সিদ্ধান্ত
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন : কেন্দ্রীয় কমিটির বিজয়ওয়াড়া বৈঠকে গৃহীত ঘোষণা
meeting of the Central Committee

বিজয়ওয়াড়ার এম বি বিজ্ঞানা কেন্দ্রমে গত ২৫-২৭ আগস্ট ২০২২ সিপিআই(এমএল) লিবারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে। শুরুতে শহীদ ও প্রয়াত কমরেড ও অন্যান্য লড়াইয়ের সাথীদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় — ভোজপুরের কমরেড কামতা প্রসাদ, বৈজনাথ প্রসাদ ও তাঁর পুত্র অজিত কুমার যাঁরা গত ১০ মে সামন্তী গুণ্ডাদের দ্বারা খুন হন, কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাক্তন সদস্য অরূপ সেনগুপ্ত (দিনাজী), যিনি ১৯৮০’র দশকে চীনে যাওয়া পার্টির প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন, রাকেশ দিবাকর, ভোজপুরের সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিক্ষক রাজেশ, তামিলনাড়ু রাজ্য কমিটির প্রাক্তন ও ত্রিচি জেলা লিডিং টিমের বর্তমান সদস্য মহেন্দ্রন, ঐ রাজ্যেরই মাণিকম, পুডুচেরীর ধাতচিনামুর্তি, ত্রিপুরার অনন্ত সুন্দরী জামাতিয়া ও হীরাবালা নাথ, কার্বি আংলঙয়ের সিং কিলিং, মোহেন বে ও রাজেন রংপি, দিল্লীর বালিচরণ রাম, শিলিগুড়ি লোকাল কমিটির সম্পাদক মোজাম্মেল হক, ১৯৭০ দশকের প্রথমার্ধে উঠে আসা নকশালপন্থী বর্ষীয়ান নেতা লেবাচাঁদ টুডু, পূর্ব চম্পারণের চৌরাদানোর জামুন পাসোয়ান, কৈমুরের বালিরাম প্রসাদ, নওয়াদার (আরা) দেবানন্দ প্রসাদ, ভোজপুরের রামনিহাল গুঞ্জন, আরওয়ালের নাগিয়া দেবী, ঝাড়খণ্ডের রামগড়ের সোহরাই বেদিয়া ও রামজী সিং, উত্তরপ্রদেশের বাবুরাম কুশোয়াহা ও ছাঙ্গুর গোন্দ, প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা ও কেন্দ্রাপাড়া জেলা কমিটির সদস্য অঞ্চল গিরি, ওড়িশায় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ভূতপূর্ব রাজ্য সম্পাদক ও তিনবারের সাংসদ শিবাজী পট্টনায়ক, সাতের দশকের প্রথমার্ধ থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বর্ষীয়ান সংগঠক শ্রীধর মিশ্র, বর্ষীয়ান কৃষক নেতা ও ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নে চৌধুরী মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের সহযোদ্ধা গুলাম মহম্মদ জৌলা, বিহারের প্রাক্তন বিধায়ক রামদেব ভার্মা যিনি ২০২০তে এই পার্টিতে যোগ দেন, কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাক্তন সদস্য ও জনসংস্কৃতি মঞ্চের অসম রাজ্য সভাপতি হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর, অসমের ডঃ আব্দুল আজিজ আহমেদ, ইতিহাসবিদ দেবব্রত ব্যানার্জী, ১০ এপ্রিল ২০২২ ত্রিকুটে (দেওঘর) রোপওয়ে দুর্ঘটনায় নিহত মানুষজন, ১৫ মে ২০২২ দিল্লীর মানডাকা কারখানায় নিহত ২৭ জন শ্রমিক — এঁদের সকলের স্মৃতিতে নিবেদন করা হয়। দ্বিতীয় দিনে বৈঠক শুরুর সময়ে কমরেড বি বি পাণ্ডের প্রথম প্রয়াণ বার্ষিকীতে তাঁর স্মরণে নীরবতা পালন করা হয়।

