আজকের দেশব্রতী : ৬ মে ২০২১ (অনলাইন সংখ্যা)
DB Issue 6 May 2021

historic mass verdict against BJP's aggression

সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের বার্তা

পশ্চিমবাংলায় নির্বাচনে বিজেপির রায় খুব স্পস্ট। এই নির্বাচনে বিজেপি বাংলায় ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল কিন্তু বাংলার মানুষ বিজেপিকে আটকে দিয়েছে। এই রায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের পক্ষে। এই নির্বাচনের রায় বিভাজন ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে, জনগণের ঐক্য ও শান্তি সম্প্রীতির পক্ষে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখলাম যে নির্বাচনের পরে লাগাতার একের পর এক খবর আসতে শুরু করে যে বিভিন্ন জায়গায় মানুষের ওপর হিংসা ও আক্রমণ হচ্ছে, দশ জন মানুষের প্রাণ চলে গেছে। এই যে নির্বাচন পরবর্তী এধরনের হিংসা প্রতিহিংসার ঘটনা তা নির্বাচনে মানুষের যে রায়, সেই রায়ের যে স্পিরিট তার সম্পূর্ণ পরিপন্থী, সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। কোনো মানুষকেই — সে তিনি বিজেপিকে ভোট দিয়ে থাকুন, সিপিএমকে ভোট দিয়ে থাকুন, কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে থাকুন বা তৃণমূলকে ভোট দিয়ে থাকুন — কোনও ভোটারকে তার নিজের পছন্দ অনুযায়ী ভোট দেওয়ার ফলে যদি তার ওপর এটাক হয়, তাদের হত্যা করা হয়, তাদের ওপর দাঙ্গা করা হয়, তাহলে তার থেকে বেশি খারাপ আর কিছু গণতন্ত্রে হতে পারে না। এই যে ব্যাপারটা চলছে পশ্চিম বাংলায়, আমরা মনে করি যে —আজকে মমতা ব্যানার্জী শপথ নিলেন — অবশ্যই এই সরকারকে অত্যন্ত কঠোরভাবে এই হিংসা আটকাতে হবে। এই ধরনের কোনও একটা ঘটনাও যেন আর না ঘটে এবং যে ঘটনাগুলো এখন পর্যন্ত ঘটে গেছে সেই সমস্ত ঘটনায় যারা দোষী তারা যেন শাস্তি পায়, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁরা যেন ন্যায় পান, যাদের ঘর ভাঙ্গা হয়েছে, যাদের বিভিন্নভাবে অনেক ক্ষতি হয়েছে তাঁদের সকলকে যেন পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এটা হচ্ছে আমাদের প্রথম কথা।

দ্বিতীয় যে প্রশ্নটা তা হল বিজেপি এই ঘটনাগুলোকে নিয়ে রাজ্যে একটা বিরাট ছক কষছে যে কি করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করা যায়। বিভিন্ন রকম মিথ্যা খবর, ভূয়ো খবর, ফেক টুইট, ফেক ফেসবুক পোস্ট, হোয়াটস্যাপ পোস্ট, ফটো ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এবং তার মধ্যে বেশ কিছু, ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে, এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যে, সেগুলো ভূয়ো, প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তা সত্বেও বিজেপি এই চেষ্টাটা চালিয়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে তারা চায়, যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণটা তারা বিধানসভা নির্বাচনে করতে চেয়েছিল এবং মেরুকরণ করে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল সেটা অসমাপ্ত থেকে গেছে, সেটা সফল হতে পারেনি, সেই কাজটা তারা এখন করতে চায়। বিরোধী দলের জায়গা হিসেবে বিধানসভায় থেকে তারা এবারে এই কাজগুলো করতে চায়। সেজন্য এটার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। বাংলা রুখে দাঁড়িয়েছিল নির্বাচনে। আমরা সবাই সজাগ ছিলাম। এই যে ৪৮% ভোট তৃণমূল কংগ্রেস পেল এটা তৃণমূল কংগ্রেসের একার ভোট নয়। তৃণমূল কংগ্রেসের একার যে ভোট আছে তার সাথে সাথে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমবাংলার ব্যাপক শান্তিপ্রিয় মানুষ গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ, যারা পশ্চিমবাংলায় বিজেপিকে চান না, বিজেপির সরকার হোক বিপর্যয় নেমে আসুক এটা চান না তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে। এই যে পশ্চিমবাংলার ব্যাপক বামপন্থী উদারবাদী মানুষ, তাদের এই নির্বাচনের সময়ে যে ভূমিকাটা ছিল সেই ভূমিকাটা আমাদের জারি রাখতে হবে। আরও বেশি করে জারি রাখতে হবে কারণ বিধানসভার ভেতরে এবার এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে যেখানে বিরোধী দল বলতে শুধু বিজেপি। সেখানে কোনও বামপন্থী বিধায়ক নেই, সেখানে এমনকি কংগ্রেসেরও কোনও বিধায়ক নেই। বিধানসভার ভেতরে এই যে এক ভারসাম্যহীন অবস্থা তৈরি হল, এই ভারসাম্যহীনতার বিপরীতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেক বেশি করে আমাদের সজাগ থাকতে হবে, সক্রিয় থাকতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে, একজোট থাকতে হবে।

Bengal's historic mass verdict

 

পশ্চিমবাংলায় কোভিড পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক। গোটা দেশেই বিপজ্জনক, এবং বাংলায় বিশেষ করে এই যে এত লম্বা নির্বাচন চলল — আট দফা নির্বাচন চলল — এই নির্বাচন যদি চার দফা পাঁচ দফায়ও শেষ হয়ে যেত, এপ্রিলের মাঝামাঝি যদি শেষ হয়ে যেত তাহলে আজকে পরিস্থিতি কিন্তু এত খারাপ হত না। কিন্তু সেটা তো হয়নি, ইলেকশন কমিশন এর জন্য দায়ী। কিন্তু যাই হোক, এখন আমাদের যে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হচ্ছে সেখানে বিরাট সংখ্যায় কোভিডের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা টেরও পাচ্ছি না কারণ টেস্ট হচ্ছে না। সরকারী হাসপাতালে সপ্তাহে মাত্র একদিন টেস্ট হচ্ছে, সাধারণ মানুষ টেস্ট করানোর সুযোগ পাচ্ছে না। এছাড়া যে চিকিৎসার দরকার, বেড দরকার, অক্সিজেন দরকার, ভ্যাক্সিন দরকার – এগুলো অপ্রতুল। সারা দেশেই অপ্রতুল, পশ্চিমবাংলাতেও কম। ফলে এই মুহূর্তে আমাদের কাছে একটা বড় প্রশ্ন হচ্ছে যে বাংলার বুকে এই কোভিডের যে আক্রমণ এই আক্রমণটাকে রুখে দিতে হবে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ফলে, আর হিংসা নয়। নির্বাচন পরবর্তী এই ধরনের হিংসা প্রতিহিংসার ঘটনা নয়, গণতন্ত্রের ওপর কোনও আক্রমণ নয়, কোনোরকম কোনও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বিভাজন নয়। আমরা সবাই মিলে একসাথে কোভিডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। এটাই এখন হওয়া উচিত আমাদের স্পিরিট। আজকে কলকাতায় লেনিনমূর্তির পাদদেশে একটা সংক্ষিপ্ত নাগরিক প্রতিবাদ হল যেখানে আমরা এই দাবিগুলোই তুলেছিলাম যে, সরকার চলুক। জনগণ রায় দিয়েছে সরকার গঠিত হয়েছে। সরকার চলুক, সন্ত্রাস নয়। শান্তি চাই, দাঙ্গা নয়। এবং লড়াইটা চলুক কোভিডের বিরুদ্ধে, এই মহামারীর বিরুদ্ধে।

পশ্চিমবাংলার নির্বাচনের যে রায় তা গোটা ভারতবর্ষের মানুষকে আশা জাগিয়েছে অনুপ্রাণিত করেছে। যে কৃষকরা আন্দোলন করছেন, যে শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন পাব্লিক সেক্টর বাঁচানোর জন্য, প্রাইভেটাইজেশনের বিরুদ্ধে, যুবকেরা যারা আন্দোলন করছেন চাকরির দাবিতে, গোটা দেশে সংবিধান বাঁচানোর জন্য যারা লড়ছেন, নাগরিকত্বের অধিকারের জন্য যারা লড়ছেন, মহিলাদের অধিকারের জন্য যারা লড়ছেন, সবাই অনুপ্রাণিত হয়েছেন বাংলার এই নির্বাচনের ফলাফল দেখে, এটা দেখে যে, এই যে প্রচার করা হয় যে বিজেপিকে আর ঠেকানো যাবে না – এটা নয়, এটা মিথ্যা প্রচার, বিজেপিকে রীতিমতো ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব, যেভাবে বাংলা ঠেকিয়ে দিয়েছে, আগামি দিনে এইভাবে উত্তরপ্রদেশও ঠেকিয়ে দিতে পারে, এবং ২০২৪-এ এইভাবেই গোটা দেশ ঠেকিয়ে দিতে পারে। ২০২৪ তো এখনও দেরী আছে। এই মুহুর্তেগোটা দেশে দাবি উঠছে যে মোদী সরকার হয় কোভিডের ব্যাপারে কাজ করুক, আর না হলে, যদি সরকার না চালাতে পারে, তাহলে মোদী পদত্যাগ করুক, পদত্যাগ করে ভারতবর্ষে অন্তত একটা সরকার থাকুক যে সরকার এই কোভিড পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারবে। এই মুহূর্তে মনে হয় একটা বড় আন্দোলনের পরিবেশ গড়ে উঠছে গোটা দেশ জুড়ে, এবং এই আন্দোলনে পশ্চিমবাংলার জনতার এই রায় থেকে প্রেরণা নিয়ে শক্তি নিয়ে আমরা সবাই মিলে এগিয়ে যাব। এবং বাংলার ভেতরে বামপন্থীদের যে বিধানসভার মধ্যে একটা দুর্বলতার জায়গা তৈরি হল সেই দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠে বামপন্থি শক্তি নতুন করে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে, নতুন উদ্যমে আমরা রাস্তায় থেকে এই শক্তি অর্জন করব। এটা আজ আমাদের সকলের কাছেই চ্যালেঞ্জ। আমরা সিপিআই(এমএল)-এর পক্ষ থেকে সিপিআই(এমএল)-এর সমস্ত কর্মী ও সমর্থকদের কাছে এবং গোটা পশ্চিমবাংলার সমস্ত বাম কর্মীবাহিনী এবং যারা সচেতন সক্রিয় নাগরিক, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ সকলের কাছে এই আবেদন রাখি যে আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে পশ্চিমবাংলায় পরিস্থিতি সামাল দিই, পরিস্থতির মোকাবিলা করি এবং বাংলার বুকে বিজেপি যে চক্রান্ত করছে সেই চক্রান্তকে রুখে দিই। এবং তৃণমূল কংগ্রেস যদি এটা মনে করে যে তারা এবার বিরাট একটা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে অতএব সংখ্যাগরিষ্ঠতা মানেই হচ্ছে পশ্চিমিবাংলার বুকে এক ধরনের স্বৈরাচার চালানোর লাইসেন্স, তাহলে এটা খুব ভুল হবে। এই তৃতীয় দফার যে তৃণমূলের সরকার ক্ষমতায় এসছে, গণতন্ত্র যেন আক্রান্ত না হয় মানুষের অধিকার যেন বিঘ্নিত না হয়। শান্তি যেন আক্রান্ত ও বিঘ্নিত না হয়, এবং পশ্চিমবাংলার মানুষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যর ওপর যেন কোনও আঘাত নেমে না আসে এটা আমাদের দেখার দায়িত্ব সকলের, দেখার দায়িত্ব সরকারের, দেখার দায়িত্ব মানুষের। আমরা সবাই মিলে এই কাজটা পালন করব। আমরা চাই বাংলার বুকে গণতান্ত্রিক শক্তি, বামপন্থী শক্তি সংহত থাকুক, আরও শক্তিশালী হোক।

(পার্টি রাজ্য ফেসবুক পেজের লাইভ বার্তা থেকে অনুলিখিত)

New situation

অবশেষে ফ্যাসিবাদী বিজেপির বাংলা দখলের অভিযান রুখে দেওয়া গেল। এটাই এবারের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনী ফলাফলের সবচেয়ে বড় খবর। এটা শুধুমাত্র বাংলার জন্য শুভ তা নয়, সারা দেশের জন্যও একটা বার্তা। বুঝিয়ে দিল তেমনভাবে লড়তে পারলে বিজেপিকে রুখে দেওয়া যায়। তবে তা মোটেই সহজ ছিল না। রাজনৈতিক লড়াই হয়েছে প্রতি পদে পদে। মোদী-অমিত শাহদের অনুকূলে কিছু সুযোগ তৈরি হয়েছিল। একদিকে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, অন্যদিকে বিরোধী দল হিসাবে বিশেষত সিপিএম ও কংগ্রেসের ক্রমাগত রাজনৈতিক-নৈতিক অধঃপতন বিজেপিকে গত দু’বছর যাবৎ ক্রমাগত জমি পেতে পরোক্ষে সহায়তা জুগিয়ে এসেছে। এছাড়া আড়াল থেকে মানুষের মগজ ধোলাইয়ের আরএসএস-এর কাজের ধারা বাড়তি সুবিধা করে দেয়। বিজেপির চাপানো ইস্যুগুলো সহজে উড়িয়ে দেওয়ার ছিল না। বিদ্বেষ-বিভাজনের মেরুকরণের রাজনীতির হামলা নামিয়েছিল বেশ সুকৌশলে। কিন্তু পরিণাম দেখিয়ে দিল তাকে ছাপিয়ে নির্দ্ধারক হয়ে ওঠে বিজেপিকে হারানোর যুক্তি, বুদ্ধি, শ্লোগান, জেদ, ভোটদান কৌশল; পাল্টা হাওয়ায় তাকে পর্যুদস্ত করে রুখে দেওয়ার অভিযানই জিতে গেল। একস্বরের একেশ্বর কায়েম করার সাধ মিটিয়ে দিল বহুস্বরের বাংলা।

