈষম্য বা আয় বৈষম্যকে প্রকাশ করে না। তাই মানব উন্নয়ন সূচক রিপোর্ট বৈষম্যকে গুরুত্ব দিয়ে ইনইকোয়ালিটি এ্যাডজাস্টেড মানব উন্নয়ন সূচকও প্রকাশ করা হয়। আর্থিক বৈষম্য যে দেশে যত বেশি সে দেশে মানব উন্নয়ন সূচক ততটা কমে যায়। ভারতের বৈষম্যের সহগ ২৪.৪ যা চিন (১৪.৮), বাংলাদেশ (২৩.১) ও নেপাল (২৪.৩)এর থেকে বেশি। ফলে বৈষম্যকে ধরে সূচক তৈরি করলে ভারতের মানব উন্নয়ন সূচকের ২৫% হ্রাস ঘটে। চিনের ক্ষেত্রে তা ১৫.২%, সারা বিশ্বে ১৯.৪%। ভারতের বৈষম্য কতটা তা আয়ের বণ্টন দেখলেই বোঝা যায়। দেশের ১% ধনাঢ্য ব্যক্তি দেশের মোট আয়ের ২১.৭% আয় করে, নিম্নতম আয়ের বন্ধনীতে থাকা ৪০% মানুষ মোট আয়ের ১৯.৮% উপার্জন করে। অর্থাৎ ১% ধনীতমদের গড় আয়ের তুলনায় ৪০% দরিদ্রতমদের গড় আয় ৪৪ ভাগের এক ভাগ। চিনের ক্ষেত্রে ওই অনুপাত ৩২। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই অনুপাত আরো কম, ৩০; ভূটান (৩২) ও নেপাল (২৭) সব কটি দেশই ভারতের থেকে তুলনামূলক উন্নত অবস্থানে আছে।

ভারতের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয় পাকিস্তান ও আফগানিস্থান ব্যতিরেকে দক্ষিণ এশিয়ার (ও চিনের) অন্য সব দেশের গড় আয়ু থেকে কম। ভারতবাসীর গড় আয়ু যেখানে ৬৭.২ বছর, বাংলাদেশের ৭২.৪ বছর, চিনের ৭৮.২ বছর। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় থাকার প্রত্যাশিত গড়ও ওই পাকিস্তান ও আফগানিস্থান ছাড়া অন্য সব দেশের থেকে কম।

লিঙ্গ বৈষম্য সূচকের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ১২২তম। ফলে শাসক বিজেপি বলতে চাইছে যে, মোদি জামানায় নারীদের মর্যাদা দেওযা হচ্ছে। খুঁটিয়ে দেখলে তেমন কিছু চোখে পড়ছে না। ২০১৮ সালেও ভারত ১২২তম স্থানে ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে ভারতের অতি অল্প বয়সের নারীদের (১৫-১৯) ১০০০ জন প্রতি ১৩.২ জন শিশু জন্মাত, ২০২১ সালে তা বেড়ে ১৭.২ হয়েছে। সংসদে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব মাত্র ১৩.৪%, যা ভূটান, নেপাল, বাংলাদেশ এমনকি পাকিস্তানের থেকেও বেশ কম। কর্মীবাহিনীতে মহিলাদের অংশগ্রহণ ২০১৮ সালে ২৩.৬% থেকে কমে ১৯.৪%এ দাঁড়িয়েছে। যা নেপাল (৭৮.৭%), ভূটান (৫১.৬%) বাংলাদেশ (৩৪.৯%) ও পাকিস্তান (২০.৭%) থেকে কম।

সামগ্রিকে আয় বৈষম্য ও লিঙ্গ বৈষম্যও ভারতের পক্ষে যথেষ্ট নৈরাশ্যব্যঞ্জক।

Periyar and

(পেরিয়ারের জন্মদিন ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর। এই দিনটিকে মনে রেখে সেপ্টেম্বর মাসের দু’টি সংখ্যা জুড়ে আমরা পেরিয়ার সম্পর্কিত এই নিবন্ধটি প্রকাশ করছি। এটি দ্বিতীয় পর্ব। – সম্পাদকমণ্ডলী)

