আজকের দেশব্রতী : ২২ জুলাই ২০২১ (অনলাইন সংখ্যা)
22 July Deshabrati online paper

2021 July 28 pledge_0

২০২১’র ২৮ জুলাই কমরেড চারু মজুমদারের হেফাজত হত্যার ৪৯তম বার্ষিকী আর সিপিআই(এমএল) পুনর্গঠনের ৪৭তম বার্ষিকী। ১৯৭০ দশকের প্রথমভাগের সেই ঝোড়ো দিনগুলি ১৯৭৫’র কুখ্যাত জরুরি অবস্থায় গিয়ে চূড়ান্ত রূপ নেয়। তখন থেকে প্রায় পাঁচ দশক অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখন ভারতীয় রাষ্ট্র জরুরি অবস্থার সেই নিপীড়নের পালা নিয়ে আবার মঞ্চে হাজির হয়েছে। এবারের পালার নিষ্ঠুরতা ও নিপীড়নের মাত্রা অবশ্য ব্রিটিশ যুগকে লজ্জা দিচ্ছে।

নিপীড়ন এতটাই বেআব্রু এততাই উচ্চকিত যে মোদী সরকারকে এমনকি আদালতকেও স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে যে তাদের নির্বিচার নিপীড়ন গণতন্ত্রের সাংবিধানিক কাঠামোর সাথে মোটেই খাপ খাচ্ছে না। বিরুদ্ধতা ও প্রতিবাদ করার অধিকার যে গণতন্ত্রের মূল স্বীকৃতি তা দিল্লী হাইকোর্ট তুলে ধরল। সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে প্রশ্ন করল কেন স্বাধীনতার সাত দশক পরেও ঔপনিবেশিক যুগের রাজদ্রোহ আইন দরকার পড়ছে।

রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবি এবং ঔপনিবেশিক যুগের রাজদ্রোহ আইন ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ইউএপিএ’র মতো আইনগুলি বাতিল করার দাবি আরও একবার জনগণের চিন্তাচর্চাকে উদ্দীপিত করতে শুরু করেছে। এই দাবিগুলি, এই মুহূর্তের অন্যান্য বুনিয়াদি দাবি — বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, বিপর্যয়কর কৃষি আইন ও নয়া শ্রমকোড বাতিল করা এবং শ্রমিকের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, বেসরকারিকরণ ও মূল্যবৃদ্ধি থামানো, কর্মসংস্থান ও মজুরি বাড়ানো, প্রতিটি কোভিড-মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ ও সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগ — এইসব দাবিগুলির সাথে একত্রে বর্তমান সময়ের মূল গণতান্ত্রিক এজেণ্ডা নির্ধারণ করে দিচ্ছে।

মোদী সরকার এবার যখন তার পুনর্বিন্যস্ত বিশালাকার মন্ত্রীসভা নিয়ে সংসদের বাদল অধিবেশনে নয়া নয়া বিল আনার লক্ষ্যে প্রস্তুত তখন দেশে বিরোধী পক্ষকেও, তা সে রাস্তার আন্দোলনই হোক বা সংসদের ভেতরের বিরোধী দল, আরও নির্ধারক প্রতিরোধ গড়তে কোমর বাঁধতে হবে।

এই নতুন পরিস্থিতির যথাযোগ্য উদ্যোগে পার্টির সব কমিটি ও সমস্ত সদস্যকে পূর্ণ প্রাণশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। পরপর দু’বছর আমরা কোভিড১৯ মহামারি ও তার আনুষঙ্গিক প্রতিকুলতার সম্মুখীন রয়েছি, বিশেষত রয়েছে বিভিন্ন মাত্রার লকডাউন ও বিধিনিষেধ। এই পর্বে আমরা বেশ কিছু সাথীকে হারিয়েছি। অনেক কমরেড এখনও কোভিড সংক্রমণ পরবর্তী জটিলতায় ভুগছেন। এই পরিস্থিতি আমাদের চিরাচরিত কার্যধারায় এবং আন্দোলন ও সমাবেশের পন্থায় ছেদ এনেছে। তথাপি আমরা অনেকগুলি কার্যকরি অভিযান চালাতে সক্ষম হয়েছি ডিজিটাল ও ফিজিকাল উভয় উদ্যোগের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে। মহামারীর কালপর্ব দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং ‘স্বাভাবিক অবস্থা ফেরা’ নিয়ে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। এই অবস্থায় আরও সৃজনশীল পথে আমাদের উদ্যোগ ও সক্রিয়তা এবং আন্দোলনের প্রভাব পরিধি বাড়িয়ে চলতে হবে।

