প্রতিবেদন
রাজ্যের বিভিন্ন প্রতিরোধ আন্দোলন একত্রিত হল পরিবেশ অধিকার গণকনভেনশন
Environmental Rights Mass Convention

গত ২৭ আগস্ট কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটি সভাঘরে অনুষ্ঠিত হল পরিবেশ অধিকার গণকনভেনশন। পরিবেশ সংকটের রাজনৈতিক প্রশ্নে সংগঠিত এই গণকনভেনশনে উপস্থিত ছিলেন এরাজ্যের বিভিন্ন ছোট বড় প্রতিরোধ ও আন্দোলনের প্রতিনিধিরা। এসেছিলেন ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় আদানি কোম্পানির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চলা আন্দোলনের প্রতিনিধিরা। বিভিন্ন গণসংগঠন, বিশেষত ছাত্রছাত্রী এবং চিত্রশিল্পী ও গানের দলের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণে সভাঘর উপছে পড়েছিল। কনভেনশন শুরু হওয়ার আগে সভাঘরের সামনের রাস্তায় বাণীপুর বেসিক থেকে আসা স্কুলছাত্র সপ্তকের হিপহপ, সঞ্জয়ের গান, শুভঙ্করের কবিতা এবং রকি, অচিন্ত্য ও আরজুর সঙ্গতে এক জোরালো পারফরম্যান্স এলাকার মানুষকে সচকিত করে। সভাঘরে সঙ্গীত পরিবেশন করে অগ্নিঋক, গাছেদের জন্য গানের দল, স্কুল ছাত্রছাত্রীদের টিম ‘অন্য রকম’ এবং জৈব কৃষক নিতাই মাল। সভাঘরে সাজানো ছিল দেওচা-পাচামির আন্দোলনে তন্ময়ের তোলা একগুছ স্থিরচিত্র এবং লাবণী জঙ্গির বিভিন্ন পেইন্টিং। আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে ছিলেন অর্থনীতিবিদ তথা গণআন্দোলন চিন্তক শুভেন্দু দাশগুপ্ত, তরুণ নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকার ও গণ আন্দোলনের কর্মী আশিষ কুসুম ঘোষ। সমগ্র কনভেনশন সঞ্চালনা করেন মোহিত রণদীপ ও মধুরিমা বক্সী।

দেওচা-পাচামির বৃহৎ কয়লাখনি প্রকল্পের পরিবেশ বিপর্যয়ের দিক নিয়ে চর্চা ও বিরোধিতা গড়ে তোলার তাগিদ থেকে গত জানুয়ারি মাসে বেশ কিছু রাজনৈতিক কর্মী ‘পরিবেশ অধিকার আন্দোলন’ নামে একটি সমন্বয় গড়ে তুলে প্রচারান্দোলন শুরু করে। কলকাতায় পথসভা, মিছিল, পদযাত্রা সংগঠিত করা ও একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে দেওচা-পাচামি প্রকল্পের বিপর্যয়ের বিষয়ে মানুষকে অবগত করার চেষ্টা করা হয়। এবং শেষে রাজ্যের বিভিন্ন আন্দোলনগুলির সাথে যোগাযোগ গড়ে তুলে পরস্পরের বিষয়ে জানা, বিভিন্ন সরকারি পলিসি বিষয়ে আলোচনা ও পরিবেশ অধিকার আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করার লক্ষ্যে এই গণকনভেনশন সংগঠিত করা হল। কনভেনশনে স্বাগত ভাষণ দেওয়ার সময় এই সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেন শুভপ্রতীম রায়চৌধুরি। এর পর আলোচনার জন্য খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন মলয় তেওয়ারি। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য নাশ এবং দূষণ ও বর্জ্য-জঞ্জাল — এই ত্রিমুখী পরিবেশ সংকটের নানা দিক এবং বিভিন্ন আন্দোলনগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও পরিবেশধ্বংসী বিভিন্ন সরকারি নীতি তুলে ধরা হয়। পুঁজিবাদী উন্নয়নের মডেলকে পরিবেশ সংকটের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং সমস্ত ক্ষেত্রেই স্থানীয় জনগোষ্ঠি-নির্ভর ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন-পরিকল্পনাকে বিকল্প হিসেবে তুলে ধরা হয়। ইতিমধ্যেই বিভিন্নভাবে যে পরিবেশের যে ক্ষতি হয়ে গেছে তার মেরামতি ও পরিবেশ সংকটজাত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের সার্বিক নীতি এবং পরিবেশধ্বংসী প্রকল্প থেকে সরে আসাকে মূল দিশা হিসেবে তুলে ধরা হয়।