রামাস্বামীর রাজনৈতিক জীবনে আমরা বারবার বাঁক বদল লক্ষ্য করি। যে ব্রিটিশ সরকারের শাসন নিয়ে এক সময় রামাস্বামীর বিশেষ কোনো মাথাব্যথাই ছিল না, পরবর্তীকালে আমরা দেখি এই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তিনি জেলে গেছেন। আবার ১৯২৫’র পর লক্ষ্য করা গেল এই সময় তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রচার কিছুটা হ্রাস করেন এবং আবার নিম্নবর্গীয়দের সংরক্ষণ এবং দ্রাবিড় জাতির উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে মনোনিবেশ করেন। এরপরেই আত্মমর্যাদা লীগের মধ্যে ভাঙ্গন দেখা যায় এবং ১৯৩৫’র নভেম্বরে যে জাস্টিস পার্টির সঙ্গে একসময় তার যথেষ্ট মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল সেই জাস্টিস পার্টির তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। জাস্টিস পার্টির সহায়তায় ১৯৩৫’র পয়লা জুন তিনি প্রকাশ করলেন ‘ভিদুথালাই’ বা স্বাধীনতা নামে একটি তামিল সাপ্তাহিক পত্রিকা, যা পরে দৈনিক সংবাদপত্র রূপে প্রকাশিত হতে থাকে। এই পত্রিকাই পরবর্তীকালে দ্রাবিড় জাতির মধ্যে পৃথক স্বাধীন দ্রাবিড়নাড়ুর বীজ রোপন করেছিল। ১৯৩৫এ রামাস্বামী দ্রাবিড় জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা সামনে নিয়ে আসতে লাগলেন। বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হলেন আর্য অপেক্ষা দ্রাবিড়রা অনেক পুরনো এবং সাংস্কৃতিকভাবে অনেক উন্নত একটি জাতিসত্তা এবং তামিল ভাষা ভারতীয় ভূখণ্ডের একটি প্রাচীন ভাষা। ১৯৩৭’র জুলাইয়ে মাদ্রাজ প্রদেশে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তামিল ব্রাহ্মণ শ্রী রাজাগোপালচারী। ক্ষমতায় এসেই তিনি প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রমে হিন্দি ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার সার্কুলার জারি করেন। সারা দক্ষিণ ভারত এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং এই ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে রামাস্বামী তার বিরোধী শক্তিগুলোকেও তার আন্দোলনে শামিল করতে সমর্থ হন। এই আন্দোলনের তীব্রতা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় এবং সমস্ত তামিল জনগণ যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে তাতে কংগ্রেস সরকার পিছু হটে হিন্দিকে একটি ঐচ্ছিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেন। এই আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। প্রসঙ্গত ১৯৩৮ ডিসেম্বরে রামাস্বামী জেলে থাকার সময়ই তামিলনাড়ুর প্রগ্রেসিভ ওমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে তার প্রতি সম্মান জানিয়ে তাকে ‘পেরিয়ার’ বলে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। ‘পেরিয়ার’ শব্দটির অর্থ ‘মহামানব’। হিন্দি ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিবাদ পৃথক দ্রাবিড়নাড়ুর বিষয়টিকেও সামনে এনে দেয়। ১৯৩৭ “তামিলনাড়ু তামিলদের জন্য” এই স্লোগান তামিলদের জাত্যাভিমানকে জাগিয়ে তুলেছিল। ১৯৩৭-এ জাস্টিস পার্টির উদ্যোগে ভেলোরে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে পৃথক অঞ্চল সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। এই সময়ের পর থেকে আমরা দেখছি রামাস্বামী সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের থেকে জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক আন্দোলনকে বেশি গুরুত্বপূর্ণবলে মনে করেছিলেন। এই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল, রামাস্বামী মনে করেছিলেন ব্রিটিশদের পক্ষে থাকলে দ্রাবিড়নাড়ু আদায় করা সহজ হবে। এরপর যখন ক্রিপস মিশন ভারতে আসে তিনি কমিটির প্রধান স্ট্যান্ড ফর স্ট্যান্ডফোর্ডক্রিপস’এর কাছে পৃথক ও স্বাধীন দ্রাবিড়নাড়ুর দাবি পেশের জন্য প্রতিনিধি পাঠান। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাস্টিস পার্টির সঙ্গে রামাস্বামীর মতবিরোধ শুরু হয় এবং সিএন আন্নাদুরাই জাস্টিস পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই বিতর্কিত পরিস্থিতিতেই ১৯৪৪’র জুলাইয়ে রামাস্বামীর নেতৃত্বে সালেমে জাস্টিস পার্টি ও আত্মমর্যাদা আন্দোলনের যৌথ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং জাস্টিস পার্টির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় দ্রাবিড় কাজাগম বা দ্রাবিড় সমিতি। এই সময়টা রামাস্বামীর পক্ষে একদমই অনুকূল ছিল না। নানান রকম অভিযোগে তিনি জর্জরিত হচ্ছিলেন। তারমধ্যেই তিনি পৃথক দ্রাবিড়নাড়ুর দাবিতে এগিয়ে যান। এবং ভারত রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দ্রাবিড় প্রজাতন্ত্রের দাবি তামিল জনগণের সামনে হাজির করেন। দ্রাবিড় জাতিসত্তার মুক্তি আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে রামাস্বামী দ্রাবিড় কাজাঘামের সকল সদস্যকে কালো জামা পড়তে উৎসাহিত করেন কিন্তু এটা নিয়েও শুরু হয় বিতর্ক এরপর তিনি ১৯৪৭’র ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনকে বয়কট করার ডাক দেন এবং বলেন এই স্বাধীনতা তামিলদের জন্য নয়। তামিলদের কাছে এটা একটা অশুভ দিবস। এই স্বাধীনতা আর কিছুই নয় আসলে ব্রিটিশদের হাত থেকে ব্রাহ্মণ ও বেনিয়াদের হাতে শাসন ক্ষমতার হস্তান্তর। তথাকথিত স্বাধীন ভারতে রামাস্বামী তামিল আব্রাহ্মণদের মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। এই সময় মাদ্রাজ হাইকোর্ট একটি রায়ে তামিলনাড়ুতে তপশিলি জাত ও জাতির জন্য যে সংরক্ষণ চালু ছিল তা সংবিধানের পরিপন্থী বলে ঘোষণা করে। এর বিরুদ্ধে রামাস্বামী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং কংগ্রেস ১৮ জুন ১৯৫১ সালে সংবিধানে প্রথম সংশোধন করে তপশিলভূক্ত জাত-জাতির জন্য সরকারি শিক্ষা চাকরি ও অন্যান্য পদে সংরক্ষণ পুনর্বহাল করে। এ’ভাবে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলনে পেরিয়ার রামাস্বামী সফল হন। এই সময় ১৯৫৫ অক্টোবরে ভারতের রাজ্যগুলোর সীমানা নির্ধারণের জন্য বিচারপতি ফজল আলীর নেতৃত্বে তৈরি হয় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন। দক্ষিণের রাজ্যগুলো নিয়ে দক্ষিণপ্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা নেয় কংগ্রেস। পেরিয়ার রামাস্বামী সরাসরি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন, কিন্তু তার সেই দাবি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় না। এই সময়েই দ্রাবিড় কাজাগামের স্বাধীন দ্রাবিড়নাড়ুর দাবি ভাষা-ভিত্তিক রাজ্য তামিলনাড়ুর দিকে ঘুরে যায়। ১৯৫৭ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর কংগ্রেস বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসে। এই সময় পেরিয়ার রামাস্বামী জাতপাত অস্পৃশ্যতা উৎখাতের লক্ষ্যে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রকাশ্যেই জাতপাত প্রকাশ করে এই ধরনের সমস্ত চিহ্ন বর্জন করার আহ্বান জানান। ব্রাহ্মণদের পৈতে পড়ার বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। প্রকাশ্য জনসমাবেশে বলতে থাকেন জাতপাতের বিনাশের প্রথম পদক্ষেপ হলো সেই সমস্ত চিহ্নগুলো ছুঁড়ে ফেলা যা একজনের জাত প্রকাশ করে। এই আন্দোলনের জন্য সমস্ত রকম আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং একমাত্র তাহলেই আগামী প্রজন্ম জাতপাত ব্যবস্থার অশুভ কবল থেকে মুক্ত হতে পারবে। কংগ্রেস সেই সময় দ্রাবিড় কাজাগমকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে। কংগ্রেসের এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে রামাস্বামী সারা রাজ্যজুড়ে গান্ধীমূর্তি ভাঙার ডাক দেন। উত্তেজনা বাড়তে থাকলে তামিলনাড়ু সরকার পেরিয়ার রামাস্বামীকে গ্রেফতার করে। জেল থেকে বেরোবার পরও আবার পেরিয়ার সমস্ত শক্তি দিয়ে কংগ্রেসের জাত ব্যবস্থা রক্ষার বিরুদ্ধে নানান কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এবং মনুস্মৃতি ও ভারত রাষ্ট্রের সংবিধান জ্বালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং আবার গ্রেপ্তার হন। জীবনের শেষ দিকে এসেও আমরা দেখি পেরিয়ার রামাস্বামী তার যুক্তিবাদী নিরিশ্বরবাদী প্রচার কাজ চালিয়ে গেছেন। ১৯৭০এ তার বয়স যখন ৯০’র বেশি তখন তিনি তামিল ভাষায় একটি দ্বি-মাসিক পত্রিকা ‘উন্ময়’ বা সত্য প্রকাশ করেন এবং তারসঙ্গে তৈরি করেন রেশনালিস্ট ফোরাম নামে একটি সামাজিক সংগঠন।