বিধানসভায় বিরোধী দলের আসনে এবার নজর কাড়ছে নজিরবিহীন সমাপতন। বামফ্রন্টের দলগুলোর কোনও প্রতিনিধিত্ব থাকছে না। সেই জায়গায় প্রবেশ ঘটছে বিজেপির, সংখ্যাটা হেলাফেলার নয়, শাসক দল তৃণূলের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ। বিজেপিকে নির্বাচনে হারানো গেছে, এটা একটা সাফল্য ঠিকই, কিন্তু লড়াইটা দীর্ঘস্থায়ী চালিয়ে যাওয়ার দাবি রাখে। কেন্দ্র এবং সারা দেশ থেকে দূর করার প্রয়োজনে যেমন, তেমনি এখানেও লড়াই শুরু করতে হবে নতুন করে। ওরা বাংলায় ক্ষমতা দখল করতে পারেনি, কিন্তু বিধানসভায় বিরোধীপক্ষের একচেটিয়া দখল পেয়ে গেল। ওদের হিন্দুত্বের ঘৃণার রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ফেলতে পেরেছে সামাজিক শক্তিগুলোর বিশাল পরিসরে, বিশেষত নিম্নশ্রেণী-নিম্নবর্ণের মধ্যে। সমাজে পদানত করে রাখা শক্তিগুলোর ভেতর থেকে আবার ব্যবহারের পদাতিক বানাচ্ছে উচ্চ শ্রেণীমুখী-বর্ণবাদী-ধর্মরাষ্ট্রবাদী একটা দল। ফলে নানা পরিচিতির গরিব ও মধ্যবিত্ত সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে তৈরি হচ্ছে অচেনা সব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিস্থিতি। এইসব জট ছাড়ানোর কোনো সহজ-সরল সূত্র পাওয়া সম্ভব নয়। খুবই নিবিড় ও ব্যাপক বোঝাবুঝির নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া প্রয়োজন। তবেই সম্ভব ওসব মাটি থেকে বিজেপিকে বিচ্ছিন্ন করার উপায়গুলো বার করা।

পরিস্থিতি একইসাথে দাবি করছে বাংলার বামপন্থীদের নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে গড়ার আত্মানুসন্ধান নতুন করে শুরু করতে হবে। আন্দোলনের বামপন্থার টুকরো-টাকরা চেষ্টা ছাড়া বামফ্রন্টের বড় শরিক দলটি গত দশ বছর খোঁজে থেকেছে কেবল কিভাবে সুড়ঙ্গের শেষে মসনদে পৌঁছানোর তালাশ পাওয়া যায়। তার জন্য বারবার হাত ধরেছে কংগ্রেসের, সেই মূঢ়ামীর প্রথম মাশুল গুণতে হয়েছিল ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে। এবারের নির্বাচনে সিপিএম নেয় আরও সুবিধাবাদী কৌশল। এক মুসলিম মৌলবাদী শক্তিকে মিত্র বলে চালিয়ে তিন পক্ষের ‘সংযুক্তমোর্চা’ বানিয়ে নামে ফাটকা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এবার মাশুল গুণতে হল জুয়ারীর সর্বস্ব হারিয়ে ঘরে ফেরার মতোই। সিপিএম-কংগ্রসের মাঝখান থেকে বিধানসভায় ঢুকে গেল ‘সেকুলার’ বুলি আউরানো আইএসএফ। একটি মাত্র আসনে। আর, সিপিএমের কাছে মসনদ রইল মরীচিকা হয়ে, বিরোধীপক্ষের আসন সব হয়ে গেল চৌপাট, বাম মান মর্যাদাও সবই গেল। যে নতুন প্রজন্ম এসেছে, দিশার সঠিকতা ধরতে পারলে, পর্যালোচনার একটু গভীরে ঢুকতে পারলে, তারা প্রত্যক্ষ করতে পারবে এবার নেতৃত্বের সুবিধাবাদ ও দেউলিয়াপনা পৌঁছেছে কোথায়। ফেটে পড়বে এলোপাথারি তর্ক-বিতর্ক। সঠিক নীতি-আদর্শ-চিন্তাচেতনা থাকলেও লড়ে ধাক্কা খেতে হতে পারে। তবু তার মধ্যেও একটা সার্থকতা থাকে এই যে, পঙ্গুত্ব গ্রাস করেনি। কিন্তু বাংলার এখনও আকারে বড় বাম দলটি সবদিক থেকে জড়বৎতন্ত্রের কেন্দ্র বনে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই বাংলায় পুরানো প্রথাগত বাম দলগুলোর ভাঙচুর শুরু হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। তা থেকে আজ সময়ের দাবিতে ইতিবাচক আশাপ্রদ অংশগুলো বেরিয়ে আসতে পারে। আর, তুলনায় আকারে অনেক ছোট-মাঝারি হলেও চেতনায় নতুনত্ব আয়ত্ব করা বাম সংগঠন ও মঞ্চগুলোর শক্তির স্ফূরণ ঘটার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। অবশ্যই আপনা থেকে নয়, উপযুক্ত প্রচেষ্টা চালালে।

পশ্চিমবাংলার পরিস্থিতিতে বিজেপির সাথে সংগ্রামী বাম শক্তির টক্কর দেওয়ার অবস্থান থাকবে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের। বাম ও প্রগতিপন্থী ধারাগুলোর সামনে সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়ার সম্ভবপর ক্ষেত্র বহুধা বিস্তৃত বৃহত্তর। বিজেপি করবে কেন্দ্রের মোদী সরকারকে আগলানো আর রাজ্যের তৃণমূল সরকার বিরোধী রাজনীতি। আর, বামপন্থীদের সামনে সুযোগ থাকছে আন্দোলনের বর্শামুখ কেন্দ্রের দেশবিরোধী জনবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে অব্যাহত রাখার, রাজ্যের নবনির্বাচিত সরকারকে দায়বদ্ধ করে চলার। কোভিড মোকাবিলার যুদ্ধ এই সুযোগ এনে দিয়েছে। তাছাড়া লড়াইয়ের সুযোগ থাকবে বিজেপির বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধেও। বিজেপি ক্ষমতার দখল না পাওয়ার আক্রোশ মেটাতে বলতে শুরু করেছে, ‘জিহাদিরা সক্রিয়’, ‘হিন্দুরা একটু বুঝুক’! নির্বাচিত রাজ্য সরকারের শপথ না হতেই হল্লা তুলতে শুরু করে দিয়েছে ‘ রাষ্ট্রপতি শাসন চাই’!

Circular of the State Committee

গত ৪ মে ২০২১ পার্টির রাজ্য কমিটির এক অনলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতে সাম্প্রতিককালে প্রয়াত কমরেডদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। যথা দার্জিলিং জেলা ও শিলিগুড়ির পার্টি সংগঠক কমরেড অপূর্ব (অপূ) চতুর্বেদী, নদীয়ার নপাড়া অঞ্চলের কমরেড সিরাজ মোল্লা, হাওড়া জেলার কমরেড রঞ্জিত দে। কবি-প্রাবন্ধিক ও বিশিষ্ঠ বামপন্থী বুদ্ধিজীবী প্রয়াত শঙ্খ ঘোষকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। এছাড়া কোভিড আক্রান্ত কর্মী-সমর্থক-দরদীদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করা হয়। বৈঠকে আলোচিত বিষয় ও গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি নিম্নরূপ –

১) নির্বাচনী পর্যালোচনা – পশ্চিমবাংলার নির্বাচনী ফলাফল স্পষ্টতই এক বিজেপি বিরোধী গণরায় হিসাবে উঠে এসেছে, যেখানে মেরুকরণ হয়েছে রাজনৈতিকভাবে, ধর্মীয় ভিত্তিতে নয়। বিভিন্ন জেলাওয়াড়ি নির্বাচনী ফলাফলের চিত্রে যা পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। কেবলমাত্র তৃণমূলের সপক্ষে নয় এ রায় বিজেপি বিরোধী নানা স্তরের জনগণের এক প্রতিবাদী জনমত হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।

২) বাংলার বুকে ফ্যাসিবাদী শক্তির দখলদারী রুখে দিতে বিভিন্ন ধরনের বাম গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল জনগণ পথে নেমেছিলো। একুশের ডাক,নো ভোট টু বিজেপি প্রভৃতি ব্যানারে বিভিন্ন সংগ্রামী শক্তির বিজেপি বিরোধী প্রচার যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছে, ফলাফলে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে, সর্বস্তরে এক নৈতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দ এ রাজ্যে এসে বিজেপির বিরুদ্ধে যে প্রচার করেছে সেটাও যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। তৃণমূলের যে ৫ শতাংশ ভোট বৃদ্ধি ঘটেছে তার পেছনে কাজ করেছে এই সমস্ত শক্তিগুলি এবং নাগরিক সমাজের এক সক্রিয় বিজেপি বিরোধী ভূমিকা।

৩) তৃণমূলের সপক্ষে তথা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এই ফলাফলের পেছনে প্রাথমিক ভাবে যে দিকগুলি কাজ করেছে তা হলো শ্রেণীগত বঞ্চনা তথা শ্রমজীবী শ্রেণীগুলির উপর যে হামলাগুলি নামিয়ে আনা হয়েছে সেই দিকগুলি, যা আমরা তুলে ধরেছি। এছাড়া মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে কূৎসিত ভাষায় গালাগালি ও বিজেপির পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর বিপরীত প্রতিক্রিয়া ফলাফলে প্রতিফলিত হয়েছে। তৃণমূল সরকার বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পগুলিতে মহিলাদের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলি তুলে ধরেছিলো। এছাড়া বিজেপির হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান দৃষ্টিভঙ্গী চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে বাঙ্গালী ভাবাবেগ অনেকাংশে কাজ করেছে। তৃণমূলের পক্ষে এই গণরায়কে আমরা স্বাগত জানিয়েছি।

৪) সিপিএম বাংলার জনগণের এই রায়কে বিচার বিবেচনা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ফ্যাসীবাদের পক্ষে নাকি এ রাজ্যের বুকে যে কোনো মূল্যে তাকে প্রতিহত করতে হবে – নির্বাচনের এই প্রধান ইস্যুটাকেই তারা ধরতে অস্বীকার করেছে। তৃণমূল বিজেপি একই মূদ্রার এপিঠ ওপিঠ তাদের এই সূত্রায়ণ রাজ্যের মানুষ মেনে নেয়নি। ভুল রাজনৈতিক কৌশলের জন্যই তাদের ভোটের একটা বড় অংশ দ্বিমেরুকৃত রাজনীতির অঙ্গীভূত হয়ে পড়েছে এবং এ রাজ্যে বামশক্তির এক চরম অবনমন ঘটিয়েছে, যা অভূতপূর্ব। পঃ বাংলায় ধারাবাহিকভাবে বিরোধীপক্ষের কোনো ভূমিকা তারা গ্রহণ করেনি বরং যেন ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য অপেক্ষমান এক শক্তি হিসাবেই তারা নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে। কংগ্রেস ও অন্য একটি শক্তির সাথে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ জোট গঠনের কৌশল প্রয়োজনবাদী ও সুবিধাবাদী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে, বামমহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আমরা সিপিএম তথা বামদের জয়ী আসনগুলিতে সমর্থন জানিয়ে তাদের থেকে রাজনৈতিক দূরত্ব বজায় রাখার যে অবস্থান আমরা গ্রহণ করেছিলাম তা সঠিক বলেই প্রমাণিত হয়েছে। সিপিএম কেন্দ্রীয়ভাবে বলছে যে বিজেপিকে ঠেকাতে মানুষ তৃণমূলকে বেছে নিয়েছে। কিন্তু কেন সিপিএম বা সংযুক্ত মোর্চা নিজেকে এক বিজেপি বিরোধী শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে পারল না বা তার চেষ্টাই করল না সে ব্যাপারে তাদের বিশ্লেষণে আত্মসমালোচনা বা এমনকি আত্মজিজ্ঞাসাও নেই। এখনও রাজ্যে তাদের বহু নেতা পুরো ফলাফলটাকে আরএসএস-এর ছক বলে চালিয়ে যাচ্ছেন।

৫) নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি ও আমাদের কাজ – নির্বাচনী ফল প্রকাশের পরই রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে হিংসার ঘটনাবলী দেখা যাচ্ছে। তৃণমূলের দুষ্কৃতিরা বিরোধীদের উপর হামলা নামিয়ে এনেছে। নীচু তলায় গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ তথা গরিব মেহনতি মানুষের জীবন-জীবিকার উপর হামলার এই ঘটনাবলীর পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে রাজ্য জুড়ে বিজেপি একে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চক্রান্ত শুরু করেছে। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে তারা একটি সম্প্রদায়কে আক্রমণের লক্ষবস্তু বানাচ্ছে এবং দাঙ্গা লাগানোর অপচেষ্টা ও প্ররোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ক্ষমতাকে তারা ব্যবহার করছে, গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করতে চাইছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কলকাতায় তাৎক্ষণিকভাবে পথে নেমে প্রতিবাদী কর্মসূচী গ্রহণ করেছি।

স্লোগান – সরকার চলুক সন্ত্রাস নয়। শান্তি চাই দাঙ্গা নয়। লড়াই হোক করোনার বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাংলার এই সুস্পষ্ট রায়কে নসাৎ করার বিজেপির গভীর চক্রান্তর বিরুদ্ধে আমাদের প্রচার ও প্রতিবাদী কর্মসূচী অব্যাহত রাখতে হবে। পার্টি ও গণ সংগঠনের ব্যানারে জেলাগুলিতে ও ব্লকে ব্লকে প্রচার কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা করা ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবি তুলে ধরতে হবে। হিংসার ঘটনাবলীতে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন মারা গেছে। সন্ত্রাসের ঘটনাবলীতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের দায়দায়িত্বর প্রশ্ন তুলে ধরে আমাদের প্রচারে নামতে হবে।

৬) ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা বিভিন্ন বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তিগুলির ঐক্যবদ্ধ কার্যকলাপকে আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্ভাবনাগুলি খতিয়ে দেখে বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে। যথা একুশের ডাক ফোরামের মাধ্যমে নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন শক্তির সাথে আন্তঃক্রিয়া চালানো। এই প্রথমবার বিধানসভায় বামদের কোনো প্রতিনিধি নেই, বিরোধীপক্ষের অবস্থানগত ভারসাম্য এক দিকে ঝুঁকে রয়েছে। এই ভারসাম্যহীনতাকে মোকাবিলা করতে রাস্তার লড়াইয়ের মাধ্যমে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। সতর্কতা সজাগতা বজায় রাখতে হবে। বামপন্থার পুনর্জাগরণ বা পুনর্গঠনের লক্ষ্যে আমাদের সার্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আমাদের ছাত্র-যুব-নতুন প্রজন্মর কর্মীদের ইতিবাচক রাজনৈতিক ভূমিকা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নতুন অনুশীলনে নতুন কর্মীদের দায়দায়িত্বে নিয়ে আসার লক্ষ্যে জেলা কমিটিগুলিকে পরিকল্পনা নিতে হবে।

৭) আমরা যে কেন্দ্রগুলিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি তার মধ্যে কয়েকটি কেন্দ্রে আমরা উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে নির্বাচনী প্রচারকাজ করতে পেরেছি। সেখানে স্বল্প হলেও আমাদের ভোট কিছুটা বেড়েছে। যথা ধনেখালি, ফাঁসিদেওয়া, খরগ্রাম, মন্তেশ্বর (বিগত উপনির্বাচনের তুলনায়) প্রভৃতি। কিন্তু কিছু আসনে আমাদের প্রাপ্ত ভোট আগের তুলনায় কমেছে। সেখানে সংগঠনের অবস্থা বা আমাদের কাজকর্ম গুটিয়ে এসেছে কিনা পর্যালোচনা করে দেখতে হবে এবং সমস্যাগুলিকে কাটিয়ে তোলার কার্যকরী পদক্ষেপগুলি নিতে হবে।