মূল মূল গৃহীত বিষয়গুলি হল —

১) সম্প্রতি রাজস্থানের একটি সরস্বতী বিদ্যামন্দিরে ‘জাতপাতের বিধিনিষেধ’ লঙ্ঘন করে দলিতদের জন্য নিষিদ্ধ পাত্র থেকে জল পান করার জন্য ৯ বছর বয়সী দলিত শিশু ইন্দ্র মেঘওয়ালকে একজন শিক্ষক নির্মমভাবে পিটিয়ে খুন করেছে এবং ২০০২’র গণহত্যার সময়ে বিলকিস বানোকে ধর্ষণ ও তাঁর পরিবারকে হত্যার অপরাধীদেরকে গুজরাট সরকার ছেড়ে দিয়েছে। এই দু’টি ঘটনায় কেন্দ্রীয় কমিটি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছে। কেন্দ্রীয় কমিটি ইন্দ্র মেঘওয়ালের হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কঠিন শাস্তি এবং সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন অন্তর ঘটে চলা রোহিত ভেমুলা থেকে ইন্দ্র মেঘওয়ালের মর্মান্তিক প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার মত সমস্ত দলিত-বিরোধী বিভাজন সম্পূর্ণরূপে নিকেশ করার দাবি জানাচ্ছে। বিলকিস বানোর ঘটনায় দোষীদের খালাস করার সিদ্ধান্তও প্রত্যাহারের দাবি করছে। এহসান জাফরি সহ গুলবার্গ সোসাইটির ঘটনার শিকার অন্যান্যদের ন্যায়বিচারের দাবিতে জাকিয়া জাফরির দাখিল করা পিটিশন খারিজ হয়ে যাওয়া ও তিস্তা শেতলবাদের গ্রেপ্তারির ঘটনার পরপরই বিলকিসের ধর্ষক ও তাঁর পরিবারের খুনে অভিযুক্তদের পুরস্কৃত করা হল। গুজরাট গণহত্যার সমস্ত চক্রীদের বেকসুর খালাস ও জামিনে মুক্তি এবং পুলিশ ও গোয়েন্দা আধিকারিক সঞ্জীব ভাট, আর বি শ্রীকুমার, মানবাধিকার কর্মী তিস্তা শেতলাবাদের মতো ন্যায়ের পক্ষে থাকা লড়াকু মানুষদের উপর নিপীড়ন ও গ্রেফতারি আসলে গুজরাট গণহত্যার ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়াকে পদ্ধতিগতভাবে উলটোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার ও নস্যাৎ করে দেওয়ার প্রয়াস। জাতপাতের নিপীড়ন ও ন্যায়বিচারকে হত্যা করার এইসব ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্তের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় কমিটি দেশজুড়ে শক্তিশালী প্রতিবাদের আহ্বান জানাচ্ছে।

২) বিহারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিকাশ নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি আলোচনা করেছে। বিহার রাজ্য কমিটি সঠিকভাবেই এই অবিজেপি সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এই সরকারকে কিছু ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি গ্রহণের ও তা বাস্তবায়নে তদারকির জন্য একটি সমন্বয়কারী কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। নতুন সরকারের তরফে অবশ্যই সমস্তরকম সাম্প্রদায়িক হিংসা ও জাতিগত নিপীড়নকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করে বিজেপি মডেলের শাসন প্রণালীকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করা এবং নাগরিক সমাজ ও গণআন্দোলনগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত। এই নতুন পরিস্থিতিতে একদিকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইকে ঘনীভূত করতে আর অন্যদিকে জনগণের কাছে রাখা সমস্ত প্রতিশ্রুতি পালনে এবং জনকল্যাণ ও মানুষের মৌলিক চাহিদার বিষয়গুলোর উন্নততর বিলিবণ্টনের জন্য নতুন সরকারের উপর লাগাতার গণচাপ জারি রাখতে গোটা পার্টিকে চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হবে।

