প্রতিবেদন
কাতার বিশ্বকাপ ২০১০-২২
Qatar World Cup

আর এক সপ্তাহের প্রতীক্ষা। দীর্ঘ চার বছরের প্রতীক্ষার শেষে শুরু হতে চলেছে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব – ফুটবল বিশ্বকাপ, ২০২২। যেই উৎসবে সারা বিশ্বের অগণিত ফুটবলপ্রেমী মানুষ সামিল হন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে। একটি মাসের জন্য গোটা বিশ্ব মেতে উঠবে সাম্বার জাদুতে কিংবা স্প্যানিশ তিকিতাকায়। বহু মানুষ রাত্রি জাগবে আর্জেন্টাইন রাজপুত্রের পায়ের জাদু দেখতে। মুগ্ধ করবে সবুজ গালিচায় জার্মান আভিজাত্য। বহু মানুষ উপভোগ করবে পর্তুগিজ তারকার - The last dance।এবার সেই মহোৎসবেরই কেন্দ্রবিন্দু হতে চলেছে এশিয়ার একটি ‘ছোট্ট’ দেশ — কাতার।

২০১০ সালে জুরিখ শহরে যখন ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ হিসেবে তথাতকথিত ‘ফুটবল শক্তিধর’ দেশগুলির বাইরে গিয়ে যখন কাতারের নাম ঘোষণা করলেন তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার, তখন স্বভাবতই নানা জল্পনার সূত্রপাত হয়। মাত্র আঠাশ লক্ষ জনসংখ্যার একটি দেশ, যাদের ফুটবল সংস্কৃতির সঙ্গে দূর দুরন্ত পর্যন্ত কোন সম্পর্কই ছিল না, এমনকি উন্নতমানের একটি ফুটবল স্টেডিয়ামও পর্যন্ত ছিল না যেসময়, সেইসময় দাঁড়িয়ে তারা এত বড় একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব পেল কীভাবে? কাতার নিছকই আরব সাগরের তীরে অবস্থিত একটি ছোট্ট মরুভূমির দেশ নয়।দেশটি প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডারের নিরিখে তৃতীয়, এবং তেলের ভান্ডারের  তালিকায় ত্রয়োদশ বৃহত্তম দেশ। এই দেশের পার ক্যাপিটা জিডিপি একাশি হাজার ডলার। খুব সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায় বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশগুলির মধ্যে একটি হল কাতার। এই দেশটিতে জুন-জুলাই মাসে, অর্থাৎ যখন বিশ্বকাপ সাধারণত অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, তখন তাপমাত্রা মাঝে মধ্যেই প্রায় ৪৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ছুয়ে ফেলে। ফিফা শুধু মাত্র কাতারে অনুষ্ঠিত করতে হবে বলেই বিশ্বকাপের সময় বদলে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে নিয়ে এল। আপাতদৃষ্টিতে দেখে খুবই সাধারণ সিদ্ধান্ত মনে হলেও, গোটা  ইউরোপ জুড়ে [যে মহাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি ১৩ টি দেশ অংশগ্রহণ করে বিশ্বকাপে] প্রতিটা দেশের ঘরোয়া লীগগুলির সময়সূচী ওলট-পালট হয়ে গেল। ইউএফার বারংবার বিরোধ সত্ত্বেও আয়োজক দেশ এবং ফিফা এসবে কর্ণপাত করল না। এবার সবচেয়ে বড় বিষয়, পূর্ববর্তী বিশ্বকাপগুলি, যেমন রাশিয়া বিশ্বকাপ [২০১৮] অনুষ্ঠিত করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ১১৬০ কোটি ডলার, ব্রাজিল বিশ্বকাপ [২০১৪] অনুষ্ঠিত করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ১৫০০ কোটি ডলার, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ [২০১০] আয়োজন করতে খরচ হয়েছিল ৩৫০ কোটি ডলার। সেই  সবাইকে ছাপিয়ে কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনে খরচ হয়েছে ২২০০০ কোটি ডলার – যেটি একটি বিশ্বকাপ আয়োজনের ক্ষেত্রে অনেকটাই বেশি। যার মধ্যে বিশ্বকাপের জন্য শহরের অন্যান্য কাঠামো তৈরিতে কয়েকশো কোটি খরচ করে দিয়েছে কাতার। হয়েছে সাতটি নতুন স্টেডিয়াম, নতুন একটি বিমান বন্দর, নতুন একটি সুবিশাল মেট্রো স্টেশন এবং উল্লেখযোগ্য লুসেইল শহর, যেটিতে বিশ্বকাপের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। যার কিছু বছর আগে পর্যন্তও কোনো অস্তিত্ব ছিল না। শুধুমাত্র বিশ্বকাপের জন্য কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হয়ে হয়েছে একটি গোটা শহর। তাহলে হঠাৎ করে এত পরিমাণ টাকার প্রয়োজন পড়ল কেন? এখানেই সবচেয়ে বড় প্রশ্নের জন্ম নেয় – মাত্র আঠাশ লক্ষর একটি দেশ যত পরিমাণ টাকাই খরচ করুক না কেন, এই বিশাল পরিমাণ কাজের জন্য শ্রমিক পেল কোথায়?