যেকোনো যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ এই সংগঠনের সদস্য হতে পারতেন। ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭৩ চেন্নাইয়ের সমাজে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূরীকরণ নিয়ে একটি সভায় উপস্থিত ছিলেন ৯৪ বছরের পেরিয়ার ই ভি রামাস্বামী। এই সভায়ও তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন আমাদের ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রের পরিবর্তন করতে হবে। এটাই ছিল তার শেষ বক্তৃতা। এই সভায় মাত্র কয়েক মিনিট কথা বলার পরেই তার বুকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হয়। ২০ ডিসেম্বর ১৯৭৩ তাকে চেন্নাই মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। এবং তারপর ভেলোর সিএমসি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। ২৪ ডিসেম্বর সকাল সাতটা বাইশ মিনিটে ৯৪ বছর বয়সে রামাস্বামী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ চিন্তকদের মধ্যে পেরিয়ার ছিলেন এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। তার সমসাময়িক সময়ে প্রায় কেউই এভাবে জাতপাতের বৈষম্য, ভারতীয় সমাজের স্তরবিশিষ্ট কাঠামো, সমস্ত রকম কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এত স্পষ্ট ভাষায় মতামত ব্যক্ত করেননি। পেরিয়ার তার সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়েছিলেন। নারী মুক্তি, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, দেবদাসী প্রথা ইত্যাদি সম্পর্কেও তার স্পষ্ট বৈপ্লবিক মতামত ছিল। সর্বোপরি ধর্মের বিরুদ্ধে নাস্তিকতার স্বপক্ষে এত স্পষ্ট অবস্থান এই সময়ে আমরা আর কোনও রাজনৈতিক বা সামাজিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে খুব একটা দেখতে পাই না। এখানেই পেরিয়ার রামাস্বামীর মৌলিকত্ব। তামিলনাড়ুতে বাল্যবিবাহ, বিধবা বিবাহ সম্পর্কে তার চিন্তাভাবনা আমাদের তার পূর্বসূরী বিদ্যাসাগরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই সময়ে ভারতবর্ষের রাষ্ট্র ও সমাজ সবকিছুর হিন্দুত্ববাদী বিনির্মাণ চলছে। দলিত শিশুকে শুধুমাত্র জল ছোঁয়ার অপরাধে স্রেফ মরে যেতে হচ্ছে। ধর্মীয় বিভাজন দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। ফ্যাসিবাদী কায়দায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস জারি করে অন্যস্বর অবদমিত করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে পেরিয়ার’এর মতামত শাসক শক্তির কাছে স্পষ্টতই একটা চ্যালেঞ্জ। সেইজন্যেই হিন্দুত্ববাদী শক্তির তাকে নিয়ে এত অস্বস্তি। মৃত্যুর ৫০ বছর পরেও তার স্ট্যাচুতে কালি লেপন করা হচ্ছে আর ঠিক এখানেই পেরিয়ারের প্রাসঙ্গিকতা। এই সর্বাত্মক নেতিবাচক শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের প্রয়োজন শক্তিশালী বৈপ্লবিক বিকল্প চিন্তা কাঠামো। সেই কাঠামো নির্মাণের জন্য রামাস্বামী পেরিয়ারের উপর নতুন করে আলোকপাত করা সারা দেশেই অত্যন্ত জরুরি। বিন্ধ্য পর্বতের বাধা টপকে তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সমগ্র দেশে।

