প্রতিবেদন
পেরিয়ার ও তাঁর সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন
Periyar

(পেরিয়ারের জন্মদিন ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর। এই দিনটিকে মনে রেখে সেপ্টেম্বর মাসের দু’টি সংখ্যা জুড়ে আমরা পেরিয়ার সম্পর্কিত এই নিবন্ধটি প্রকাশ করছি। এটি প্রথম পর্ব। – সম্পাদকমণ্ডলী)

বিংশ শতাব্দীতে যে কয়েকজন যুক্তিবাদী সমাজ সংস্কারক ও চিন্তক জন্মেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম এরোড ভেঙ্কাটাপ্পা রামাস্বামী নায়কার। তার জন্ম ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই সেপ্টেম্বর তামিলনাড়ুর এরোডে। শুধু সমাজ সংস্কারই নয় একইসঙ্গে তিনি ছিলেন সমস্ত রকম আর্থসামাজিক বৈষম্যের প্রবল বিরোধী একজন অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। প্রকৃত বিচারে সেই সময়ে অন্যান্য যে সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের আমরা পাই তাদের মধ্যে সবথেকে স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ চিন্তাভাবনা ছিল রামাস্বামীর। যেভাবে ওই সময় দাঁড়িয়ে তিনি ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদ বর্ণ ব্যবস্থা এবং সরাসরি ধর্ম এবং ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য রেখেছেন তা ভারতে যুক্তিবাদী বিশ্লেষণের ধারায় পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। পারিবারিক সূত্রে রামাস্বামীর পরিবার ছিল বৈষ্ণব হিন্দু পরিবার। তারা ছিলেন বালিয়া নাইডু সম্প্রদায়ের মানুষ। বালিয়া নাইডুরা বৈশ্য অথবা শূদ্রদের মধ্যে থাকা উচ্চ সম্প্রদায়। রামাস্বামীর বাবার নাম ভেঙ্কাটাপ্পা নায়কর মায়ের নাম চিন্নাতায়াম্মা। প্রথমদিকে পরিবারে যথেষ্ট দারিদ্র থাকলেও পরবর্তীকালে রামাস্বামীর বাবা নিজেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন। প্রথাগত পড়াশুনায় তার একেবারেই মন ছিল না, বছর দু’য়েক তিনি স্কুলে যান কিন্তু তারমধ্যেই তার সংবেদনশীল মন লক্ষ্য করেছিল স্কুলে হিন্দু এবং মুসলিম ছাত্রদের পৃথক জায়গায় জল খাওয়ার ব্যবস্থা। তবে এবিষয়ে তখন থেকেই রামাস্বামী প্রচলিত কোন নিয়ম কানুন মানতেন না। বাড়িতেও তাকে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেওয়া হতো না। এইসব নানা কারণে তার বাবা তাকে মাত্র বারো বছর বয়সেই ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দেন সেখানে কিন্তু তিনি নিজেকে সফল হিসেবেই প্রমাণ করেন। রামাস্বামী তার বাল্যকাল সম্পর্কে নিজেই বলেছেন, “শেষ পর্যন্ত আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হলো ও আমাকে দোকানে বসিয়ে দেওয়া হল। সেখানে আমার কাজ ছিল ভর্তি বস্তায় ঠিকানা লেখা ও পণ্যের নিলাম ডাকা।” রামাস্বামীর পৈত্রিক বাড়িতে ধর্ম কর্মের যথেষ্ট চর্চা ছিল, এমনকি এরোডের বিভিন্ন মন্দিরেও তাদের পরিবার থেকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হতো। তা সত্ত্বেও রামাস্বামীর মনে প্রথম থেকেই ধর্মীয় আচার-আচরণ সম্পর্কে একটা বিরূপতা জন্মেছিল। তিনি নিজেই বলছেন, “আমার ফাঁকা সময় পুরানের ওপর তর্ক করে কাটতো। আমাদের ঘরে সাধু সন্ন্যাসী পন্ডিত পুরোহিতদের অনেক সম্মান করা হতো। কিন্তু আমি তাদের একেবারেই পছন্দ করতাম না। এইজন্যেই তারা যা বলতেন আমি ইচ্ছাকৃতভাবে সেসবের বিরোধিতা ও উপহাস করতাম।” রামাস্বামীর এই পরিবার বিরোধী এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাবের কারণ খুঁজতে হলে আমাদের একটু দেখে নিতে হবে সেই সময়ের দক্ষিণ ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং রামায়ণ-মহাভারত সহ হিন্দু পুরাণের একটি বিকল্প ব্যাখ্যা, সেই সময় দক্ষিণ ভারতের বুদ্ধিজীবী সমাজে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠছিল। মাদ্রাজ সেকুলার সোসাইটির সদস্যরা ঘোষণা করলেন রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী প্রকৃতপক্ষে উত্তর ভারত থেকে আসা বহিরাগত আর্যদের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতে বসবাসকারী মূল নিবাসীদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের কাহিনী উত্তর ভারতের মানুষেরা রাক্ষস অসুর ইত্যাদি নেতিবাচক শব্দের মধ্যে দিয়ে দ্রাবিড়দের হেয় করার পাশাপাশি নিজেদের উচ্চবর্ণজাত বলে দাবি করে এবং একইসঙ্গে তাদের ওপর সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম করে। মাদ্রাজ সেকুলার সোসাইটি নামে একটি সংগঠন এই ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রায় ১০ বছর ধরে নিরন্তর লড়াই জারি রেখেছিল। এই সময়কালে প্রকাশিত পত্রপত্রিকাগুলি ছিল সূর্যদয়ম, পঞ্চমা, সুগিরদোবসনি, দ্রাবিড় কোকিলাম, তামিল কলম ইত্যাদি। এই পত্রিকাগুলির লক্ষ্য ছিল শূদ্রাতিশূদ্রদের সচেতন করা, হিন্দু সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথাকে নাকচ করা, ব্রাহ্মণ্যবাদের তীব্র সমালোচনা করা এবং মনুর অনুশাসনগুলিকে অস্বীকার করা।