তথ্য বলছে প্রায় ১৭ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এই বিশাল আয়োজন, গোটা দেশের শ্রমিক শ্রেণীর ৯০ শতাংশই যাদের দিয়ে তৈরি। এদের অধিকাংশই এসেছেন ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং নেপাল থেকে। এই লক্ষ্য লক্ষ্য শ্রমিকদের অত্যন্ত খারাপ পরিবেশে থেকে, নূন্যতম আহার এবং উপার্জনের উপর ভিত্তি করে কাতারের দুঃসহ গরমে কাজ করে যেতে হয়েছে। তাদের সপ্তাহের প্রতিদিন ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা করে কাজ করতে হত কোনরকম ছুটি ছাড়া। বিভিন্ন হিউম্যান রাইটস গ্রুপ বারেবারে এদের পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করে গেছে, হয়েছে নানারকম তথ্যচিত্র। কিন্তু তাতে না ছিল কাতারের সরকারের ভ্রুক্ষেপ, না ছিল সেই সকল শ্রমিকেদের দেশের সরকারগুলির। গারডীয়ানের সমীক্ষায় উঠে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য — বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ হিসেবে কাতারের নাম ঘোষণা করার পর থেকে কাতারে প্রায় ৬৫০০ পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। কাতারের সরকার সেই তথ্যকে সরাসরি নাকচ করে দেয়। তারা শুধুমাত্র নির্মাণ সাইটে সরাসরি মৃত্যুগুলিকে চিহ্নিত করে আসল সংখ্যাটিকে সকলের অগোচরে রেখে দেয়। কিন্তু সেই সাইটে দিনভর গরমের কাজ করার ফলে হৃদ যন্ত্রের দুর্বলতা এবং শ্বাসবায়ুর সমস্যার কারণ গুলিকে সেই সরকার সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে গেছে। আইএলও এবং অন্যান্য হিউমান রাইটস গ্রুপস-গুলির বারংবার চাপে ২০১৭-তে কাতারের সরকার বাধ্য হয় শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে। তারা বিভিন্ন প্রকারের চমকপ্রদ ভিডিও বানিয়ে নিজেদের পদক্ষেপগুলো জাহির করতে থাকে, যেটার সাথে আমরা ভারতীয়রা খুব ভালোভাবে পরিচিত। কিন্তু এই পদক্ষেপগুলি ছিল অনেকটা তাদের দেশের নারী স্বাধীনতার মতোই! এই প্রসঙ্গে উঠে আসে কাতারের আরও একটি অদ্ভুত নিয়মের কথা। মধ্য-প্রাচ্যের এই দেশে সমকামিতা বেআইনি। এর কারণে বিশাল অঙ্কের জরিমানা থেকে শুরু করে, জেল সাজা, এমনকি মৃত্যুদন্ডও পর্যন্ত হতে পারে! বিশ্বকাপের মতো একটি আয়োজন, যেখানে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানারকমের মানুষ এসে গা ভাসাবেন এই আনন্দের জোয়ারে – সেখানে কাতারের মতো একটি অত্যন্ত সংরক্ষণশীল দেশ অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে কি না সেটাই চিন্তার।এর প্রতিবাদে যেমন বিভিন্ন বড় বড় দেশের ফুটবল সংস্থা, ফুটবলার এবং বিজ্ঞাপন সংস্থারা মুখ খুলেছেন, তার সাথে মুখ খুলেছেন অস্ট্রেলীয়ার যস ক্যাভালো, বিশ্বের প্রথম অ্যাক্টিভ gay ফুটবলার। ততসত্ত্বেও ফিফা নীরব!

এত প্রতিকূলতা, এত প্রতিবাদের পরেও কি প্রয়োজন পড়ল ফিফার কাতারেই আয়োজন করার?

কাতারের ২০১০ সালে বিড পাওয়াটা কোনোকালেই স্বচ্ছতায় মোড়া ছিল না। কাতারের সরকার দাবি করে গেছে বারবার যে সমস্তটাই ফিফা কমিটির সিদ্ধান্ত। তথাপি সেই সময় ফিফা কমিটির বেশ কিছু বড় বড় নাম ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে সাসপেন্ড হয়েছিল আমেরিকান কোর্টের দ্বারা।

সেপ ব্লাটার নিজেই বিভিন্ন রকম তদন্তের অধীনে ছিলেন, বিশাল পরিমাণ অর্থ তছরূপের জন্য। এমনকি দুর্নীতির জন্য তাকে আট বছরের নির্বাসনের সম্মুখীনও হতে হয়েছিল। অবশেষে ২০২০ সালে আমেরিকান সুপ্রিম কোর্টের কথায় সিলমোহর পরে যে কাতারের bid টাকার মাধ্যমেই কেনা হয়েছিল। আরও তদন্তের পর জানা যায় সেই ২২ জনের ফিফা কমিটির যে ১৬ জন কাতারের পক্ষে ভোট দিয়েছিল তাদের অর্ধেকই নানারকম দুর্নীতির সাথে যুক্ত এবং তিনজন সরাসরি কাতারের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার জন্য অভিযুক্ত হয়েছিলেন।

স্বভাবতই কাতারের পক্ষ থেকে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। এত কিছুর পরেও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এই উৎসবে সামিল হতে আসবেন। এবং তাদের সমস্ত রকম চমকে মুড়ে রাখতে কাতার জলের মতো অর্থ খরচ করতেও পিছপা হবে না। কাতার অবশ্যই প্রথম দেশ নয় যে কিনা বিশ্বমঞ্চে নিজেদের দেশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সবরকম প্রচেষ্টা করছে। এবং অবশ্যই কাতারের মতো ধনী দেশের কাছে এটি প্রথম সুযোগ বিশ্বের শক্তিধর দেশদের মধ্যে নিজস্ব একটি স্থান সুনিশ্চিত করার। কিন্তু সেই গৌরবগাথা কোনদিনই হাজার হাজার মানুষের প্রাণের বিনিময়ে হতে পারে না। আজ বারবার এই পুঁজির খেলার মধ্যে কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে ফুটবলের আসল মাধুরী। বারবার যেন আরও উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠছে টিউনিশিয়ার সেই ক্লাবের tifo - CREATED BY THE POOR, STOLEN BY THE RICH.

– অয়ন গুহরায়

খণ্ড-29
সংখ্যা-44