(সমাপ্ত)

- সুমনা সেনগুপ

Professor Sudhakar Sardar

সুধাকর সরদার একজন আম্বেদকরপন্থী, দলিত অন্দোলনের সাথে যুক্ত অধ্যাপক, কলকাতায় অবস্থিত বি এড কলেজ জগদীশচন্দ্র বসু কলেজে অধ্যাপনা করেন। দক্ষিণ ২৪ পরগণার মন্দিরবাজারে এক সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে গেছিলেন গত ২৪ সেপ্টেম্বর। আরএসএস কর্মীরা তাঁকে নির্মমভাবে মেরেছে। আরএসএসের হামলাটা ছিল আসলে ঐ সাংস্কৃতিক কর্মসূচির ওপরেই। ওদের আক্রোশ দলিত সমাজের মাথাচাড়া দেওয়ার বিরুদ্ধে। এবং এই হামলা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে, ঠাণ্ডা মাথায়। একটি ভবনের দোতলায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কবিতা-গান-নাচের আসরে চার-পাঁচ জন আরএসএস কর্মী ঢুকে পড়ে সুধাকর সরদারকে মারতে মারতে নীচে টেনে নিয়ে আসে। বাইরে আরএসএসের আরও বড় ঠ্যাঙাড়েবাহিনী অপেক্ষা করছিল। নির্মমভাবে মারা হয় অধ্যাপক সুধাকর সরদারকে। সুধাকর আম্বেদকরের শিক্ষা তুলে ধরে এইসব এলাকায় অনেকদিন ধরেই সামাজিক কাজ করছেন। এলাকায় একটি বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে বুদ্ধমেলা শুরু হয়েছে। প্রাচীন ধর্মরাজ মেলা বা নতুন চালু হওয়া এই বুদ্ধমেলা প্রান্তিক নিপীড়িত মানুষের সামাজিক ঐক্যের পরিসর বাড়ায়। আরএসএস এই ঐক্য ভাঙতে চায়। সেই সংঘাতের পথ বেয়েই এই হামলা। সাংস্কৃতিক কর্মসূচীতে সুধাকর সরদারের বক্তব্য রাখার কথা ছিল। আরএসএস এই কর্মসূচী আটকাতে হুমকি দিতে শুরু করে। প্রথমে যে সভাঘর ভাড়া নেওয়া হয়েছিল তা বাতিল করে দেওয়া হয়। এরপরও নতুন হল ভাড়া নিয়ে যখন কর্মসূচী হচ্ছে দেখে, তখন আরএসএস হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাংস্কৃতিক কর্মসূচীতে আসা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আরএসএসের এই হামলায় আতঙ্কগ্রস্ত হয় পড়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অধ্যাপক সুধাকর সরদার ২৫ সেপ্টেম্বর দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে জানান, “হিন্দু ধর্মের আচারবিচার সম্পর্কে আমার যুক্তিবাদী অবস্থানের কারণেই এই আক্রমণ। কিছু আরএসএস কর্মী আমাকে আগেও হুমকি দিয়েছে, কিন্তু আমি ভয় পাইনি।” ঘটনার পরদিন বিভিন্ন দলিত আন্দোলন, সংখ্যালঘু সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরা মন্দিরবাজার থানায় বিক্ষোভ ও ডেপুটেশন দেওয়ার পর একজন দুস্কৃতিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, বাকিরা পলাতক বলে জানায় পুলিশ। নেপথ্য ষড়যন্ত্রকারী সন্ত্রাসী আরএসএস কর্মকর্তারা অবশ্য পুলিশের নাগালের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। দক্ষিণ ২৪ পরগণায় এই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ অত্যন্ত দ্রুত হারে বাড়ছে।

Modern slavery

আধুনিক দাসত্বের বৈশ্বিক অনুমান আধুনিক দাসত্বের মাত্রা এবং গভীরতার একটি চিত্র প্রদান করে। ২০১৭ সালের অনুমান অনুযায়ী আধুনিক দাসপ্রথা ন্যায়বিচার ও উন্নয়ন বিরোধী। বিশ্বব্যাপী ৬৮টি দেশে জোরপূর্বক শ্রম ও ৭৫টি দেশে জোরপূর্বক বিবাহের ওপর একটা জরিপ করা হয়, তাতে ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা, ওয়াক ফ্রি এবং ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের মতে আধুনিক দাসত্বের পরিস্থিতিতে প্রায় ৫ কোটি মানুষকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে বা তাদের বাধ্য করা হয়েছে জোরপূর্বকভাবে বিবাহ করতে। অর্থাৎ সেই সংখ্যা অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ১৫০ জনের মধ্যে একজন এর শিকার। টার্গেট ৮.৭ হল জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপিং গোলস্ বা ‘এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা পূরণের একটি বেসলাইন, যা সাধারণত নারী ও মেয়েদের ওপর সহিংসতা দুর করার বিষয়ে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও যা জোরপূর্বক শ্রম, আধুনিক দাসত্ব, এবং মানব পাচার, সেইসাথে শিশু শ্রম বন্ধ করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানায়।