চিদাম্বরমের লেখা পেরিয়ার রামাস্বামীর জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায় ১৯০৪ সালে একদিন তিনি বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। তারপর গঙ্গা নদীর তীরে তীর্থস্থান কাশিতে পৌঁছোন। সেই সময় তার দারিদ্র্য এমন চরমে ছিল যে প্রায় অনাহারে তাকে দিন কাটাতে হচ্ছিল। একদিন বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা হয় এমন একটি ধর্মশালায় খেতে গেলেন। কিন্তু শুধুমাত্র শূদ্র আর আব্রাহ্মণ বলে তাকে খেতে দেওয়া হল না। এই সময়ে শুধু জাতিগত কারণে এবং দ্রাবিড় বলে নানা রকম লাঞ্ছনা তার মনে ব্রাহ্মণদের প্রতি অত্যন্ত অসহিষ্ণুতার জন্ম দেয়। তিনি এর কারণ খুঁজতে থাকেন। কাশীর এই অভিজ্ঞতা তাকে পরবর্তী জীবনে চলার সঠিক দিশা দেখায়। তিনি এরোডে ফিরে আসেন এবং পারিবারিক ব্যবসার সমস্ত দায়িত্ব নেন। এই সময়েই এরোডের দুইজন যুক্তিবাদী ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ক গবেষক মারুথাইয়া পিরালাই এবং কৈবল্য সামিয়ার তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। ১৯৬০ সাল থেকে ই ভি রামস্বামী কংগ্রেসের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হন ১৯১৫-তে দ্রাবিড় অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সি সংকরানের লেখা ‘অব্রাহ্মণের চিঠি’ নামে একটি বই প্রকাশকে কেন্দ্র করে এই কাগজের কর্মীদের ওপর ব্রিটিশ সরকারের আক্রমণ নেমে আসার তীব্র প্রতিবাদ করেন ই ভি রামাস্বামী। ১৯১৭-তে মন্টেগু চেমসফোর্ড কমিটি যখন ভারতে সাংবিধানিক শাসন কাঠামো সংস্কার করার জন্য বিভিন্ন অংশের ভারতীয় প্রতিনিধিদের কাছে বক্তব্য জানতে চাইলেন তখন জাস্টিন পার্টির এই কমিটির কাছে প্রশাসন ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অব্রাহ্মণদের জন্য সংরক্ষণ দাবি করে। ১৯১৭ সেপ্টেম্বর মাসে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কংগ্রেসের অব্রাহ্মণ দ্রাবিড় নেতারা ‘মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি অ্যাসোসিয়েশন’ তৈরি করলে তাতে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন ই ভি রামাস্বামী। এরপর পর পর ঘটে যাওয়া রাওলাট আইন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড এসবের প্রতিবাদে এরোড পৌরসভার চেয়ারম্যানের পথ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে তিনি সেই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু নানান ঘটনায় তিনি এই উপলব্ধিতে পৌঁছোন, কংগ্রেস মূলত উত্তর ভারতীয় উচ্চবর্ণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি রাজনৈতিক দল। যারা কখনো জাতপাত বিলোপের বিষয়ে এবং শূদ্র এবং শুদ্রাতিশূদ্রদের উন্নয়নের ব্যাপারে কিছুমাত্র ভূমিকা নেবেনা। সেইজন্যেই তার সম্পাদিত কুদি আরাসু পত্রিকায় তিনি স্পষ্টভাবে বলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে তিনটি ভয়ানক শত্রুকে নিকেশ করা দরকার। প্রথম কংগ্রেস দল যেটা একটা ব্রাহ্মণ ও বেনিয়া দল, দ্বিতীয় জাতপাত যুক্ত হিন্দুধর্ম, আর তৃতীয় ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। গান্ধী সম্পর্কেও তিনি খুব তাড়াতাড়ি মোহমুক্ত হন। বুঝতে পারেন মহাত্মা গান্ধীও জাতীয়তাবাদের নামে উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্ববাদকে তামিলদের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। এবং আদৌ তিনি বর্ণাশ্রম প্রথাভিত্তিক ধর্মটি বিলুপ্ত হন এটা একেবারেই চান না। এরপরে রামাস্বামী রাজনৈতিক আন্দোলন ছেড়ে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতে থাকেন। এখানে রামাস্বামী চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে একটা একটা প্রশ্ন আমাদের মনে দানা বাঁধে। এতটা স্পষ্ট রাজনৈতিক চিন্তা এবং দূরদর্শিতা থাকা সত্ত্বেও কোনো রাজনৈতিক বীক্ষা ছাড়া যে সমাজ সংস্কার আন্দোলন সফল হতে পারে না এটা কেন তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন না। তবে অতি দ্রুতই এই সীমাবদ্ধতা তিনি কাটিয়ে ওঠেন এবং ১৯২৫’র নভেম্বরে কংগ্রেস পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে এসে তিনি সংগঠিত করেন তার জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সমাজ সংস্কার আন্দোলন সুয়ামারিদাইকাম বা আত্মমর্যাদা আন্দোলন। এই আন্দোলনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য তিনি প্রচার করতে থাকেন তার সম্পাদিত কুদি আরাসু পত্রিকায়।