৮) করোনা পরিস্থিতি – বর্তমানে করোনা পরিস্থতি ক্রমশ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিজেপি তার বাংলা দখলের মরিয়া প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ৮ দফায় ভোট করেছে, বড় বড় জমায়েত ও রোড-শো করেছে। রাজ্যের বুকে কোভিড সংক্রমণ বাড়িয়ে তোলার পেছনে এটা অন্যতম একটা কারণ হিসাবে কাজ করেছে। স্বাস্থ্যবীমা কার্ডের নামে মানুষকে সম্পূর্ণ প্রবঞ্চনা করা হয়েছে, নীচুস্তর থেকে শুরু করে সমগ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকাঠামোগত উন্নয়ন চরম অবহেলিত রয়েছে। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় বেড, অক্সিজেন, করোনা টিকা সব কিছুর এক চরম সংকট চলছে। মানুষ কার্যত অসহায়। সরকারী নীতির বিরুদ্ধে নানাবিধ জরুরি দাবিতে আওয়াজ তোলার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি এলাকায় আমাদের যুব ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা নিয়ে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যা খুবই প্রশংসনীয়। এই প্রক্রিয়াটি কয়েকটি জেলায় সমন্বিত করার প্রচেষ্টা চলছে। উপসর্গ থাকলেই ভর্তি করা, অক্সিজেনের পর্যাপ্ত সরবরাহ, সকলের জন্য বিভিন্ন কেন্দ্রগুলিতে কোভিড টিকাকরণ ও করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা, ব্যপক মাত্রায় সেফ হোম আশ্রয়স্থল গড়ে তোলা প্রভৃতি দাবিগুলিকে তুলে ধরতে হবে। এলাকাস্তরে জনগণের পাশে দাঁড়াতে আমাদের উদ্যোগগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে হবে। আমরা পুনরায় লকডাউনের সংকটের দিনগুলির সন্মুখীন হতে চলেছি। গরিব মেহনতি মানুষের কাজ, খাদ্য, নগদ ভর্তুকি ও নিরাপত্তার একপ্রস্থ দাবিসনদ সূত্রবদ্ধ করে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। রাজ্যে কয়েকটি স্থানে মহিলা নিগ্রহর ঘটনা ঘটছে। এতে আমাদের ছাত্র যুব ও মহিলা সংগঠনকে দ্রুত তৎপরতার সাথে যথাযথ ভুমিকা গ্রহণ হবে।

৯) আংশিক করোনা লকডাউন ও রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে বাধ্যতামূলকভাবে দেশব্রতী প্রকাশনা আপাতত স্থগিত রাখা হচ্ছে। পত্রিকার ডিজিটাল সংখ্যা প্রকাশিত হবে।

অভিনন্দন সহ,
সিপিআই(এলএল) লিবারেশন
পঃ বঙ্গ রাজ্য কমিটি

Hold the Modi government to Account

গোটা দুনিয়া যখন কোভিড-১৯ অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, মোদী সরকার তখন প্রথম ঢেউ মোকাবিলায় ‘চমকপ্রদ সাফল্য’ দেখাতে নিজেদের পিঠ চাপড়াচ্ছিল। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে মোদী জানালেন, করোনা ভাইরাসের মোকাবিলায় ভারত কিভাবে দুনিয়াকে সাহায্য করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে বিজেপির জাতীয় নেতৃত্ব প্রস্তাব গ্রহণ করে মোদীর ‘বিচক্ষণ, সংবেদনশীল, অঙ্গীকারবদ্ধ ও দূরদর্শী’ নেতৃত্বকে অভিবাদন জানাল যা নাকি ‘কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতকে বিশ্বের কাছে গর্বিত ও বিজয়ী দেশ হিসাবে তুলে ধরেছে’। মার্চ মাসের গোড়ায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন ঘোষণা করলেন যে ভারত কোভিড-১৯-এর ‘খেলা শেষ’ করে এনেছে। তিনি আহ্বান জানালেন যে কোভিড-১৯ নিয়ে যেন রাজনীতি না করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ভারতকে বিশ্বের ওষুধ তৈরির কারখানা বলে বর্ণনা করলেন।

নির্বাচন ঘোষণা হয়ে যেতেই মোদী সরকার নিজেকে নির্বাচন যন্ত্রে পরিণত করল। যেখানে নির্বাচন ছিল না সেখানে কুম্ভ মেলা হল। এই মেলাকে রহস্যজনকভাবে এক বছর এগিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু মার্চ মাসের শেষে মহারাষ্ট্র থেকে কোভিড সংক্রমণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সংবাদ আসতে লাগল। এবং তারপর এপ্রিল মাস আমাদের প্রচণ্ড ধাক্কা দিল। এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ প্রতি চারদিন অন্তর দশ লক্ষ নতুন সংক্রমণ আগের সংখ্যার সঙ্গে যোগ হতে থাকল। মৃতের সংখ্যা প্রতি দিন ২০০০ ছাড়িয়ে যেতে থাকল। ক্রমেই বেশি-বেশি শহর ও রাজ্য থেকে হাসপাতালে শয্যার অভাব, অক্সিজেনের জন্য হাহাকার এবং এমনকি মৃতদেহ দাহ করার স্থানের অভাবের রিপোর্ট আসতে লাগল। স্বঘোষিত নেতৃত্বকারী দেশ আজ আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চোখে অতিমারীর সদর দপ্তর, যে দেশের সরকার দেশকে এক মহা বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

অতিমারীর প্রাদুর্ভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্স ও গ্ৰেট ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশগুলো সহ অনেক দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল। তবে টিকা তৈরি করে ফেলার সাথে-সাথে অনেক দেশই গণ টিকাকরণের পথে গিয়ে ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয়েছে। ভারতের ভাগ্য ভালো যে এখানে সংক্রমণের তুলনায় মৃত্যুর হার অনেকটা কম ছিল। এর ফলে কিছুটা সময় আমরা পেয়েছিলাম। এই সময়কে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটানো যেত। সত্যি বলতে ২০২০ সালে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুব কঠিন কোনও পরীক্ষার মুখে পড়েনি, বরং লকডাউনের ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং মানবিক সংকটই আমাদের দেশে ২০২০’র কোভিড সঙ্কটের বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু কোভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ ভারতকে কার্যত অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। আমরা এখন জানি নভেম্বর মাসেই সংসদীয় কমিটি সরকারকে দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কে সতর্ক করে রিপোর্ট দিয়েছিল, তথাপি সরকার ক্রমাগত অক্সিজেন রফতানি করে গেছে এবং টিকাকরণ অভিযানকে জোরদার করতেও ব্যর্থ হয়েছে।

এর চেয়েও নিকৃষ্ট ব্যাপার হল, সংক্রমণের ঢেউ আছড়ে পড়ার লক্ষণগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরও সরকার সেগুলোকে উপেক্ষা করল। উত্তরাখণ্ড সরকার এবং বিভিন্ন আখড়া কুম্ভ মেলায় স্নানের কর্মসূচী চালিয়ে গেল (এমনকি একেবারে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত, এ বছরের সম্ভবত শেষ ‘সাহি স্নান’, তা পালন করা হল)। এবং নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তাঁদের রোড-শো ও বড়-বড় জমায়েতগুলো চালিয়ে গেলেন। অভূতপূর্ব ভাবে নির্বাচনকে আট পর্বে প্রলম্বিত করে নির্বাচন কমিশনও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলল, পশ্চিমবাংলায় কোভিড সংক্রমণের সংখ্যা ভয়াবহ ভাবে বেড়ে চললেও শেষ তিন দফাকে এক দফায় সাঙ্গ করতে তারা অস্বীকার করল। মাদ্রাজ হাইকোর্ট একেবারে যথার্থভাবেই নির্বাচন কমিশনকে তিরস্কার করেছে, এবং ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের এক পদস্থ কর্তা সোজা কথাটা সোজা ভাবে বলেছেন নরেন্দ্র মোদীকে রোগ ছড়ানোর “সুপার স্প্রেডার” হিসেবে অভিহিত করে।

যে সরকার সতর্কতা শিথিল করে তোলার দিকে দেশকে নিয়ে গেল এবং গুরুত্বপূর্ণ সময় ও সম্পদের অপচয় ঘটিয়ে ভারতের কোভিড মোকাবিলার পন্থাকে দুর্বল করে তুলল, তারাই এখন নিজেদের ভাবমূর্তি বাঁচাতে আর কর্পোরেটদের মুনাফাকে জনগণের জীবনের চেয়ে ঊর্দ্ধে স্থাপন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। সামাজিক মাধ্যমের মঞ্চগুলোকে সমালোচনা মুছে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, উত্তরপ্রদেশে যাঁরা অক্সিজেনের অভাব নিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছেন তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, এবং বিরোধী পক্ষকে নিশানা করতে এবং সব দোষ জনগণের ঘাড়ে চালান করতে মিডিয়াকে নামানো হচ্ছে। সংবেদনশীল ও কর্মঠ কোনও সরকার থাকলে যে জীবনগুলিকে নিশ্চিত বাঁচানো যেত সেরকম হাজার হাজার জীবন বলি হয়ে যাচ্ছে এই অপদার্থ সরকারের জন্য, আর সেই চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও চূড়ান্ত ব্যর্থতাকে আড়াল করতে সমালোচনা করা হচ্ছে এক অনির্দিষ্ট বিমূর্ত ‘সিস্টেম’- কে। বিশ্ব স্তরে আজ আমরা যে ভয়ঙ্কর কর্পোরেট মুনাফাবাজি দেখতে পাচ্ছি, তার জায়গায় নিদারুণভাবে প্রয়োজন পেটেন্ট-মুক্ত গণ টিকার জমানা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকেও অবিলম্বে টিকার ওপর থেকে বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধা স্বত্বের অধিকার তুলে নিতে হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্ৰেট ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেন তাতে বাধা না দেয়। তবে, ভারত বিশ্বের বিভিন্ন মঞ্চে এই দাবিটি তুললেও পরিহাসের ব্যাপার হল, মোদী সরকার নিজেই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নির্মম কর্পোরেট মুনাফাবাজির কিছু কদর্য দৃষ্টান্তে সক্রিয়ভাবে মদত জোগাচ্ছে। বিনা খরচে সবার জন্য টিকাকরণের দায়িত্ব না নিয়ে বিজেপি টিকাকে সংযুক্ত করছে ভোটের সঙ্গে এবং টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে ‘সুপার প্রফিট’ করার অবাধ ছাড়পত্র দিচ্ছে; এবং আরও অনুমোদন দিচ্ছে স্বেচ্ছাচারীভাবে নির্ধারিত ভিন্ন-ভিন্ন দামে টিকা বিক্রির অধিকারে; টিকার দাম কেন্দ্রের জন্য হবে ১৫০ টাকা, রাজ্য সরকারগুলোর জন্য ৪০০ ও ৬০০ টাকা এবং বেসরকারী হাসপাতালগুলোর জন্য হবে ৬০০ ও ১২০০ টাকা।

জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারের অপরাধসম অবহেলাকে আরও একবার আড়াল করতে, জনগণের ক্ষতিপূরণের কোনও ব্যবস্থা না করেই বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন মাত্রার লকডাউন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। জনগণ কিন্তু গত বছরের লকডাউন থেকে অনেক কিছু শিখেছে, জনগণ এবার যথেষ্ট সতর্ক ও ক্রুদ্ধ। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সতর্কতাগুলোকে মেনে চলে আমাদের পীড়িত জনগণের জন্য সাহায্যের আয়োজনে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। বিহার ও ঝাড়খণ্ডে আমাদের বিধায়করা তাঁদের আন্তরিক ও নিবেদিত ভূমিকার জন্য জনগণের কাছ থেকে যথেষ্ট প্রশংসা পাচ্ছেন। অনেকগুলি মহানগর ও জেলা শহরে কমরেডরা কোভিড সেবায় হেল্পলাইন চালাচ্ছেন। আমাদের কাজের সমস্ত এলাকায় এই উদ্দীপনা ও জনসেবার মডেলকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। প্রতিটি মৃত্যুই আজ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে নীতি নির্ধারণ ও সরকার পরিচালনার প্রশ্নে গণ স্বাস্থ্যের কী অপরিসীম গুরুত্ব, দেখিয়ে দিচ্ছে এক আধুনিক সভ্য সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে কেন পদে পদে সঙ্ঘ-বিজেপির হিন্দু রাষ্ট্রের ছকের এত গভীর সংঘাত। আমাদের এইসব মৃত পরিজন ও সহনাগরিকদের প্রতি শোক জ্ঞাপনের একমাত্র উপায় হল সরকারকে দায়ী করে সরকারী কর্মনীতিতে প্রগতিশীল পরিবর্তন আনা এবং দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নির্ধারক পরিবর্তন আনার লড়াই তীব্র করে তোলা।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৭ এপ্রিল ২০২১)

A clear mandate against the BJP

সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনগুলির রায় সম্পর্কেকেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি

ভারতে মোদী সরকারের অপশাসনের ফলে সৃষ্ট কালান্তক কোভিড-১৯ অতিমারী সংকটের মধ্যে পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল আমাদের সামনে এলো।

বিজেপি’র এইরকম হামবড়াই মনোভাব মানুষের ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদ বিরোধী রায়ে নির্মমভাবে শূন্যগর্ভ প্রমাণিত হলো। ‘একুশের ডাক’ ও ‘নো ভোট টু বিজেপি’ এই দুই প্রচারাভিযান, পাশাপাশি কৃষক আন্দোলন রাজ্যের মানুষকে বিজেপি ও মোদী শাসনের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। মোদী সরকার ও শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ, নির্বাচন কমিশন সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা, পাশাপাশি বিজেপি’র বিষাক্ত ইসলাম বিদ্বেষ প্রচারও বিজেপিকে জয় এনে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই জয়ের জন্য আমরা তৃণমূল কংগ্রেসকে উষ্ণ অভিনন্দন জানাচ্ছি।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি একচেটিয়া বিরোধী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এইরাজ্যে সরকার বিরোধী অবিজেপি সংগঠনে শক্তিসঞ্চার এবং বামপন্থী শক্তির পুনর্গঠনের মাধ্যমে রাজ্যের এই রাজনৈতিক অবস্থার জরুরি প্রতিকার প্রয়োজন।

কেরালায় এলডিএফ স্পষ্ট জনাদেশ পেয়ে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছে। এই জনাদেশ গত বছর কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের তৎকালীন পরিস্থিতিতে নির্মম ও অযোগ্য ভূমিকার বিপরীতে রাজ্য সরকারের মানবিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকার ফসল। আমরা এই জয়ের জন্য সিপিআইএম ও এলডিএফকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

তামিলনাড়ু এআইএডিএমকে সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনী জনাদেশ দিয়েছে, এই এআইএডিএমকে ক্রমশ বিজেপি’র প্রচ্ছন্ন মুখ হিসেবে ব্যাপকভাবে অনুভূত হচ্ছিলো। তবে রাজ্যে কিন্তু বিজেপি’র প্রবেশ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। এখানে তারা দু’টি আসন পেয়েছে এবং অন্য দু’টি আসনে খুব কম ভোট পার্থক্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, তৎসহ তাদেরকে এই আসনগুলোতে এআইএডিএমকে-র থেকে বেশি ভোট প্রভাবিত করতে দেখা যাচ্ছে। তামিলনাড়ুর সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে এই প্রাথমিক বিপদসঙ্কেতের দিকে নজর রাখতে হবে এবং রাজ্যে বিজেপি’র সম্ভাব্য যে কোনও উত্থানকে রুখতে হবে।

