কাজগুলো সব কোথায় গেল!
all-the-work-go

(প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়ক নিউজক্লিক’এর ৭ মে ২০২৩ সংখ্যায় এই লেখাটি লেখেন। লেখাটার গুরুত্ব বুঝে আমরা এখানে তা প্রকাশ করছি। শিরোনাম আমাদের। - সম্পাদকমন্ডলী)

সিএমআইই’র বেকারত্ব সংক্রান্ত তথ্য সামনে মেলে ধরল অত্যন্ত বিবর্ণ এক ছবিকে। বেকারত্ব যে মাত্র কয়েক বছর আগে থেকে মাথা তুলেছে, ব্যাপারটা তা কিন্তু নয়। বরং অতিমারীর আগে থেকে এই বেকারত্বের হার বাড়তে শুরু করে। অতিমারীর সময়ে বেকারত্বের যে হার এক লাফে বেড়েছিল, বহু ঢাক পেটানো জিডিপি বৃদ্ধি কিন্তু সেই হারে লাগাম পরাতে পারল না।

বেকারত্বের যে হার ছিল ২০১৭-১৮’তে ৪.৭ শতাংশ, তা ২০১৮-১৯এ বেড়ে হল ৬.৩ শতাংশ। অতিমারীর সময়ে লকডাউনের হাত ধরে তা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। উদাহরণ স্বরূপ, ডিসেম্বর ২০২০তে ৯.১ শতাংশ। তারপর থেকে এই হার একটু কমলেও অর্থনীতির অংশত বা খানিক পুনরুজ্জীবনের সাপেক্ষে যতটা অনুমান করা হয়েছিল, তা নিতান্তই কম। ২০২২’র ডিসেম্বরে যা ছিল ৮.৩ শতাংশ, তা সামান্য একটু কমে ২০২৩’র জানুয়ারিতে হল ৭.১৪ শতাংশ। কিন্তু, আবার মার্চে তা মাথা তুলে দাঁড়াল ৭.৮ শতাংশে, সিএমআইই’র তথ্য অনুযায়ী।

জিডিপি বৃদ্ধি থমকে রয়েছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত ২০২২-২৩’র জন্য জিডিপি’র যে আনুমানিক বৃদ্ধির পূর্বাভাস রয়েছে তা ২০১৯-২০’র সাপেক্ষে ৮.৪ শতাংশ বেশি আর ২০১৮-১৯’র সাপেক্ষে ১২.৯৫ শতাংশ বেশি। জিডিপি’র ১২.৯৫ শতাংশ বৃদ্ধি হলেও বেকারত্বের হার ২০২২-২৩’র শেষে বেশি (৭.৮ শতাংশ), ২০১৮-১৯এ যা ছিল ৬.৩ শতাংশ। যেহেতু এই চার বছরে শ্রমশক্তির বৃদ্ধি হয়নি, বা তা ১২.৯৫ শতাংশের ধারেকাছে আসেনি, এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে প্রতি ইউনিট জিডিপি বৃদ্ধিতে কর্মসংস্থান ২০১৮-১৯ ও ২০২২-২৩এ কমেছে।

এখান থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, অতিমারীর সাপেক্ষে বর্তমানের উঁচু বেকারত্বের হারের পেছনে রয়েছে দু’টো কারণ : প্রথমত, যেটুকু আর্থিক পুনরুজ্জীবন হয়েছে, তা ঘটেছে এমন ক্ষেত্রগুলোতে যেখানে কর্মসংস্থান হয় না। অর্থাৎ, যে সমস্ত ক্ষুদ্র ছোট শিল্প ইউনিটগুলো শ্রমনিবিড়, সেই ক্ষেত্রগুলো পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়ার বাইরেই থেকে গেছে। আর দ্বিতীয় কারণ হল, বাজারে চাহিদার অভাবে বড় মাত্রায় লে-অফ হয়েছে, অথবা, ব্যয় সংকোচের নামে শ্রম সংকোচন ঘটানো হয়েছে।

