প্রতিবেদন
নোট বাতিল — রেফারির পক্ষপাতে ৪-১ জিতলেও বিপক্ষের গোলটিই দর্শনীয়


নতুন বছরের শুরুতেই দেশের শীর্ষ আদালতের ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ অল্প অল্প করে শুকোতে থাকা ঘায়ে আঁচড় কেটে নুনের ছিটে দিল, ৬ বছর আগের নোট বাতিল ও তৎপরবর্তী যন্ত্রণাকে নরেন্দ্র মোদী ও তার দলবলের কাছে উপভোগ্য করে তুলল নোট বাতিলকে সংবিধানসম্মত বলে রায় দান করে। এখনো বাড়ির দেরাজে পড়ে থাকা ১০০০ টাকার নোটটা জানান দেয় এই নির্মম রাষ্ট্রের কাছে আমরা কতটা অসহায়, জানিয়ে দেয় যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো অছিলায় আমাদের সম্পদ, সম্মান, আয় করার অধিকারকে লুঠ করে নিতে পারে এই ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার; এবং শীর্ষ আদালতের ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের ৪ জন বিচারপতি অবলীলাক্রমে বলে দিলেন যে তা করতে পারে অনায়াসে ‘সংবিধান সম্মত’ ভাবে। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর অবিবেচকের মত ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে দেশের চালু নোটের ৮৬ শতাংশকে অকার্যকরী করে তোলার মধ্য দিয়ে যে ‘একুশে’ আইনের সূত্রপাত ঘটানো হয়েছিল তাকে বৈধতা দিয়ে শীর্ষ আদালতের ৪ জন বিচারপতি নোট বদলানোর বা টাকা তোলা লাইনে দাঁড়িয়ে মারা যাওয়া ১৭৩ জন নাগরিককে আরেকবার হত্যা করলেন। তাঁরা তৎকালীন সময়ে কাজ হারানো অসংগঠিত ক্ষেত্রের লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন এদেশ ধনীর দেশ, ছবি তোলার জন্য নবতিপর বৃদ্ধা মাকে এটিএম’এর লাইনে দাঁড় করিয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে টিটকিরি মারা প্রধানমন্ত্রীর রাজত্ব এটা।

নোট বাতিলের বৈধতার সপক্ষে পাতার পর পাতা রায় লেখা হয়েছে, পাতার সংখ্যা ২৫৮। তাতে সহমত হয়েছেন বিচারপতি নাজির, গাভাই, বোপান্না ও রামাসুব্রমনিয়াম। নোট বাতিলকে সংবিধান বিরোধী বলে ১৩০ পাতার রায় লিখেছেন বিচারপতি নাগারত্না। দুটি লেখাকে পড়ে যেকোনো বিবেচক যুক্তিবাদী মানুষের মনে হবে যে, দ্বিতীয়টি অনেক যুক্তিসঙ্গত।

বিচারপতি নাগারত্নার মতে, রিজার্ভব্যাঙ্ক আইনের ২৬(২) ধারা অনুসারে রিজার্ভব্যাঙ্ক মনে করলে কোনো মূল্যের নোটের কোনো এক বা একাধিক শ্রেণী’কে (সিরিজ) বাতিল করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার সেই সুপারিশ মানতে পারে নাও পারে। যদি কেন্দ্রীয় সরকার তা মেনে নেয় তাহলে সরকারি গেজেটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেই সিরিজের নোটগুলিকে বাতিল ঘোষণা করতে পারে। তবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সমস্ত সিরিজের নোট বাতিলের সুপারিশ করার ক্ষমতা বা অধিকার নেই। কারণ রিজার্ভব্যাঙ্কের সুপারিশ মূলত দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য, আর্থিক নীতিকে মাথায় রেখেই হতে পারে। তাই রিজার্ভব্যাঙ্ককে সমস্ত মূল্যের সমস্ত সিরিজের নোট বাতিলের সুপারিশের যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। অপরদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সমস্ত মূল্যের সমস্ত নোট বা যেকোনো মূল্যের যেকোনো নোট বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে। তবে তা রিজার্ভব্যাঙ্ক আইনের ২৬(২) ধারা অনুসারে নয়, সংবিধানের সপ্তম তফশিলের ১নং তালিকার ৩৬তম দাখিলা (এন্ট্রি) অনুসারে। কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের দায়ীত্ব অনেক ব্যাপক, কেবল দেশের আর্থিক স্বাস্থ্য নয়, দেশের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক প্রভৃতি। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োজনে সমস্ত নোট বাতিল করতে পারে। কিন্তু তা করতে হবে সংসদে আইন পাশ করে যার আগে রাষ্ট্রপতি দ্বারা অর্ডিন্যান্স জারি করা যেতেও পারে নাও পারে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার নোট বাতিলের প্রক্রিয়ার সূচনা করবে, রিজার্ভব্যাঙ্কের কাছে মত চাইতে পারে, কিন্তু রিজার্ভব্যাঙ্কের মত মানার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে এমনটা করা যাবে না। ফলে নোট বাতিলের ভাবনার সূত্রপাত যদি নরেন্দ্র মোদী করে থাকেন তাহলে কেবল গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে তা করা সংবিধান সম্মত ছিল না। কিন্তু তাই করা হয়েছে, যা নোটবাতিলকে অসাংবিধানিক করে তুলেছে।