এআইএনআরসি-বিজেপি জোট পুদুচেরিতে তাদের জয় নিশ্চিত করেছে। পুদুচেরির মানুষকে পুদুচেরির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখতে সদাসতর্ক থাকতে হবে এবং বিজেপি’র তামিলনাড়ু বা কেরালায় প্রবেশের খিড়কির দরজা হিসাবে এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটিকে ব্যবহারের যে কোনও চেষ্টা আটকে দিতে হবে।

আসামে বিজেপি দ্বিতীয়বারের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। তবে এখানেও কিছু উৎসাহব্যঞ্জক লক্ষণ রয়েছে। সিএএ-বিরোধী ও কৃষক আন্দোলনের কর্মী অখিল গগৈকে তাঁর লড়াই ও জয়ের জন্য আমরা অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাঁর এই জয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ বিজেপি সরকার তাঁর বিরুদ্ধে নিৰ্মম ইউএপিএ ধারায় মামলা করায় তিনি জেলবন্দী থেকে এই লড়াই লড়েছেন।

কোভিড-১৯ ভাইরাসটি ভারতের প্রত্যন্ত কোণ থেকে কোণে ছড়িয়ে পড়ছে এবং চরম ভোগান্তি ও মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠছে। নবনির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলিকে কোভিড-আক্রান্তদের ত্রাণ ও চিকিৎসা নিশ্চিত করার পাশাপাশি এই মারণ ভাইরাসের পুনরায় ছড়িয়ে পড়া থামাতে হবে।

Quench the violence

পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচনের রায় হল বিজেপির মুসলিম বিরোধী প্রচারের সার্বিক প্রত্যাখ্যান। তবে, ফলাফল বেরোনোর পরপরপরই পশ্চিমবাংলায় উদ্বেগজনকভাবে হিংসার ঘটনা ঘটে চলেছে, যাতে সমস্ত দলের সমর্থকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আরও উদ্বেগের ব্যাপার হল, বিজেপি নেতারা ভুয়ো খবর ছড়িয়ে নির্বাচনী রায় এবং তার সাথে নির্বাচনপরবর্তী হিংসায় সাম্প্রদায়িক রং লাগাতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

এখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, পশ্চিমবাংলায় নির্বাচন-পরবর্তী হিংসায় যারা আহত বা নিহত হয়েছেন তারা বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম)-এর লোকজন। কিছু ক্ষেত্রে সিপিআই(এমএল) কর্মীরা হিংসা থামাতে গেলে তাঁদেরও হিংসার মুখে পড়তে হয়। বিজয়ী তৃণমূল কংগ্রেস একতরফাভাবে তার প্রতিপক্ষদের ওপর হিংসা চালাচ্ছে, ঘটনা এমন না হলেও আর এক দফার জন্য পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় হিংসাকে প্রশমিত করা এবং হিংসার জন্য যারা দোষী তাদের গ্রেপ্তার করা ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার দায় সুনিশ্চিতভাবে তাদেরই।

পরিস্থিতিকে শান্ত করতে চাওয়ার পরিবর্তে বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা সাম্প্রদায়িক হিংসাকে উস্কিয়ে তুলতে এবং সাম্প্রদায়িক রং লাগিয়ে রায়কে কালিমালিপ্ত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। বাংলায় বিজেপির নির্ধারক পরাজয়ের জন্য বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ রাকেশ সিনহা মুসলিম ‘সংখ্যালঘু ভেটো’কে দায়ী করেছেন! তিনি প্রতারণাপূর্ণভাবে এই ইঙ্গিতই দিয়েছেন যে, এককাট্টা হয়ে ভোট দিয়ে মুসলিমরা একটা হিন্দু পার্টিকে হারিয়ে দিয়েছে। প্রকৃত ঘটনা হল, হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ব্যাপক সংখ্যাধিক ভোটারই বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। বিজেপির প্রাক্তন রাজ্যসভা সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত, যিনি বিধায়ক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাস্ত হয়েছেন, টুইট করে এই ভুয়ো খবরটি প্রচার করেছেন যে, তৃণমূল কংগ্রেসের মুসলিম লোকজন বিজেপির হিন্দুভোটারদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। বিজেপির সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয় একটা ভিডিও টুইট করেছেন যাতে দাবি করা হয়েছে যে মুসলিম জনতা হিন্দুদের প্রহার করছে। এই ভিডিওটা সম্পূর্ণ ভুয়ো বলে প্রমাণিত হয়েছে।

বিজেপির প্রচার যন্ত্র নির্বাচনী লড়াইকে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলগুলোর মধ্যে লড়াইয়ের পরিবর্তে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে লড়াই বলে তুলে ধরতে চেষ্টা চালাচ্ছে। আর তাই সামাজিক মাধ্যমে তাদের প্রচারে এবং রাকেশ সিনহার টুইটে দাবি করা হয়েছে, ৩০ শতাংশ মুসলিম “ঐক্যবদ্ধভাবে” ভোট দিলেও ৭০ শতাংশ হিন্দু ভোটারের মধ্যে বিভাজন রয়েছে, আর এই কারণেই হিন্দু আধিপত্যবাদী বিজেপিকে পরাস্ত হতে হয়। আসল ঘটনা কিন্তু পুরোপুরি আলাদা : অধিকাংশ হিন্দু এবং মুসলিম ভোটারই সমানভাবে বিজেপির সাম্প্রদায়িক ঘৃণার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

পশ্চিমবাংলায় বিজেপির প্রচার একটা মাত্র এজেণ্ডার ওপরই ভর করেছিল — টিএমসি-কে মুসলিমপন্থী ও হিন্দু-বিরোধী রূপে তুলে ধরা, আর সেটা করতে গিয়ে তারা যতটা ইসলাম-বিরোধী কুৎসিত ভাষা কল্পনা করা যায় ততটাই ব্যবহার করেছে। এই প্রচার একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে। নির্বাচনী ফলাফল দেখিয়ে দিচ্ছে, হিন্দুভোটার সহ বাংলার ভোটাররা এই প্রচারকে শুধু অবিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে করেননি, বিদ্বেষমূলক ও বিপজ্জনক বলেও গণ্য করেছেন। নির্বাচন পরবর্তী পর্যায়ে বিজেপির প্রচারে যে অলীক “মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে” দায়ী করা হয়েছে তার উৎস রয়েছে একচেটিয়া হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক গড়ার তাদের ব্যর্থতা জনিত হতাশার মধ্যে। “ন্যায়নিষ্ঠ ভোটব্যাঙ্ক” বলে যে একটা বস্তু আছে সেটা স্বীকার করার সাধ্য ওদের নেই। ধর্মীয় পরিচিতি নির্বিশেষে এমন সমস্ত ভোটার যাঁরা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমতা ও ন্যায়ের জন্য ব্যাগ্র।

নির্বাচনী রায়কে কেন্দ্র করে বিজেপি সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগ উস্কিয়ে তুলতে চাইছে, এবং তা শুধু পশ্চিমবাংলার মধ্যেই নয়, দেশজুড়ে। মোদী সরকারের সৃষ্টি করা সর্বনাশা কোভিড-১৯ বিপর্যয় থেকে ওরা দৃষ্টিকে সরিয়ে দিতে উন্মুখ। ব্যাপক হারে মাথাচাড়া দেওয়া এই অতিমারী আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট অক্সিজেন ঘাটতি, হাসপাতালের শয্যা এবং ওষুধপত্রের অভাবের কারণে। এ সত্ত্বেও, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সাহায্য যাতে পীড়িত জনগণের কাছে পৌঁছয় তা সুনিশ্চিত করতে সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়ার পরিবর্তে মোদী সরকার ৩০০ জন উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে “পারসেপশন ম্যানেজমেন্ট” (জনমানসে তৈরি হওয়া নেতিবাচক ধারণার মোকাবিলা করা) বিষয়ে অনলাইনে একটি কর্মশালা সংগঠিত করে! এই কর্মশালার লক্ষ্য ছিল সরকারী কর্তাব্যক্তিদের এমনভাবে প্রশিক্ষিত করা যাতে তাঁরা “সরকার সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারেন”, “সদর্থক ঘটনাবলী ও সাফল্যকে ফলপ্রসূভাবে তুলে ধরে ধারণাকে” ইতিবাচক করতে সক্ষম হন, এবং সরকারকে “সংবেদনশীল, উদ্যোগী, তৎপর সহানুভূতিশীল, কর্মঠ, ইত্যাদি” রূপে দেখাতে সমর্থ হন। মোদী সরকার যথারীতি কোভিড আক্রান্ত জনগণের জীবন রক্ষার পরিবর্তে নিজেদের ভাবমূর্তি বাঁচানোটাকেই ধ্যানজ্ঞান করছে।

অতিমারী কালে জনগণের জীবন রক্ষা নিয়ে যে সরকার একেবারেই বিচলিত নয়, যারা ভাবমূর্তি নির্মাণ এবং সাম্প্রদায়িক আখ্যান তৈরির লক্ষ্যেই নিজেদের উদ্যমকে টিকিয় রাখে, ক্ষমতায় থাকার যোগ্যতা সেই সরকারের নেই। কোভিড-১৯ সংকট থেকে বাঁচার সুযোগ যদি ভারতকে আদৌ পেতে হয় এবং অধিকতর মানুষের মৃত্যুর সংখ্যায় লাগাম পরাতে হয় তবে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে নরেন্দ্র মোদীকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। আর পশ্চিমবাংলা সম্পর্কে বলতে হবে যে, হিংসাকে শক্ত হাতে রোখা এবং সমস্ত সংস্থান ও উদ্যমকে রাজ্যে কোভিড-১৯ অতিমারী মোকাবিলার লক্ষ্যে চালিত করার দায়িত্ব অবশ্যই ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের ওপরই বর্তাচ্ছে।

এম এল আপডেট এডিটরিয়াল, ৫ মে, ২০২১

May Day

বর্তমান করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে, সমস্ত নিয়ম মেনে, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে রাজ্য জুড়ে সিপিআই(এমএল), এআইসিসিটিইউ ও বিভিন্ন গণসংগঠন এবারের মে দিবস পালন করে। মহান মে দিবসের বার্তা পাঠ করা হয়, শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষের নিশান লাল পতাকা উত্তোলন করে শহীদ বেদীতে মাল্যদান করা হয়।

১) যাদের প্রয়োজন, তাঁদের সকলকেই নিখরচায়, দ্রুত অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সবাইকে বিনামূল্যে টিকাকরণ,
২) প্রায় লকডাউনের এই পরিস্থিতিতে কৃষি মজুর, গ্রামীণ শ্রমিক সহ সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য মজুরি সুনিশ্চিত করা ও অন্তত আগামী ৬ মাসের জন্য দশ হাজার টাকা ভাতা ও নিখরচায় রেশন (মাথাপিছু প্রতিমাসে দশ কেজি খাদ্যশস্য) প্রদান,
৩) যে সমস্ত স্বাস্থ্য কর্মী বা পুরোভাগে দাঁড়িয়ে যারা করোনা যুদ্ধে সামিল আশা-অঙ্গনওয়ারি সহ সমস্ত কর্মীর জন্য সুরক্ষা সরঞ্জাম সুনিশ্চিত করা,
৪) নয়া দাসত্বের চারটি শ্রমকোড ও তিনটি কৃষিআইন বাতিল করার দাবি তোলা হয়। করোনার অজুহাতে তীব্রতর কর্পোরেট হামলার বিরুদ্ধে ও সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধ আওয়াজ তোলা হয়।

Protests across Uttar Pradesh

উত্তরপ্রদেশে কোভিড ব্যাধিতে মৃত্যু মিছিল অব্যাহত। যোগী সরকার মৃত্যু হার কমাতে ব্যর্থ। ২৫ এপ্রিল সারা রাজ্য জুড়ে যোগী সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদে সিপিআই(এমএল) বাড়ি বাড়ি, পার্টি অফিস এবং কর্মস্থলে কোভিড নিয়মবিধি মেনে প্রতিবাদ সংগঠিত করেন। প্রতিবাদীরা প্ল্যাকার্ড হাতে বিভিন্ন দাবি নিয়ে শ্লোগান দেন। বিভিন্ন জেলা থেকে ছবি, ভিডিও এবং স্মারকলিপি ই-মেইলের মাধ্যমে সরকারের কাছে পাঠানো হয়।

মোদী-যোগী’দের কেন্দ্র-রাজ্যের সরকার কোভিডের বর্তমান ২য় সংক্রমণের ঢেউ নিয়ে যে অপরাধসমান উদাসীনতা দেখিয়েছেন তা ক্ষমার অযোগ্য। তাঁরা বিগত ১ বছরে যদি হাসপাতালের শয্যা, অক্সিজেন ইত্যাদির ব্যবস্থাপনা করতেন তাহলে এই মৃত্যু মিছিল দেখতে হত না। গোরখপুরের বিআরডি হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবের জন্য যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার থেকে কোনো শিক্ষাই নেয়নি যোগী সরকার। উত্তর প্রদেশকে তাঁরা পরিণত করেছেন শ্মশান প্রদেশে, তাঁদের এই হিংস্র অপরাধমূলক উদাসীনতার মাধ্যমে। তাই যোগীকে এই অপরাধের দায়ভার নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে।

লক্ষ্মৌ, প্রয়াগরাজ, বেনারস, গোরখপুর, গাজীপুর, আজমগড়, কানপুর, মথুরা, শোনভদ্র, এবং অন্যান্য জেলায় প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। সিপিআই(এমএল) রাজ্য সম্পাদক সুধাকর যাদব বলেন, বিজ্ঞানীরা আগেই সাবধান করেছিলেন করোনার ২য় ঢেউ মে মাসে আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে, তাই সরকারের উচিত নির্বাচন ও ভোটে জেতার চেষ্টা ছেড়ে মানুষকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করা।

Take a scientific approach

খুব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। আমাদের চারপাশে, মানুষ মারা যাচ্ছে, নিশ্বাস নিতে হাসফাঁস করছে, শবদাহ হচ্ছে কাতারে কাতারে, প্রতিদিন চব্বিশ ঘন্টা।