২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ২.৪৯ কোটি মানুষ জোরপূর্বক শ্রমের আওতায় ছিল। অর্থাৎ তাদেরকে হুমকি বা জবরদস্তিতে কোনো গোপন কারখানায় বা খামারে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ১.৫৪ কোটি মানুষ জোরপূর্বক বিবাহের শিকার। অর্থাৎ তারা তাদের যৌন স্বয়ত্তশাসন হারিয়েছিল। আধুনিক এই দাসপ্রথা বা দাসত্বের এই ব্যবস্থায় মহিলা বা মেয়েরাও পিছিয়ে নেই। এরমধ্যে প্রায় ৭১ শতংশ বা ২.৮৭ কোটি হলো মহিলা। এই মহিলা বা নারীদের প্রায় ৯৯ শতংশই বাণিজ্যিক যৌন সংস্থার শিকার। আর বাকি খাতেও মহিলা এবং মেয়েদের কাজ করানো হয়। এছাড়াও এই আধুনিক দাসত্বের শিকার চারজনের মধ্যে একজন শিশু। গত পাঁচ বছরে, প্রায় ৮.৯ কোটি মানুষ আধুনিক দাসত্বের কোনো না কোনো রূপের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। সারা বিশ্ব জুড়েই এই আধুনিক দাসপ্রথা চলে এসেছে, এবং যা জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় রেখাজুড়ে বিভক্ত। যার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় আফ্রিকায়, তারপর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জোরপূর্বক শ্রমের ওপর যে পরীক্ষা নেওয়া হয় তাতে দেখা যায়, বাধ্যতামূলক শ্রমের শিকার প্রায় ২৪.৯ কোটি মানুষ। তারমধ্যে আবার ১.৬ কোটি ব্যক্তিগত অর্থনীতিতে, ৪৮ লক্ষ যৌন শোষণে এবং প্রায় ৪১ লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রীয় কতৃপক্ষের দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক শ্রমশক্তির শিকার। এছাড়াও জোরপূর্বক শ্রমের বেশিরভাগ ঘটনা (৮৬ শতংশ) বেসরকারি খাতে পাওয়া যায়। পুরুষদের চেয়ে মহিলারা বেশি এই জোরপূর্বক বা বাধ্যতামূলক শ্রমের শিকার হন। প্রাপ্তবয়স্কদের এই সব শ্রমের মধ্যে ছিল, গৃহকর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, ম্যানুফ্যাকচারিং এবং কৃষি ও মাছ ধরা। অন্যদিকে জোরপূর্বক বাণিজ্যিক যৌন শোষণের পাঁচজনের মধ্যে প্রায় চারজনই নারী বা মেয়ে। বাধ্যতামূলক শ্রমের আটজনের মধ্যে প্রায় একজন শিশু (৩৩ লক্ষ)। এরমধ্যে অর্ধেকের বেশি ব্যবসায়িক যৌন শোষণের শিকার।

২০২১ সালের গণনা অনুযায়ী প্রায় ২ কোটি মানুষ জোরপূর্বক বিবাহে আবদ্ধ। এটি ২০১৬ সালের বৈশ্বিক অনুমান থেকে ৬৬ লক্ষ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও পুরুষ এবং ছেলেরাও জোরপূর্বক বিয়ের শিকার হতে পারে, তবে মহিলা এবং মেয়েরাই বেশিরভাগ (৮৮ শতংশ) এর শিকার। যারমধ্যে এক তৃতীয়াংশেরও বেশি (৩৭ শতংশ) মেয়েদের বিয়ের সময় বয়স ১৮ বছরের থেকেও কম ছিল। আবার এই রকম বিবাহে বিশেষ করে ১৬ বছর বা তার কম বয়সী শিশুরা জড়িত, কারণ একটি শিশু আইনত বিয়েতে সম্মতি দিতে পারে না। তাই বাল্যবিবাহও জোরপূর্বক বিয়ের অন্তর্ভুক্ত। জোরপূর্বক বিবাহ দীর্ঘস্থায়ী পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব এবং অনুশীলনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং এটি অত্যন্ত প্রসঙ্গ নির্দিষ্ট। বেশিরভাগ (প্রায় ৮৫ শতংশ) বিয়েই পারিবারিক চাপ দ্বারা চালিত। এবং জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে দেখা যায়, এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই প্রকার বিয়ের সংখ্যা বেশি।

অ-অভিবাসী শ্রমিকদের তুলনায় অভিবাসী শ্রমিকদের জোরপূর্বক শ্রমে নিযুক্ত হওয়ার সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেশি। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন বা ‘আইওএম’র মহাপরিচালক আন্তোনিও ভিতোরিনো বলেছেন, “অভিবাসীদের জোরপূর্বক শ্রম এবং ব্যক্তিদের পাচারের ঝুঁকি হ্রাস করা প্রভৃতি নির্ভর করে অভিবাসীদের মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতাকে সম্মান, সুরক্ষা আইনের ওপর। বিশ্বজুড়ে অভিবাসন সংক্রান্ত এই কম্প্যাক্ট এবং এইসব প্রবণতাগুলিকে পাল্টাতে সমগ্র সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”