Environmental Rights
দেওচা-পাচামি থেকে বুধি হাঁসদা

দেওচা-পাচামির খনি-বিরোধী আন্দোলনের সংগঠন ‘বীরভূম জমি জীবন জীবীকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভার’ পক্ষ থেকে বুধি হাঁসদা স্পষ্ট জানান যে তাঁরা কোনও শর্তেই কয়লাখনি চাইছেন না। পাথর খাদানের বায়ু দূষণের প্রসঙ্গ টেনে বলেন যে, কলকাতা ও বর্ধমানের বাবুরা খাদান থেকে মুনাফা লোটে, কিন্তু পাথর গুঁড়োর ধুলোটা খায় গ্রামের আদিবাসী মানুষেরা। মহাসভার আরেক নেতা রতন হেম্ব্রমও উপস্থিত ছিলেন। ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা থেকে এসেছিলেন সুভাষ হেম্ব্রম ও মেরি নিশা হাঁসদা। তাঁরা আদানি কোম্পানির তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন। এখান থেকে আদানিরা বিদ্যুৎ বেচবে বাংলাদেশে। তার জন্য ফারাক্কার গ্রামবাসীদের মাথার ওপর দিয়ে হাই টেনশন তার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আম ও লিচু বাগান কাটা হচ্ছে জোর করে। পুরুলিয়ার আযোদিয়া পাহাড়ে ধ্বংস হতে চলেছে বিপুল পরিমাণ অরণ্য। এই পাহাড়টি যে বাংলার আদিবাসী সান্তাড় সমাজের চিরাচরিত পবিত্র স্থান হিসেবে সান্তাড় সমাজের দ্বারা ব্যবহৃত ও রক্ষিত হয়ে আসছে সেই দিকও বিবেচনায় আনছে না সরকার। আস্ত এক পাহাড় তিলাবনি, যা পর্যটন ও গ্রামবাসীদের নিসর্গ ও বনসৃজনের সাথে জড়িত তাকে পাথর ব্যবসায়িদের স্বার্থে বেচে দেওয়া হয়েছে। এইসব প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা উঠে আসে ফারাক্কার জোবায়ের আলি ও তিলাবনি সংহতির সঞ্জয় দাসের বক্তব্যে। সুন্দরবন বাঁচাও কমিটির দীর্ঘদিনের কর্মী ডঃ মদন চন্দ্র করণ বিস্তারিতভাবে সুন্দরবনের বাস্তব সমস্যা তুলে ধরেন, নব ঘোষিত সুন্দরবন জেলা আসলে সুন্দরবনের জনগোষ্ঠির ঐক্যকে ভাগ করবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন তিনি। বস্তুত জলবায়ু সংকটের আশু বিপর্যয়ের মুখে সুন্দরবন অঞ্চল ও তার ওপর নির্ভরশীল মানুষেরাই আছেন বলে গণকনভেনশনের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে।

কনভেনশনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল বিভিন্ন নদী বাঁচাও, খাল বাঁচাও ও জলাভূমি বাঁচাও আন্দোলনের কর্মীরা। জলঙ্গী নদী সমাজের দেবাঞ্জন বাগচি ও নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলনের কল্লোল রায় সমগ্র বিষয়টি তুলে ধরেন। নদী মানে জীববৈচিত্র্য, জীবিকা, সংস্কৃতি, উর্বর পলি, জল সুরক্ষা, আবহাওয়া ভারসাম্য, সহ বহু কিছু। সমস্তটা নিয়ে যে নদী, তাকে শুধু জলের জন্য বাঁধ দিয়ে প্রাণহীণ করে তোলা হচ্ছে। নদী-নির্ভর, নদী পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকায় নেমে আসছে নানা বিপদ। নদী বাঁচাতে হলে নদীতে বাধা সৃষ্টিকারী সমস্ত ছোট-বড় বাঁধ-বাঁধাল তৈরি বন্ধ করতে হবে; নদী নির্ভর মৎস্যজীবীদের স্বাধীন জীবিকা বাঁচিয়ে রাখতে নদীতে পর্যাপ্ত নির্মল জল সুনিশ্চিত করতে হবে; মৃত ও মৃতপ্রায় নদীগুলিকে বাঁচাতে সার্বিক ভূমিরূপ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় আত্রেয়ী নদীতে চেক ড্যাম তৈরি অবিলম্বে বন্ধ করে নদীকে পুরোন রূপে ফিরিয়ে দিতে হবে। মৎস্যজীবীদের জীবিকা সুরক্ষা করতে মাথাভাঙা-চূর্ণি নদীতে দূষণ রোধে আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় নদী সংযুক্তি প্রকল্প আমাদের নদীব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে চায়। এই প্রকল্প কোটি কোটি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তাদের নদীগুলিকে কর্পোরেটদের স্বার্থে কেড়ে নেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। কেন্দ্রীয় এই প্রকল্পের ফলে নদী-মোহনায় জলপ্রবাহ অত্যন্ত কমে যাওয়ায় জোয়ারের নোনাজল আরও বহুদূর উঠে এসে নানারকম বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

