মেডিকেল ডিপ্লোমা কোর্স — পুঁজির নতুন বাজার
new-capital-market
জনমত সংগ্রহ হোক

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে কয়েক দিন আগে জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার ৩ বছরের মেডিকেল ডিপ্লোমা কোর্স চালু করার চিন্তাভাবনা করছে। রাজ্যে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে ডাক্তারের অভাব আছে (ডিমান্ড সাপ্লাই ডারসাম্যের অভাব), তা পূরণ করতেই এই সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী আরো জানিয়েছেন, এজন্য ১৪ জনের এক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং তাদের একমাসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এই বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যদের বিশেষত্ব কি, এবং তাদের বিবেচ্য বিষয়, সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পদ্ধতি, জনগণের মতামত সংগ্রহের পদ্ধতি প্রকরণ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানানো হয়নি। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে, বিশেষত ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিষয়টির ভালমন্দ নিয়ে চর্চার পরিবর্তে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে মমতা সরকার এইসব ভাবনা ও পরিকল্পনা করছে। আকাশে বাতাসে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব প্রশ্ন নস্যাৎ না করেও আমরা প্রধানত মুখ্যমন্ত্রীর ভাবনা নিয়ে আলোচনার উপর জোর দেব। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্য থেকে এই প্রসঙ্গে যে মতামতগুলো উঠে এসেছে, তাও বিবেচনায় রাখব। সমস্যা হল, পূর্ণাঙ্গ কোনো আইন বা পরিকল্পনা এখনও হাজির না করায় আমাদের মতামত চূড়ান্ত করার জন্য আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।

এই প্রসঙ্গে ২০০৯ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার প্রায় একই ধরনের একটি প্রস্তাব হাজির করেছিল এবং একটা আইনও পাশ করেছিল (ওয়েস্ট বেঙ্গল রুরাল হেলথ রেগুলেটরি অথরিটি এ্যক্ট, ২০০৯) । কিন্তু সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম লালগড় আন্দোলনের চাপে নড়বড়ে (লেম ডাক) সরকার ঐ আইনকে কার্যকরী করার বিশেষ কোন উদ্যোগ নিতে পারেনি। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এমনকি দলের মধ্যে এবং বামফ্রন্টের শরিক দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐকমত্য না থাকায় ঐ ভাবনা ও আইনকে কার্যকরী করতে পারেনি। রাজ্যের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সুপ্রিমো সহ ছোট বড় নেতা ঐ আইন ও পরিকল্পনাকে প্রতারণামূলক বলে বাতিল করে দিয়েছিলেন। তারপর ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল, ১২ বছর এই নিয়ে বিশেষ কিছু চর্চা হয়েছে বলে জানা যায় না। রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেয়ালে নীল-সাদা বিপ্লব নিয়ে কিছু কথা হয়েছে, পূর্বতন সরকারের রাজত্বে রাজ্যের কলেজ হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর যে অবস্থা ছিল, তার কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা এই নিয়ে কিছু তর্ক বিতর্ক হলেও ঐ আইনটি কার্যকরী করার কোনো কথাবার্তা হয়নি। ফলে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠকের রিপোর্টের উপরেই আমাদের আপাতত নির্ভর করতে হচ্ছে।

‘হোয়ার টু পুট দি নাইফ’, শল্য চিকিৎসা বইয়ের প্রথম পাতায় পেয়ে যাবেন এই নজরকাড়া উদ্ধৃতিটি। অস্ত্রোপচারের জন্য হাতের ছুরিটা ঠিক কোথায় বসাতে হবে, এটা নির্ধারণ করাটাই একজন শল্য চিকিৎসকের দক্ষতার মাপকাঠি। একইভাবে হাতের স্টেথোস্কোপটা ঠিক কোথায় বসাব, একজন চিকিৎসককে সেটাই নির্দিষ্ট করতে হয়। গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসকের অভাব, কথাটা ঠিক বলে ধরে নিলে প্রশ্ন উঠবে — কেন অভাব? অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে যথোপযুক্ত/মোটামুটি চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় শয্যা, ওষুধপত্র, রোগীর পথ্য, পানীয় জল ইত্যাদি প্রভৃতি মোটামুটি ঠিক আছে, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য লোকবল ও ব্যবস্থা আছে, প্রসূতি মায়ের ডেলিভারি ব্যবস্থা, প্রতিষেধক ও চেক-আপ ব্যবস্থা আছে। শুধু পাশ করা ডাক্তারের অভাব। কেন অভাব? দুটো সহজ উত্তর!

১) পাশ করা ডাক্তাররা গ্রামে যেতে চায় না, অথবা
২) এত পাশ করা ডাক্তার কোথায় পাওয়া যাবে?