কমরেড চারু মজুমদারের শেষ কথা “জনগণের স্বার্থকে ঊর্দ্ধে তুলে ধরা ও যে কোনও মূল্যে পার্টিকে বাঁচিয়ে রাখা” ১৯৭০’র ধাক্কার দিনগুলিতে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিল, পথ দেখিয়েছিল। আজকের দিনে মোদী ২.০ ও কোভিড ২.০ এই সর্বনাশা যুগলবন্দীর মোকাবিলা করতেও আমাদের সেই একই মূলনীতি ও মেজাজ নিয়ে এগোতে হবে। পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই আন্দোলন ও পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, এখানে নিষ্ক্রিয়তা ও উদ্যোগহীনতার কোনো অবকাশ নেই।

- কেন্দ্রীয় কমিটি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেনিনবাদী)

the compensation

আমাদের দেশে এপর্যন্ত করোনায় ক্ষতি যে হয়েছে ব্যাপক তা এখন কেন্দ্র-রাজ্য সরকারি সব পক্ষ স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে। বেসরকারি সূত্রগুলোর সংগ্রহ করা তথ্য পরিসংখ্যান সরকার পক্ষকে বেশ চাপে রেখেছে। তবে এখনও ক্ষয়ক্ষতির হিসেব নিয়ে দুরকম গন্ডগোল চলছে। একদিকে চাপান উতোর চলছে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে, অন্যদিকে ফারাক রয়ে যাচ্ছে সরকারি এবং বেসরকারি তথ্যের মধ্যে। সরকারি হিসেবের চেয়ে বেসরকারি হিসেবে ক্ষতির পরিমাপ অনেক বেশি। যা সরকারের কেন্দ্রীয় স্তর ও রাজ্য স্তর তার তার প্রতি ‘কুৎসা’ ও ‘ষড়যন্ত্র’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছে। মোটামুটি পাওয়া হিসেব বলছে, এপর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা দু'কোটি পঞ্চাশ লক্ষাধিক, আর মৃতের সংখ্যা তিন লক্ষাধিক। তথ্য চাপা দিতে গণ চিতা, মাটি চাপা, নদীবক্ষে ভাসিয়ে দেওয়া কত অনাচারই তো হল! কত তথ্য যে হিসেবের বাইরে বিলীন হয়ে রয়েছে! তবু ক্ষতির ব্যাপকতা ক্রমশ প্রকাশ হচ্ছে। তবে একমাত্র দেশজুড়ে জনগণনার মতো অভিযান চালালে সমস্ত তথ্য পঞ্জীভূত করা সম্ভব। ক্ষতির পরিমাপ করা মানে শুধু মৃত্যুর খতিয়ান নয়,সংক্রামিতের সংখ্যা, চিকিৎসা কেমন মিলেছে, কত নিরাময় হল, কত আর্থিক-পারিবারিক-মানসিক-সামাজিক ক্ষতি হয়েছে, সমস্ত তথ্য আসা দরকার। ২০২০-তে সুপ্রীম কোর্টের বাইরে ও ভিতরে একাধিকবার ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে সামাজিক রাজনৈতিক মহল থেকে দাবি ওঠে। যে সমস্ত পরিবারে এক বা একাধিক সদস্যের করোনায় মৃত্যু হয়েছে তাদের শিশুদের ও বাকিদের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবি উঠেছে। বিশেষত, এনসিপিসিআর অর্থাৎ শিশু অধিকার সুরক্ষা জাতীয় কমিশনের সুপারিশ ছিল। আকস্মিক পিতৃমাতৃহীন হয়ে পড়া হাজার হাজার শিশুদের অবিলম্বে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হোক। সুপ্রীম কোর্টের এন নাগেশ্বর রাও-অনিরুদ্ধ বসুর ডিভিশন বেঞ্চ সুপারিশ করেছিল আইসিপিএস অর্থাৎ সুসংহত শিশু সুরক্ষা প্রকল্প থেকে করোনায় অনাথ হয়ে পড়া শিশুদের আর্থিক সহায়তা করা হোক। ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে আইনজীবীরা সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করেন প্রয়াতদের পরিবার পিছু আশু এককালীন চার লক্ষ টাকা দেওয়া হোক। আগে কেন্দ্র এটা দিক। প্রয়োজনে আরও বিভিন্ন সহায়তা দিতে হবে। কেন্দ্র-রাজ্য-কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল সবাই মিলে দিতে হবে। তবু মোদী সরকার এসব দায় পালনের নাম নেয় না। কেবল সাফাই দেয় রাজকোষে তহবিল নেই। এই অতিমারীর একটানা রোজগার পড়ে যাওয়া সময়ে, বেরোজগেরে হয়ে যাওয়া সময়ে, ক্রমাগত পেট্রোপণ্যে কর বসানোয় বিরাম নেই। কর হ্রাসের দাবি তুললে বলে সরকার করোনা মোকাবিলা করবে কি করে? কর না বাড়িয়ে উপায় নেই। যখন দাবি করা হয় করোনা কারণে আর্থিক সুরাহার, তখন আবার সরকার দেয় অর্থ না থাকার সাফাই। এভাবে অতিমারীর সময়কালীন ত্রাণ-পরিত্রাণের নিমর্ম প্রহসন চালানো হয়ে আসছে। নাহলে যে ধোঁকাবাজি, চাতুরি, তথ্যের কারচুপি সব ধরা পড়ে যাবে। তবে সরকার দায় থেকে পালাতে চাইলেও পালাতে দেওয়া যাবে না। বরং বাড়াতে হবে গণচাপ।

