আক্রমণাত্মক ফ্যাসিবাদী অ্যাজেণ্ডা

১)      গত চার বছরের মধ্যে ভারতের রাজনীতিতে এক বড় সড় পরিবর্তন দেখা গেল। শাসক শ্রেণীর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিনিধি কংগ্রেসকে পুরোপুরি সরিয়ে বিজেপি এখন সেই স্থান দখল করে নিয়েছে। ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে এই প্রথম বিজেপি কেবল যে কেন্দ্রেই নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেছে তাই নয়, হাতেগোনা কয়েকটি রাজ্য বাদ দিলে সর্বত্রই শাসক পার্টি হিসাবে সে আত্মপ্রকাশ করেছে। কোথাও এককভাবে, কোথাও বা অন্য দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠন করে। খুব সম্প্রতি সে ত্রিপুরায় জয়লাভ করল, যেখানে বামেরা নিরবচ্ছিন্নভাবে ২৫ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল। আর, এর মধ্যে দিয়ে গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিজেপি নিজের কব্জাকে আরও মজবুত করতে সক্ষম হল। ভারতের কেন্দ্র ও আঞ্চলিক স্তরে প্রাধান্যমূলক শাসক পার্টি হিসাবে বিজেপির উত্থানের সুবাদে গোটা সংঘপরিবার তার ফ্যাসিস্ট অ্যাজেণ্ডাকে নজিরবিহীন গতিতে ও মারমুখী হয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল।

২)      ২০১৪ সালের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীকে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে খাড়া করার সময় থেকেই এই আক্রমণাত্মক বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। অনেকটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ধাঁচে বিজেপি ২০১৪-র সংসদীয় নির্বাচনী প্রচার সংঘটিত করল, মোদী ও গুজরাট মডেলকে ঘিরে নির্মিত হল মোক্ষম এক কল্পকথা। মোদীর তুলে ধরা শ্লোগান “কংগ্রেস মুক্ত ভারত” এবং তার মিছিলগুলোর নামকরণ “ভারত বিজয়” নিঃসন্দেহে আগ্রাসী অভিযানকেই সূচিত করল। ২০১৪ সালের নির্বাচনী বিজয়ের (যদিও এই জয় এসেছে মাত্র ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে) পর থেকেই বিজেপি এমন হাবভাব শুরু করল যে সে যেন সত্যিই ভারত জয় করে ফেলেছে। আর সংঘ-বিজেপির মতাদর্শ ও অ্যাজেণ্ডার অধীনে সব কিছুকে বদলে ফেলার ঢালাও ছাড়পত্র যেন তারা পেয়ে গেছে। সংবিধানের ওপরে বিজেপি খোলাখুলি হামলা নামিয়েছে। অনন্ত হেগড়ের মতো মোদীর মন্ত্রীরা প্রকশ্যেই গলা চড়িয়ে সংবিধান বদলানোর বিজেপির লক্ষ্যকে ঘোষণা করছে।

৩)      রাষ্ট্রের পাশাপাশি রাষ্ট্র বহির্ভুত শক্তিগুলো একতালে ও একে অপরের সঙ্গে যোগসাজশ করে ভারতে নামিয়ে এনেছে এই ফ্যাসিবাদী হামলা। রাষ্ট্র ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে, সব ক্ষেত্রেই করছে অনধিকার হস্তক্ষেপ। রাষ্ট্র সংঘবাহিনীকে প্রকাশ্যে বা আড়াল থেকে মদত দিচ্ছে যাতে সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী-পিতৃতান্ত্রিক আচরণবিধিকে বলবৎ করতে গণপ্রহার, ভিন্ন মতাবলম্বী বুদ্ধিজীবী ও কর্মীদের পরিকল্পিত খুন, ধারাবাহিক ঘৃণাভরা প্রচার চালাতে পারে। নাগরিকত্বের শর্তাবলী থেকে শুরু করে প্রজাতন্ত্রের ধরন—মোদী সরকার ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্রের মূল বনিয়াদকেই ধ্বংস করতে চাইছে। সংসদীয় গণতন্ত্রকে বানচাল করা

৪)      সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মন্ত্রীসভা কেন্দ্রীক শাসন প্রণালীকে পুরোপুরি লঙ্ঘন করে মোদী মার্কিন রাষ্ট্রপতির আদলে সরকার পরিচালনা করছে। তার একের পর এক কার্যকলাপের দিকে চোখ রাখলেই সেটা স্পষ্ট হবে। বিদেশ দপ্তরের মন্ত্রীকে অপ্রাসঙ্গিক করে তার নিত্যনৈমিত্তিক বিদেশ যাত্রা, উত্তরপ্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের ঠিক আগে নোট বাতিলের আচমকা ঘোষণা, ফ্রান্স ভ্রমণের সময়ে রাফাল যুদ্ধ বিমান চুক্তি সম্পাদনা যা পূর্বতন সরকারের সম্পাদিত চুক্তি থেকে অনেক নিকৃষ্ট। মধ্যরাতে সংসদের যুক্ত অধিবেশনে জিএসটি-র সুচনা মুহুর্তে এমন হাবভাব দেখানো হল যে ভারত বুঝি আরেকটা স্বাধীনতা অর্জন করল, বা সরকারি কোষাগার থেকে প্রতিদিন ৩ কোটি টাকা খরচের বিনিময়ে ঢালাও বিজ্ঞাপনের বন্যা — সবকিছুই দেখিয়ে দেয় যে মোদী সরকার নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এবং বেলাগাম ব্যক্তিপূজোর নির্লজ্জ শাসনের প্রতিমূর্তি।

৫)      প্রথম দিন থেকেই, মোদী সরকার পরিকল্পিতভাবেই সংসদীয় প্রতিষ্ঠান, পদ্ধতি ও রীতিনীতিকে অবজ্ঞা করে চলেছে। যোজনা কমিশনকে তুলে দিয়ে তার জায়গায় অনির্ভরযোগ্য নীতি আয়োগকে নিয়ে আসা, যে প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর প্রতি নিদারুণ অবজ্ঞা করে অর্থনীতিকে ডিজিটালকরণের অভিমুখে নিয়ে যায়, এমনকি একই সঙ্গে বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচন করে ফেলার জন্য নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দেয়, প্রতারণামূলক আধার সহ অনেকগুলো বিতর্কিত পদক্ষেপকে অর্থ বিলের ঘোমটার আড়ালে পাশ করানো — এগুলোই কয়েকটি টাটকা উদাহরণ মাত্র।

৬)      “এক দেশ, একটা নির্বাচন”-এর যে আওয়াজ বিজেপি তুলেছে তার উদ্দেশ্যই হল যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক বহুত্বকে ধ্বংস করা। একই সঙ্গে নির্বাচনগুলো সংগঠিত করার সুবাদে মানুষের রাজনৈতিক পছন্দকে সংকুচিত করে আরও বেশি রাজনৈতিক একমাত্রিকতার উদ্দেশ্য রয়েছে। জনগণের রাজনৈতিক পছন্দ এবং সমস্ত স্তরে যে ভিন্ন ধর্মী রাজনৈতিক চর্চাগুলো চলে, তাকে শাসক পার্টি ও বড় বড় মিডিয়ার তৈরি করা আখ্যানের অধীনে রাখতেই এসব করা হচ্ছে।

৭)      নতুন জমানার তরফ থেকে নিয়োজিত বেশিরভাগ রাজ্যপাল আরএসএস-র প্রচারক হয়ে কাজ করছেন। খোলাখুলি আরএসএস-র অ্যাজেণ্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলোতে রাজ্যপালের পদমর্যাদার অপব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটাচ্ছে। রাজ্যগুলোর ওপর কেন্দ্রের প্রাধান্য বজায় রাখার যে লক্ষ্য নিয়ে রাজ্যপালের সাংবিধানিক পদ নির্মিত হয়েছিল তা আজ বিজেপি ক্ষমতা কব্জা করার সংকীর্ণ স্বার্থে নগ্নভাবে অপব্যবহার করছে। আর তা করতে গিয়ে আমাদের সাংবিধানিক কাঠামোতে রাজ্যের অধিকার ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদের প্রতিটা দিককে নস্যাৎ করে ভারতের রাজ্য শাসন প্রণালীকে পুরোপুরি একমাত্রিকতায় পরিণত করতে চাইছে।

ক্রোনি পুঁজি বাদ, দুর্নীতি, আর্থিক বিপর্যয়

৮)      প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এবং সংসদীয় রীতিনীতি ও প্রক্রিয়াগুলোকে অবজ্ঞা করে উদারিকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের স্বার্থবাহী ধ্বংসাত্মক আর্থিক অ্যাজেণ্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্ষমতায় এসেই নরেন্দ্র মোদী ২০১৩-র জমি অধিগ্রহণ আইনের রক্ষাকবচ এবং ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের তুলনামূলক উন্নততর শর্তাবলীকে নস্যাৎ করতে উদ্যত হয় যা জমি ও জীবিকা হারানো মানুষেরা অর্জন করেছিল। যদিও প্রবল প্রতিরোধের মুখে তার সরকার জমি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করতে পারেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কর্পোরেট স্বার্থবাহী অ্যাজেন্ডাকে নগ্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা থেকে সে নিজেকে বিরত রাখেনি। গোটা ভারতীয় অর্থনীতিকে বিদেশী পুঁজির কাছে হাটখোলা করে ‘মেক ইন ইণ্ডিয়া’র অছিলায় বিদেশী বিনিয়োগকে তোয়াজ করা, যৌথ উদ্যোগ এবং পিপিপি-র মাধ্যমে পরিকল্পিত বেসরকারিকরণ, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও কোম্পানি সম্পত্তির ঢালাও বিক্রি করে দেওয়াটাই মোদী সরকারের আর্থিক অ্যাজেণ্ডার প্রধান অভিমুখ থেকেছে, যার দরুণ বিকাশের গালভরা বুলির আড়ালে ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে তার ভিটে মাটি থেকে উৎখাত ও স্থানান্তরিত হতে হয়েছে।

