প্রতিবেদন
অপেক্ষমান সমস্ত এসএসসি প্রার্থীদের নিয়োগ করতে হবে
to be recruited

কোনো কোনো আন্দোলন কীভাবে মৃদু নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে রাজনৈতিক বিন্যাস পাল্টে দিতে পারে তা প্রত্যক্ষ করেছিল এই পশ্চিমবঙ্গ দেড় দশক আগে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জোর করে কৃষিজমি দখলের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা কৃষকদের সমবেত প্রতিরোধে, সমাজের অন্য বর্গের লোকেরা বাধ্য হয়েছিল তার পাশে দাঁড়াতে। গত ১১ বছর ধরে তৃণমূল ক়ংগ্রেস সারা রাজ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভা হয়ে লোকসভা পর্যন্ত, জোর করে লোভ দেখিয়ে গাঁজা কেসের ভয় দেখিয়ে পুলিশ লেলিয়ে নিজেদের নিরঙ্কুশ করে তুলেছে; তোলাবাজি, সিণ্ডিকেটরাজ, দুর্নীতি, ঘুষকে প্রসারিত করেছে নির্মাণ, ব্যবসা, নিয়োগ, আবাস যোজনা, লক্ষী ভান্ডার, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা সর্বত্র। কলেজের ছাত্রনেতা থেকে শিক্ষামন্ত্রী পর্যন্ত সকলেই ভেবেছিলেন এমনভাবেই দিন কেটে যাবে। কিন্তু শিক্ষক পদে কর্মপ্রার্থী যুবকরা সমাজের অন্যতম প্রকৃত শিক্ষক হয়ে নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে এমন এক আন্দোলন গড়ে তুললেন যে তা ওই ‘সর্বশক্তিমান’ তৃণমূল কংগ্রসের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যে আন্দোলন ছিল চারাগাছ আজ তা মহীরূহে পরিণত হয়ে সমাজের বহু গণতন্ত্রপ্রিয় নাগরিকের কাছে আশার আলো দেখাচ্ছে।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে তৎকালীন আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। স্বচ্ছ নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো প্রতিশ্রুতি পালিত না হওয়ার কারণে প্রায় সাড়ে পাঁচশ দিন ধরে ক্রমান্বয়ে অবস্থান করছে সহস্রাধিক বঞ্চিত নিয়োগপ্রার্থী। আন্দোলনকারীরা একদিকে যথাবিহিত নিয়োগের দাবিতে অবস্থান অনশন করছে, অন্যদিকে বেআইনি নিয়োগের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েছে। আদালতের নির্দেশে বেশ কিছু বেআইনিভাবে নিযুক্ত শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। পরিবর্তে চাকরি পেয়েছে তালিকায় থাকা দুজন।

শিক্ষক নিয়োগের বিধিনিষেধ, যা মূলত এনসিইআরটি (জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ পর্ষদ) দ্বারা প্রণীত, তার মধ্যেই যথেষ্ট গলদ রয়েছে। শিক্ষা প্রশিক্ষণের সরকারী প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত কম রয়েছে, কিন্তু বিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে গেলে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের জন্য বিএড ও প্রাথমিকের জন্য ডিএড উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যিক করা হয়েছে। ফলে ব্যাঙের ছাতার মতো শিক্ষা প্রশিক্ষণের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে, মুনাফা করা হচ্ছে ট্রাস্টের নামে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলি পাঠরত ছাত্রীছাত্রদের শিক্ষকতায় নিয়োগের জন্য প্রভাব বিস্তার করছে, উৎকোচের বিনিময়ে, যে অর্থ ছাত্রদের কাছ থেকেই আদায় করা হচ্ছে। শিক্ষা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন থেকেই টাকার খেলা শুরু হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক কালে শিক্ষক নিয়োগের যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে সেটিই জানিয়ে দিচ্ছে যে নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে ও অস্বচ্ছভাবে নিয়োগের বন্দোবস্ত করে টাকার বিনিময়ে নিয়োগের উপায় করে দেওয়া হয়েছে। সাধারণভাবে নিয়োগের পরীক্ষা দেওয়ার পরে ফলাফল ঘোষিত হবে ও প্রত্যেক পরীক্ষার্থী তার প্রাপ্ত নম্বর ও তালিকার ক্রমিক সংখ্যা জানতে পারবেন। এটাই স্বচ্ছতা। ২০১৬ সালে ডিসেম্বর মাসে হওয়া স্কুল সার্ভিস কমিশনের নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার পরীক্ষার্থীদের তেমন কোনো ফল প্রকাশিত হয়নি। প্রথমে কাগজপত্র (ডকুমেন্টস) যাচাই করার জন্য একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়, যেখানে পরীক্ষার্থী অনলাইনে নিজের দরখাস্ত সংক্রান্ত কিছু তথ্য দিয়ে জানতে পারেন যে তিনি ওই ডকুমেন্টস যাচাইযোগ্যতা অতিক্রম করেছেন কিনা। অন্য কে বা কার অতিক্রম করেছেন তা জানা যায় না। প্রথম পর্যায়ের যাচাই সম্পূর্ণ হওয়ার পরে একইভাবে দ্বিতীয় পর্যায়, সেটির পরে তৃতীয় পর্যায়ের যাচাই সংক্রান্ত তথ্য একইভাবে পাওয়া যায়।