ছাঁটাইয়ের জলজ্যান্ত উদাহরণ রয়েছে সিএমআইই’র দেওয়া তথ্যে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কর্মী সংখ্যা ফেব্রুয়ারিতে ৪০ কোটি ৯৯ লক্ষ থেকে কমে মার্চে এসে দাঁড়ায় ৪০ কোটি ৭৬ লক্ষে। ২০১৯-২০’তে ভারতে সমগ্র কর্মরত কর্মীর সংখ্যা ছিল ৪০ কোটি ৮৯ লক্ষ। যার অর্থ, ২০২৩’র মার্চে সমগ্র কর্মীর সংখ্যা ২০১৯-২০’র তুলনায় কম ছিল। এটা অত্যন্ত মলিন এক ছবি, যা দেখিয়ে দেয়, নতুন নতুন কাজ তৈরি হওয়ার বিপরীতে উল্টে যে কাজগুলো ছিল, সেগুলোই অনেকাংশে খোয়া গেল।

পরিহাস এটাই যে, সরকারি মুখপত্র দাবি করেছেন, দেশে কর্মসংস্থানের চিত্র নাকি অনেকটাই উন্নত হয়েছে। তারা নিজেদের যুক্তির সপক্ষে দু’টো দাবি তুলে ধরছেন। এক, সিএমআইই’র তথ্য সত্যনিষ্ঠ নয় আর পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভের (পিএলএফএস) তথ্যের সাথে তার কোনো সাযুজ্য নেই যা থেকে কর্মসংস্থানের উন্নতির ছবি বেরিয়ে আসে। আর দ্বিতীয় কারণটা হল, মনরেগার কাজে যুক্ত হওয়ার চাহিদা বেশ কমেছে, যা কর্মসংস্থানের উন্নতির অবস্থাকে প্রতিফলিত করে।

এই দু’টো যুক্তিরই কোনো সারবত্তা নেই। পিএলএফএস এবং কর্মসংস্থান সংক্রান্ত সিএমআইই’র দেওয়া তথ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় তফাৎ হল, প্রথমোক্তটি কর্মসংস্থানের সংজ্ঞার অধীনে গার্হস্থ্য আর্থিক কর্মকান্ডে মজুরিহীন শ্রমকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা শেষোক্তটি করেনি। কিন্তু, গার্হস্থ্য কর্মকান্ডের মধ্যে মজুরিহীন শ্রমকে অন্তর্ভুক্ত করলে তখনই সমস্যা হয় যখন বহির্জগতে ছাঁটাই বা সংকুচিত কর্মসংস্থানের ঘটনা ঘটে। মোদ্দা কথাটা হল, একটি পরিবারের উপার্জন যখন বন্ধ হয়ে যায়, পরিবারের সদস্যরা বাইরে কাজকর্ম থেকে বঞ্চিত হয়, তখন বাধ্যতামূলকভাবে তাঁরা ঘরের মধ্যে যেটুকু কাজ পান, তাই করতে বাধ্য হন। এক্ষেত্রে পিএলএফএস বেকারত্বের বৃদ্ধি দেখায় না। অন্য কথায়, পিএলএফএস ঘরের কোণে বাধ্যতামূলকভাবে আটকে থাকা আর উপার্জনশীল গাহর্স্থ্য কর্মকান্ডের মধ্যে তফাৎ টানে না।

সিএমআইই এই সমস্ত ফাঁক ফোকর থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছে। তারা ধারাবাহিকভাবেই বহির্জগতে কর্মসংস্থানের চিত্রটাকেই সমীক্ষা করে চলেছে। ফলে, তাদের সমীক্ষা অনেক নিখুঁত ও বিশ্বাসযোগ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত।

লকডাউনের সময় মনরেগা প্রকল্পে যে বিরাট চাপ লক্ষ্য করা যায় তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এটা ভুলে গেলে চলবেনা, ঠিক সময়ে মনরেগা প্রকল্পের মজুরি কেন্দ্রীয় সরকার দিচ্ছেনা দেখে এই প্রকল্পে মজুররা কাজ করতে চাইছেনা। তাই, এই প্রকল্পে কাজ হওয়াটা এখন কর্মসংস্থান পরিমাপের দুর্বল সূচক। ঠিক সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার বকেয়া মজুরি প্রদান না করায় অনেকেই এই প্রকল্পে আগ্রহ হারাচ্ছে। আর এটাকেই প্রচার করা হচ্ছে যে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর কমছে! কী অদ্ভুত যুক্তি।