৯)      ব্যাঙ্কিং সেক্টরের পুনর্গঠন এবং আর্থিক লেনদেনে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর মোদী সরকারের অর্থনৈতিক কর্মসুচীর এক প্রধান ক্ষেত্র হিসাবে সামনে এসেছে। এটা সর্বজনবিদিত যে, ভারতে ব্যাঙ্কিং সেক্টরের সঙ্কটটি উদ্ভূত হয়েছে বিপুল পরিমাণে অনাদায়ি ঋণের বোঝা থেকে, যা মূলত বিশাল মাত্রায় অপরিশোধযোগ্য কর্পোরেট ঋণের এক টেকনিক্যাল সংজ্ঞা মাত্র। ঋণখেলাপিদের শাস্তি না দিয়ে সরকার উল্টে মাঝেমধ্যে ঋণ মকুব বা আর্থিক ছাড় দিচ্ছে। আর, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ৮৬ শতাংশ মুদ্রা বিমুদ্রাকরণের মাধ্যমে বাতিল করার পর সরকার এখন আমানতকারীদের টাকায় ব্যাঙ্কগুলোর সঙ্কট মোচনের জন্য তাদের তহবিলকে ব্যাঙ্ক শেয়ারে রূপান্তরিত করার চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। এটা লক্ষণীয় যে, ডিজিটাল প্রক্রিয়া থেকে আধার এবং তারপর এফআরডিআই-র দানবীয় বিল — ফিনান্সিয়াল ক্ষেত্রকে পুনর্গঠিত করার যাবতীয় প্রস্তাবগুলোই আন্তর্জাতিক ফিনান্স প্রভুদের তৈরি করা নীলনকশা আর ওই সমস্ত ইস্যুতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মোদী ও তার দল ক্ষমতায় আসার পর পুরোপুরি ডিগবাজি খেয়েছে। আন্তর্জাতিক ফিনান্সের প্রভাব থেকে তুলনামূলকভাবে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখা বা পুরোপুরি মিলেমিশে না যাওয়ায় দুনিয়াব্যাপী ফিনান্সিয়াল সঙ্কটের বিপর্যয় থেকে ভারতের আর্থিক ক্ষেত্রটি নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। আন্তর্জাতিক ফিনান্সের প্রবল অস্থিরতা ও মরিয়া আগ্রাসনের হাত থেকে ভারতীয় আর্থিক ক্ষেত্রকে রক্ষা করতে সার্বভৌম রাষ্ট্র যে সমস্ত রক্ষাকবচ ও বিধিনিষেধ তৈরি করেছিল, মোদী সরকার সেগুলোকে ইতিমধ্যেই দুর্বল করে দেওয়ায় ভারতীয় অর্থনীতি বর্তমানে বাইরের চাপ ও ধাক্কার মুখে রীতিমতো বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে গেল।

১০)      দুর্নীতি ও ক্ৰোনি পুঁজি বাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান গণরোষ আর নানা কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে পড়া ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়ে মোদী ক্ষমতায় আসে। কিন্তু অতীতের কোন সরকারকেই কর্পোরেটদের এরকম ঘনিষ্ঠ স্বার্থবাহী হিসাবে, আর তাও আবার হাতে গোনা কয়েকটি বৃহৎ ঘরানার পক্ষে দাঁড়াতে দেখা যায়নি, যেটা মোদী সরকারের ক্ষেত্রে ঘটেছে। প্রাকৃতিক সম্পদগুলো পুরোপুরি কর্পোরেটদের কজায় নিয়ে যাওয়া, দেশের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সম্পদ এবং ব্যাঙ্ক ফিনান্স থেকে শুরু করে বিদেশে আদানি-আম্বানির স্বার্থবাহী পদক্ষেপগুলো নিয়ে অল্পদিনের ব্যবধানেই এই সরকারটি ক্ৰোনি পুঁজি বাদের চুড়ামণি হয়ে উঠেছে। বিজয় মাল্য এবং বর্তমানে নীরব মোদীর মতো আর্থিক কেলেঙ্কারীর রাঘব বোয়ালদের দেশ ছেড়ে পালাতে সরকারের মদত, মিডিয়া জয় অমিত শাহর হঠাৎ বিপুল অর্থপ্রাপ্তির ঘটনাগুলো উদঘাটন করতে শুরু করলে তাদের রক্তচক্ষু দেখানো, বাণিজ্যিক কারণে গোপনীয়তা বজায় রাখার অজুহাতে ও জাতীয় নিরাপত্তার ধুয়ো তুলে সংসদে রাফাল যুদ্ধ বিমান কত দামে কেনা হয়েছে তা জানাতে অস্বীকার — এ সবকিছুই দুর্নীতিকে মোকাবিলা করার প্রশ্নে তার চুড়ান্ত কপট অবস্থানকেই বেআব্রু করে। সরকারের প্রত্যেকটা গুরুত্বপুর্ণ আর্থিক সিদ্ধান্ত সাধারণ নাগরিকদের উপর ঘনিয়ে এনেছে নিদারুণ দুর্দশা আর মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের জন্য বিপুল সুবিধা।

গভীরতর কৃষিসংকট, মাত্রাছাড়া কর্মহীনতা এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্য

১১)      ক্ষুদ্র উৎপাদন ও ব্যবসা বাণিজ্যকে তছনছ ও ধ্বংস করার পর কৃষিক্ষেত্রে আক্রমণ তীব্রতর হয়েছে। ঋণ মকুব ও ন্যায্য দামের দাবি জানানোর জন্য চাষি ও গ্রামীণ শ্রমিকদের ঠাণ্ডা করা হচ্ছে নির্মম নিপীড়ন চালিয়ে। ঝাড়খণ্ডে চাষি ও আদিবাসীদের জমি বলপূর্বকভাবে অধিগ্রহণের জন্য বারংবার পুলিশী গুলি চালনা, মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরে প্রতিবাদী কৃষকদের ওপর গুলি, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানে ঋণ মকুবের নামে কৃষকদের সঙ্গে তামাশা, উত্তরপ্রদেশে, বিহার ও আসামে বিরাট পরিধি জুড়ে শ্রমজীবী কৃষকদের উচ্ছেদ এবং এনএসএ-তে অখিল গগৈকে গ্রেপ্তার — এই সমস্ত ঘটনা পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেয় যে বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলো কৃষক জনতার বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। গো-রক্ষার নামে বিজেপি যে বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছে তা কৃষি অর্থনীতিকে লণ্ডভণ্ড করে বিরাট বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ফলস্বরূপ গবাদি পশুর ব্যবসা, ডেয়ারি থেকে শুরু করে মাংস ব্যবসা ও হোটেল শিল্প-সমগ্র অর্থনৈতিক কার্যকলাপ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাজেট বরাদ্দ ক্রমাগত কমে আসার দরুণ গ্রামীণ অর্থনীতি ও হরেক কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আর প্রতিটা প্রকল্পকেই আধারের সঙ্গে যুক্ত করায় সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে।

১২)      কৃষি সংকট, উৎপাদন ও বাণিজ্য এই দুটো ক্ষেত্রেই ছোট ব্যবসায় ক্রমশ প্রতিকূল অবস্থা তৈরি হওয়ায় সমগ্র আর্থিক বৃদ্ধি মন্থর হয়েছে আর নিদারুণভাবে তার প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। বাস্তবে ভারতীয় অর্থনীতি কর্মসংস্থানহীন বৃদ্ধি থেকে আশঙ্কাজনকভাবে ক্রমেই কর্মসংস্থাননাশক বৃদ্ধির দিকে উত্তরিত হচ্ছে, আর সংখ্যাগত দিক থেকে প্রকৃত কর্মসংস্থানের অবনমন ঘটেছে। গত কয়েক দশক যাবত সরকারি সংগঠিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলো ক্ৰমে গুটিয়ে আনায় সেখানে কাজের সুযোগ ক্রমাগত সংকুচিত হলেও আইটি এবং অন্যান্য রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোই ভাল পরিমাণে কর্মসংস্থানের সুযোগ খুলে রেখেছিল। কিন্তু আজ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং মোদী সরকারের স্বেচ্ছাচারী ও ক্ষতিকারক পদক্ষেপ, বিশেষ করে নোট বাতিল এবং জিএসটি-র দরুণ আইটি এবং রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোতেও কাজের সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ফি-বছর বাড়তি ২ কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, সে এখন কর্মপ্রার্থীদের স্ব-নিযুক্তি প্রকল্পে যুক্ত হতে বলছে এবং ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের মুদ্রা প্রকল্পটিকে (যেখানে গড়ে ৫০ হাজার টাকার কম ঋণ প্রদান করা হয়) সর্বকালের বৃহত্তম কর্মসংস্থানমুখী পদক্ষেপ হিসাবে বিজ্ঞাপিত করছে।

১৩)      প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বুক বাজিয়ে বলেছেন যে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় কর্পোরেশনদের জন্য ‘সহজে ব্যবসা করার সুযোগ’ তিনি দিয়েছেন। আর তা করতে গিয়ে শ্রম ও পরিবেশ সুরক্ষার আইনগুলোকে লঙ্ঘন ও ধ্বংস করা হয়েছে। নিজের জমানার কর্পোরেটপন্থী ভাবমূর্তিকে আড়াল করতে মোদী ও তার মন্ত্রীরা এখন ‘সহজে ব্যবসা করার সুযোগে’র পাশাপাশি ‘সহজ জীবনধারণ’ করার কথা বলছেন। কিন্তু এই শঠতাপূর্ণ অবস্থান ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় অনাহারে মৃত্যু ও কৃষক আত্মহত্যার হাড় হিম করা রিপোর্ট যখন সামনে আছড়ে পড়ে। মোদীর ‘স্কিল ইণ্ডিয়া’ প্রকল্পটি একটা মিথ্যার বেসাতি ছাড়া আর কিছুই নয়। বেতন ভিত্তিক চাকরির জন্য নতুন প্রশিক্ষণ ও সুযোগ সুবিধার বদলে কর্মহীনদের কোনোরকমে বেঁচেবর্তে থাকতে চাকরির জন্য পড়ে রয়েছে হকারির মতো ইনফর্মাল স্বনিযুক্তি প্রকল্প, আর কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়ার বদলে সরকার নিজের বাহবা কুড়াচ্ছে পকোড়া বিক্রির মতো স্বনিযুক্তি প্রকল্পের সুযোগগুলো তৈরি করার। হকাররা আঙুল তুলে দেখিয়েছেন যে, তাদের ‘সহজ জীবনধারণ’ ও ‘সহজে ব্যবসা করার সুযোগ’ এই দুটোই বারবারই আক্রমণের মুখে পড়েছে ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ করার মাধ্যমে। বিশ্ব বিকাশের সুচকগুলো (আইএলও, আইএলও স্ট্যাট ডেটা বেস, মার্চ ২০১৭) দেখায় যে ভারতে সমগ্র কর্মসংস্থানের নিরীখে মজুরি ও বেতনভিত্তিক কাজের শতকরা হার লজ্জাজনকভাবে কম। মাত্র ২১.২ শতাংশ — গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় যার শতকরা হার ২৬, বাংলাদেশে ৪৪.৫, পাকিস্তানে ৩৯.৬ শতাংশ। দারুণভাবে ঋণগ্রস্ত গরিব দেশগুলোর শতকরা হার ২৮.৯ এবং কম উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শতকরা হার ৩৩.৩। সম্প্রতি বিশ্বব্যাঙ্কের এক খসড়া রিপোর্ট ‘সিসটেমেটিক কান্ট্রি ডায়গোনস্টিক’ জানিয়েছে যে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, নিম্ন আয় সম্পন্ন পেশায় অধিকাংশ মানুষকে ঠেলে না দিয়ে নিয়মিত ধরনের বেতন ভিত্তিক কাজ ভারতের সৃষ্টি করা উচিত যেগুলোতে আয় বাড়বে।

