প্রতিবেদন
ক্রমবর্ধমান নারী হিংসা আর নারী শক্তির মিথ্যা ভাষণ
false discourse of women's power

স্বাধীনতার ৭৫ বছরের উদযাপনের সময়  প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ভাষনে মহিলাদের প্রতি সকলকে মানসিকতার পরিবর্তন করার  আবেদন রাখেন। তিনি বলেন “আমাদের আচার-আচরণে এক বিকৃত মানসিকতা বাসা বেঁধেছে, আমরা হামেশাই মেয়েদের অপমান করে থাকি”। তিনি ২০১৪ সালেও   প্রথম বার স্বাধীনতা দিবসের  ভাষনের সময়েও বলেন, “এই সমস্ত ধর্ষণের ঘটনাগুলো যখন ঘটে তখন প্রত্যেক ভারতবাসীর মাথা হেঁট হয়ে যায়”। কিন্তু নির্মম বাস্তব এটাই যে, মোদীর গত আট বছরের শাসন কালে মহিলাদের উপর অত্যাচার ও হিংসার ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে।

২০২০ ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। ওই বছরটা বাদ দিলে দেখা যাচ্ছে প্রতি বছর মহিলাদের উপর হিংসার ঘটনা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। ২০২০ সালে, দেশব্যাপী লকডাউনের সময় মাসের পর মাস গোটা দেশ অচল থাকায় তথ্য সংগ্রহ করার কাজ বিঘ্নিত হয়। তাই, ওই বছরে মহিলাদের উপর অত্যাচার বা হিংসার ঘটনাগুলোর প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায়নি।

এনসিআরবি-র তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, গত বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশের খাতায় যে ৬০ লক্ষ অপরাধের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে তার মধ্যে ৪২৮,২৭৮ অপরাধের ঘটনা মহিলা সম্পর্কিত। যা, ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত (অর্থাৎ ছ’বছরে) বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬.৩৫ শতাংশ হারে। এর মধ্যে ২০২১ এর বেশির ভাগ অপরাধমূলক ঘটনা হল অপহরণ, ধর্ষণ, গার্হস্থ্য হিংসা, পণ মৃত্যু ও শারীরিক আক্রমণ। আর, এই ব্যাপারেও সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশ রয়েছে এক নম্বরে। এর পর রয়েছে রাজস্থান (৪০,৭৩৮টি ঘটনা) আর তারপর মহারাষ্ট্র (৩৯,৫২৬)।

প্রতি বছর হাজারে হাজারে নারী ধর্ষণের ঘটনা বিশ্বের মধ্যে ভারতকে তুলে এনেছে অনেক উপরে। শুধু ধর্ষণ করেই অপরাধীরা ক্ষান্ত হয় না, সমাজ তাদের কলঙ্কিত করে, পুলিশ এমনকি বিচারব্যবস্থাও প্রায়ই আক্রান্ত নারীর নামে বদনাম চাপিয়ে দেয়।

গোটা দেশে গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। ২০২১ সালে পুলিশের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে ১৩৭,৯৫৬টি কেস — অর্থাৎ প্রতি চার মিনিটে একটি করে ঘটনা। আর, ২০১৬ সালের পর থেকে এই বৃদ্ধি ২৭ শতাংশ! এটা যে কেবল আমাদের দেশেই ঘটছে তা নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, দুনিয়া জুড়েই প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন মহিলা এই গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। আর, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল, এ প্রশ্নে আত্মীয় পরিজনদের ও নীরব সম্মতি থাকে।

বেশ কিছুদিন আগে সরকার এক সমীক্ষা চালায়। তাতে দেখা যাচ্ছে, ৪০ শতাংশ মহিলা ও ৩৮ শতাংশ পুরুষ মনে করে তার শ্বশুর - শ্বাশুরিকে অপমান করার জন্য, নিজের সন্তানদের প্রতি অবহেলার জন্য, অনুমতি না নিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য, ঠিক মতো রান্না-বান্না না করা বা যৌন মিলনে অনিচ্ছা দেখানোর কারণে স্ত্রীকে পেটানোর হক পুরুষ/স্বামীর রয়েছে।

১৯৬১ সালে, সরকার আইনত পণ প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও আজ ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই প্রথা রমরমিয়ে চলে আসছে। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাঙ্কের এক তথ্য বলছে, গ্রামীণ ভারতে এখনো ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে পণ প্রথা বহাল রয়েছে। পর্যাপ্ত পণ নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে না আসায় নব বিবাহিত বধুর উপর নানা অত্যাচার চালানো হয় এমনকি পুড়িয়ে হত্যা করার ঘটনাগুলোকে রান্না ঘরে কাজ করতে গিয়ে পুড়ে যাওয়ার ঘটনা বলেই চালানো হয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার জন্মদিন উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেন – নারী শক্তির উত্থান ঘটে গেছে। গত শতাব্দী থেকে এই শতাব্দীর মধ্যে “পঞ্চায়েত ভবন” থেকে “রাষ্ট্রপতি ভবন” পর্যন্ত নারী শক্তির পতাকা পত পত করে উড়ছে। কত সংখ্যক শৌচাগার মহিলাদের জন্য তার সরকার তৈরি করেছে, কত জন মহিলাকে উজ্জ্বালা যোজনায় রান্নার গ্যাস দেওয়া হয়েছে, তার ফিরিস্তি দিয়ে মোদী নারী শক্তির জাগরণের পরিমাপ করছেন। এই প্রবঞ্চনাকে ছিন্নভিন্ন করেই গোটা নারী শক্তিকেই প্রকৃত ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।

– স্বপ্না চক্রবর্তী

খণ্ড-29
সংখ্যা-37