এই মৃত্যু-মিছিলের জন্য আর কেউ নয়, একমাত্র দায়ি মোদী সরকার। এই সরকার মহামারী মোকাবিলায় ‘বিজয়’ ঘোষণা করেছিল গত জানুয়ারী মাসে, আহাম্মকের মতো ছাড়পত্র দিয়েছিল কুম্ভমেলা আর বিধানসভা নির্বাচনের জনসভাকে। মহামারীর ভাইরাসকে হুহু করে ছড়িয়ে পড়তে এইভাবে ইন্ধন যুগিয়েছে মোদী সরকার। তদুপরি, গতবছর ধরে, পর্যাপ্ত অক্সিজেন প্ল্যান্ট বা হাসপাতালের বেড ও জীবনদায়ী ওষুধের ব্যবস্থাপনাটুকুও গড়ে তুলতে পারেনি এই অপদার্থ সরকার। বিধানসভা নির্বাচন প্রচারকালে বিনা পয়সায় টিকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মোদী, কিন্তু বাস্তবে মুনাফাবাজ কোম্পানিদের কাছ থেকে চড়া দামে টিকা কিনতে রাজ্য সরকারগুলোকে বাধ্য করতে চাইছে মোদী সরকার।

তাছাড়া এই মোদী সরকার ও শাসক বিজেপি সমস্ত সমালোচনাকে থামিয়ে দিতে আর অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে প্রচার অভিযানে নেমে পড়েছে। অক্সিজেন সঙ্কটে প্রাণ চলে যাচ্ছে, কিন্তু সেই সঙ্কট নিয়ে লেখা বা বলা যাবে না, কোভিড-১৯ মৃত্যুর সরকারী সংখ্যা আর বাস্তবের শবদাহের সংখ্যার গরমিল দেখিয়ে দেওয়া যাবে না, চেপে দেওয়া হবে এবং গ্রেপ্তারের ভয় দেখানো হবে। ওনার মন কি বাতে প্রধানমন্ত্রী নিজে একটি ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে মিথ্যা দাবি করেছিলেন যে নেবুলাইজার নাকি অক্সিজেন সাপোর্টের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যে ভয়াবহ সঙ্কট এই দেশের ওপর তারা চাপিয়ে দিয়েছে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার আর তার পার্টি ন্যূনতম কোনও দায় স্বীকার করতেই রাজি নয়।

১) বিবেচক হন, আতঙ্কগ্রস্ত নয়। করোনা ভাইরাস প্রশ্নে বৈজ্ঞানিক মনোভাব গ্রহণ করুন

পুঁজিবাদি ব্যবস্থায় কর্পোরেটরা সব সঙ্কটকেই তাদের মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চাইবে – কোভিড-১৯ তার ব্যতিক্রম নয়। এই মহামারী আসলে বিনামূল্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবার অপরিসীম গুরুত্বকেই বিশ্বব্যাপী মান্যতা দিয়েছে। কর্পোরেট লালসার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছি আমরা। কিন্তু তা করতে গিয়ে যেন আমরা ষড়যন্ত্র তত্ত্বে ফেঁসে না যাই যেখানে কোভিড-১৯’র ভয়াবহতাকে নাকচ করে দেওয়া হয় বা খাটো করে দেখানো হয় অথবা মানুষকে মাস্ক পরতে বা টিকা নিতেও নিরুৎসাহিত করা হয়।

যেহেতু ভাইরাসটা বাতাসেও ছড়াচ্ছে সেহেতু মাস্কটাই সবচেয়ে কার্যকরী প্রতিরোধক। হয় এন৯৫ মাস্ক নয়তো ডাবল মাস্ক – নীচে সার্জিক্যাল মাস্ক ও তার ওপর সূতির মাস্ক – পরা সকলের জন্য জরুরী। যদি কারও সর্দিকাশি বা জ্বর হয় তাহলে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে, কোভিড টেস্ট করাতে হবে এবং নিভৃতবাসে যেতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সর্দিকাশি ও জ্বর হলে তাকে প্রথমেই কোভিড-১৯ বলে ধরে নিতে হবে এবং সাথে সাথে কোভিড সতর্কতাবিধি যথাযথভাবে মেনে চলা শুরু করতে হবে।

সকলের জন্য টিকাকরণের দাবি আমাদের অবশ্যই তুলে ধরতে হবে এবং যদি সরবরাহ থাকে তাহলে সকলকে টিকা নিতে উৎসাহিত করতে হবে।

২) জনগণকে সাহায্য ও সহযোগিতা দিন

সব ধরনের সুরক্ষাবিধি মেনেই মানুষের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে রাখতে হবে এবং যতভাবে সম্ভব পাশে থাকতে হবে। সামাজিক ও সাংগঠনিক দায়দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে করোনা সঙ্কটকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রাখতে হবে আমাদের। অনেক মানুষকে জমায়েত করতে হয় এমন ধরনের কর্মসূচী থেকে বিরত থাকতে হবে। বিবাহ বা এই ধরনের উৎসব জমায়েতে অংশগ্রহণ আপাতত এড়িয়ে চলুন, আত্মীয় স্বজনদেরও সেরকম করতে বলুন।

এই সঙ্কটে মানুষের পাশে দাঁড়াতে ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে আমাদের কমরেডরা বহুবিধ উদ্যোগ নিচ্ছেন। বিভিন্ন স্থানে হেল্পলাইন নাম্বার দেওয়া হয়েছে। কমরেডরা হাসপাতালগুলি পরিদর্শন করেছেন এবং যাদের প্রয়োজন তাঁদের জন্য সাহায্যশিবির গড়ে তুলেছেন। বিহার ও ঝাড়খণ্ডে আমাদের এমএলএ কমরেডরাও ধারাবাহিক উদ্যোগ নিচ্ছেন।

৩) পার্টির ত্রাণ তহবিলে অর্থ প্রদান করুন

এই ক্রমবর্দ্ধমান সঙ্কট মোকাবিলায় মানুষকে সাহায্য করার জন্য ও আমাদের যে সমস্ত সদস্য কোভিড-১৯ আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁদের সাহায্যের জন্য একটি ‘বিপর্যয় মোকাবিলা তহবিল’ দরকার। এইপর্বে পরিবারের সকলে একসাথে করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন যা দিনমজুর পরিবারগুলির জন্য গভীর সঙ্কট তৈরি করছে।

build resistance without seeing the team

হিংসা ও দাঙ্গা চক্রান্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মুখ্য সচিবকে আইসার চিঠি

মাননীয় মুখ্যসচিব
পশ্চিমবঙ্গ সরকার

নির্বাচন পরবর্তীকালে ভুয়ো সংবাদ ছড়িয়ে দাঙ্গা লাগানোর চক্রান্তের বিরুদ্ধে এবং রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন

মহাশয়,

বাংলার মানুষের বিজেপি বিরোধী ব্যাপক জনরায়কে বিজেপি মেনে নিতে পারছে না। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি দিল্লি দাঙ্গার মতোই বাংলাতেও নির্বাচন পরবর্তীতে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভুয়ো খবর ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপির আইটি সেল। তার পক্ষ থেকে নির্বাচন পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গায় যে রাজনৈতিক হানাহানি শুরু হয়েছে তাকে বিকৃত করে সাম্প্রদায়িক মোড়ক দিয়ে বিশেষ একটি সম্প্রদায় কে চিহ্নিত করে এই সমস্ত খবর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যার ফল আগামী দিনে আরো ভয়াবহ হতে পারে বলে আমাদের আশঙ্কা। বিভিন্ন জায়গাতেই এই উস্কানির ফলে দাঙ্গার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে; তাই আমরা আপনার কাছে আবেদন করছি দ্রুত এই সমস্ত ভুয়ো ও মিথ্যা সংবাদ সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। তার সাথেই নির্বাচন পরবর্তীকালে যেভাবে রাজ্যের নবনির্বাচিত শাসকদল বিরোধীদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তৎপর হতে আপনাকে আবেদন জানাচ্ছি। এর সঙ্গেই এই সময়ে রাজনৈতিক হানাহানিতে যাদের মৃত্যু হয়েছে ও যাদের ঘরবাড়ি ভাঙা হয়েছে তাদের যথপোযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও দাবি করছি আমরা। তাই আমরা দাবি জানাচ্ছি শান্তি ফিরুক দাঙ্গা নয়; সরকার চলুক সন্ত্রাস নয়; সম্মিলিত লড়াই চলুক কোভিড অতিমারীর বিরুদ্ধে।

ধন্যবাদান্তে, অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশন (আইসা)
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে
নীলাশিস বসু (সভাপতি) ও স্বর্ণেন্দু মিত্র (সম্পাদক)

Agnikanya Pritilata

জন্মদিবসে অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা স্মরণে

Failed Tripura government

১ মে একটি প্রেস বিবৃতিতে ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি বলে, পয়লা মে থেকে ১৮-৪৫ বয়সীদের টিকাকরণ শুরু করা যায়নি টিকার অভাবে। পরীক্ষা নামমাত্র। জেলায় জেলায় কোভিড কেয়ার কেন্দ্রে আইসিও, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেনযুক্ত শয্যা এখনো তৈরি করা হয়নি। উপযুক্ত সংখ্যায় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, ল্যাবকর্মী, প্যারামেডিক্যাল কর্মী, সাফাইকর্মী, অ্যাম্বুলেন্স চালক নিয়োগ করা হয়নি। অথচ গত দশদিনে ১,০৭৫ জনের পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে। ১৭ জনের মধ্যে বিপজ্জনক নতুন স্ট্রেন সনাক্ত হয়েছে। এই স্ট্রেনগুলির মধ্যে মহারাষ্ট্রের ডাবল মিউটেন্ট স্ট্রেন, ব্রিটেন স্ট্রেন ও দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেন। কিন্তু রাজ্যে টেস্ট পরিকাঠামো নেই। আগরতলা এজিএমসি ল্যাবে পরীক্ষা হয়। মাইক্রোবাইলোজিষ্ট নেই। তাই নমুনা পাঠাতে হয় পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণীতে। রিপোর্ট আসতে যথেষ্ট দেরী হয়। সম্প্রতি বিমানবন্দরে ও রেল স্টেশনে পরীক্ষা শুরু করা হয়েছে। বাজারে পরীক্ষা নেই। হোম আইসোলেশান ও কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে যথেষ্ট দুর্বলতা আছে।

এমতাবস্থায় বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে সিপিআই(এমএল) রাজ্য কমিটি রাজ্য সরকারের কাছে দাবি সনদ তুলে ধরে।

No Vote to BJP campaign

২০১৯-এ ৩০৩টি আসন দখল করে মোদী-অমিত শাহের নেতৃত্বে বিজেপি সরকার দেশবাসীর উপর ব্যাপক সন্ত্রাস নামিয়ে আনে — কাশ্মীরের জনগণের দীর্ঘদিনের অধিকার ৩৭০ ধারা বিলোপ করে গোটা কাশ্মীরকে কারাগারে পরিণত করা, সিএএ সংশোধনী-২০১৯ এনে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব বিভাজনকে আইনি রূপ দিয়ে সংবিধানের মৌলিক চরিত্রটাই পাল্টে দেওয়া, বনবাসী আইন ২০০৬-কে খর্ব করা, এনএসএ ও ইউএপিএ আইন সংশোধন করে আরো হিংস্র করা, পুলিশের স্বৈরাচারী ক্ষমতা বাড়ানো ইত্যাদি। এরপরই আমরা দেখলাম ৪৪টি শ্রম আইনকে ৪টি শ্রমকোডে রূপান্তরিত করে এযাবতকালের লড়াইয়ে অর্জিত শ্রমিক শ্রেণীর অধিকারগুলি কার্যত কেড়ে নেওয়া হলো। আর লকডাউন পিরিয়ডেই জারি করা হল তিনটি কৃষি বিল নিয়ে অর্ডিন্যান্স। ফুঁসে উঠলো পাঞ্জাবের কৃষকরা। হরিয়ানার কৃষকরাও তাতে যোগ দিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়লো। সমস্ত প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে নভেম্বর মাসে বিল তিনটিকে আইনে রূপান্তর করা হলো। শুধু এটুকুই নয়, লকডাউন পিরিয়ডে পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর অমানবিক আচরণ করা হলো। এর সাথে দেখা গেলো ধর্ষকদের নিয়ে বিজেপি-আরএসএস মিছিল করছে। স্তম্ভিত হলো গোটা দেশ। মানুষ কি খাবে কি পরবে তা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আদেশ জারি করা হলো। গো-মাংস রাখার অজুহাতে পিটিয়ে খুন করা হলো। এবং প্রতিবাদ করার জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলে আটক করা শুরু হল। এর পাশাপাশি বিদ্বেষ বিভাজনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হলো। করোনার বৃদ্ধির জন্য দায়ী মুসলমানেরা – এই প্রচার ছড়িয়ে দেওয়া হলো। তবলিগি জমায়েতকে দায়ী করে এই কাজ শুরু হলো। এই সময়ে আমরা দেখলাম একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সবচেয়ে আগ্রাসী অংশ সরকারের সহযোগিতায় বিপুল মুনাফা করছে। একদিকে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারাচ্ছে, অপরদিকে বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির মুনাফা বেড়েই চলছে। এককথায় গোটা দেশে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে।

আমাদের দেশে শাসকদের বিভিন্ন দল আছে আবার শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষাকারী বিভিন্ন দল আছে। কিন্তু তারা কেউই ফ্যাসিস্ট দল নয়। ফ্যাসিস্ট দল তাদেরই বলা হয় যাদের ফ্যাসিবাদী কর্মসূচী থাকে। ফ্যাসিবাদী গণআন্দোলন চালিয়ে যারা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়। এবং রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠান এরা কব্জা করতে চায়। মুসোলিনি এদের আদর্শ হয়। আরো একটা বিষয় বোঝা প্রয়োজন। ফ্যাসিস্ট শক্তির সুনির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ থাকে। আমাদের দেশে একমাত্র আরএসএস বিজেপির এরকম ফ্যাসিবাদী কর্মসূচী আছে। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান গঠনের নামে একনায়কতন্ত্র হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। এর জন্য একটি কল্পিত শত্রু খাড়া করে, এক্ষেত্রে যা মুসলিম সমাজ, তার বিরুদ্ধে সব অর্থেই যুদ্ধ ঘোষণা করে। যেমন হিটলারের নেতৃত্বে নাজীরা ইহুদিদের শত্রু খাড়া করে একাজ করেছিল। সমাজবিকাশের পরিপন্থী সব পিছিয়ে পড়া ভাবনাকে জনমানসে ছড়িয়ে দেয়। বিরোধী সব কণ্ঠকে জোর করে বন্ধ করে দেয়। নিজেদের স্বার্থর জন্য এমন হীন কাজ নেই, যা ওরা করেনা। উদাহরণ, বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা, ২০০২ সালে গুজরাটে হাজার হাজার মুসলমান হত্যা। আর, একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষার জন্য সমস্ত পন্থা নেয়। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন বেশ কিছু রাজনৈতিক শক্তি আছে যারা শাসক শ্রেণীর সব দলকেই ফ্যাসিস্ট দল বলে। তারা বোঝে না স্বৈরাচারী শাসন মানেই ফ্যাসিবাদী নয়। কিন্তু ফ্যাসিবাদে স্বৈরাচারী শাসনের সাথে ফ্যাসিবাদী কর্মসূচী থাকে। যেমন সিপিএমের শাসনকালে আমরা স্বৈরাচারী আক্রমণ দেখেছি, কিন্তু সিপিএমের ফ্যাসিবাদী কর্মসূচী নেই। একই কথা তৃণমূল দল সম্পর্কেও প্রযোজ্য। একটা কথা পরিষ্কার হওয়া দরকার আমাদের দেশে ফ্যাসিস্ট শক্তি বলতে একমাত্র আরএসএস-বিজেপিকেই আমরা চিহ্নিত করি।