যাচাই পর্বের পরে নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের সময়েও কোনো তালিকা প্রকাশিত হয় না। যাচাই করা পরীক্ষার্থীরা নিজেদের দরখাস্ত সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে জানতে পারেন যে তিনি প্যানেলে বা অপেক্ষমান তালিকায় আছেন কিনা। ১৯ জন পরীক্ষার্থী আদালতে মামলা করলে মাননীয় বিচারপতি শেখর ববি সরাফ তালিকা প্রকাশের নির্দেশ দেন। তালিকা প্রকাশ করা হয়, নির্বাচিতদের ও অপেক্ষমানদের প্যানেল। ওই তালিকাতেও কোনো প্রাপ্ত নম্বরের অস্তিত্ব থাকে না। বহুক্ষেত্রে একই নাম প্যানেলের তিন চার স্থানে থাকে; যেমন, কোনো মহিলা পরীক্ষার্থীর নাম সাধারণ মহিলা, সাধারণ মহিলা ও পুরুষ, তফশিলী জাতি মহিলা এবং তফশিলী জাতি মহিলা ও পুরুষ এই চারটি স্থানেই হয়তো থেকেছে। ফলে তাঁকে নিয়োগের পরে তিনটি স্থান খালি থেকেছে। সেই নিয়োগের জন্য আবার অপেক্ষমানদের থেকে তালিকা প্রকাশ পাওয়ার পরে নতুন অপেক্ষমান তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এমনও হয়েছে যে নতুন তালিকায় পুরোনো অপেক্ষমানদের টপকে আগে অপেক্ষমান তালিকায় না থাকা প্রার্থীর নামও চলে এসেছে। অমনটাই হয়েছিল মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর ক্ষেত্রে। তাঁর চাকরি গিয়েছে। অন্য আরেকজন প্রার্থী ইনসান আলিরও চাকরি গিয়েছে। কিন্তু যেটা ঘটেছে তা অদ্ভুত। ইনসান আলি ওবিসি শ্রেণীতে একজনকে টপকে চাকরি পেয়েছিলেন। তাই তাঁর চাকরি গেছে। কিন্তু তাঁর মোট প্রাপ্ত নম্বর সাধারণ শ্রেণীতে নিয়োজিত শেষ নম্বরের থেকে বেশি। ফলে তিনি সেই চাকরি পাওযার যোগ্য। এখানে যে মোট প্রাপ্ত নম্বরের কথা বলা হচ্ছে তা জানা গিয়েছে আদালতের নির্দেশে সমস্ত এমপ্যানেলড ও অপেক্ষমান প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশের পরে। ওই তালিকা প্রকাশের পরেও কতজন বেআইনি ভাবে নিযুক্ত তা জানা যাচ্ছে না, কারণ কারা প্যানেলের বাইরে থেকে নিযুক্ত হয়েছেন তা খোঁজা সমস্যাজনক। আন্দোলনরত প্রার্থীরা বিভিন্ন সূত্র থেকে বা আরটিআইএর মাধ্যমে বিদ্যালয় থেকে নবনিযুক্তদের নাম জানতে ও প্রকাশিত প্যানেলের সঙ্গে মিলিয়ে প্যানেল বহির্ভুত বা ক্রম টপকানোদের চিহ্নিত করতে পারছেন। প্রাপ্ত নম্বরযুক্ত তালিকা প্রকাশের পরে দেখা যায় অনেকে শিক্ষাগত যোগ্যতার ও পরীক্ষার মাপকাঠিতে প্রথম পর্যায়ে ডাক পাওয়া প্রার্থীর থেকে বেশি নম্বর থাকা সত্বেও সেই পর্যায়ে যাচাইএর জন্য ডাক পাননি। কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে প্রার্থী আরটিআই করে নিজের প্রাপ্ত নম্বর যেটা জেনেছিলেন (সাক্ষাতকারে বা পরীক্ষায়) তার থেকে প্রকাশিত তালিকায় প্রাপ্ত নম্বর পৃথক। ফলে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নের সম্মুখীন।