কিন্তু অন্য ৪ বিচারপতির মতে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আইনের ২৬(২) ধারা মেনে সরকার রিজার্ভব্যাঙ্কের সুপারিশ অনুযায়ী ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার সব নোট বাতিল করে কোনো ভুল করেনি। অবশ্যই তাঁদের রায় সরকারের দিকে পক্ষপাতদুষ্ট। প্রথমত, ২৬(২) ধারায় সকল সিরিজের নোট বাতিলের কথা বলা হয়নি, যদিও যেকোনো সিরিজকে সকল সিরিজ বলে ব্যখ্যা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু ঘটনা অনুযায়ী ৭ নভেম্বর ২০১৬ সরকারের তরফ থেকে রিজার্ভব্যাঙ্কের কাছে নোট বাতিল সংক্রান্ত সুপারিশ যায়, ৮ নভেম্বর ২০১৬ রিজার্ভব্যাঙ্কের কেন্দ্রীয় পর্ষদ সেই সুপারিশকে মান্যতা দিয়ে সরকারের কাছে পাঠায় এবং ক্যাবিনেট নোট বাতিলে শিলমোহর লাগায়। গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এই ঘটনা পরম্পরা দেখিয়ে দেয় যে, রিজার্ভব্যাঙ্ক আইনের ২৬(২) ধারা মেনে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মোটেই নোট বাতিলের সুপারিশ করেনি। ফলে ওই ২৬(২) ধারা প্রয়োগ সংবিধান সম্মত নয়, যা বিচারপতি নাগারত্না অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন। প্রয়োজন ছিল সংসদে আলোচনার, যা প্রায় কোনো জটিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই করতে নারাজ মোদী সরকার।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও যেটিকে বিচারপতি নাগারত্না উল্লেখ করেছেন, সরকারের হলফনামা ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হলফনামার মধ্যে ফারাক। সরকারের তরফে বলা হয়েছে যে, কালো টাকা, জাল টাকা ও বেআইনি অর্থ সরবরাহকে বন্ধের জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কেন্দ্রীয় পর্ষদ ৮ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সুপারিশ করেছে। ওদিকে রিজার্ভব্যাঙ্কের হলফনামায় বলা হয়েছে যে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ (ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশন) ও বৈদ্যুতিন উপায়ে লেনদেনকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সুপারিশ করা হচ্ছে। ফলে সরকার কিংবা রিজার্ভব্যাঙ্ক শীর্ষ আদালতের সামনে হলফনামা দিয়ে অসত্য বলছে। এতদসত্ত্বেও দেশের শীর্ষ আদালতের ৪ জন বিচারপতি সরকারের কোনো ত্রুটি দেখতে পাননি।

উপরের আইনি চাপান-উতোর অবশ্যই খুব উপভোগ্য নয়। নোট বাতিল সংবিধান সম্মত কিনা তা নিয়ে আমজনতার মাথাব্যথা নেই। যারা নোট বাতিলের সরাসরি আঘাতে দিনের পর দিন অভুক্ত অর্ধভুক্ত ছিলেন, সেই অটোচালক,  রিক্সাচালক, অতি ছোট ব্যবসায়ী, তাদের অনেকেই ভেবেছিলেন এটি নরেন্দ্র মোদীর মাস্টারস্ট্রোক, দেশের সব কালো টাকা হস্তগত করে সকলকে ১৫ লক্ষ না হোক কয়েক লক্ষ করে টাকা দেবেন তিনি। কিন্তু যখন সব টাকাই ব্যাঙ্কে ফিরেছে তখন তাঁরা আশাহত হলেও ধর্মের জিগির তুলে তাঁদের ভুলিয়ে রাখা গিয়েছে। লকডাউনে যারা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছে, যাদের প্রিয়জন অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছে তাঁদের বিদ্রুপ করে আদালতে হলফনামা দেওয়া হয়েছে এই বলে যে, অক্সিজেনের অভাবে কোভিডে একজনও মারা যায়নি। কোভিড টিকার শংসাপত্রে মোদীজির ছবি ছাপতে ভুল হয়নি, কিন্তু কোভিড টিকাকরণের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বিষয়ে আদালতে হলফনামা দেওয়া হয়েছে যে টিকা বাধ্যতামূলক ছিল না, সকলে স্বেচ্ছায় টিকা নিয়েছেন। আদালত তা মেনেও নিয়েছে। ফলে সরকারি হলফনামা হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নোটবাতিলের পরে দেশে নগদ টাকার পরিমাণ গত ৬ বছরে ৭১ শতাংশ বেড়েছে, যতই অনলাইন ও ইউপিআই লেনদেনের গুণগান করাহোক, এখনো গরিব ও সাধারণ মানুষের কাছে নগদই লেনদেনের উপায়। কালো টাকার কোনো হদিশ নোট বাতিল দিতে না পারলেও, রাজ্যের মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ পাত্রীর ঘর থেকে ৫০ কোটি টাকার নগদ উদ্ধার হচ্ছে। বিজেপি গত কয়েক বছরে ৩০০’র বেশি বিধায়ক ও সাংসদকে কিনেছে, নিশ্চয়ই ব্যাঙ্কের মাধ্যমে লেনদেন করে নয়। নোট বাতিলের অভিঘাতে বহু অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পাততাড়ি গুটিয়েছেন, তাঁদের কোমর ভেঙে গিয়েছিল, আজও তা সোজা হয়নি। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে জিএসটি ও তারপরে মারণাত্মক লকডাউন। কোনো কিছুতেই শীর্ষ আদালত কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে বলা যায়না। ফলে নোট বাতিলের মামলার রায় কি অযোধ্যা মামলার রায়ের মতই পূর্বনির্ধারিত ছিল না? তা সত্বেও বিচারপতি নাগারত্নার বলিষ্ঠ অবস্থান অন্ধকারের মধ্যে বিদ্যুতরেখা হিসেবে আশা জাগায়, যদিও তিনি নোট বাতিলের সামাজিক অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ফলাফল লাভক্ষতি নিয়ে কিছুই বলেননি।

- অমিত দাশগুপ্ত 

খণ্ড-30
সংখ্যা-2