সুপ্রীম কোর্টের এক বিচারক বেঞ্চ শুনিয়েছে আরও কিছু কড়া মন্তব্য। বলেছে, সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চলছে ক্ষয়রোগ। আর বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চলছে জমাটি ব্যবসা, অনেকটা রিয়েল এস্টেটের মতো, ‘ফেলো কড়ি, কর চিকিৎসা’, এ স্বাস্থ্য বাজারে কোনও নিয়ম মানার বালাই নেই, রোগী প্রতি যা হেঁকে নেওয়া যায় — পাঁচ-দশ-বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ লাখ টাকা। রোগী পক্ষ সর্বস্বান্ত হলেও নিরাপত্তা পাওয়ার কোনও ছাড় নেই, ‘স্বাস্থ্য সাথী’ বা ‘আয়ুস্মান’-এর সীমা আছে, তাও বহু ক্ষেত্রে মান্যতা মেলে না, এখনও পাওয়া থেকে না-পাওয়া জনতার অংশ অনেক বেশি, বানিয়া হাসপাতালের জুলুম বাধা দেওয়ার দায় কোনও সরকার নেয় না। রাজ্য সরকার যাও বা কিছু পদক্ষেপ করেছে নিয়ন্ত্রণের, কেন্দ্র কিছুই দেখে না। ব্যবসায়িক হাসপাতালগুলোর নিয়ম না মানার দুঃসাহস এতই যে, অনেকক্ষেত্রে হাসপাতাল ভবনও তৈরি করেছে আইন না মেনে। যেন জতুগৃহ। যার পরিণামে গত বছর অতিমারী সময়ের মধ্যেই গুজরাটে, মহারাষ্ট্রে পুড়ে মারা যান অনেক রোগী ও হাসপাতাল স্টাফ। এই মরণ পরিণামের উৎস হল অমানবিক স্বাস্থ্য নীতি।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হয় পরিষ্কার দুরকম। একটি জনকল্যাণমূলক, অন্যটি মুনাফা লোটার। কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে কাগুজে ‘জনকল্যাণমূলক’ ঘোষণা থাকলেও কার্যত অগ্রাধিকার পাচ্ছে মুনাফাখোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। কারণ  জনসংখ্যা যেখানে ১৩০ কোটি, সেখানে জিডিপি’র মাত্র ০.৯৬ শতাংশ বরাদ্দ করে জনকল্যাণমূলক স্বাস্থ্য নীতির দাবি করা যায় না। মোদী সরকার যা নয় তাই ভন্ডামী চালাচ্ছে। পশ্চিমবাংলার রাজ্য সরকারের নীতি-পলিসিও ঠিকঠাক নেই। বহু গলদে ভরা। এর প্রতিটা হিসাব মনে রাখতে হবে, আন্দোলন ছাড়া প্রতিকার আদায় করার উপায় নেই।