১৪)      বৃদ্ধি হ্রাসপ্রাপ্ত হওয়া এবং ব্যাপক ভারতীয় জনতার প্রকৃত আয় ক্রমেই নিম্নমুখী হওয়ার আবহে আর্থিক বৈষম্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গত তিন দশকে এই প্রক্রিয়াটার গতিবেগ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে আর বিশেষ করে মোদীর জমানায় বেড়ে চলা আর্থিক বিপর্যয়ের সাথে সাধারণ মানুষের ওপর বেলাগাম কর্পোরেট হামলা তীব্রতর হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে উচ্চস্তরে আসীন ১ শতাংশের সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে—২০১৪ সালে ছিল ৪৯ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৫৩ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ৫৮.৪ শতাংশ হারে। অক্সফ্যাম-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে প্রকাশ, ২০১৭ সালে ১ শতাংশ ধনকুবের নিজেদের পকেটে পুরেছে ৭৩ শতাংশ সম্পদ! একই সঙ্গে, ভারত গোটা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুধাতুর দেশের শিরোপা পেয়েছে। ২০১৭-য় বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের নিরীখে, ১১৯ দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০০তম।

সংখ্যালঘু, দলিত ও সমস্ত ধরনের বিরোধী কণ্ঠস্বরের বিরুদ্ধে হামলা

১৫)      এই কর্পোরেট স্বার্থবাহী আর্থিক অ্যাজেণ্ডার সঙ্গেই আসছে উগ্র জাতীয়তাবাদের উচ্চকিত নিনাদ। যে কোনো বিরোধী কণ্ঠস্বর থামানো হচ্ছে, প্রতিটি অস্বস্তিকর প্রশ্নের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ বিরোধী তকমা এঁটে, তাকে দাঁড় করানো হচ্ছে দেশের সীমান্তে প্রহরারত সৈনিকদের আত্মত্যাগের বিরুদ্ধে। আর এই উগ্র জাতীয়তাবাদের খোলসে তীব্র মুসলিম বিরোধী ঘৃণা ও হিংসা চালানো হচ্ছে। গো-মাংস ভক্ষণ থেকে শুরু করে গবাদি পশুর ব্যবসা, ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহকে সংঘ পরিবারের “লাভ জিহাদ” আখ্যা, যে কোনো গুজব বা মনগড়া অভিযোগের উপর দাঁড়িয়ে যে কোনো জায়গায় যে কোনো সময়ে মুসলিমদের কোতল করা হচ্ছে। আমরা দেখেছি মহঃ আকলাখকে কিভাবে তার বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বার করে মধ্যরাতে খুন করা হল। এটাও দেখলাম, ঝাড়খণ্ডে ইমতিয়াজ ও মজলুমকে হত্যা করে কিভাবে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় একটা গাছে। রাজস্থানে পেহলু খানকে তার ট্রাক থেকে বার করে কোতল করা হল প্রকাশ্য দিবালোকে। তরুণ জুনেইদকে ভিড়ে ঠাসা ট্রেনের কামরায় ছুরিকাঘাতে খুন করা হল, স্বচ্ছ ভারত অভিযানের অছিলায় মহিলাদের অবমাননা ও হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিরোধরত জাফর খানের হত্যা, মহঃ আফরাজুলকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে গোটা হত্যালীলার নৃশংস ঘটনাটিকে ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হয় ‘লাভ জিহাদে’র বিরুদ্ধে সতর্ক বার্তা দিয়ে। এমনকি, তাৎক্ষণিক তিন তালাকের স্বেচ্ছাচারী প্রথার বিরুদ্ধে যে শীর্ষ আদালতের রায়টি এলো মুসলিম মহিলা সংগঠনগুলোর দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক আইনি লড়াইয়ের ফলশ্রুতির দরুণ, সেটাকেও এখন মুসলিম পুরুষদের হয়রানি ও শাস্তি দেওয়ার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

১৬)      মুসলিমদের সম্প্রদায়গতভাবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করার পাশাপাশি দলিতদের বিরুদ্ধেও সংঘবাহিনীর হামলা সমানভাবে ঘটছে। ক্ষমতার নানা স্তর ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংঘ বাহিনীর উত্থান দলিতদের ওপর অত্যাচারের তীব্রতা ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। বিহারে ভূস্বামীদের ব্যক্তিগত সেনাগুলোর সঙ্গে বিশেষ করে রণবীর সেনার সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সংযোগ সর্বজনবিদিত, সেই রণবীর সেনা যারা ১৯৯০ ও ২০০০ সালে একের পর এক গণহত্যা সংগঠিত করে। আজ আমরা দেখছি প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকা থেকে শুরু করে মেট্রোপলিটন শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে দলিতদের বিরুদ্ধে নানান ক্ষেত্রে হিংসাত্মক অভিযান চালানো হচ্ছে। হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ মেধাবী দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা থেকে শুরু করে গুজরাটের উনা-য় দলিত যুবকদের নির্মমভাবে চাবকানোর ভিডিও সম্প্রচার, সাহারানপুরে দলিতদের ওপর হামলা, ভীম সেনার নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ “রাবণ”-এর বিরুদ্ধে কুখ্যাত এনএসএ-র অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার, উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের হামলাবাজ উচ্চবর্ণের হিন্দু যুব বাহিনী সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ড, আর এখন বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্রে দলিতদের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণ থেকে সমগ্র ছবিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাত—এই হল আরএসএস মতাদর্শের একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এদিকে, সংঘ পরিবার মরিয়া হয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সে মুসলিম বা খ্রীষ্টান, যাই হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে দলিতদের পদাতিক বাহিনী হিসাবে নিয়োজিত করে সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো সংগঠিত করছে।

১৭)      সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাতকে কেন্দ্র করে ক্রমে বেড়ে চলা হামলা অনেক বেশি রেজিমেন্টেড হয়েছে। এর ফলে মহিলাদের ওপর নীতি পুলিশের নজরদারি ও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে যা আজ শুধুমাত্র সাবেক খাপ পঞ্চায়েতগুলোর মধ্যে সীমায়িত থাকছে না, বরং সদ্য গজিয়ে ওঠা নজরদারি বাহিনী স্বঘোষিত অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সরকার ও প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন বা খোলাখুলি মদতে। মোদী তার সরকারকে মহিলা দরদী হিসাবে প্রতিপন্ন করার জন্য ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’-র শঠতাপুর্ণ শ্লোগান বা তিন তালাক বিল হাজির করেছে। কিন্তু বিএইচইউ-র মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তর থেকে অথবা শীর্ষ আদালতের কক্ষের ভেতর থেকে যখন ন্যায় বিচারের দাবি আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়, তখন স্পষ্ট বোঝা যায় যে মহিলাদের ওপর পিতৃতান্ত্রিক আক্রমণগুলো তীব্রতর ও সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, নারী বিদ্বেষী ভাবধারা নিহিত রয়েছে মনুস্মৃতির নীতি ও পরম্পরাগত ধ্যানধারণার মধ্যে—জাতপাতভিত্তিক নিপীড়ন ও পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যের এই নির্দেশাত্মক নীতিশাস্ত্র মনুস্মৃতিকে আরএসএস ভারতের পরম ও প্রকৃত সংবিধান বলেই মনে করে।

১৮)      মুসলিম, দলিত (এবং আদিবাসীদের কিছু অংশকে মাওবাদী বা খ্রীষ্টান হিসাবে অভিযুক্ত করে) ও মহিলাদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা ও হিংসা সংগঠিত করে তা সংঘ পরিবার কমিউনিস্ট এবং বাম উদারপন্থী বুদ্ধিজীবী ও কর্মীদের সমগ্র অংশের বিরুদ্ধেও করে থাকে। এটাই তাদের মতাদর্শ। নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গি এবং গৌরি লঙ্কেশ-এর মতো যুক্তিবাদী এবং সামাজিক ন্যায়ের সপক্ষে প্রচারকদের একের পর এক হত্যা সংগঠিত করে উদযাপন করা, ছাত্র নেতা বা যুবনেতাদের জাতীয় নিরাপত্তা আইন বা দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। সত্য উদঘাটন করায় বা দায়বদ্ধতা সম্পর্কিত অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং সোশ্যাল মিডিয়া, মূলধারার বৈদ্যুতিন ও সংবাদমাধ্যমে যে কোনো বিরোধী কণ্ঠস্বরকে গালিগালাজ ও শাসানোর জন্য তৈরি করা হচ্ছে গোটা একটা বাহিনীকে। অফিসে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কমিউনিস্ট কর্মীবাহিনী, তাদের আইকন বা প্রতীক চিহ্নগুলোর উপর হামলা—পরিকল্পিত ঘৃণাভরা মিথ্যার বেসাতি ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মিশেলে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে নির্মমভাবে স্তব্ধ করতে এবং রাষ্ট্রীয় মদতের মেলবন্ধনে বিভিন্ন বাহিনী বা গোষ্ঠীর তরফ থেকে সংগঠিত হামলা মোদীর ভারতবর্ষে প্রতিটা কোনায় কোনায় দেদার সংঘটিত হচ্ছে।

১৯)       কাশ্মীরের মতো এক রাজ্যে, যেখানে মানুষেরা তীব্রতম রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের সম্মুখীন হয়েও আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘস্থায়ী লড়াই চালাচ্ছেন, সেখানে বিজেপি, শ্রীনগরে রাজ্য ক্ষমতার শরিক হয়েও সাংবিধানিক শাসনপ্রণালীর লেশমাত্র আবরণকে পরিত্যাগ করে কার্যত সাধারণ কাশ্মীরীদের সঙ্গে যুদ্ধবন্দীর মতো আচরণ করছে। বিগত দু-বছর ধরে কাশ্মীরী জনতার ওপর ভারতীয় রাষ্ট্রের বিরামহীন দমন পীড়নের বিরুদ্ধে কাশ্মীরী জনগণের প্রতিরোধও তীব্রতর হচ্ছে। ব্যাপক সংখ্যক সাধারণ মানুষ, এমনকি মহিলা ও স্কুল পড়ুয়ারাও সেনা ও পুলিশের বিরুদ্ধে উপত্যকায় নিত্যদিন সংঘর্ষে অংশ নিচ্ছে। কেন্দ্রে ও জম্মু কাশ্মীরে বিজেপি সরকার সামান্য ছুতোয় প্রকৃত সমস্যাকে সমাধান না করে কাশ্মীরকে ব্যবহার করছে তার ইসলামোফোবিয়া ও উগ্র জাতীয়তাবাদী অ্যাজেণ্ডাকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে।