এই প্রেক্ষিতেই আমরা বিচার করবো বাংলার নির্বাচনকে এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম ও ‘নো ভোট টু বিজেপি’ প্রচারাভিযানের প্রাসঙ্গিকতা। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ১০ শতাংশ ভোট পায়। ৩টে বিধানসভাতে জয়লাভ করে। কিন্তু ২০১৯ লোকসভা ভোটে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটপেয়ে ১৮টি আসনে জয়লাভ করে। অভূতপূর্ব ভাবে শক্তি বাড়ে। তারপরই বাংলা দখলের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে ওরা। বস্তুত বাংলায় ক্ষমতায় না আসলে তাদের ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিজয়রথ আটকে যাবে। তাই বিগত কয়েক মাসে ঘৃণা, কুৎসা ও মিথ্যার রাজনীতিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। সঙ্ঘপরিবার এটা বুঝতে পারে যে বাংলার রাজনীতি, কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতির সাথে তাদের কাজকর্ম খাপ খায় না। তাই চাকাটা উল্টো দিকে ঘোরানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। বিদ্বেষ বিভাজনের মতাদর্শ ও রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এককথায় সারা দেশের সঙ্ঘপরিবারের ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে এই রাজ্যের ভোটের গুরুত্ব অনুভূত হয়।

মতাদর্শ ও রাজনীতিতে যারা অগ্রণী সেই কমিউনিস্টদের যদি সেইভাবে শক্তি থাকতো তাহলে তারা তুল্যমূল্য লড়াই দিতে পারতো যার উপর ভিত্তি করে শ্রমিক শ্রেণী সহ মেহনতি সমাজ ফ্যাসিস্ট হামলার বিরুদ্ধে পথে নামতো। কিন্তু গোটা দেশ সহ রাজ্যে সেই পরিস্থিতি নেই। আবার, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সব ধরনের বামেদের শক্তি ক্ষয় হয়ে চলেছে। কিন্তু একটা ইতিবাচক জায়গা সমাজে গুরুত্ব পায়। সেটা হলো বাম, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো মতামত বা কাজ করলে সমাজে সেটা গুরুত্ব পায়। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম থেকে হোক কলরব বা সাম্প্রতিককালের ভাঙ্গর, এনআরসি-বিরোধী আন্দোলন সেই তাৎপর্য বহন করেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্তরের মানুষজন বিশেষ করে তরুণ-তরুণী, ছাত্রছাত্রী ও মহিলাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদ বিরোধী অবস্থান বেশ তীব্র। এরা ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পথে নেমে লড়াই করতে প্রস্তুত। নভেম্বরে বিহারের নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী জোটের লড়াই গণআন্দোলনের রূপ নেয় এবং তার ফলাফল এরাজ্যের জন্যও অনুপ্রেরণা জোগায়, পশ্চিমবাংলাতেও বিজেপিই প্রধান শত্রু – এই দৃঢ় ঘোষণা প্রত্যয় জাগায়। এই অবস্থায় আমরা কয়েকজন উদ্যোগি হই এরাজ্যে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবী সংগঠন, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে কথাবার্তার ভিত্তিতে। আজকের পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবতায় ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই কি ভাবে হবে এবং নির্বাচনী সংগ্রামে আমাদের অবস্থান কি হবে তা বিভিন্ন স্তরে বিভিন্নভাবে আলোচনা করে স্থির হয় ফ্যাসিবাদ বিরোধী মঞ্চ গড়া হবে। যেখান থেকে জনগণের কাছে ফ্যাসিস্ট শক্তির স্বরূপ উন্মোচন করা হবে। অর্থাৎ জনগণকে ফ্যাসিস্ট শক্তির প্রভাব মুক্ত করার লাগাতার প্রয়াস নেওয়া হবে। অপরদিকে যেহেতু নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতায় আসতে চাইছে, তাদের নির্বাচনে হারানোরও উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কথা ওঠে ফ্যাসিবাদকে কি নির্বাচনের মাধ্যমে পরাস্ত করা যায়? আলোচনাতে স্থির হয় বাংলার নির্বাচনে হারলে ফ্যাসিস্ট শক্তির আগ্রাসন সাময়িকভাবে হলেও প্রতিহত হবে এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী গনআন্দোলন বেগবান হবে।

সঙ্ঘপরিবার যেহেতু বিদ্বেষ বিভাজনের মেরুকরণ করাতে চাইছে তাই তার বিরুদ্ধে ‘বিজেপি বনাম না-বিজেপি’ এই মেরুকরণ করাতে হবে। এই রাজ্যে কাজটা কঠিন ছিল। কারন এখানে রাজ্য সরকারে বিজেপি কোনোদিন ছিল না। কিন্তু অসম্ভব নয়। কারণ শ্রমকোড, কৃষিআইন থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প বেচা, চরম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, এনআরসির নামে লাখ লাখ মানুষকে না মানুষ করা, বিদ্বেষ বিভাজনকে বাড়িয়ে তোলা, নারীসমাজ সম্পর্কে কুৎসিত অবস্থান, ঘৃণা-ভয়-চোখরাঙানি দিয়ে বিরুদ্ধ মতকে আক্রমণ করা, মিথ্যা ভাষণ অনর্গল বলে যাওয়া, উগ্র জাতীয়তাবাদকে অবলম্বন করে যে কাজ সঙ্ঘপরিবার করছে তাকে এ রাজ্যের বহু মানুষ মেনে নিতে পারছেন না। তৃণমূলের শাসনকাল, কিংবা ৩৪ বছরের বাম শাসন নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও এই ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন মানতে পারছিলেন না। সুতরাং এখান থেকেই ‘নো ভোট টু বিজেপি’ শ্লোগান স্থির হয়। আরো স্থির হয় শুধু বিজেপিকে নয়, আরএসএসের বিরুদ্ধেও প্রচার করতে হবে। যেখান থেকে সংগঠনের নাম হয় ‘ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা’।

আমরা বলি, বিজেপিকে ভোট দেবেন না। আবার সঙ্ঘপরিবারের মতাদর্শ ও রাজনীতির স্বরূপও তুলে ধরি।

এই বক্তব্য নিয়ে প্রচার শুরুর সাথে সাথে বহু মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র প্রচার শুরু করেন। অসংখ্য মানুষের সাথে তরুণ-তরুণী ছাত্র ছাত্রীরা প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এটা একটা গণ আন্দোলনের রূপ পায়। এর মানে এটা নয় যে আমরাই করেছি। এর মানে হলো আমরা যে বক্তব্য রেখেছি তা বহু মানুষের মননে প্রবেশ করে। এটা একটা শক্তি হয়ে ওঠে। আমরা যোগসূত্র তৈরি করেছি।

আজ বিজেপি ভোটে পর্যুদস্ত। বিজেপি কি শুধু ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র জন্য পরাজিত হলো? না এটা ঠিক নয়। অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারনের সাথে এটাকেও যুক্ত করতে হবে। আবার এটাও মনে রাখতে হবে বিজেপি এ রাজ্যে ২ কোটির বেশি ভোট পেয়েছে। সুতরাং লড়াই অনেক বাকি আছে। সবশেষে যে কথা না লিখলেই নয়। দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলন এই কাজটাকে অনেক ত্বরান্বিত করেছে। যেভাবে তারা ‘নো ভোট টু বিজেপি’ প্রচার করেছে সেটা আমাদের গোটা কাজকে অনেক অনেক শক্তি যুগিয়েছে। আমরা আরো দৃঢ় ভাবে কৃষক আন্দোলনের পাশে দাঁড়াবো। শুধু এটাই নয় ফ্যাসিবাদ বিরোধী সমস্ত প্রতিবাদী মানুষকে নিয়ে লড়াই চলবে। একমাত্র বাংলাতে নয়। গোটা দেশেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই লড়াই চলবে।

– কুশল দেবনাথ 

Can an improved version of politics

চতুর্দিকে দেখি, যতদূর পর্যন্ত চোখ যায়, খবর এসে কানে পৌঁছায়; বিভক্ত গ্রামসমাজ! ভোটের পর এই বিভাজন চরম আকার ধারণ করে, রক্ত ঝরে মাটির বাড়িগুলিতে। কেউ মারতে আসে, কেউ বাঁচার চেষ্টায় লাঠি ধরে। ঘটনা ঘটে। সত্যি মিথ্যা মিশিয়ে এফআইআর হয়। হাজারে হাজারে খেতমজুর, তপশিলিভুক্ত দরিদ্র মানুষ রাতের বেলা পুলিশী হামলার ভয়ে মাঠের মধ্যে দিন কাটায়। আসল অপরাধীরা সাবধানে থাকে। সাধারণ মানুষকে পুলিশ শাসকের চাপে জেলে ঢোকায়।

আহত মানুষের চিকিৎসা হয় না। কারণ তাতে শাসক ভুক্ত অপরাধীর অপরাধের প্রমাণ পোক্ত হয়! যারা আজ মার খাচ্ছে, ঘরছাড়া; বিজেপি জিতলে হয়তো তারা উল্টো পক্ষের উপর এর চেয়েও বেশি করতো! হয়তো কেন বলছি, সত্যিই করতো।

“খেলা হবে” -এর দুই পক্ষই গরিব মানুষ- এসসি, আদিবাসী, খেতমজুর! এক অশুভ চক্রব্যুহে এরা ফেঁসে গেছে সবাই। সেই গত শতকের ৯০-এর দশক থেকে। চলছে খেলা। রক্তাক্ত কৃষিভূমি – পুনরাবৃত্তিই শুধু দেখছি, দেখে চলেছি।

এই দিগন্ত বিস্তৃত হিংসায় লাভ আছে অনেকের। দরিদ্রদের মধ্যে মুখিয়া দুই একজন আর উপরের ভদ্রলোক নেতা। বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করতে পারলে পঞ্চায়েতের উপর দখলদারি নিশ্চিত!

এবারের নির্বাচনী যুদ্ধ কোনো সাধারণ লড়াই ছিল না। এটা ছিল ফ্যাসিবাদকে আটকানোর লড়াই। বিজেপির হাত থেকে বাংলা বাঁচানোর লড়াই। গত দশ বছর কোনায় কোনায় বিস্তৃত যে দুর্নীতি আর দমনের সাক্ষী গ্রাম, তাতে এই নির্বাচন জেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে সহজ ছিল না।

মহারণ শেষে এই যে বিজেপি-বিরোধী মহারায়, তার কারণ এটা ছিল ফ্যাসিস্ট বিরোধী সকলের লড়াই। ধনেখালির লড়াই যদি দেখি, তবে এখানে টিএমসি বিরোধী ভোট এক লক্ষ। এরা মূলত গরিব। এরা ঘরছাড়া, সন্ত্রস্ত। এই যদি চলতে থাকে তবে বিজেপির পক্ষে কিছু দিনের মধ্যেই মাটি ফিরে পাওয়া কঠিন হবে না।

অশুভ চক্রমুক্তি কিভাবে সম্ভব? এমনটা ভেবে যে ফ্যাসিবাদ তো হেরেছে, সুতরাং যারা মার খাচ্ছে ঠিকই আছে। নাকি দরিদ্র মানুষকে শুধুমাত্র ফ্যাসিবাদের বিপদ বুঝিয়ে? নাকি অপেক্ষা করে? আগে ওরা মার খাক। পরে দেখা যাবে! নাকি আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে?

সরাসরি পাশে না থেকে রাজনীতির উন্নত ভার্সন মাটিতে শিকড় মেলতে পারে?

এর সন্ধান করতে হবে ফ্যাসিবাদ বিরোধীদের। অবশ্যই পেতেও হবে।

গত পরশু ধনেখালি ১ নম্বর পঞ্চায়েতের তালবোনা মুদিপাড়ায় (দিনমজুর পাড়া) দুটি টিউবওয়েল থেকে বিরোধী দলের লোকেদের জল খাওয়া নিষিদ্ধ করে তৃণমূল। আমরা হস্তক্ষেপ করি। কল খোলে। ওদের রাগ বাড়ে।

গতকাল এক আশা কর্মী মহিলার বাড়ির উপর হামলা করে। “কেন বিরোধীদের পরিষেবা দিয়েছো” কুৎসিত গালিগালাজ করে। আমাদের সাহসে ওই আশা কর্মী পুলিশে জানায়। আবার গ্রামে পুলিশ ঢোকে।

সন্ধ্যার সময় গ্রামের অত্যাচারিত মেয়েরা কমরেড রুমা আহেরীর বাড়ি জড়ো হন। আমাদের সাথে কথা বলতে চান। সে সময় ছিলাম পাশের বেলমুড়ি পঞ্চায়েতের এক আদিবাসী পাড়ায়, মল্লিকপুরে, যেখানে এক আদিবাসী মহিলা আগের দিন খেতের কাজ শেষে, খাবার জন্য কলে বাসন ধুতে গিয়ে শাসক দলের বাইক বাহিনীর আচমকা হামলায় মাথায় মারাত্মক আঘাত নিয়ে শয্যাশায়ী!

আগামীকাল হসপিটালে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে জয়হরিপুর পৌঁছে কমরেড সজল দে, কমরেড সম্রাট মাহেলী সহ যাওয়া হল তালবোনা। সেখানে আলোচনা চলছিল বিজেপির রাজনীতি কেন পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী সাফল্য পেল না; কেন আমাদের একসাথে গরিব মানুষের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে – এসব নিয়েই।

আধঘণ্টার মধ্যেই খবর এলো, শাসক দলের লোক বাইরে জমায়েত করছে। আমরা চলে গেলেই এই বাড়িতে হামলা করবে।

স্বভাবতই আমরা থেকে যাওয়া স্থির করলাম। ওরা আর কতো অপেক্ষা করবে! বাড়িতে হামলা করলো। আমাদের বাইক দুটো ভাঙ্গলো। কমরেড রুমাদির ছাদের অ্যাসবেসটস চাল ভাঙ্গলো। এরপর ঘরে ঢুকে রুমাদিকে টেনে বাইরে বার করতে চাইলো। দ্রুত দরজার মুখেই আমরা বাধা দিলাম। প্রায় মিনিট ১৫। ওরা যখন কিছুতেই ঘরে ঢুকতে পারলো না, তখন আমাকে ও কমরেড সজল দে’কে টেনে বাইরে বার করতে চাইলো। আমাদের দুজনেরই জামা ছিঁড়ে দিলো। এরা জনা দশেক মেয়ে! দরিদ্র পরিবারের। এরা সবাই জানে বিজেপির বিরুদ্ধে আমাদের প্রচার যুদ্ধ। এই পাড়াতেও মাইক নিয়ে “বিজেপিকে একটাও ভোট নয়” সভা করেছি আমরা। ফলে জাতশত্রু জ্ঞান করতে পারছে না!