এই যে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে হইচই তা পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সরকারি স্তরে সমস্ত নিয়োগের সামনেই এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন দাঁড় করিয়েছে। প্রশ্নটা যতটা না যোগ্য বা অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের তার থেকে অনেক বেশি অসৎ, নিয়োগের শুরুতেই দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকের; আরো বড় প্রশ্ন শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বাঙ্গীণ দুর্নীতির। গ্রাম-ব্লক-মহকুমা-জেলা-শহর-কলকাতা জুড়ে দুর্নীতির এই বৃহৎ শৃঙ্খল সাজিয়ে তুলে নিয়োগে উৎকোচ থেকে সমস্ত সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রে তোলাবাজির নরক তৈরি করেছে শাসক দলের গুন্ডাবাহিনী।

বড় প্রশ্ন হচ্ছে আন্দোলনরত প্রার্থীদের যথাবিহিত চাকরির। একদিকে বেআইনিভাবে নিযুক্ত প্যানেল বহির্ভুত বা প্যানেল টপকানো প্রার্থীদের খুঁজে বের করে তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে; এবং দুর্নীতি উৎকোচের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত তৃণমূল ও বেশ কিছু তৃণমূল থেকে বিজেপিতে রূপান্তরিত নেতাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। অপরদিকে যেহেতু পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটিই চরম অস্বচ্ছ, তাই সমস্ত আন্দোলনরত অপেক্ষমান প্রার্থীদের নিয়োগ করতেই হবে। তার জন্য অতিরিক্ত শিক্ষক পদ তৈরি করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যালয়স্তরে শিক্ষাকে উপযুক্ত মানে পৌঁছতে গেলে বহু শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা অবশ্য প্রয়োজনীয়। তাই, গত ২০১৬ থেকে প্রতীক্ষায় থাকা, গত ২০১৮ সাল থেকে আদালতে মামলা করা, ধর্মতলায়, বিধাননগরের বিকাশ ভবনে বা সেন্ট্রাল পার্কের সামনে অনশন অবস্থান করা যথাবিহিত প্যানেলে থাকা সমস্ত প্রার্থীদের চাকরি দেওয়া রাজ্য সরকারের অবশ্য কর্তব্য।

সাধারণভাবে আন্দোলনের ফলে নিয়োজিত প্রার্থীদের অনেকেই মনে করবেন যে ওই নিয়োগের জন্য আন্দোলনের ভূমিকা নগণ্য, কিন্তু সেইসব নবনিযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মনে রাখতে হবে যদি এই ধারাবাহিক আন্দোলন না হোত তাহলে টেবিলের তলায় লেনদেনের মাধ্যমেই চাকরি নিয়ম হয়ে দাঁড়াতো। ভবিষ্যতের সরকারি পদে বিধিসম্মত নিয়োগের ক্ষেত্রেও শিক্ষক পদপ্রার্থীদের আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আন্দোলনরত শিক্ষকপদ প্রার্থীদের এই লেগে পড়ে থাকা অধ্যবসায়কে কুর্ণিশ জানাতেই হবে।

– অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-34