সন্দেহাতীতভাবে ফ্যাসিবাদের উত্থান মোদী জমানার মূল বৈশিষ্ট্য

২০)      সীমাহীন কর্পোরেট লুঠ, বেলাগাম সাম্প্রদায়িক হামলা ও জাতপাতের নিপীড়ন, পরিকল্পিতভাবে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করা, কমিউনিস্টদের ওপর হামলা—এগুলোই হল মোদী জমানার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মূলস্রোতের মিডিয়া, যাদের মধ্যে একটা অংশ সংঘ বিজেপি প্রতিষ্ঠানের বা মোদী জমানার মুখপত্র হিসাবে দিবারাত্র কাজ করছে, তারা মোদীকে এক গতিময় নেতা হিসাবে তুলে ধরছে। মোদী নাকি এমন এক মানুষ, যার সঙ্গে বিকাশ আজ সমার্থক হয়ে গেছে। তিনি অর্থবহ প্রশাসক, ২০০২-এর গুজরাট বিভীষিকাকে তারা সযত্নে পাঠিয়ে দিয়েছে বিস্মৃতির অতলে। ২০১৪ সালে নির্বাচনী বিজয়কে দেখানো হয়েছিল বিকাশের অবতার মোদীর যুক্তিসঙ্গত উত্থান হিসাবে। কিন্তু অচ্ছে দিন, বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা ফেরত আনা ও স্বচ্ছ ভারতের বাগাড়ম্বরপূর্ণ কার্যকলাপে প্রথম দিকে ব্যস্ত থাকার পর গোটা দুনিয়া আজ মোদী শাসনের আসল চেহারা দেখতে পাচ্ছে।

২১)      যোগী আদিত্যনাথকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বেছে নেওয়া, মোদী ও অমিত শাহ-র পরবর্তী সর্বভারতীয় মুখ হিসাবে তাকে তুলে ধরা, প্রায় প্রতিটি সাম্প্রদায়িক হিংসা ও উন্মত্ত জনতার হাতে খুনের নেপথ্যে সংঘ-বিজেপির খোলাখুলি পৃষ্ঠপোষকতা সেই উদারবাদী বিভ্রমকে বেআব্রু করেছে, যে ধারণা মনে করতো যে বিজেপি শুধুমাত্র মূলধারার দক্ষিণপন্থী এক পার্টি হিসাবেই নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছে, আর তার উগ্র সাম্প্রদায়িক ধারাটা এখন গৌণ দিক মাত্র। বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও গুজরাটে খোদ মোদী নিজে বিজেপির যে সমস্ত নির্বাচনী প্রচারাভিযানকে নেতৃত্ব দিয়েছে সেখানে বারবার দেখা গেছে কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ব্ৰাণ্ড মোদীর সংখ্যাগুরুতন্ত্রের সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাজনীতি। যে সমস্ত নৃশংস অপরাধগুলো সংঘ বাহিনীর মদত ও উস্কানিতে সংঘটিত হয়, মোদী ও বিজেপি এবং আরএসএস-র বরিষ্ঠ সহকর্মীরা সে ব্যাপারে নীরবতা বজায় রেখে চলেন, আর অন্যেরা প্রকাশ্যে তার সপক্ষে যুক্তি খাড়া করে, এমনকী আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে যেমনটা দেখা গিয়েছিল সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ হত্যার পর। আর সম্প্রতি দেখা গেল রাজস্থানের রাজসমন্দে মহঃ আফরাজুলকে কোতল করার ভিডিওগ্রাফিতে, বাবরি মসজিদের ধ্বংসের ২৫তম বার্ষিকীর দিনই লক্ষ্যণীয়ভাবে যা ঘটল।

২২)      আরএসএস-র মূল মতাদর্শ ও ইতিহাসের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আমরা যদি বর্তমান জমানার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিবেচনা করি, তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভারতবর্ষে আমরা ফ্যাসিবাদী উত্থানকে প্রত্যক্ষ করছি। বেশ কিছু দিক থেকে মোদী রাজকে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সঙ্গে তুলনা টানা হয়। এই দুটি পর্বকালে নিশ্চয়ই কিছু প্রশ্নে রয়েছে দারুন মিল যেমন ব্যক্তিপূজা, সংগঠিত প্রচারযন্ত্র, পরিকল্পিতভাবে স্বাধীনতাকে খর্ব করা, গণতন্ত্রের নানান প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপর্যস্ত করা। বস্তুত জরুরি অবস্থার সময় দেখা গেছিল অনেকগুলো মৌলিক অধিকারের হরণ, সংবাদ মাধ্যমের সেন্সরশিপ, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার, নির্বাচনগুলোকে অনিশ্চিতকাল পর্যন্ত মুলতুবি করে দেওয়া, আইনসভার মেয়াদগুলো বাড়ানো, বর্তমান জমানায় যে বৈশিষ্ট্যগুলো এখনও পুরোপুরি ফুটে ওঠেনি। কিন্তু রাষ্ট্র ও শাসনপ্রণালীর সাদৃশ্যগুলোকে অতিক্রম করে যদি আমরা দৃষ্টিকে প্রসারিত করি তবে আমাদের চোখে পড়বে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার সঙ্গে বর্তমান মোদী রাজের গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যগুলো। জরুরী অবস্থা মূলগতভাবে নিপীড়িত রাষ্ট্রকে ঘিরেই আবর্তিত হত, কিন্তু মোদী রাজে রাষ্ট্রের নেতৃত্বে কর্পোরেট হামলার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়েছে হিন্দু কর্তৃত্ববাদী আরএসএস-এর সংখ্যাগুরুবাদী নিমর্মতা। উন্মত্ত গণহিংসার সহযোগে সংঘ বাহিনীর হাতে তার ফ্যাসিস্ট অ্যাজেণ্ডাকে বাধা বন্ধনহীনভাবে কার্যকারী করার ঢালাও ছাড়পত্র দেওয়ার মাধ্যমেই মোদী মডেলের স্বৈর শাসনের সঙ্গে জরুরি অবস্থার কর্তৃত্ববাদী জমানার পার্থক্য রয়েছে।

রাষ্ট্রযন্ত্রের সাম্প্রদায়ীকরণ, শিক্ষা ও চিন্তন প্রক্রিয়াকে নির্দিষ্ট ছাঁচে ঢালা

২৩)      বিজেপি সরকারের শাসন প্রণালীর মধ্যেও রয়েছে ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য। বিজেপির নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রকাশ্যেই সংবিধান সংশোধনের কথাবার্তা বলেন। ফ্যাসিবাদের সঙ্গে কর্তৃত্ববাদের এটাই ফারাক যে সে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কার্যকলাপে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকে বৈধতা দেয়, আর, সমাজের আরেকটা অংশকে সেই কাজে সামিল করায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ও আরএসএস-এর মধ্যে ন্যক্কারজনক তুলনা টেনে মোহন ভাগবত বুঝিয়ে দিলেন, হিন্দু সমাজকে সামরিকীকরণ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাম্প্রদায়িকীকরণ/রাজনীতিকরণে তাদের বহু পুরাতন অ্যাজেণ্ডা রয়েছে। ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভা নেতা বি এস মুঞ্জে (যিনি ইতালির ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনীর সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলেন) নাগপুরে ভোঁসলা মিলিটারী অ্যাকাডেমি গঠন করেন, যার মাধ্যমে ওই অ্যাজেণ্ডার উভয় দিকই পূরণ করা যায়। ভাগবত নিজেই ২০১২ সালে বলেছিলেন, ভোঁসলা অ্যাকাডেমি সেনা অফিসারদের বকেয়া কাজগুলো সম্পন্ন করার জোগানদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। মালেগাঁও বিস্ফোরণে অভিযুক্ত কর্মরত এক সেনা অফিসার তো ওই কেন্দ্র থেকেই প্রশিক্ষণ নেয়। কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার এবং অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ আই বি অফিসারেরাও ওই অ্যাকাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এমনকি বজরং দলের ক্যাডারদেরও প্রশিক্ষিত করে যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সংঘটিত করে সাম্প্রদায়িক হিংসা। হিন্দু যুবকদের সশস্ত্র করার পেছনে সংঘের প্রকল্পটি মুসলিমদের ‘পাকিস্তানি’ হিসাবে চিহ্নিত করে, যাতে, ‘অভ্যন্তরীণ শত্রুর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হিংসা’কে ‘জাতীয়তাবাদের’ মোড়কে পরিবেশন করা যায়।

২৪)      বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর আরেকটি ফ্যাসিস্ট শাসন প্রণালী হল, রাজ্যের নীতি হিসাবে সাজানো সংঘর্ষ ও যুদ্ধ অপরাধকে উদযাপন করা। ভোপালে ৮ জন মুসলিমকে সাজানো সংঘর্ষে খুন করার পর মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহানের প্রকাশ্যে উদযাপন, পরপর সাজানো সংঘর্ষের সপক্ষে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নির্লজ্জ ওকালতি, এক কাশ্মীরীকে জিপে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে সেনা মেজরের প্রকাশ্যে ঘোরানোর ঘটনাটিকে সরকারের তরফ থেকে অনুমোদন, জম্মুতে ৮ বছরের এক গুজ্জর মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করার অপরাধে অভিযুক্ত স্পেশ্যাল পুলিশ অপারেশনের ব্যক্তিরা গ্রেপ্তার হলেও তাদের সমর্থনে মিছিল সংগঠিত করা কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। ওই অপরাধগুলো অ-বিজেপি শাসনেও ঘটতো, কিন্তু সেক্ষেত্রে উর্দিধারীদের সপক্ষে খোলাখুলি দাঁড়ানোর বদলে বরং তা অস্বীকার করাটাই ছিল সরকারি ভাষ্য।

২৫)      শিক্ষার গৈরিকীকরণ ও ধ্বংসসাধন সংঘ ফ্যাসিস্ট প্রকল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা বিজেপি পরিচালিত সরকারগুলো বাস্তবায়িত করছে। বিজেপি পরিচালিত রাজ্যগুলো স্কুল সিলেবাসের গৈরিকীকরণ করছে, বিকৃত ইতিহাস লিখছে, কচিকাঁচাদের মনকে বিষিয়ে দিতে স্কুলের ছাত্রদের সংঘ পরিচালিত ক্যাম্পে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোও আক্রমণের মুখে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মাথায় বিজেপি তার বশংবদদের নিযুক্ত করায় সেখানে বাক স্বাধীনতা, ক্যাম্পাস গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায় ও গবেষণা পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে, আর সমস্ত বিরুদ্ধ মতো ও প্রগতিশীল কণ্ঠস্বরকে কন্ঠরুদ্ধ করতে এবিভিপি সংঘের ঝটিকা বাহিনীর ভূমিকা পালন করছে।

ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ এবং আরএসএস-র উত্থান

২৬)      অনেক দিক থেকে মোদী জমানার সঙ্গে হিটলারের নাৎসি জার্মানির দারুণ মিল রয়েছে। এটা লক্ষ্যণীয় যে ১৯২০ সালে তার সুচনা লগ্ন থেকেই আরএসএস ঐতিহাসিকভাবে তার মডেলটিকে সমরবাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী, পুরুষোচিত তেজস্বী মডেলের আদলে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়, যেটা মুসোলিনী ও হিটলার গৌরবান্বিত করেছিল। অভ্যন্তরীণ শত্রু (নাৎসি জার্মানিতে ইহুদি ও অন্যান্য সংখ্যালঘ ও কমিউনিস্ট, মোদীর ভারতে মুসলিম, দলিত এবং সমস্ত ধরনের মতাদর্শগত প্রতিপক্ষ)-র বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসাই এখানে কেন্দ্রস্থলে থাকে, এক সর্বোত্তম নেতার চারপাশে ব্যক্তিপুজোর মাহাত্ম্য তৈরি করতে গণউন্মাদনাকে চুড়ান্তভাবে কাজে লাগানো, মিথ্যা ও গুজবের লাগাতার প্রচার — নাৎসি জার্মানি আর আজ বিজেপি শাসিত ভারতে বাস্তবে বিরাট মিল রয়েছে।