রামাস্বামী সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে যুক্ত না হলেও রাজনৈতিক চিন্তাধারায় তিনি কমিউনিস্টদের খুব কাছেই ছিলেন। দক্ষিণ ভারতের তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতা এম সিঙ্গারাভ্যালু নিয়মিতভাবে আত্মমর্যাদা লীগের মুখপাত্র কুদি আরাসুতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতেন। এইসব নিবন্ধ পড়ে রামাস্বামী মার্কসের দ্বান্দিক বস্তুবাদ, বিজ্ঞান, কমিউনিস্টদের লক্ষ্য ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আগ্রহী হন এবং এরপরেই সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক কাজকর্ম নিজের চোখে দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। রামাস্বামীর সোভিয়েত সফর তার মনে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর প্রভাব ফেলে। এরপর তিনি বার্লিনে যান এবং সেখানে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট সংগঠনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার এইসব কার্যক্রম থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে তিনি তার আগেকার যে সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র সমাজ সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে আত্মমর্যাদা লিগকে সীমাবদ্ধ রাখার ধারণা থেকে সরে এসেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিপ্লব ছাড়া এবং সমাজের আমূল পরিবর্তন ছাড়া উপর উপর কিছু সংস্কার সাধনের মধ্যে দিয়ে জাতপাত ব্যবস্থার বিলোপ এবং শ্রমিক কৃষকের প্রকৃত শৃঙ্খল মুক্তি সম্ভব নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ বিশ্বভ্রমণ থেকে ফিরে আসার পর রামাস্বামী একটি নতুন প্রগতিশীল কর্মসূচি হাজির করলেন যা এরোড কর্মসূচি হিসেবে বিখ্যাত। এখানেই তিনি সমাজ সংস্কার আন্দোলনের পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন এবং আত্মমর্যাদা লীগের একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি হয়।

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্ত)

- সুমনা সেনগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-37