শোক সংবাদ
জঁ লুক গোদার
John Luke

চলে গেলেন জঁ লুক গোদার। সিনেমার অভিধান থেকে “প্রজ্ঞা” শব্দটা বিদায় নিল। সময় তাঁকে প্রজ্ঞা দিয়েছিল তাঁর তারুণ্য হরণ করতে পারেনি। প্রতিটি নতুন ছবিতে তিনি ছিলেন নতুন। প্রতিটি নতুন ছবিতে তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেছেন। নিরন্তর প্রশ্ন করেছেন ক্যাপিটালিজম নামের ব্যবস্থাটাকে। আর কেইবা পারবেন চলচ্চিত্রের সামান্য একটি টেকনিককে ইতিহাস ও দর্শনের আলোকে বিচার করতে। চিরকাল মনে থাকবে শট-কাউন্টার শট বিষয়ে তাঁর একটি ফিল্মের দৃশ্য। তিনি বলছেন শট কাউন্টার-শট আসলে শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের দু-জন প্রতিনিধিকে সমসত্ত্ব পদ্ধতিতে দেখায়, যা আসলে এক প্রকার প্রতারণা। তাঁর ব্যাখ্যা শেষ হয় আশ্চর্য এক উচ্চারণে, ইজরায়েল আর প্যালেস্টাইনের মধ্যে কোনো শট কাউন্টার শট হয় না। কারণ ইজরায়েল হল ফিকশন আর প্যালেস্টাইন ডকুমেন্টারি। চলচ্চিত্রের নেহাতৎই চলতি একটা কৌশলকে এভাবে ইতিহাস আর রাজনীতির আলোতে দেখা একমাত্র গোদারের পক্ষেই সম্ভব ছিল।

তিনি বিদায় নিলেন, সিনেমার সঙ্গে ছিন্ন হলো ইতিহাস ও দর্শনের সম্পর্ক। তরুণ গোদার এককালে লিখেছিলেন চলচ্চিত্র একটা জনমোহিনী মাধ্যম, যার নির্মাণ পুঁজির উপর নির্ভরশীল। তাকে দর্শন আর চিত্রকলার মহিমায় যিনি রূপান্তরিত করতে পারেন তিনিই প্রকৃত শিল্পী, ‘অত্যর’। গোদার সেই কাজটাই করার চেষ্টা করে গেছেন সারা জীবন ধরে। তার চলচ্চিত্র জীবনে তাই আমরা দেখতে পাই অনেকগুলি বাঁক। প্রথম জীবনে ব্রেথলেসের মতো কালজয়ী ছবি যিনি করেছেন তিনি সেই গরিমা নিয়েই সেলিব্রেটি হয়ে তিনি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু খ্যাতির চূড়ায় উঠে কিংবদন্তি হবার থেকে সমকাল তাঁকে অনেক বেশি করে টেনেছিল। মে ৬৮’র তারুণ্যের উৎসবে জঁ লুক গোদারকে তাই প্যারিস আমরা আশা করেছিল। তিনি ছিলেন। শুধু ছিলেন এই তথ্যটুকুই শেষ নয়। বন্ধু জঁ পিয়ের গরি(ন)কে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করলেন ‘জিগা ভের্তভ কালেক্টিভ’। সম্মিলিত প্রয়াসে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছা নিয়ে। শিল্পকর্ম ও রাজনীতিবোধকে বোধহয় তিনি কোনোদিন আলাদা করে ভাবেননি। তাই ইতিহাস আর সমকালকে আশ্চর্য প্রজ্ঞায় মেলাতে পেরেছেন বারবার। সময় বদলেছে, প্রযুক্তি বদলেছে, পুঁজিবাদ তার রূপ বদলেছে গোদারও নিজেকে বারবার ভেঙ্গেছেন, পরিবর্তন করেছেন কারণ তিনি মনে করতেন শিল্পীর দায়িত্ব তাঁর সময়কে বোঝা। শিল্পী যে অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করেন তা আসলে সমাজ ও ইতিহাসের দান। ব্যবস্থা’র ব্যবচ্ছেদ করা তার কর্তব্য। গোদারের ছবিতে অসম্ভব শাণিত যে সব সংলাপ আমরা শুনতে পাই তা আসলে ঐ ব্যবচ্ছেদের ফলাফল।

তাঁর শেষদিকের অন্যতম ছবি ‘গুডবাই ল্যাঙ্গুয়েজ’এর কথা বলা যায়। এটি একটি থ্রি-ডি ছবি। জটিল স্থানিক বিন্যাস দেখা যায় প্রতিটি শটেই। অনেকগুলি প্রশ্ন তিনি আর তর্ক তিনি হাজির করেন আমাদের সামনে। মানুষের ভাষা যেখানে শেষ হয় সেখানে কি প্রকৃতির ভাষা শুরু হয়? মানুষের ভাষার নিশ্চয়তা কি ডেকে আনে হিটলার আর হলোকস্টকে? ছবিতে উপস্থিত কুকুরটি যেন মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে এক যোগসূত্র রচনা করে। ছবিটি দেখলে মনে হয় এসব গভীর প্রশ্ন নিয়ে তিনি যেন ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে এক আশ্চর্য সংলাপে লিপ্ত।

পরিণত, বৃদ্ধ গোদারকে আমার তরুণ গোদারের থেকে বেশি ভালো লাগতো। কারণ বুদ্ধিমানেরা যখন বুঝলেন সমাজতন্ত্র আর 'বাজারে' আগ্রহের বিষয় নয়, অতএব সরে পড়তে হবে, গোদার তখন একের পর এক ছবিতে সমাজতন্ত্রকে কনটেমপ্লেট করে গেছেন। অজ্ঞাতবাসে নিজেকে প্রচারের আলো থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন অনেকদিন, কিন্তু ইতিহাসের সঙ্গে, চলমান বর্তমানের সঙ্গে এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। পৃথিবীর শেষ সমাজতন্ত্রী আজ বিদায় নিলেন, মে ৬৮-এর প্রতি তাঁর অবিচল আস্থায় ছেদ পরেনি কোনোদিন। আজ তাঁর পথ চলা শেষ হল। তাঁর বিদায়ে চলচ্চিত্র অতি সাধারণ একটি মাধ্যমে পরিণত হল। তিনি গোদার বলেই বোধহয় নিজের মৃত্যুর স্থান আর কাল নিজেই রচনা করলেন। আমরা এতক্ষণে জেনে গেছি তিনি স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করলেন। তিনি তাঁর মত জানাতে কখনো ভয় পাননি। স্বাধীনতা শব্দটাকে তিনি সম্মান করতেন। মৃত্যুর মুহূর্তটাতেও পরাধীনতা মানলেন না। বিদায় জঁ লুক গোদার!

– মানস ঘোষ

খণ্ড-29
সংখ্যা-36