২৭)      ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে জার্মান পুঁজির বিকাশের স্তরে ভারতীয় পু জি এখনও পৌঁছায়নি, সংঘ বাহিনী এখনও সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামোকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পারল না, বা ভারতের মতো বিশাল ও বহুত্ববাদী দেশ ও সমাজে ফ্যাসিবাদের একমাত্রিক বুলডোজারের বিরুদ্ধে আভ্যন্তরীণভাবে অনেকগুলো রক্ষাকবচ রয়েছে — এই সব তথ্য হাজির করে যদি ভ্রান্ত স্বস্তিবোধ খোঁজার চেষ্টা হয় তবে ইতিহাসের শিক্ষাকে অবজ্ঞা করা হবে। তা অদুরদর্শীতা ও আত্মঘাতী হয়ে উঠবে। ভারতের বুকে একবিংশ শতাব্দীর ফ্যাসিবাদ অনিবার্যভাবে বিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের তুলনায় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে সামনে আসবে। কিন্তু তা ফ্যাসিবাদী বিপদের মাত্রাটাকে খাটো এবং তার সর্বনাশা দিকগুলোকে কম ধ্বংসাত্মক করে তোলে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডল পুনরায় ফ্যাসিবাদী প্রবণতার উর্বর জমি তৈরি করে রেখেছে—বিশ্বজুড়ে বহু দেশে বর্তমানে আমরা সেসব দেখতে পাচ্ছি। নাছোড়বান্দা আর্থিক মন্দা, লাগাতারভাবে বেড়ে চলা কর্মহীনতা ও আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, ইসলামোফোবিয়া এবং অভিবাসী বিরোধী উন্মাদনা—এই সমস্ত কিছুই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অনেক ইউরোপীয় দেশে ফ্যাসিবাদ ও বর্ণবাদী রাজনীতির উত্থানের উর্বর জমি তৈরি করে দিয়েছে। সঙ্কট জর্জর বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান একীভবন, বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ইজরায়েলের সঙ্গে ক্রমাগত বেড়ে চলা নিবিড় রণনৈতিক সম্পর্ক ভারতের মাটিতে সাম্প্রদায়িক প্রবণতাকেই মজবুত করছে।

২৮)      ভারতের বুকে ফ্যাসিবাদী উত্থান ও বিকাশের প্রধান শর্ত হল সাম্প্রদায়িকতাবাদ। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বুঝতে হবে যে ঠিক যেভাবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান কালক্রমে দেশ ভাগ করেছে অকল্পনীয় রক্তপাত ও দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে, আর তা ঘটেছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের মদতে। আর আজ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী কাঠামোকে ভেঙ্গে হিন্দু শ্রেষ্ঠত্বের সংখ্যাগুরুবাদী একমাত্রিকতায় রূপান্তরিত করাটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সভ্যতার সংঘাত তত্ত্বের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খেয়ে যায়। যেখানে ইসলামপন্থী আরব দুনিয়া আর কনফুশিয়াসপন্থী চীন-র বিরুদ্ধে যুদ্ধে হিন্দু ভারতবর্ষ মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী দেশগুলোর এক গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী শক্তি!

২৯)      জাতপাত হল স্তরান্বিত সামাজিক অসাম্যের বৈশিষ্ট্য। সমাজের মূলস্রোতের বাইরে রেখে নিপীড়নের এক হাতিয়ার। আর তা রয়েছে ভারতে ফ্যাসিবাদী প্রকল্পের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহিলাদের এই জাতপাতভিত্তিক ব্যবস্থার সমস্ত দমনমূলক বোঝা বহন করতে হয়। ডঃ আম্বেদকর এই সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলেন বলেই তিনি বর্ণনা করেন যে ভারতের অগণতান্ত্রিক জমিতে সাংবিধানিক গণতন্ত্র বহিরঙ্গের এক ভড়ং মাত্র। ভারতীয় সমাজে যে সমস্ত অন্যায় ও হিংসা অন্তর্নিহিত, ভারতীয় ফ্যাসিবাদ সেখান থেকে সংগ্রহ করে তার প্রাণশক্তি, তাকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ও সম্প্রসারিত করে, আর ভারতীয় ইতিহাস ও প্রথায় যা কিছু অগণতান্ত্রিক, আজকে আর এস এস তারই প্রতিনিধিত্ব করে।

৩০)      গড়ে ওঠার প্রথম অর্ধ শতকে আরএসএস-র ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের অনুগামী কমই ছিল। তারা স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখে বহু যোজন দূরে, নানা ক্ষেত্রে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সঙ্গে সহযোগিতার সাধারণ নীতির ওকালতি করে যাতে বিশেষভাবে দুর্বল হয় আধুনিক ভারতে অন্যতম প্রধান সম্প্রদায় হিসাবে মুসলমানদের স্থান। গান্ধী হত্যার পর আরএসএস-র ওপর আইনি নিষেধাজ্ঞা যেমন জারী হল তেমনি সাধারণ মানুষের চোখে তারা হল চরম নিন্দিত। সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কংগ্রেসের দোদুল্যমানতা, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে জনগণের আকাঙ্খা ও তাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগ নিয়ে আরএসএস পুনর্গঠিত হতে লাগল, শক্তি সঞ্চয় করে নিজেদের বৈধতা প্রতিষ্ঠিত করল। এটা লক্ষ্যণীয় যে, ১৯৬০-র প্রথম দিকে আর এস এস-কে পুনর্বাসন দেওয়া হল প্রথমে ১৯৬২ সালে চীনের সাথে এবং তারপর ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে দশক ধরে যুদ্ধের পরিণতিতে উগ্র জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার পরিমণ্ডলে। জরুরি অবস্থার সময়ে নিজের সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক ও প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াবার সুযোগ আরএসএস পেল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জনপ্রিয় সংগ্রামের মাধ্যমে। আর্থিক উদারীকরণের নীতিগুলোকে অনুসরণ করা, মার্কিনপন্থী বৈদেশিক নীতির দিকে ঝুঁকে পড়া, আর স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য থেকে নির্ণায়কভাবে কংগ্রেসের সরে আসার দরুণ বিজেপি আর কংগ্রেসের মধ্যকার তফাৎগুলো ক্রমেই ঝাপসা হতে শুরু করল। এদিকে, এখানে সেখানে ছোটখাটো প্রয়োজনবাদী সমঝােতা করে বিভিন্ন অঞ্চল ও সামাজিক শক্তির মধ্যে নতুন শরিক খুঁজে পেতে বিজেপির অসুবিধে হল না।

৩১)      উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ ও বিশ্বায়নের আগ্রাসী নীতিসমূহকে অনুসরণ করতে গিয়ে সংকট তৈরি হয়। কংগ্রেস সহ অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা বিরাটভাবে ধাক্কা খাওয়ায় সৃষ্টি হয় এক রাজনৈতিক শূন্যতা। এই শূন্যতাকে ভরাট করতে বিজেপি মারমুখী অবস্থান নিয়েছে, আর এই সন্ধিক্ষণে আরএসএস ভারতের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কল্পনাকে নিজেদের মতো করে নির্মাণ করতে চাইছে। ভারতের স্বাধীনতার সময়ে আর এস এস চেষ্টা করেও মনুস্মৃতিকে ভারতীয় সংবিধানের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করাতে পারেনি। জাতপাত, পিতৃতান্ত্রিকতা, সাম্প্রদায়িকতার ক্ষতিকারক ভাবনাগুলো ভারতে ব্যাপকভাবেই প্রচলিত সাধারণ ধারণা বা কমন সেন্স হয়ে থাকা সত্ত্বেও তদানীন্তন প্রাধান্যকারী রাজনৈতিক ঐক্যমত্য ওই সমস্ত ক্ষতিকারক ধারণাগুলোকে না আঁকড়ে, নিদেনপক্ষে, সামান্য মাত্রায় হলেও রাজনৈতিক ও সামাজিক সমতার লক্ষ্য গ্রহণ করেছিল। নেহরু ও প্যাটেল-র মতো নেতারা ভারত সম্পর্কে গোলওয়ালকারের ধারণাকে অনুমোদন করেনি। এখন, মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর আর এস এস তড়িঘড়ি করে তার এতদিনকার সযত্নলালিত জাতীয়তাবাদ, ইতিহাস সম্পর্কিত প্রত্যাখ্যাত ধারণাকে একমাত্র ভারতীয় ধারণা বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। এই প্রক্রিয়ায় তারা নেহরুর গায়ে কাদা ছিটিয়ে, গান্ধীকে সাফ-সুতরো করে আম্বেদকর-ভগৎ সিং-কে বিকৃত করে, সমস্ত মুসলিম ব্যক্তিত্ব ও ইতিহাসের স্মারক, আকবর ও তাজমহলকে ‘জাতীয়তাবাদ বিরোধী’ তকমা দিয়ে কলঙ্কিত করে, জাতপাত ও লিঙ্গগত শ্রেণীক্রম, গোঁড়ামী ও ঘৃণ্য সমস্ত সামাজিক প্রথা ও সাম্প্রদায়িক ক্ষতিকর ভাবনাগুলোকে ‘ভারতীয় সংস্কৃতির মর্মবস্তু’ বলেই ঊর্দ্ধে তুলে ধরছে।

৩২)      ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ইতিহাসকে আত্মসাৎ ও বিকৃত করে লেখার প্রক্রিয়াটিকে প্রতিরোধ করা। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনতার উপনিবেশ বিরোধী জাগরণ ও স্বাধীনতার সংগ্রামের সঙ্গে আরএসএস-র শুধু বিচ্ছিন্নতাই ছিল তাই নয়, তারা এর বিরোধিতাও করেছিল। আরএসএস নিজের মনগড়া এক সভ্যতা নির্মাণ করেছে যাকে সে সভ্যতা বা সাংস্কৃতিক সভ্যতা বলে চালান করছে। তারা লাগাতারভাবে পৌরাণিক কাহিনীগুলো সামনে এনে তাকে ইতিহাস বলে চালান করে, তাদের সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদীর ঝুঠা আলেখ্যর স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রকৃত ইতিহাসকে মিথ্যার আবরণে চালিয়ে তা আত্মসাৎ করার চেষ্টা চালায়। ভারতবর্ষকে ব্যাখ্যা করতে ও বিকাশের লক্ষ্যে তাই বর্তমানে চলমান আন্দোলনে ইতিহাস এক গুরুত্বপুর্ণ ক্ষেত্র হিসাবে সামনে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইতিহাসকে বিকৃত, মিথ্যাচারের ভিত্তির ওপরে ও তাকে লক্ষ্যচ্যুত করার যে অপচেষ্টা আর এস এস করছে, তার মোকাবিলা করে আমাদের ভারতীয় জনগণের প্রকৃত ইতিহাসকে ঊর্দ্ধে তুলে ধরতে হবে। সামনে আনতে হবে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে মানব মুক্তির মহান ঐতিহাসিক পরম্পরা। ভারতীয় ঐতিহ্য যা কিছু প্রগতিশীল ও শৃঙ্খল মোচনের বার্তা বহন করে, তাকেই ঊর্দ্ধে তুলে, লালন পালন ও আহরণ করে আমাদের দেশের মহান গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ভবিষ্যতের লক্ষ্যের সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে হবে।