এরা পেরে উঠছে না দেখে এতক্ষণ পরে মেঘের আড়াল সরিয়ে সামনে উদয় হলো বুথ সভাপতি মেঘনাদ, মেঘনাদ আহেরী। সজলকে বললো, কেন এসেছিল! আমাকে বললো, তোমাকে জ্যান্ত ফিরতে দেবো না।

ইতিমধ্যে আমাদের টানাটানি করছে দেখে পুলিশে ফোন করি। মিনিট তিরিশের মধ্যে পুলিশ ঢোকে। ওরা গা ঢাকা দেয়!

আমরা ঠান্ডা মাথায় ধৈর্যশীল চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক বড়ো ঘটনা ঘটতে পারতো কালকে। বিশেষত একবার যদি প্রতিরোধটা ভেঙ্গে পরতো! ওদের সবার হাতে ছিল চ্যালা কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি।

ফ্যাসিবাদকে রুখতে গেলে চাই গণতন্ত্র, চাই গণতন্ত্রের শক্তিশালী ভূমিকা – আক্রান্ত গ্রামে, মানুষের পাশে এবং উপরে রাজধানী শহরে, জেলা শহরে, ব্লক সদরে সাহসিক বহুমুখী উদ্যোগ। আমরা কি পারবো?

না হলে ৭৭ এমএলএ সহ শক্তিশালী বিরোধী অবস্থানে থাকা বিজেপির পক্ষে খোলা মাঠ পড়ে থাকছে। সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ এবং গণতন্ত্রের জন্য মানুষের হাহাকারকে ফ্যাসিবাদ তার পক্ষেই কাজে লাগাবে।

মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী আজ শপথ নিলেন। গণতন্ত্র রক্ষা করা হবে বললেন।

পারবেন কি গ্রামস্তর পর্যন্ত কর্মী বাহিনীকে সামলাতে? নাকি বিভক্ত গ্রামসমাজ অশুভ শক্তির মৃগয়াক্ষেত্র, চারণভূমিই থেকে যাবে?

সজল অধিকারী
ধনেখালি, হুগলি, ৫ মে ২০২১

Tathagata Roy

বিরুদ্ধ দলের মহিলা প্রার্থীদের অবমাননা, তাদের প্রতি নারীবিদ্বেষী মন্তব্য ভোট প্রচারে নতুন নয়। ঊনত্রিশটি দেশে সমীক্ষা করে দেখা গেছে যে ৪৪% মহিলা রাজনীতিবিদদের খুন, ধর্ষণ বা অপহরণের হুমকি পেতে হয়, বা সত্যিই এসব অপরাধ ঘটে তাঁদের সঙ্গে।

পশ্চিমবঙ্গের সদ্য সমাপ্ত বিধান সভা নির্বাচন থেকেও তার ভুরি ভুরি নিদর্শন তুলে আনা যায়। যেমন নন্দীগ্রামে যেতে গেলে আটকে দেওয়া হয় মহিলা প্রার্থী মীনাক্ষী মুখার্জীকে আর বলা হয়, তাঁর আসার কথা ‘আগে জানলে ভয়ংকর পরিণতি হত’৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নারী হওয়ার তাঁকে ঘিরে নারীবিদ্বেষী মন্তব্যও কম হয়নি৷ সম্প্রতি খবর, যে সুরে প্রধানমন্ত্রী ‘দিদি, ও দিদি’ বলে মুখ্যমন্ত্রীকে ডেকেছিলেন দু-একটি জনসভা থেকে, সেই সুর নাকি ভারি পছন্দ হয়েছে এ রাজ্যের রাস্তার রোমিওদের। সেই সুরেই তারা মহিলাদের উত্যক্ত করছেন আজকাল।

ওদিকে মুখ্যমন্ত্রীর তথাকথিত ‘চোট পাওয়া’ পাটি সভায় ঈষৎ তুলে রাখতে হচ্ছে বলে, গোড়ালি দেখা যাচ্ছে বলে, বিরোধী দলের রাজ্য সম্পাদকও মুখ্যমন্ত্রীকে বারমুডা পরার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এসব ভোটের আবহে নিত্যদিনের চক্ষু কর্ণের যন্ত্রণার কারণ।

কিন্তু নিজেরই দলের নারী প্রার্থীদের বারংবার অপমান করার, প্রায় স্লাট-শেইম করার নজির গড়েছেন বিজেপির অন্যতম ‘শিক্ষিত’ নেতা, মেঘালয়ের প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায়। তিনি এর আগেও তাঁরই দলের নারী প্রার্থীদের ‘নগরীর নটী’ বলে সম্বোধন করেছিলেন৷ তাঁরা দোলের দিন বিরুদ্ধ দলের এক নেতার সঙ্গে সেলফি তুলেছিলেন। সে কারণেই আক্রোশ। বাক্যবন্ধটি যে রবীন্দ্রনাথের ‘অভিসার’ কবিতা নেওয়া নেওয়া তা বাঙালি মাত্রেই জানে। বাসবদত্তা সম্পর্কে কবি বলেছিলেন, ‘নগরীর নটী চলে অভিসারে যৌবন মদে মত্তা’। যদিও বাসবদত্তার কালে বেশ্যারা ছিলেন নগরে সম্মাননীয়া। তাঁদের বৃত্তিকেও হীন ভাবা হত না৷ কিন্তু বাসবদত্তার ‘যৌবন মদে মত্তা’ অভিসারী রূপটি একজন মহিলা রাজনৈতিক প্রার্থীর উপর আরোপ করা কতটা যুক্তিসঙ্গত, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সে নারীরা আবার বক্তার নিজেরই দলের প্রার্থী। তাঁরা অভিনয় জগত থেকে এসেছেন বলেই কি তাঁদের ‘নগরীর নটী’ বলা হল? কিন্তু বাসবদত্তার কাল আর এ কাল তো সমান নয়। এ কালে নটীরা আবশ্যিক ভাবে বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বনও করেন না৷ আবার বেশ্যাবৃত্তিও তার সম্মান খুইয়েছে। যতই যৌনকর্মকে শ্রমের মর্যাদা দেওয়ার দাবি তোলা হোক, আম্রপালি বা বাসবদত্তার মতো সম্মান পান না আজকের যৌনকর্মী। তাই সে সব রেফারেন্সে কোনো নারী অসন্তুষ্ট হতেই পারেন। অনভিজ্ঞ প্রার্থীদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে বর্ষীয়ান নেতার বক্তব্য থাকতেই পারে। কিন্তু তিনি যেন নারী হিসেবেই তাদের খাটো করে দেখতে তৎপর, যেন ‘নগরীর নটী’ বা যৌনবস্তু বা পার্টির শোকেসে সাজানোর জন্য সুদৃশ্য সামগ্রী ছাড়া কিছু ভাবতেই পারছেন না।

কার্যক্ষেত্রে অবশ্য দেখা গেল, নারীবাদী কর্মী ও নাগরিকরাই তথাগতবাবুর এই দুর্বিনীত টুইটারের নিন্দা করলেন। আক্রান্ত প্রার্থীরা নীরব থাকলেন বা অতি মৃদু প্রতিবাদ করলেন।

এরপর ভোট হল। ফলও বেরোলো। ফল বেরোনোর পর ক্রুদ্ধ তথাগত রায় একই বাক্যবন্ধ ব্যবহার করে আবারও ফেসবুকে পোস্ট করলেন। এবারের পোস্টটি ছিল এরকম : ‘পায়েল শ্রাবন্তী পার্নো ইত্যাদি ‘নগরীর নটীরা’ নির্বাচনের টাকা নিয়ে কেলি করে বেড়িয়েছেন আর মদন মিত্রর সঙ্গে নৌকাবিলাসে গিয়ে সেলফি তুলেছেন (এবং হেরে ভূত হয়েছেন) তাঁদেরকে টিকিট দিয়েছিল কে? কেনই বা দিয়েছিল? দিলীপ-কৈলাশ-শিবপ্রকাশ-অরবিন্দ প্রভুরা একটু আলোকপাত করবেন কি?’

অর্থাৎ হারের দায় চাপালেন প্রার্থীর উপর। অযোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের দায় চাপালেন ‘কারিয়াকর্তা’-দের উপর। কিন্তু ‘কেলি,’ ‘নৌকাবিলাস’ আর ওই ‘নগরীর নটী’ কথাগুলি থেকেই গেল স্লাটশেমিং-এর দ্যোতক হয়ে। প্রশ্ন জাগে, পরাজিত পুরুষ প্রার্থীদেরও কি একই ভাষায় ভর্ৎসনা করেন তথাগতবাবু? বলা বাহুল্য, করেন না।

এ বিষয়ে অন্যতম পরাজিত প্রার্থী তথা অভিনেত্রী শ্রাবন্তীর প্রতিক্রিয়া অবশ্য তাড়াতাড়িই পাওয়া গেছে। তিনি ‘পার্টির টাকা’ ওড়ানোর অভিযোগের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। বাকি অংশটুকু সম্পর্কে নীরবই থেকেছেন।

মেয়েরা যে কেবল পুরুষের সন্তান উৎপাদন, যৌনসুখ প্রদান এবং গৃহকর্মের সাধনের জন্য, এই মনোভাব বিজেপির আদর্শগত উৎসমুখ আরএসএস কখনও গোপন করেনি৷ আরএসএস যে দুর্গাবাহিনী পরিচালনা করে, বিজেপির আছে যে মহিলা মোর্চা, তা নারীর এই সনাতনী রূপকেই তার শক্তির উৎস বলে মানে। এই ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক দলে মহিলারা তবু যোগ দেন, এই দলের হয়ে মহিলারা তবু ভোটে দাঁড়ান, ঠিক যেভাবে অনেক মহিলাই সমাজে ও পরিবারে পিতৃতন্ত্রের বাহক হয়ে ওঠেন, পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচারক হয়ে ওঠেন। এ বড় দুর্ভাগ্যের বিষয়।

আমাদের আরও ভাবা দরকার, যে দলের একজন অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত নেতাই অহরহ স্লাট শেইম করতে থাকেন, তাও আবার নিজেরই দলের প্রার্থীদের, সেই দলের ৭৭ জন বিধায়ক বিধান সভায় থাকাটা কতটা কাঙ্ক্ষিত, তা নারী নাগরিকদের জন্য কতটা হিতকর। চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম, তাই নিজের বাড়ির নারীদের সম্মান করার শিক্ষার মাধ্যমেই লিঙ্গসাম্যের দীক্ষা শুরু হয়। যে দল নিজের দলের মেয়েদেরই যোগ্য সম্মান দিতে অক্ষম, সে কীভাবে গোটা দেশের মেয়েদের সম্মান দেবে কী করে? কী করেই বা তাদের অধিকারের লড়াই-এ ভূমিকা নেবে?

– শতাব্দী দাশ  

Raghunath Murmu

৫ মে পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর জন্মদিন। ছোটবেলা থেকেই তিনি অনেককে প্রশ্ন করেন সকলেই নিজের ভাষায় লেখা পড়া করতে পারলেও সাঁওতালরা পারে না কেন? বড়ো হয়ে বুঝতে পারেন এর কারণ তাদের কোনো লিপি নেই। তিনি বুঝেছিলেন সাহিত্যের বিকাশ ছাড়া কোনো জাতির বিকাশ অসম্ভব আর সাহিত্যের বিকাশের জন্য দরকার লিপি। আর তাই তিনি অসম্ভব পরিশ্রম করে তৈরি করেন সাঁওতালি ভাষার নিজস্ব লিপি অলচিকি। এই ভাষায় তিনি ছোটদের ছড়ার বই ধারাপাত, নাটক ও কাব্যগ্রন্থ লিখেন। স্বাধীনতার পর ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠনের সময় সাঁওতালদের আলাদা রাজ্যের জন্য ১৯৪৮ সালে উড়িষ্যার ময়ুরভঞ্জে তিনি সাঁওতালদের এক জমায়েতের ডাক দেন। স্বাধীন ভারতের পুলিশ ওই জমায়েতের উপর গুলি চালিয়ে অনেক মানুষকে হত্যা করে এবং তাদের নেতা রঘুনাথ মুর্মুকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু মানুষ লুকিয়ে রাখার জন্য পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। রঘূনাথ মুর্মু সারা জীবন আদিবাসীদের হাসা-ভাষা-লায় লাকচারের জন্য লড়াই করে গেছেন। আজ আবার নতুন করে আদিবাসীদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। জল-জঙ্গল-জমি থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ ও শিক্ষার জগৎ থেকে তাদের বের করে দেবার জন্য নানান ফন্দিফিকির আঁটছে। তাই আজকে নিজেদের হাসা-ভাষা-লায় লাকচারের লড়াইয়ের জন্য নতুন করে শপথ নিতে হবে।

(লেখাঃ পার্টির বাঁকুড়া জেলা ফেসবুক পেজ থেকে।

comrade Apuda

তখন বছর ছয় সাত হবে। আমাদের বাড়ির পাশে বিনয় কাকুদের বাড়িতে বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে একজন ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা আসতেন। ভদ্রলোক পাজামা পাঞ্জাবি পড়া মাঝারি হাইটের।

বেশ কিছু বছর পরে শুনেছিলাম ওনারা ‘নকশাল’ করেন। সম্পর্কে বিনয় কাকুদের কাকা কাকিমা। তারপর বিভিন্ন কারণে অনুষ্ঠান কমতে থাকলো। ওনাদের আসা যাওয়া অনিয়মিত হয়ে গেলো কি? জানিনা ঐ সময়ে জানার যে বিশেষ তাগিদ অনুভব করেছিলাম তাও না। পড়াশোনা, বন্ধু, ক্রিকেট, আড্ডা নিয়ে দিব্যি ছিলাম। উচ্চমাধ্যমিকের পরে কলেজে স্বাধীনতা-সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্রের পতাকায় তখন বিকল্প দিনের ভাবনা। বিপ্লবের হাতছানি! নকশালবাড়ি সম্পর্কে বই তখন নিজের আগ্রহেই সংগ্রহ করতে শুরু করেছি। ২০০৭ নন্দীগ্রামের ঘটনায় কেমন যেন সব নড়ে উঠলো। ততদিনে অবশ্য ভোটে দাঁড়িয়েছি সিআর হওয়ার তীব্র ইচ্ছাশক্তি তখনও খানিক বাকি ছিলো বোধহয়। তারপর একদা এসএফআই নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধ, যুক্তি পাল্টা যুক্তির কলেজ গেট পেরিয়ে যখন সত্যি বিকল্প খুঁজছি। কমরেড কৃষ্ণ তখন রাতদিন এসএমএস করে আমাকে ভাবনার রসদ যোগাচ্ছে। কমরেড প্রদীপণ কখনও এপিডিআর কখনও পার্টি পত্রিকার পুরোনো নতুন সংস্করণে আমার সঙ্গের ব্যাগটি ওজন সামান্য হলেও বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। বাড়িতে সকলে সিপিএম’র সদস্য। আমিও তো এই পর্যন্ত পাড়ায়, পথসভায়, মিছিলে প্ল্যাকার্ড, পতাকাগুলা সামলেছি। তাহলে আমি কি বাড়িতে না জানিয়ে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম। লড়াইটা জারী রাখবো লাল পতাকাটাও থাকবে তবে ছোটো থেকে যা বোঝানো হয়েছে, এতদিন যা আলটিমেট বলে জানতাম, সেই বৃত্তের বাইরে বেড়িয়েই ভাববো যা ভাবার। বেশ কিছুদিন ধরে পার্টি অফিসে যেতে শুরু করেছি। ২০১২-র ফেব্রুয়ারীর কোনো একদিন সকালবেলা হঠাৎই ফোন