বৈশ্বিক অনুমান অনুসারে, জোরপূর্বক শ্রম এবং জোরপূর্বক বিবাহ এখনও প্রত্যাহার করা হয়নি তবে ২০৩০ সালের মধ্যে আধুনিক দাসত্ব এবং মানব পাচারের অবসান ঘটাতে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হবে। আইএলও’র প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবিত পদক্ষেপের প্রস্তাব করা হয়েছে যা একসাথে এবং দ্রুত নেওয়া হলে আধুনিক দাসত্বের অবসানের দিকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে। সাধারণত, দারিদ্র, আকস্মিক চাকরি হারানো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক সংকট ইত্যাদি সমস্যাগুলিও মানুষকে আধুনিক দাসত্বের দিকে ঠেলে। আইএলও অনুমান করে যে, কিছু অগ্রগতি হলেও, ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষের পর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষা নেই। ক্যাশ ট্রান্সফার স্কিম, সরকারি কর্মসংস্থান কর্মসূচি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মাতৃত্ব সুরক্ষা, অক্ষমতার সুবিধা, বেকারত্ব সুরক্ষা, এবং বৃদ্ধ বয়সে আয় সুরক্ষা সবই একটি সুপরিকল্পিত সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে প্রাসঙ্গিক যা বাধ্যতামূলক শ্রমের দিকে পরিচালিত করতে বাধা দিতে পারে। এবং জোর করে বিয়ের ঝুঁকিও কমায়। এছাড়াও সকলের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বৈশ্বিক অনুমানগুলি আধুনিক দাসত্বের দ্বারা কীভাবে প্রভাবিত হয় তার পরিপ্রেক্ষিতে নারী এবং পুরুষের মধ্যে সমর্থক পার্থক্য নির্দেশ করে। বিশেষ করে, মহিলা এবং মেয়েরা বেসরকারী অর্থনীতিতে (গৃহস্থালির কাজ এবং বাণিজ্যিক যৌন শোষণ সহ) এবং জোরপূর্বক বিয়ে এবং জোরপূর্বক শ্রমের শিকার হয়। আইএলও’র প্রতিবেদনের পদক্ষেপগুলির মধ্যে রয়েছে — আইনি সুরক্ষার উন্নতি এবং প্রয়োগ এবং শ্রম পরিদর্শন, রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত বাধ্যতামূলক শ্রমের অবসান, জোরপূর্বক শ্রম এবং মানুষ পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শক্তিশালী পদক্ষেপ, সকলের সামাজিক সুরক্ষা প্রসারিত করা, বিয়ের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছরে উন্নীত করা। অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে অভিবাসী কর্মীদের পাচার এবং জোরপূর্বক শ্রমের বর্ধিত ঝুঁকি এড়াতে ন্যায্য ও নৈতিক নিয়োগের প্রচার, এবং নারী, মেয়ে এবং দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য বৃহত্তর সমর্থন।

- অবন্তী

Comrade Amal Bhattacharya

“অমল ভট্টাচার্য ‘কাল্টুদা’র মতো ক্লান্তিহীন কমিউনিস্ট যোদ্ধা, যাঁরা নিজেরাই একটা কাজের ঘরানা, সেই সমস্ত কমরেডরা আজও আমাদের অনুপ্রেরণা।” রবিবার কমঃ অমল ভট্টাচার্যের স্মরণসভায় এভাবেই তাঁর স্মৃতিচারণা করলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। গত ১ সেপ্টেম্বর ৯০ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন পার্টির বর্ষীয়ান সহযোদ্ধা কমঃ কাল্টুদা। তাঁকে স্মরণ করে একটি সভার আয়োজন করা হয়েছিল যাদবপুরের সংস্কৃতি চক্র সভাগৃহে।

এই স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সহ পার্টির রাজ্য, কলকাতা জেলা ও যাদবপুর-ঢাকুরিয়া এলাকার নেতৃবৃন্দ। উপস্থিত ছিলেন কাল্টুদা’র হাতে গড়া যাদবপুরের জনস্বাস্থ্য জলাশয় ও পরিবেশ রক্ষা কমিটির সহযোদ্ধারা। এক সময়ে ভবানীপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় কাল্টুদা’র সঙ্গে কর্মরত কমরেডরা ও স্থানীয় বহু সাধারণ মানুষ উপস্থিত ছিলেন এই স্মরণসভায়। কাল্টুদাকে স্মরণ করে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে নীতীশ রায় বলেন, “জুনিয়ার চিকিৎসক আন্দোলনের সময় থেকেই কাল্টুদার সঙ্গে পরিচয়। স্ত্রীর মারণব্যাধির চিকিৎসার প্রতিটি পর্যায়ে কাল্টুদার সাহচর্য ও সহযোগিতা পেয়েছি।” জলাশয় ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে কাল্টুদার সহকর্মী শান্তনু চক্রবর্তী বলেন, “খুব অল্প সময়ের পরিচয় হলেও, এটা প্রথম দিন থেকে বুঝেছি কাল্টুদার মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রশস্ততা ও উদারতা ছিল। অশক্ত শরীর নিয়েও পরিবেশ রক্ষার কাজে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন কাল্টুদা। খ্যাতি-নাম-যশের বদলে সকলের দরদী ও ভালোবাসার মানুষ ছিলেন তিনি।”

আরএসপি দলের নেতা কমঃ পুলক কৃষ্ণ মৈত্র বলেন, “আমার পাশের পাড়াতেই কাল্টুদা থাকতেন। বিভিন্ন সময়ে দেখা হত, জলাশয় ও পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে মত বিনিময় হত। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে, এটাই তাঁর সহজাত গুণ ছিল। তিনি চলে গেলেও, আমাদের সেই কাজ সম্পন্ন করতে হবে।”