আর্থিক ও বিদেশনীতির দিকগুলো

৩৩)      জাতীয়তাবাদী আরএসএস তার অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদী কর্মসুচীর মাধ্যমে বিজেপিকে লাগামছাড়া বিশ্বায়নী নীতির পথ থেকে সরিয়ে আনবে — এই আকাঙ্খা অবাস্তব প্রমাণিত হয়েছে। ঠিক যেমন আশা করা হয়েছিল যে বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে সংঘ বাহিনীর তথাকথিত প্রান্তিক লোকজনগুলোকে সংযত করবে। বাজপেয়ীর প্রথম পর্বে কিছুটা সংযত দিনকালের পর ২০০২-র গুজরাট গণহত্যার পিঠে সওয়ার হয়ে জন্ম নিল গুজরাট মডেল। নির্মম নিপীড়নমূলক এক রাষ্ট্র, যে তার অধিকারের সীমাকে ডিঙ্গিয়ে সমস্ত পরিসরে অনধিকার চর্চা করে, আপাদমস্তক কর্পোরেট স্বার্থে পরিচালিত চনমনে গুজরাট মডেলের সদর দরজা দিয়ে আমরা ২০১৪ সালে প্রবেশ করি মোদীর জমানায় গোটা দেশে গুজরাট মডেলকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে। বর্তমানে আরএসএস-বিজেপির মধ্যে এক প্রতিষ্ঠিত যুগলবন্দী আমরা দেখতে পাচ্ছি, যেখানে তথাকথিত প্রান্তসীমার লোকজনগুলোর উন্মত্ত কার্যকলাপকে পুরোপুরি রেয়াত করা হচ্ছে, আর অপরদিকে আরএসএস সামাজিক রীতিনীতি ও ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিসরকে নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক বিকাশের অছিলায় সরকার যখন বিদেশী বিনিয়োগকে নির্লজ্জভাবে তোষামোদ করে ভারতীয় ও বিদেশী কর্পোরেটদের স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে অনুগত ছোট শরিকের ভূমিকায় ট্রাম্প প্রশাসন ভারতকে সার্টিফিকেট দিয়েছে বিশ্বের অন্যতম শক্তি হিসাবে।

৩৪)      ১৯৯০-র প্রথমদিকে কংগ্রেস যে নীতিসমূহ প্রবর্তন করেছিল, মোটের ওপর মোদী সরকারের আর্থিক ও বিদেশ নীতি সেই দিকেই পরিচালিত। কিন্তু যে প্রবল গতি ও একতরফা মারমুখী মূর্তিতে বর্তমান জমানা ওই লক্ষ্যে সেগুলোকে পরিচালিত করছে তা আগের কোনো সরকার এমনকি অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকারের সময়ে ছিল না। বিদেশী বিনিয়োগ, ফিনান্সিয়াল একীভবন ও ডিজিটালকরণ, বেসরকারীকরণ, শ্রম আইন সংস্কারের জন্য নজর এতটা তীব্র ও মারাত্মক পর্যায়ে আগেকার কোন সরকারের আমলে দেখা যায়নি। সরকারের যোজনা কমিশনকে অবলুপ্ত করে, কল্যাণমূলক দায়বদ্ধতাকে এতটা নির্লজ্জ ও পরিপূর্ণভাবে আর কোনোকালেই গুটিয়ে নেওয়া হয়নি। খাদ্য সুরক্ষা এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত সংক্রান্ত আইনের পরিকল্পিত লঙ্ঘন, গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে বীমা কেন্দ্রীক বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে সরে আসা, কর্মসংস্থানের অ্যাজেণ্ডাকে মামুলি স্বরোজকারের স্তরে নামিয়ে পকোড়া বিক্রির মতো নিম্ন আয় সম্পন্ন ঝুঁকিপূর্ণ পেশাকেই লাভজনক কর্মসংস্থান হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।

৩৫)      বিদেশনীতির ক্ষেত্রে মোদী সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিজের রণনৈতিক অধীনতাকে এক নতুন স্তরে নিয়ে গেছে। আমেরিকায় ভারতীয় অভিবাসীদের ওপর নেমে আসা ক্রমবর্ধমান হামলার ঘটনায় নীরব থেকে ট্রাম্প প্রেসিডেন্সির সঙ্গে নিজেদের সমস্ত তফাত মুছে দিল। (শুধুমাত্র জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরুদ্ধে ভোটদান ছাড়া)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো প্রকাশ্যেই ট্রাম্পের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের অ্যাজেণ্ডাকে অনুমোদন করছে। ঠিক যখন ইজরায়েল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতা ও সমালোচনার মুখে পড়ছে প্যালেস্তাইনকে লাগাতারভাবে দখল রাখার জন্য, মোদী তখন বিরাট সাড়ম্বরে নেতানিয়াহুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করছে। চীন-কে ঠেকানোর নামে মোদী সরকার জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দহরম-মহরম চালাচ্ছে ও এশিয়ান দেশগুলোকে কাছে টানছে। কিন্তু ঘরের কাছে তার বড় দাদাসুলভ মনোভাবের জন্য সে তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। সমস্ত বকেয়া ইস্যুগুলোতে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে লাগাতার আলাপ আলোচনা চালানোর প্রক্রিয়ায় সমাধান খোঁজার বদলে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চগুলোতে শান্তি, ন্যায়বিচার ও বিকাশের জন্য ভারত তার কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরার বদলে, মোদী কূটনৈতিক প্রশ্নে ভারতের অবস্থান আমূল পাল্টেছে। দেশের অভ্যন্তরে প্রচার পাওয়ার লক্ষ্যে এবং রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার উদ্দেশ্য নিয়ে ওই কুটনীতি ভারতের অবস্থানকে দুর্বল করেছে, ফলে সমস্ত পড়শী দেশগুলো থেকে ভারত আজ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, আগে যা কখনও ঘটেনি।

৩৬)      নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এনে, মোদী সরকার ভারতীয় নাগরিকত্বের সংজ্ঞাকেও বদলাতে চাইছে। ওই বিলের প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্থান থেকে আগত হিন্দুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই প্রস্তাবের ফলে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আগত অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের সঙ্গে ধর্মের মাপকাঠিতে বৈষম্য করা হচ্ছে আর সুবিধা পাচ্ছে অমুসলিম শরণার্থী যারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করছেন। আসলে, প্রচ্ছন্নভাবে ভারত নিজেকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে তুলে ধরতে চায় ইজ্রায়েলের ইহুদী বাসভূমি’র আদলে। এই পদক্ষেপটি আসাম জুড়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে। সকলেই আশঙ্কা করছে যে বিজেপি ওই সংশোধনীকে কাজে লাগিয়ে অসম চুক্তিকেই নস্যাৎ করে দেবে, যার ভিত্তি বর্ষ ছিল ২৪ মার্চ, ১৯৭১। সুপ্রীম কোর্টের তত্ত্বাবধানে নাগরিকদের এক জাতীয় পঞ্জি তৈরি করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সে ব্যাপারেও অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জাতীয় নাগরিকত্ব পঞ্জি কার্যকরী হলে অনথিভুক্ত লক্ষ লক্ষ মানুষকে চলে যেতে হবে। আসাম সরকারের নেতাদের এমন সমস্ত মন্তব্য অকল্পনীয় এক অমানবতাবাদী সঙ্কটের জন্ম দেবে। এই সঙ্কট এড়াতে, কেন্দ্রীয় সরকারকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটা চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে যেতে হবে, নিদেন পক্ষে এমনই একটা সমঝোতা যাতে জাতীয় নাগরিক পঞ্জীতে অনথিভুক্ত মানুষেরা অন্তত কাজের অনুমতি পায়।

যে শর্তগুলো সংঘ-বিজেপি হামলাকে ত্বরান্বিত করেছে

৩৭)      কোন প্রক্রিয়ায় সংঘ-বিজেপি ক্ষমতা কুক্ষিগত করে পরিকল্পিতভাবে তার আস্তিন থেকে বার করছে নিজের সমস্ত অ্যাজেণ্ডা ? যে চারটি শর্ত বর্তমান সন্ধিক্ষণে তাদের অনুকুলে কাজ করেছে, তার প্রতি নজর দেওয়া যাক। ২০১৪ সালে বিজেপি নিছক একটা নির্বাচনই শুধু জেতেনি, সে বিরাট এক রাজনৈতিক শূন্যতাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে। তখন কংগ্রেসের মধ্যে স্পষ্টতই নেতৃত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে চলছিল ঘোর শনির দশা। আঞ্চলিক দলগুলো, ‘সামাজিক ন্যায়ের তথাকথিত শিবির’ ও বামেরা — প্রায় সমস্ত অ-বিজেপি ধারাগুলো তখন একইসঙ্গে নির্বাচনী শক্তির নিরিখে চরম দুর্বল অবস্থায় ছিল। ২০১৪ সালে মোদীর নির্ধারক জয়ের পর রাজনৈতিক ভারসাম্য বিজেপির দিকে ঢলতে থাকে, আর তারপর থেকেই সে একের পর এক বিধানসভা নির্বাচন জিতে নিজের রাশকে মজবুত করে (কেবল ব্যতিক্রম ছিল দিল্লী, বিহার ও পাঞ্জাব)। সে অ-বিজেপি রাজ্যগুলোতে নিজের পছন্দমাফিক লোকজনকে রাজ্যপাল পদে আর দেশের প্রায় সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিয়োগ করল।

৩৮)      দ্বিতীয়ত, গত তিন দশক ধরে প্রায় সমস্ত শাসক শ্রেণীর পার্টিগুলোর মধ্যে আর্থিক নীতি, অভ্যন্তরীণ শাসনপ্রণালী ও বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে চুড়ান্ত ঐকমত্য আমরা লক্ষ্য করেছি। নীতিগত প্রশ্নে তফাত না থাকায় ওই সমস্ত নীতিগুলোকে আরও আক্রমণাত্মক ও নির্ধারকভাবে রূপায়িত করতে বিজেপি শুরু করল।

৩৯)      তৃতীয়ত, রাজনৈতিক এই ঐকমত্যের আড়ালে আমরা সাধারণ এক ধারণা বা কমন সেন্স নির্মিত হতে দেখেছি, কর্পোরেট পরিচালিত মূলধারার মিডিয়াগুলো যা প্রতিদিন কানের কাছে অনবরত বাজিয়ে চলে—গণউচ্ছেদ বিকাশের এক প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ, মানবাধিকার বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়, জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে কালা কানুন খুবই দরকারি, আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে বেসরকারিকরণ সর্বরোগহর দাওয়াই, ইত্যাদি ইত্যাদি।