৩) লাগাতার মূল্যবৃদ্ধি ও গণহারে বেকারত্ব জনগণের একটা বড় অংশকে গভীর সংকটে এনে ফেলেছে। সংঘ-বিজেপি শিবির এই গণক্ষোভকে তীব্র রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ দিয়ে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলোকে নড়বড়ে করে ফেলে দেওয়ার খেলা চলছে এবং ইডি, সিবিআই সহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নিগ্রহ করার যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মহারাষ্ট্রের সরকার ফেলা ও বিহারের ক্ষমতা হারানোর পরে মোদী-শাহ জমানা ঝাড়খণ্ডের ক্ষমতা হাতাতে উঠেপড়ে লেগেছে। এই প্রেক্ষিতে বিজেপির ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলনমুখী উদ্যোগ অনেক বাড়িয়ে তোলা দরকার। একইসঙ্গে অবিজেপি দল শাসিত রাজ্যগুলোতেও জনগণের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোতেও আমাদের যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিক্রিয়া জানানো প্রয়োজন। তৃণমূলস্তরে আমাদের পদক্ষেপ এবং গণপ্রতিবাদ ও আন্দোলনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টাই বিরোধী ঐক্যকে দানা বাঁধানোর ও জনগণের মধ্যে ২০২৪’র নির্বাচনে বিজেপিকে পরাজিত করার তাগিদ বাড়ানোর চাবিকাঠি হতে পারে। বিজেপির সর্বাত্মক বিরোধিতায় আমাদের সোচ্চার থাকা এবং জ্বলন্ত ইস্যগুলোতে ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদই বিহারের রাজনৈতিক পালাবদলে ও বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে সহায়ক হয়েছে।

৪) অন্যান্য লড়াকু শক্তি ও ভিন্ন স্বরের পাশাপাশি আমাদের কমরেডরাও বাড়তে থাকা দমনপীড়ন ও প্রতিহিংসার মুখোমুখি হচ্ছেন। পার্টির উত্তরপ্রদেশ রাজ্য কমিটির সদস্য ও ঐ রাজ্যের সীতাপুর জেলা পরিষদ সদস্য অর্জুন লাল তাঁর জেলা পরিষদ ক্ষেত্রের দলিত মানুষদের জন্য ন্যায়বিচারের দাবি করায় পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের মুখে পড়েছেন এবং বর্তমানে জেলে রয়েছেন। কর্ণাটক রাজ্য কমিটির সদস্য ও কোপ্পাল জেলা সম্পাদক সান্না হনুমান্থাও একটি খুনের মিথ্যা মামলায় জেলবন্দী রয়েছেন। অগ্নিপথ প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার হন বিহার রাজ্য কমিটির নবনির্বাচিত সদস্য তারিক আনোয়ার, তিনি সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় কমিটি কমরেডদের উপর এই নিপীড়নের ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে তাঁদের নিঃশর্ত মুক্তি ও সমস্ত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে।

৫) পাঞ্জাব, অসম, রাজস্থান, ওড়িশা, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, পুডুচেরী ও পার্বত্য পার্টি কমিটির আসন্ন রাজ্য সম্মেলন এবং আরওয়াইএ, সারা ভারত কিষাণ মহাসভা ও আয়ারলা’র সর্বভারতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি রিপোর্ট পর্যালোচনা করেছে।

৬) পাটনায় আসন্ন একাদশ পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি বিষয়েও কেন্দ্রীয় কমিটি আলোচনা করেছে।

৭) কেন্দ্রীয় কমিটি দুঃখের সাথে কমরেড কবিতা কৃষ্ণানের অনুরোধে সম্মত হয়েছে। তিনি অনুরোধ করেন যে, তাঁকে পার্টি থেকে অব‍্যাহতি দেওয়া হোক যাতে তিনি স্বাধীনভাবে কিছু রাজনৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন, যে প্রশ্নগুলিকে তিনি সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করছেন। পার্টিতে তাঁর দীর্ঘকাল সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার সময়কালে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন তাকে কেন্দ্রীয় কমিটি সমাদর করে এবং প্রত‍্যাশা করে যে আগামী দিনগুলিতে ভারতে গণতন্ত্র, ন‍্যায় ও সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে তিনি অবদান রেখে চলবেন।

৮) পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র লিবারেশনের সম্পাদকমণ্ডলীর পুনর্গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে এই বোর্ডে সদস্যরা হলেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, অরিন্দম সেন, সঞ্জয় শর্মা, ভি শঙ্কর, ক্লিফটন ডি রোজারিও, সুচেতা দে ও অজিত পাটিল।

খণ্ড-29
সংখ্যা-35