কাল্টুদা’র মেয়ে দেবপ্রিয়া ভট্টাচার্য বলেন, “ঠাকুরদার দেখানো পথেই আমার বাবা রাজনীতিতে এসেছিলেন। সবসময় অন্যদের সামনে এগিয়ে দিতেন। নিজে পেছনে থেকে কাজ করতেন। এলাকার সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে কীভাবে পরিবেশ আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়, তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা অনেক পরে যুক্ত হয়েছি। সেই অধরা কাজ আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।”

কমঃ কাল্টুদা’র স্মৃতিচারণায় পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “কবি সুকান্তের ভাষায়, এই পৃথিবীকে জঞ্জালমুক্ত করে নবজাতকের জন্য বাসযোগ্য করে যাওয়াই কমিউনিস্টদের কাজ। কমরেড কাল্টুদা সেই কাজটাই আমৃত্যু করে গিয়েছেন। অত্যন্ত অনয়াসে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যে কাজটা করতেন, সেটা আমাদের সকলের কাছে শিক্ষণীয়। এই কাজগুলোই আমাদের শহরাঞ্চলের কাজের ধারা হতে পারে। এই মুহূর্তে ভারতবর্ষ ফ্যাসিবাদী বিপদের সম্মুখীন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে এই ধরনের বিপদ তৈরি হয়নি। এই মুহূর্তে পরিবেশ রক্ষা, গণতন্ত্র রক্ষা আমাদের অন্যতম মূল কাজ। আম্বেদকর বলেছিলেন, আমাদের দেশে হিন্দুরাজ কায়েম হলে সেটাই হবে সবথেকে বড় বিপর্যয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা এই সময়ে ভারত সহ গোটা বিশ্বে অন্যতম বড় সঙ্কট। দিশা নির্দিষ্ট রেখে কোনও কিছুতেই হতাশ না হয়ে কাজ করে যাওয়া কাল্টুদাদের মতো মানুষের কাছ থেকে আমাদের সকলের শেখা উচিত।”

অভিজিৎ সাহা বলেন, “আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক থাকলেও, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাল্টুদা আমার কমরেডই ছিলেন। বাটানগরে শ্রমিকদের আন্দোলনে প্রথম কাল্টুদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। ছাত্রাবস্থায় শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আহ্বানে কাল্টুদার থেকে অনেক কিছু শিখেছি আমরা। একটা প্রজন্মের ইতিহাস আমরা কাল্টুদার মতো মানুষের মুখ থেকে জেনেছি। আজীবন লড়াই করে যাওয়া এই মানুষগুলো একে একে চলে যাচ্ছেন। ওই প্রজন্মের লড়াইয়ের ইতিহাসকে আগামী প্রজন্মের জন্য আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে।”

এদিনের স্মরণসভায় কাল্টুদা’র স্মৃতিচারণা করে বক্তব্য রাখেন, ভাগ্নে রাজীব রায়, জলাশয় রক্ষা আন্দোলনের সহকর্মী নির্মল চৌধুরী, সুচিশ্রী রায়, নিত্যানন্দ ঘোষ, মানস ভট্টাচার্য সহ অন্যান্যরা।

অমল ভট্টাচার্য ‘কাল্টুদা’র ফেলে রেখে যাওয়া কাজ সম্পন্ন করার শপথ নিয়ে ইন্টারন্যাশানাল গানের মাধ্যমে শেষ হয় স্মরণসভা।

সম্পাদক,
১৫ সেপ্টেম্বর সংখ্যার সম্পাদকীয় শিরোনাম “পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল পথে নামতে হবে বুঝে-সুঝে” আমার কাছে বিভ্রান্তিকর ও সংশয়দীর্ণ। এ কথার অর্থ কী? সাতবার ভাবব, তারপর বুঝব এবং অবশেষে পথে নামব! জনগণ বলবেন, “অমন বিপ্লবীদের দরকার নেই। পথে তো নামি, তারপর বোঝা যাবে। আর শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রবাহিনী হয়ে আমরাই কিনা এত দ্বিধা জর্জর! আসলে মূল নিবন্ধটিতে সমসাময়িক রাজ্য রাজনীতির গতিসূত্রকে ব্যাখ্যায় কোন ভুল হয়নি। গোল বেধেছে শুধু শিরোনামকে ঘিরে। প্রবন্ধের অন্তর্বস্তু উচ্চমানের হলে শিরোনামকে অবশ্যই তার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হতে হবে।
- বিনোদ আহির, বৈঁচি

== 0 ==

খণ্ড-29
সংখ্যা-38