৪০)      শেষে, ঐকমত্য নীতির তূণ এবং নির্মিত সাধারণ ধারণার উপর দাঁড়িয়ে বিজেপির হাতে রয়েছে আরএসএস-র নানা ছদ্মবেশী সংগঠন যারা ঘৃণা, মিথ্যাচার, গুজবের একরাশ নিজস্ব অস্ত্রে সজ্জিত। আর রয়েছে সন্ত্রাস তৈরি করার অসরকারি নেটওয়ার্ক।

ফ্যাসিবাদী হামলার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ

৪১)      বিপ্লবী কমিউনিস্ট হিসাবে, সমস্ত ধরনের অবিচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী, সামাজিক রূপান্তর ও মানব মুক্তির দৃঢ়তম অবিচল সেনানী হিসাবে, আমাদের স্বীকার করতে হবে যে ১৯৪৭-র পরবর্তীতে আমরা এখন সবচেয়ে মারাত্মক ফ্যাসিবাদী আক্রমণের সম্মুখীন, ১৯৪৭-র পর যা আমাদের জাতীয় জীবনে নেমে আসা বৃহত্তম জাতীয় রাজনৈতিক বিপর্যয়। তাই বর্তমান পর্যায়ে ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করাটা আমাদের সামনে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ আর এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে আমাদের সম্ভাব্য সবকিছুই করতে হবে।

৪২)      সর্বদাই তীব্র আর্থিক সংকট ও নিরাপত্তাহীনতার পর্বে ফ্যাসিবাদ পল্লবিত হয়। ইউরোপে বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে ফ্যাসিবাদের ধ্রুপদী উত্থানের পর্বে যেমন ওটাই ছিল সত্যি, আজও ইউরোপ ও আমেরিকায় যেখানে ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে সেখানেও এটা সমান সত্য। আর সেটা উৎসারিত হচ্ছে বেলাগাম বেকারত্ব ও ব্যয় সংকোচ থেকে উদ্ভূত ক্রোধ ও উদ্বেগের গর্ভ থেকে, ইসলামোফোবিয়া, বর্ণ বৈষম্যবাদ, অভিবাসী বিদ্বেষের আগুনকে উস্কে দিয়ে। এদেশেও আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ফ্যাসিবাদী শক্তি বেকার বাহিনীর ভেতর থেকে কিভাবে নিয়োগ করছে পদাতিক বাহিনী, যারা মোদী সরকারের আর্থিক বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে গণক্ষোভ ও উদ্বেগের এই মূল কারণকে তুলে ধরতে হবে। সাধারণ শ্রেণীগত দাবির এবং জীবন জীবিকা ও আর্থিক নিরাপত্তার সাধারণ ইস্যুতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।

৪৩)      ২০১৪ সালে মোদী বিজয়ী হওয়ার পর থেকে ফ্যাসিবাদী শক্তি যতই হামলা নামিয়ে আনুক না কেন, ভারতীয় জনতা অপ্রতিহতভাবে তার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখেছি ২০১৩ সালে জমি অধিগ্রহণ আইনকে বদলানোর জন্য মোদী সরকারের চেষ্টাগুলো বা ঝাড়খণ্ডে ছোটনাগপুর ও সান্তাল পরগণা টেনান্সি অ্যাক্টকে সংশোধন করার সমস্ত উদ্যোগকে কৃষক ও আদিবাসীরা বানচাল করে দেয়। খুব সম্প্রতি, সারা ভারতের কৃষক সংগঠনগুলো ঋণ মুক্তি ও কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্যের দাবিতে সংগ্রামী ঐক্য গড়ে লড়াই শুরু করেছেন। রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা দেশব্যাপী ছাত্র জাগরণের জন্ম দিল। যথেচ্ছ প্রশাসনিক হামলা, রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত মিথ্যা মামলা ও নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ, মিডিয়ার তরফ থেকে সংগঠিত ঘৃণাভরা বিচারসভা, সংঘী গুণ্ডাদের লাগাতার হামলা সত্ত্বেও তারা দৃঢ়ভাবে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। আরএসএস অনুমোদিত এবিভিপি দেশের নানান প্রান্তে ক্যাম্পাস নির্বাচনে বারংবার বিরাটভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে। আমরা দেখেছি ২০১৬ সালে ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর শক্তিশালী আন্দোলন, ৪৮ ঘন্টা দেশব্যাপী ধর্মঘট, আর ২০১৭-র নভেম্বরে সংসদের সামনে ৩ দিনের লাগাতার ধর্ণা।

বাম ঐক্য ও সমস্ত সংগ্রামী শক্তির মধ্যে সহযোগীতা

৪৪)      গুজরাট থেকে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র থেকে বিহারে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি দলিত প্রতিরোধ এবং জমি-শিক্ষা-কাজ-মর্যাদার মতো বুনিয়াদি দাবিতে বৈপ্লবিক রাজনৈতিক সমাবেশ। দলিতদের বিরুদ্ধে আর এস এস মদতপুষ্ট ক্রমবর্ধমান হামলার মুখে তরুণ দলিত নেতাদের নেতৃত্বে নতুন প্রজন্মের দলিত আন্দোলন আত্মপ্রকাশ করেছে। সবচেয়ে স্বাগত জানানো বৈশিষ্ট্য হল, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশে দলিত আন্দোলনকে দৃঢ়ভাবে দাঁড় করানোর প্রত্যয় এবং তার পাশাপাশি, সাম্প্রদায়িক হিংসায় দলিত মানুষদের জড়িয়ে নেওয়ার অপচেষ্টাগুলোকে রুখে দেওয়ার উদ্যোগ। রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা ও উনায় অত্যাচারের পর যে দলিত আন্দোলন মাথা তুলে দাঁড়াল তা অর্থনৈতিক/দেনা পাওনার অধিকার ও মর্যাদার লড়াইয়ের মাঝখানে ‘চীনা প্রাচীর’ ভাঙ্গতে শুরু করল। সংঘ পরিবারের ‘গো-মাতা’ প্রতীকের বিরুদ্ধে উনা আন্দোলন বিরাট এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে, উৎপীড়নমূলক নোংরা পেশায় দলিতদের নিয়োজিত করার বিরোধিতা করছে, আর বিপরীতে জমি ও শোভন কাজের দাবিকে সামনে তুলে ধরেছে। এই আন্দোলনগুলো আম্বেদকরপন্থী ও বামেদের পরিচালিত লড়াই, যা দলিতদের ও অন্যান্য নিপীড়িত অংশের মর্যাদা ও অধিকারের দাবিতে চলছে, ঐক্য স্থাপনের আশা জাগানো ক্ষেত্রগুলো তৈরি করে দিচ্ছে, যা জাতপাতের নির্মূলীকরণ ও সামাজিক রূপান্তরের কেন্দ্রীয় মর্মবস্তুর চারপাশে আবর্তিত হচ্ছে। এই সমস্ত বুনিয়াদী সংগ্রামগুলোকে মজবুত করার, বৈচিত্র্যমুখী প্রতিরোধের এই সমস্ত নানান ধারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে ঐক্যস্থাপন, সহযোগিতা ও সংহতি জানানোটাই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনপ্রিয় প্রতিরোধের এক প্রাণবন্ত ফ্রন্ট গড়ে তোলার জমি তৈরি করবে।

৪৫)      আজ পর্যন্ত ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোর তরফ থেকে ফ্যাসিবাদকে সামান্যতম প্রতিরোধ করা হয়নি। আমলাতন্ত্র তো একেবারেই করেনি। আসলে আমাদের দেশে আমলাতন্ত্র বরাবরই প্রকটভাবে সামন্ততান্ত্রিক উপনিবেশিক ভাবধারা নিয়ে চলায় তা জনবিরোধী দিশায় পরিচালিত। প্রভাবশালী মিডিয়াগুলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ নিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরা, দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বদলে চলমান নয়া আর্থিক নীতি এমনকি ফ্যাসিস্ট সাম্প্রদায়িক হামলার ম্যানেজার, সংগঠক ও প্রচারকের ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করেছে। যদিও হালে, আমরা বিচারব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র ও মূলধারার মিডিয়ার ভেতর থেকে ভরসা জাগানো কিছু সাহসিক বিরোধী মত সামনে আসতে দেখেছি। আরও উৎসাহজনক বিষয় হল, আমরা দেখতে পাচ্ছি কর্মতৎপরতার নতুন এক জোয়ার, যেখানে নিবেদিত প্রাণ একঝাঁক তরুণ উঠে দাঁড়িয়েছে, বিরোধ ও প্রতিরোধের নতুন নতুন রূপ ও পরিসর নিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে। ফ্যাসিস্টদের চক্রান্তকে ব্যর্থ করতে, আমাদের দেশে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক পরিসরকে সম্প্রসারিত করতে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের অবশ্যই ওই সমস্ত কার্যকলাপের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ ও সহযোগিতার রাস্তা তৈরি করতে হবে।

৪৬)      ফ্যাসিস্ট শক্তিকে প্রতিরোধ ও পরাস্ত করতে জনগণের হাতে দুটো কার্যকর হাতিয়ার রয়েছে—সংবিধান ও ভোটাধিকার। এই দুটো হাতিয়ারকে বিপর্যস্ত করতে
এক মরিয়া চেষ্টা চলছে। বাজপেয়ী জমানার সময়ে বিজেপি সংবিধানের পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করে, আর আজ আমরা প্রায়শই বিজেপি মন্ত্রীদের তরফ থেকে সংবিধান বদলানোর কথাবার্তা শুনতে পাই। সরকার তো বেশ কয়েকটি আইনী পদক্ষেপ আনার চিন্তাভাবনা করছে যা সংবিধানকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত ও পুনর্গঠিত করবে। নাগরিকত্ব আইনে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ভারতের নাগরিকত্ব নির্ধারণে ধর্মের বৈষম্যমূলক মানদণ্ড হাজির করা হচ্ছে। তার ভিত্তিতেই প্রশাসন শরণার্থীদের বিচার-বিবেচনা করবে। আইনকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলার অজুহাতে সমস্ত ফ্রন্টে গণতান্ত্রিক অধিকারকে, বিশেষ করে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, যৌথ দরকষাকষি, কর্মক্ষেত্রে গণতন্ত্রকে বিরাট মাত্রায় সংকুচিত ও কাটছাঁট করা হচ্ছে। ভারতের ঐক্যবদ্ধতার মুলে যে বহুত্ব ও বৈচিত্র্য রয়েছে সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকেও পরিকল্পিতভাবে লঙ্ঘন করে ও দাবিয়ে আরএসএস-র হিন্দী-হিন্দু-হিন্দুস্থান আখ্যানকেই সামনে আনা হচ্ছে।