আমি বিনয়ের কাকা বলছি, তুমি শাশ্বতী?
হ্যাঁ কিন্তু?
আমি অপু চতুর্বেদী।
ও আচ্ছা, আমি তোমার কথা শুনেছি।
একটু কথা বলতাম তোমার সাথে।
হ্যাঁ বলুন,
না ফোনে হবে না,
তবে?
অমুক দিন, (এত বছরে ডেট আর মনে নেই) ফকটচাঁদ প্রাইমারি স্কুলে ডাবগ্রাম ফুলবাড়ি লোকাল কমিটির সম্মেলন আছে তুমি চলে এসো।
কিন্তু আমি,
এসো কিছু হবে না আমি বলছি।  

সেই শুরু। অপুদার জন্যই সেইদিনই মেম্বারসিপের ফর্মফিলাপ করেছিলাম। প্রথম যেদিন ডাবগ্রামে অপুদার ভাড়া বাড়ির কাঠের ঘরটায় গিয়েছিলাম অনেক টুকরো টুকরো কথা শিলিগুড়ি বিভিন্ন জায়গায় সত্তরের দশকের গল্প, রাস্তার পাশে দেয়াল দেয়ালে স্টেনসিলে মাওয়ের মুখ, এক শেল্টার থেকে আরেক শেল্টার। অপুদার জেলে থাকার গল্প শুনতে শুনতে বারংবার শিহরিত হচ্ছিলাম।

সেদিন কত কি জানতে চেয়েছিলাম। হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছিলেন। উত্তর দিতে দিতে কখনও সামান্য উত্তেজিত হচ্ছেন, থামছেন আবার বলছেন।

এভাবেই দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়েছিল সেদিন। মুক্তির দশকের আবহমান উত্তাপের আঁচ কি সেদিন খুঁজেছিলাম আমি অপুদার মুখে, হয়তো! সবশেষে অপুদা টেবিলের ড্রয়ার খুলে কাপড়ে মোড়ানো দুটো বই বার করে আমার হাতে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন পড়ে ফেরত দিও কিন্তু সেই যে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের দিনগুলোর অন্যতম ভালোলাগা সঙ্গে নিয়ে চলা ‘রেডবুক’ তখন আমার হাতে, সঙ্গে জলার্কের চারু মজুমদার সংখ্যা-১। অপুদার কাছে শুনেছি সেকেন্ড সিসি করার সময়ের অভিজ্ঞতা। সঙ্গে থেকে দেখেছি নকশালবাড়ি থেকে শিলিগুড়ি গ্রামে গঞ্জে সত্তরের সময় থেকে এ সময়ের নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষগুলোর সঙ্গে ওনার সখ্যতা। কমরেড চারু মজুমদার সম্পর্কে বলতে শুরু করলে থামতেই ভুলে যেতেন। জমির পাট্টা থেকে রাস্তা, ড্রেন, সংস্কার, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ডাবগ্রাম ফুলবাড়ির সম্পাদক কমরেড অপু চতুর্বেদী মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে ছুঁড়ে শ্লোগান দিতেন অক্লান্ত। মনে পড়ছে শক্তিগড় ব্রাঞ্চ কমিটির শুরুর দিনগুলির কথা। প্রায় শূন্য থেকে আরম্ভ হওয়া একটি স্বপ্নের সময়ে কখনও ঘন্টাখানেক ফোনে কখনও ভর দুপুরে বাড়িতে এসে উৎসাহ দিয়ে গেছেন; হবে হবে ঠিক হবে লেগে থাকো। মতানৈক্য হয়েছে বারবার। তবুও তা, টেঁকেনি বেশিদিন। কেউ একজন আবার স্বাভাবিকভাবে কথা বলে ফেলেছি সব ভুলে। পার্টি অফিসের মাথার ওপর নতুন টিন, নতুন দরজা জানালা নিয়ে বর্তমানের খানিক নতুন চেহারা, তা তো অপুদাই দাঁড়িয়ে থেকে করালেন। এই তো সেদিনও পার্টি অফিসে অপুদা যখন শানুদার দোকানে চায়ের অর্ডার দিতে যাচ্ছেন বললাম খিদে পেয়েছে শুধু চায়ে হবেনা। হাসিমুখে কেক বিস্কুট এনে হাজির করলেন। গত মাসের ২৬ তারিখ সুমন্তি’র নমিনেশনের দিন বাইরে আমাদের পেটে তখন ইঁদুর লম্বা লম্বা লাফ দিচ্ছে। বসেছিলাম একজায়গায়। দেখি অপুদারা কি যেন খাচ্ছেন, বললাম এটা কি হলো? সঙ্গে সঙ্গে শশা মেখে নিয়ে এলেন। মিছিলে বা রাস্তায় কোনো উঁচু জায়গাতে ঠিক এসে সহযোদ্ধার হাতটা বাড়াতেন। এই তো ৮ এপ্রিল ফাঁসিদেওয়াতে সুমন্তি’র সমর্থনে রোড-শোতে একসাথে বসে খেলাম কমরেড – গল্প হলো – শ্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে নিয়ে চললেন লড়াইয়ের গাড়ি। মিছিল এগিয়ে চলেছিল শ্লোগানে শ্লোগানে আপনাদের লড়াইয়ের নির্যাসটুকুকে সঙ্গে করে। চেনা রাস্তা আলপথ পেরিয়ে পৌঁছে তো গেছিলাম কমরেড আমরা – আর একটু লড়াই যে খুব দরকার ছিলো কমরেড। আপনি বলেছিলেন তিনটে দিন সবসময় মনে রেখো আটাশ জুলাই বাইশ এপ্রিল ঊনিশ মার্চ। ভুলিনি কমরেড কিন্তু ‘সাতাশ এপ্রিল ২০২১’ তারিখটাও এভাবে মনে গেঁথে দিয়ে গেলেন অপুদা – ঠিক হলো না – ঠিক …!

লড়াইটা জারি থাকবে কমরেড আপনার দেখানো পথেই।

লাল সেলাম কমরেড অপু চতুর্বেদী।।
কমরেড অপু চতুর্বেদী অমর রহে।।

- শাশ্বতী সেনগুপ্ত 

Covid snatched Sudipta

গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির(এপিডিআর) রাজ্য নেতা তথা মানবাধিকার কর্মী সুদীপ্ত সেন ৬ মে ২০২১ রাত ৯-৪৫ মিনিটে করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হলেন। আমরা হারালাম এক নির্ভীক লড়াকু মানবধিকার কর্মীকে। হারালাম এক অসীম দরদী মানবিক সহযোদ্ধাকে। এ ক্ষতি অপূরণীয়।

“সুদীপ্তর বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল। গণ আন্দোলন, নাগরিক আন্দোলন ও অধিকার আন্দোলনের মিটিং পয়েন্ট নিয়ে। কথা বলতে বলতে একটু আসি বলে চলে গিয়ে ৩-৪ মিনিটের মধ্যে চলে আসলো। ওর বাড়ির নীচের মিষ্টির দোকানটা ওদের। কিন্তু সুদীপ্ত মিষ্টি খায় না। ওর মধুমেহ (ডায়াবেটিস) আছে। আমাদের কথা বলার উপলক্ষ্য ছিল জঙ্গলমহলের গণআন্দোলন ও জাগরণের পরিণতি নিয়ে। অত্যন্ত প্রাণবন্ত, পরিশ্রমী, এক সহযোদ্ধার এভাবে চলে যাওয়া খুবই বেদনার। লাল সেলাম কমরেড সুদীপ্ত।” – হাসপাতালের বেড থেকে লিখে পাঠিয়ছেন কমরেড পার্থঘোষ।

“সুদীপ্ত নেই ভাবতে পারছি না। দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব। লেক গার্ডেন্সে সুদীপ্তর বাডিতে বহুদিনের যাতায়াত ছিল। একসময় ও পার্টি ইউনিটির সাথে যুক্ত ছিল। মানবাধিকার আন্দোলনর এক নিরলস কর্মী ছিলেন। লকডাউনের প্রথম পর্যায়ে বহু কর্মসূচীতে একসাথে ছিলাম। নির্বাচনের আগে বাঘাযতীন – সুলেখায় এপিডিআর আহুত কর্মসূচীতে সুদীপ্তর সাথে চলেছি। বড় বেদনাদায়ক এই মৃত্যু। গভীর শোক ও সমবেদনা রইল। সুদীপ্ত সেন অমর রহে।” – বাসুদেব বসু

“ঠিক গতবছরের অভিজ্ঞতা যেন ফিরে এলো – ফাঁকা স্টেশন, ফাঁকা ট্রেন ! কোভিড অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ আরও আতঙ্ক, আরও আঘাত নিয়ে ফিরে এসেছে। গতবার বহু বিখ্যাত মানুষদের কেড়ে নিয়েছিল এই মারণ রোগ, এইবারেও শঙ্খ ঘোষ প্রয়াত হলেন এই রোগে, গতকাল রাতে প্রয়াত হলেন এপিডিআর-এর সহ সভাপতি সুদীপ্ত সেন। আমার বহু সহকর্মীকে হারিয়েছি এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে। অক্সিজেনের অভাব, ওষুধের অভাব, ভ্যাকসিনের অপ্রতুলতা, বেডের হাহাকার সব মিলিয়ে সরকারের ব্যর্থতা প্রকট। ভোটের সময় রাজনৈতিক নেতাদের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা প্রত্যক্ষ করেছি আমরা, সেই ফল আরও বহুদিন ভুগতে হবে আমাদের। এখন আবার ট্রেন বন্ধ হওয়াতে হকার থেকে শুরু করে, শহরে কাজ করতে যাওয়া অসংগঠিত শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, অফিস কর্মচারীরা কাজ এবং মজুরি হারাবেন। শুনছি জুলাইয়ে নাকি তৃতীয় ঢেউ আসবে – ঢেউ তো নয় যেন একেকটা সুনামি। এই সময়ে কোভিডের বিরুদ্ধে সমবেত লড়াইটা সবচেয়ে জরুরি, জরুরি কাজ হারানো মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। এই সময় সন্ত্রাস আর দাঙ্গা যারা করতে চাইছে তাদের ক্ষমা নেই।”

- সংগ্রাম ভিয়েত স্ফুলিঙ্গ

Pradeep Banerjee

বাসুদেব বসুর বার্তা

দীর্ঘদিনের পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ প্রদীপদার প্রয়াণে গভীর শোক ও সমবেদনা রইল। প্রদীপ ব্যানার্জি ৭০ দশকের নকশালবাড়ী আন্দোলনের নেতা ছিলেন। অবিভক্ত পিসিসিসি সিপিআই(এমএল)-এর নেতা ছিলেন। বহু গণ আন্দোলনে প্রদীপদার সাথে চলার স্মৃতি আছে। গতবছর সেপ্টেম্বর মাসে তালতলা শহীদ স্মৃতি রক্ষার কর্মসূচীতে শেষ দেখা হয়েছিল। প্রদীপদা পরবর্তীতে তৃনমূল দলের ট্রেড ইউনিয়ন INTTUC র সসর্বভারতীয় সভাপতি ছিলেন। প্রদীপদার প্রয়াণে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা।

কমরেড কার্তিক পালের পাঠানো শোক বার্তা

প্রদীপ ব্যানার্জি এক সময়ে (৭০ দশকে) ডেবরা গোপীবল্লভপুর জোনে সিপিআই(এমএল)-এর কাজ করেছেন। ধাক্কা পরবর্তী পর্যায়ে পিসিসি সিপিআই(এমএল)-এর হয়ে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। পিসিসি বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে আমার সাথে একবার দেখা করেন। খোলামেলা, উদার ও মানবিক বোধ সম্পন্ন ছিলেন। সিঙুর-নন্দীগ্রামের কৃষক আন্দোলনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় তূলমুল কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হন। আমরা যখন সিংগুরে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে মেট্রোর চ্যানেলে অবস্থানে বসি তখনই প্রদীপ ব্যানার্জি ও মুকুল রায়-রা আমাদের অবস্থান মঞ্চে আসে কথা বলতে। একসাথে মমতা ব্যানার্জিরা আলাদা করেই পাশে বসতে চান। আমরা আপওি করি। সেই সময়ে প্রদীপ ব্যানার্জি বারবার অনুরোধ করে। তখন থেকেই তৃণমুলের সাথে যুক্ত। অনেক বার দেখা হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতেন। বন্ধুর মতো ব্যবহার করতেন। সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। মৃত্যুর খবর শুনে আঘাত পেলাম, একজন ভালো বন্ধুকে হারালাম।

অপূর্বমুক্তিকামীর স্মৃতিচারণ

গতকাল রা‌তে সুদীপ্তদা, আজ সকা‌লে প্রদীপদা, দু’জ‌নেই যাদবপু‌রের কে‌পি‌সি‌তে। সুদীপ্তদার জন‌্য আজ সকা‌লে লাল পতাকা মে‌লে লাল সেলাম জা‌নি‌য়ে‌ছেন যাদবপু‌রের সাথীরা, কো‌ভিড তো, তাই শেষ মি‌ছিল করা যায়‌নি। প্রদীপদা‌কে আ‌গে চিনতুম, তালতলার কম‌রেড প্রদীপ ব্যানার্জী‌কে তো চিন‌তেই হ‌বে। কিন্তু প্রদীপদার স‌ঙ্গে যখন প্রথম ভা‌লো ক‌রে কথা হল তখন আর কম‌রেড বল‌তে পা‌রি না, প্রদ‌ীপদা ডানকু‌নি হাউ‌সিং‌য়ে থাক‌তেন, এক‌দিন ডানকু‌নির চা‌য়ের দোকা‌নে কথা হল, মা‌নে তর্কই হ‌লো, প্রদীপদা তো তখন আইএন‌টি‌টিইউ‌সি-র ব‌ড়ো নেতা, মা‌নে রা‌জ্যের শাসকদ‌লের প‌ক্ষের লোক, ফ‌লে যা হয় আর কী। চেনা ম‌ানুষরা সব হা‌রি‌য়ে যা‌চ্ছে, আর তো রাস্তায় হাঁট‌তে হাঁ‌ট‌তে হঠাৎ দেখা হ‌বে না, চা‌য়ের দোকা‌নে চেঁ‌চি‌য়ে বল‌তে পার‌বো না, “কম‌রেড কাজলের কথা এখন আপ‌নি ব‌লেন কী ক‌রে?”, সে‌দিনের আমার বলায় যে ঔদ্ধত্য ছিল সেট‌াও আর স্বীকার কর‌ার সু‌যোগ রই‌লো না।

- সমাপ্ত -

খণ্ড-28
সংখ্যা-16