যে কোনো ব্যক্তি স্বাভাবিক কারণেই আশা করবেন যে, কর্মহীনদের সংখ্যা সামগ্রিক কর্মরত মানুষদের গড় প্রকৃত আয়ের সাথে, স্বনিযুক্ত ব্যক্তিদের গড় প্রকৃত আয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত হবে। এই কারণে, স্বনিযুক্ত গ্রুপের মধ্যেই শ্রমের মজুতবাহিনী নিহিত। কর্মসংস্থান হ্রাসপ্রাপ্ত হলে ওই মজুত বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, যার ফলশ্রুতিতে স্বনিযুক্ত ক্ষেত্রটির গড় প্রকৃত মজুরিও হ্রাসপ্রাপ্ত হবে। এটা বেশ মজার ব্যাপার যে, সরকারের নিজস্ব পিএলএফএস’এর পরিসংখ্যানই দেখিয়েছে যে, ২০২২’র এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে স্বনিযুক্ত কর্মীদের গড় প্রকৃত আয় ২০১৯’র এপ্রিল-জুন’এর ত্রৈমাসিকের সাপেক্ষে গ্রাম ও শহরে বেশ নিচে ছিল (চন্দ্রশেখর ও ঘোষ, ম্যাক্রোস্কান)। এই তথ্য আরো একবার সিএমআইই’র বেকারত্ব সম্পর্কিত সমীক্ষাকেই প্রতিষ্ঠিত করল।

ভারতের বেকারত্ব সম্পর্কিত পরিসংখ্যান কিছু মৌলিক বিষয়কেই তুলে ধরে, আর তা হল, নব্য উদারবাদ কখনই এক সামাজিক বন্দোবস্ত হতে পারে না যা কিনা দেশের বেকারত্বের সমস্যাকে ঘুচিয়ে দেবে। যেহেতু, অল্প মাত্রায় হলেও কিছু আর্থিক কর্মকান্ডের দৌলতে মহানগরের ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সম্প্রসারিত হয়েছে আর তা তুলনামূলকভাবে মজুত বাহিনীর ছোট্ট একটা অংশ সেখানে জায়গা করে নিতে পেরেছে। তারা এখান থেকে এই যুক্তি হাজির করেন যে, এটাই যদি অন্যত্র অনুসরণ করা হয়, যদি বাকি বিষয়গুলো ‘বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়’, সরকার বৃহৎ পুঁজির স্বার্থ ছাড়া অন্য সব দিক থেকেই নিজের হাত যদি গুটিয়ে নেয়, তবে ‘সমৃদ্ধি ও একশভাগ কর্মসংস্থানের’ রাস্তা পাকা হবে।

একথা ঠিক, ‘একশভাগ কর্মসংস্থান’ পুঁজিবাদী অর্থনীতি কখনই অর্জন করতে পারবে না, কারণ বেকারদের মজুত বাহিনী ছাড়া সে অর্থহীন। কিন্তু, নব্য উদারবাদ এই মজুত বাহিনীর একটা বড় অংশকে ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা অনেক প্রগতিশীল মানুষের চোখে ঠুলি পরিয়ে দেয়। ওই যুক্তিতে ঔপনিবেশিকতাবাদের অবসানের পর তৃতীয় বিশ্বে যে ‘রাষ্ট্র’ সামনে এল, তা ধীরে ধীরে নিজের হাত গুটিয়ে নিতে সফল হয়, আর সাধারণভাবে মহানগরের পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিপরীতে এক আপেক্ষিক স্বায়ত্ততার হাবভাব নিয়ে চলতে শুরু করে।

নব্য উদার পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কিছু মহৌষধী দিয়ে বেকারত্বের সমস্যা সমাধান করা যাবেনা। বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মী এক আর্থিক সামাজিক ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে, যে ব্যবস্থাটি বেকারদের মজুত বাহিনীর উপর নির্ভর করবেনা, বরং শ্রমজীবী মানুষের দ্বারা সচেতনভাবে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে অনুমোদন দেবে।

পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে বা পিএলএফএস হল এমন এক সমীক্ষা যা বাৎসরিক ও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রধান প্রধান কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব সংক্রান্ত সূচক, যেমন শ্রমে অংশগ্রহণের হার, কর্মী জনসংখ্যার অনুপাত, কর্মহীনতার হার ইত্যাদি সম্পর্কে আলোকপাত করে।

ভাষান্তরঃ অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-30
সংখ্যা-16