চড়িয়াল খাল পুনরুদ্ধারের আহ্বান নিয়ে বক্তব্য রাখেন রাজীব দত্ত। বেআইনি নির্মাণে মৃতপ্রায় এই খাল সংস্কার করে আবার আগের অবস্থায় ফেরৎ দিতে হবে। রাজাপুর খাল বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষে মুজিবর রহমান বলেন, রাজাপুর খাল হাওড়া জেলার অন্যতম জীবনরেখা, যার ওপর প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ নির্ভরশীল। এর সাথে যুক্ত কানা দামোদর ও তাদের সাথে যুক্ত অসংখ্য ছোট খাল ও নালা আজ বিপন্ন। হাওড়ার সাঁকরাইলে অম্বুজা সিমেন্ট কারখানার দূষণে অনেকগুলি গ্রামের জীবন ও জীবিকা চরম ক্ষতিগ্রস্ত। গ্রিন ট্রাইব্যুনাল ক্ষতিয়ে দেখে দূষণের বাস্তবতা ক্ষতির সম্ভাব্য পরিমাণ নির্দিষ্ট হওয়া সত্বেও কেউ ক্ষতিপূরণ পাননি বলে জানান লক্ষ্মীকান্ত আড়ি।

came together to form the Environmental Rights

কনভেনশনের প্রস্তাবনায় এরাজ্যে বনাধিকার আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে বনাধিকার আইন পাস হওয়ার পর জঙ্গলমহল নামে পরিচিত পশ্চিমাঞ্চলে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বদলে উল্টে কর্পোরেটদের হাতে জঙ্গলের জমি তুলে দেওয়া এবং পুলিশ প্রশাসনের সাথে আদিবাসীদের এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতের চিত্র সামনে আসে, পরিশেষে কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ বাহিনীর স্থায়ি সন্ত্রাস কায়েম হয় এবং বর্তমান সরকারও বনভূমির ওপর আদিবাসীদের প্রাপ্য ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত মালিকানার আবেদনগুলি হয় খারিজ করে দিয়েছে অথবা ঝুলিয়ে রেখেছে। উত্তরবঙ্গ বনজন শ্রমজীবী মঞ্চের পক্ষ থেকে স্বরূপ সাহা বলেন যে তাঁরা বনাধিকার আইন নিয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এবং কিছু অধিকার আদায় করতে পেরেছেন।

একেকটি বড় গাছ আমাদের বাস্তুতন্ত্রের একেকটা খুঁটি। যশোর রোড গাছ বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষে তাঁদের দীর্ঘ লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা বলেন অরিন্দম। সম্প্রতি তারকেশ্বর চকদীঘি রাস্তা সম্প্রসারণ প্রকল্পেও বিপুল বৃক্ষচ্ছেদ যজ্ঞ চলছে। এর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলেন কল্যাণ আদক। বড় বড় গাছগুলিকে টিকিয়ে রেখেই রাস্তা চওড়া করার বিকল্প পরিকল্পনা রচনা করতে হবে যা বাস্তবে সম্ভব। উত্তরপাড়া গণ উদ্যোগের রূপম চট্টোপাধ্যায় ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির তাপস চক্রবর্তী আরও কিছু দিক তুলে ধরেন। গণবিজ্ঞান সমন্বয় মঞ্চের প্রদীপ বসু টেকনলজি কেন্দ্রীকতার বিরুদ্ধে সচেতন করে দেন। মৃণাল জানা কনভেনশনের দাবিসনদ পেশ করেন।

শুভেন্দু দাশগুপ্ত তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে নজর কেন্দ্রীভূত করতে বলেন গ্রামসভা, পেশা আইন ও তটভূমি সুরক্ষা আইনের ওপর। আইনগুলি সম্পর্কে সর্বস্তরে সচেতনতা গড়ে তোলার কথা বলেন তিনি। সুপ্রতিম কর্মকার মূল জোর দেন স্থানীয় জনগোষ্ঠির চিরাচরিত জ্ঞানভাণ্ডারের ওপর। বিভিন্ন প্রবাদ প্রবচন, ছড়া ও এক চিলতে গল্প উল্লেখ করে অত্যন্ত সহজ সরলভাবে তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটির গুরুত্ব তুলে ধরেন। আশিষ কুসুম ঘোষ বলেন, এই কনভেনশনে পরিবেশ এক অধিকার হিসেবে উঠে এল। নির্দিষ্ট কিছু বিন্দুতে নজর কেন্দ্রীভূত করে আগামিতে এগোতে হবে। সমস্ত বক্তব্যের শেষে তাপস দাস সমাপ্তি ভাষণ দেন। উপস্থিত সকলে হাততালি দিয়ে সমস্ত সংজোযন সহ কনভেনশনের প্রস্তাবনা ও দাবিপত্র গ্রহণ করে। আগামিতে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে ওয়ার্কশপ ও অন্যান্য কর্মসূচি নেওয়া হবে।

খণ্ড-29
সংখ্যা-34