৪৭)      নির্বাচনী ময়দানেও প্রচলিত নিয়মকে লাগাতারভাবে বদলে ফেলার চেষ্টা চলছে। বড় বড় দলগুলোকে অজ্ঞাতনামা কর্পোরেটগুলো নির্বাচনী তহবিল জোগানোর নিয়মকে পাল্টানো থেকে শুরু করে একই সঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার তোড়জোড় চলছে। বিপুলভাবে বিকেন্দ্রীভূত আঞ্চলিক বা সামাজিক অগ্রাধিকারগুলোকে সেই সময়ের প্রাধান্যকারী কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক আখ্যানের অধীনে এনে, বৈচিত্র্যময় বহুদলীয় গণতন্ত্রকে ক্রমাগত দ্বিমেরু কাঠামোতে আটকে রাখতে চায়। নির্বাচনী প্রতিযোগিতার শর্তগুলো বারবার নতুন নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে। বুথ স্তরে ভোট গণনার সময়ে ই ভি এম যন্ত্রগুলোর ত্রুটি ও অসঙ্গতি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কেই বিরাট ধরনের প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরেছে। সংবিধান ও নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করতে মোদী সরকারের এই সমস্ত অপচেষ্টাগুলোকে কিছুতেই অনুমোদন দেওয়া যায় না।

৪৮)      এবার গুজরাট নির্বাচন তার নিজের দুর্গের মধ্যেই মোদী রাজের দুর্বল দিকগুলো ফুটিয়ে তুলল। রাজ্যের মধ্যে শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ না থাকা সত্ত্বেও জনগণের নানা স্তরগুলোর একের পর এক বিক্ষোভ আন্দোলন এমন একটা পরিমণ্ডল তৈরি করল যে বিজেপির প্রায় ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার উপক্রম ঘটেছিল। বিহারের মতো একটি রাজ্যে, যেখানে বিজেপির শেকড় গভীরে প্রোথিত ছিল না এবং জনপ্রিয় আন্দোলনগুলো অনেক বেশি জোরদার, সেখানে বিজেপিকে নির্বাচনী ময়দানে জোরালো ধাক্কা দেওয়া গিয়েছিল, মোদী-অমিত শাহ যুগলবন্দীর তীব্র বিভেদমূলক সাম্প্রদায়িক প্রচার সত্ত্বেও । বাম ও অন্যান্য সংগ্রামী শক্তির মধ্যে ঐক্য ও জোরালো আত্মপ্রকাশকে মজবুত করার পাশাপাশি নির্বাচনী ময়দানে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাস্ত করার চ্যালেঞ্জ হাতে নিতে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের কার্যকরী হস্তক্ষেপের রণনীতি সুত্রায়িত করতে হবে। কমিউনিস্ট আন্দোলনে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বিন্দুমাত্র জলাঞ্জলি না দিয়ে, যেখানে প্রয়োজন, সেখানেই ফ্যাসিস্ট বিজেপি ও তার শরিকদের বিরুদ্ধে অবাম বিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলানোর সুযোগটি অবশ্যই খোলা রাখতে হবে।

ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করুন! জনগণের ভারত গড়তে কদম বাড়ান!

৪৯) ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার চ্যালেঞ্জটা শুধুমাত্র নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ হিসাবে গণ্য করে নির্বাচনী চৌহদ্দির মধ্যে আটকে রাখা চলবে না। তা করা উচিতও হবে না। বিজেপিকে দূরে রাখতে কোনো একটি তথাকথিত মহাজোটে ঢুকে পড়া বা তাকে সমর্থন করার কর্তব্য কর্মেও নামিয়ে আনা ঠিক হবে না। বিহারের অভিজ্ঞতা দেখাল যে ওরকম এক মহাজোট যেটি বিজেপিকে বিরাটভাবে পর্যুদস্ত করতে পারে, পরবর্তীতে ভেঙ্গে পড়ল, বিজেপি খিড়কি দরজা দিয়ে ফের ক্ষমতায় এল। এটাই ওই জোটের ভঙ্গুরতা ও ফাঁপাপনাকে দেখিয়ে দেয়। গুজরাটে দুর্বল কংগ্রেস বিজেপিকে প্রায় হারিয়ে দিতে বসেছিল। নানা আন্দোলনের ভেতর থেকে উঠে আসা সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে কংগ্রেস তার পাশে টানতে সক্ষম হয় বলেই তা সম্ভবপর হয়। কিন্তু এটাও আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি, যে কংগ্রেস ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক প্রশ্নে বিজেপির সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে যা শেষ বিচারে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিজেপির দ্বারাই। ভারতের হালফিল ইতিহাস এটাই বারবার দেখায় যে যখনই কংগ্রেস বিজেপির পাল থেকে হিন্দুত্ববাদী হাওয়া কাড়তে গিয়ে বিজেপির শ্লোগান ও তার তুলে ধরা আইকনদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, ততই বিজেপির হাত মজবুত হয়েছে, আর শক্তি ও বৈধতা পেয়েছে মারমুখী সংখ্যাগুরুতন্ত্র। আরেকটা উদাহরণ হল পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস। এটা মনে হতে পারে যে তৃণমূল বিজেপির বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তৈরি করছে। কিন্তু যে সন্ত্রাসের রাজ তারা কায়েম করেছে, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়েছে, গণতন্ত্রের ওপর নামিয়েছে সার্বিক হামলা, তা বাস্তবে এ রাজ্যে বিজেপির বৃদ্ধিকেই মদত দিচ্ছে। তাই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী মতাদর্শগত রাজনৈতিক অভিযান গড়ে তোলার বুনিয়াদী কাজের নজর থেকে আমরা কখনই সরে আসতে পারি না। তাই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী মতাদর্শগত-রাজনৈতিক কার্যধারা গড়ে তোলার বুনিয়াদী কর্তব্যকর্মের প্রতি মনোযোগ যেন হারিয়ে না যায়।

৫০)      জনগণের বুনিয়াদী দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি, মনে রাখতে হবে ফ্যাসিবাদী শক্তিরা তাদের বিদ্বেষমূলক প্রচার ও ঘৃণা ছড়িয়ে অপরাধ সংগঠিত করার এই দ্বৈত হাতিয়ার যেন অবাধে ব্যবহার না করতে পারে। অভিজ্ঞতা দেখায় যে, স্থানীয় স্তরের সংগঠনগুলো যদি সচেতন থাকে এবং ফ্যাসিস্ট শক্তিকে মোকাবিলা করার হিম্মত রাখে তবে সাম্প্রদায়িক হিংসাকে রোধ করা যায়। সংগ্রামী জনতার পাড়া ভিত্তিক সংগ্রামী ঐক্য ফ্যাসিবাদী চক্রান্তকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে পারে। সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী হিংসাকে ঠেকাতে সজাগতা ও আগাম প্রস্তুতি এবং যে কোনো হিংসাত্মক ঘটনা ঘটলে স্থানীয় স্তরের কর্মীবাহিনী এলাকার বর্ষীয়ান নাগরিকদের নিয়ে দ্রুত ও বুক চিতিয়ে প্রতিরোধ করলে তা যে কার্যকরী হয়ে ওঠে, বহু ক্ষেত্রেই তা প্রমাণিত হয়েছে। জনগণকে আসল তথ্য ও ঘটনাবলীর বিশ্লেষণাত্মক ব্যাখ্যা সরবরাহ করে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্টদের ঘৃণা মিশ্রিত প্রচারকে উদ‌‌্ঘাটন করে চ্যালেঞ্জ জানানোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কাজের ক্ষেত্রগুলোতে বিভিন্ন স্তরের জনগণের যে সমস্ত গণসংগঠনগুলো রয়েছে, সেগুলোকে এই কাজে ও লক্ষ্যে অবশ্যই নামাতে হবে।

৫১)      শ্রমিক, কৃষক, মহিলা, দলিত, আদিবাসী, ছাত্র-যুব, এলজিবিটি কিউ মানুষেরা, ভিন্ন ধর্ম ও জাতপাতের মধ্যে যারা বিবাহ করেন, সমলিঙ্গের যুগল, কাশ্মীরূ — এ ধরনের সমস্ত সম্প্রদায়, শ্রেণী ও গোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়ে তাদের প্রতিরোধ আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করতে হবে। জনবিরোধী আর্থিক, পরিবেশগত নীতি ও সাংবিধানিক অধিকার-মর্যাদা ও জীবনের ওপর নেমে আসা আক্রমণের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও হিংসা ছড়াতে ‘জাতীয়তাবাদী’ শ্লোগান ও প্রতীকগুলোকে অপব্যবহার করার যে কোনো অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। সাংবিধানিক-গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল মূল্যবোধগুলো যাতে মানুষ অনুধাবন করে ও তা রক্ষা করতে পারে, তার জন্য আমাদের সবসময়ে উদ্যোগ নিতে হবে এবং উন্নত, আরও কল্যাণকামী, গণতান্ত্রিক ভারতের জন্য সংগ্রামকে তীব্র করতে হবে।

৫২)      বিশৃঙ্খল ও সংকট জর্জর এই সময়ে তৈরি হওয়া শূন্যতায় ফ্যাসিস্ট শক্তি ত্রাণকর্তা রূপে হাজির হয়েছে। উন্নততর আগামীর লক্ষ্যে উজ্জ্বল স্বপ্ন তুলে ধরে এই শূন্যতা পূরণ করতে হবে। যে স্বপ্ন সমৃদ্ধশালী, বহুত্ববাদী, সর্বজনীন সমানাধিকারের নীতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে এবং সমস্ত ভারতবাসীর জন্য উন্নত জীবন ও বৃহত্তর অধিকারের গ্যারান্টিকে সুনিশ্চিত করবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে এবং তারপর স্বাধীন ভারতবর্ষে দেশ গঠনের সুচনা পর্বের বছরগুলোতে যে উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গেছিল, তা আজ নিঃশেষিত হয়েছে। আমাদের কাছে প্রয়োজন দ্বিতীয় এক স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করার যা জনগণের পূর্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে গ্যারান্টি করার লক্ষ্যে আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে মজবুত করবে। ক্রমে বেড়ে চলা সামাজিক-আর্থিক বৈষম্য ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’-এর রাজনৈতিক সমতাকে বিরাট এক তামাশায় পর্যবসিত করেছে। তাই অসাম্যের কাঠামোগুলোকে অতিক্রম করতে সামাজিক রূপান্তরণ জরুরি। ভারতের অগণতান্ত্রিক ভূমির ওপরে আরোপিত গণতন্ত্রের ভড়ংকে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার লাগাতারভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। অগণতান্ত্রিক জমির সুযোগ নিয়ে ফ্যাসিবাদ আমাদের সাংবিধানিক গণতন্ত্রকে পুরোপুরি তার অধীনস্থ করে দেবে, এই বিপদ আজ আমাদের সামনে। জনতার হাতে প্রকৃত ক্ষমতা অর্পণ করার জন্য আমাদের সেই জমিটার গণতান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। ফ্যাসিবাদকে পল্লবিত হতে, জনতাকে ধ্বংস করতে আমরা কিছুতেই দেব না। ঐক্যবদ্ধ জনতা ফ্যাসিবাদী হামলাকে পরাস্ত করে নিজেদের স্বার্থে এক শক্তিশালী ও গভীর সঞ্চারী গণতন্ত্র অর্জন করবে।