প্রয়োজনীয় সংখ্যায় ডাক্তার তো তৈরি করা যাচ্ছে না। প্রথম কারণ সম্পর্কে বলা হয়, হেলথসেন্টারগুলোতে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো, ওষুধপত্র, নার্স ইত্যাদির‌ অভাব, এমনকি চিকিৎসকের বাসস্থান সমস্যা ইত্যাদি আছে। কেন অভাব? জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হওয়ার সময় ৩/৪ বছরের জন্য গ্রামে সার্ভিস দেওয়ার বন্ড নেওয়া হোক। গ্রামে একটানা ৩/৪ বছর সার্ভিস দিলে পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্সে ভর্তির সময় অতিরিক্ত নম্বর দেওয়া হবে। এসব তো চালু করার কথা ছিল। হোলো না কেন? এখানেই মূল প্রশ্নটা জড়িয়ে আছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসক যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন, বাকিগুলোর অভাব ডাক্তার পাঠিয়ে মেটানো যাবেনা। চিকিৎসা পিরামিডের শীর্ষে ডাক্তার রাখলেই চিকিৎসা পরিষেবা বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। এখানেই উঠে আসে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ ও তার rational ব্যবহারের প্রশ্ন।

১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার দিনগুলো থেকে যত স্বাস্থ্য ক‌মিশন হয়েছে, তার প্রত্যেকটি গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা ও তার উপর নজর দেওয়ার কথা বলেছে। স্বাস্থ্য যে মাত্রায় বেসরকারি পুঁজি ও তার মুনাফার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে, ততই এই গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রাথমিকতা হারিয়ে গেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, ৫ বছরের এমবিবিএস কোর্স ছেটে কেটে ৩ বছরের কোর্সে ডাক্তার/হাফ ডাক্তার তৈরি করে গ্রামাঞ্চলে পাঠানো যেতেই পারে। কিন্তু প্রয়োজনীয় হাতে কলমে ট্রেনিং ছাড়া (ইন্টার্ন/হাউসস্টাফ শিপ) প্রাথমিক চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া সম্ভব/যুক্তিযূক্ত হবে কি? একটা চটজলদি উত্তর অবশ্য আছে। দেশ ও রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে তো নগ্নপদ ডাক্তাররাই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে, তাহলে ৩ বছরের কোর্স করে কেন করতে পারবে না? যুক্তিটাকে যদি একটু উল্টো দিক থেকে দেখা যায়, তাহলে তো বলতেই হয়, ৩ বছরের শিক্ষাই যদি যথেষ্ট হয়, তবে আর ৫ বছর সময় নষ্ট না করে গ্রামের জন্য তিন বছরের ডাক্তার তৈরি করা যাক। কিন্তু এরাইবা কেন নার্সিংহোম/হাসপাতালগুলোতে এই রুরাল হেলথকেয়ার প্রোভাইডার সার্টিফিকেট হাতে নিয়েই চিকিৎসায় যুক্ত হবেন। সবই আশঙ্কা। এই সার্টিফিকেট হাতে নিয়েই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে যে চিকিৎসা ব্যবস্থা চলবে, তা ‘রেফারাল সিস্টেম’কে আরও শক্তিশালী করবে। টারশিয়ারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ভিড় এখনই উপচে পড়ছে। আরও পড়বে।

এই আশঙ্কা আরো দৃঢ় হয়েছিল, ২০০৯ সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল রুরাল হেলথ রেগুলেটরি অথরিটি এ্যক্ট ২০০৯’র ৮নং ধারার ২নং উপধারায় নজর দিয়ে। দেখা যাবে, ৩ বছরের জন্য মেডিকেল সার্ভিস প্রোভাইডার (সহজ ভাষায়, গ্রামীণ চিকিৎসক) তৈরির এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দায়িত্ব দ্রুত চলে যাবে প্রাইভেট পুঁজির হাতে। যেভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা কোর্সের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাইভেট পুঁজির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ৩ বছরের ডাক্তার তৈরির নতুন বাজার খুলে যাবে। ২০০৯ সালের ঐ বিল/আইনের বিরুদ্ধে এটাই ছিল একটা বড় আপত্তি। অবশ্য ২০০৯ সালের ঐ আইনে স্পষ্ট বলা আছে (১৭নং ধারার ৪নং উপধারা), রুরাল হেলথ প্রাকটিশনার্শরা নামের আগে কিংবা পরে ডক্টর বা ডাঃ লিখতে পারবেন না। অবশ্য বর্তমান সরকার এখনও কোন আইনের প্রস্তাব রাখেনি বা পুরানো আইন অনুসরণ করবে একথাও জানায়নি। পুঁজির দৌরাত্ম্যে ইন্ডিয়া আর ভারতকে চিনতে কোনো অসুবিধা হয় না। মুনাফালোভি লগ্নিপুঁজি চিকিৎসা ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামকে আলাদা বিন্যস্ত করে দিয়েছে। এমডি, এমআরসিপি, এফআরসিএস শহরের মানুষের জন্য আর ট্রেনিং প্রাপ্ত কোয়াক কিংবা ৩ বছরের ডাক্তারবাবু গ্রামের মানুষদের জন্য। গ্রাম ও শহরের বুনিয়াদি দ্বন্দ্ব সমাধানের কথা মার্কস বলেছিলেন, আগ্রাসী পুঁজি তার বিপরীতে আমাদের হাঁটতে বলছে। চিকিৎসক মহলে এবং বৃহত্তর সমাজে এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। একে সংগঠিত করতে হবে। স্বাস্থ্যের মতো সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা নিশ্চুপ থাকতে পারি না।

- পার্থ ঘোষ

খণ্ড-30
সংখ্যা-15