A signal of a new storm

সামনের ২৫ জুলাই রাজধানী দিল্লীকে অবরুদ্ধ করে রাখা কৃষকদের ঐতিহাসিক অবস্থান আন্দোলনের আট মাস পূর্ণ হচ্ছে। পুরো শীতের মরশুম পার করে, প্রখর গ্রীষ্মের দিন কাটিয়ে বর্ষার মুখে দাঁড়িয়েও হাজার হাজার কৃষক খোলা আকাশের নিচে আজও দিন কাটাচ্ছেন। মাইলের পর মাইল জুড়ে পথেই তারা আস্তানা গেড়েছেন। পথের ওপরেই তারা ছাউনি বানিয়েছেন, অজস্র-অগণিত। ফসল খেতের দেখভালের জন্য একদল বাড়ি গেছেন তো গ্রাম থেকে অন্যরা এসে সে জায়গা পূরণ করেছেন। এখন খারিফ চাষের সময়। অনেকেই ঘরমুখী। ছাউনিগুলিতে লোক সমাগম আগের তুলনায় কিছু হ্রাস পেয়েছে। কিন্ত বোঝার তো উপায় নেই। প্রতি দুশো মিটার অন্তর এক একটা লঙ্গরখানা। কিছু দূর অন্তর অন্তর পাঞ্জাব ও হরিয়ানার এক এক জেলার মানুষেরা গান গাইছেন। কবিতা, আবৃত্তি, নাট্যানুষ্ঠানে জমিয়ে তুলছেন সকাল থেকে রাত অবধি। বলা বাহুল্য, মহিলারাও আছেন ভালো সংখ্যায়। দীর্ঘ অবস্থানে অসুস্থ হয়ে পড়া মানুষদের চিকিৎসার জন্য গড়ে উঠেছে অস্থায়ী বহু মেডিক্যাল ক্যাম্প। সামনে সংসদের বাদল অধিবেশন। নির্বিকার মোদী সরকারকে আরও চাপে ফেলার জন্য আন্দোলনকারী কৃষকরা নতুনতর রণকৌশল গ্রহণ করছেন। কিন্তু মোদী সরকার যদি এত কিছুর পরেও তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার না করে? কৃষকদের সাফ জবাব — দরকারে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই অবস্থান চলবে। তাঁরা জানেন, এত দীর্ঘ সময়ধরে গণঅবস্থান খুবই বিরল ঘটনা যা সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছে। তাঁদের চূড়ান্ত জয় অর্জনের অর্থ ফ্যাসিস্ট মোদী সরকারের পরাজয়। ধৈর্য্য তাঁদের প্রধান অস্ত্র, সঙ্গে সঙ্গে বিপুল গণসমর্থন তাঁদের প্রধান ভরসা। যে কারণে তাঁরা জানেন, এ শুধু এক কৃষক আন্দোলন নয়, এ হল কোম্পানীরাজ খতমের জন্য ব্যাপক জনগণের আকাঙ্খার প্রতিফলন — যেখানে এসে মিলেছে ছাত্র-যুব-বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক সহ সর্বস্তরের জনগণের দেশজোড়া সমর্থন। ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রকে নির্মূল করতে চায়। বিপরীতে বিরোধী স্বরকেও মর্যাদা দেওয়া এবং শুধু সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কর্মসূচি গ্রহণ — গণতান্ত্রিকতার এটাই মূল সুর। এই অর্থেও দিল্লীর কৃষক আন্দোলন অনন্য। বাম, অ-বাম, সমাজবাদী, গান্ধিবাদী, সংস্কারপন্থী — নানা বিচিত্রধারার ছোট বড় প্রায় পাঁচশ কৃষক সংগঠনের সর্বোচ্চ মঞ্চ হল সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। সর্বোচ্চ এই মঞ্চ থেকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তগুলিই কেবল কর্মসূচি বলে ঘোষিত হয়। যেমন সংযুক্ত মোর্চার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল — (১) প্রত্যেক সাংসদের কাছে, সংসদের বাদল অধিবেশনের প্রারম্ভে ‘ভোটারদের হুইপ হিসেবে’ নির্দেশিকা পাঠানো হবে। নির্দেশিকা অনুসারে একজন সাংসদকে কৃষি আইন প্রত্যাহারের জন্য সংসদ কক্ষে প্রস্তাব আনতে হবে। অন্যথায় অধিবেশনের সব কাজ বন্ধ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে সাংসদকে দলীয় হুইপ অমান্য করতে হবে। (২) সংসদের অধিবেশন চলাকালীন, বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের বাছাই করা কর্মীদের নিয়ে প্রতিদিন দুশো কৃষক সংসদ ভবনের সামনে ধর্ণা দেবেন।

A signal of a new storm_Delhi-Border

 

সংসদের বাদল অধিবেশনের পূর্বাহ্নে ‘দিল্লী সীমান্তগুলিতে’ আন্দোলনকারী কৃষকদের মধ্যে নবতর উদ্দীপনা সঞ্চারের লক্ষ্যে সারা ভারত কিষাণ মহাসভা (এআইকেএম) ১৫-১৯ জুলাই একের পর এক মিছিল ও জমায়েত সংগঠিত করে। ১৫ জুলাই শাজাহানপুর বর্ডারের (দিল্লী-জয়পুর সড়ক) সমাবেশে বক্তব্য রাখেন এআইকেএম’এর সাধারণ সম্পাদক রাজারাম সিং, সংগঠনের রাজস্থান রাজ্য সভাপতি ফুলচাঁ ঢেবা প্রমুখ নেতৃবর্গ। ১৬ জুলাই টিকরি বর্ডারে (দিল্লী-ভাতিন্দা জাতীয় সড়ক) জমায়েতে বক্তব্য রাখেন রাজারাম সিং, কার্তিক পাল, পুরুষোত্তম শর্মা (উত্তরাখণ্ড) ও এআইকেএম সর্ব ভারতীয় সভাপতি রুলদু সিং। ২৭ তারিখ সিঙ্ঘু বর্ডারে (দিল্লী-চন্ডীগড় জাতীয় সড়ক) অবস্থান মঞ্চে বক্তব্য রাখেন জনপ্রিয় কৃষক নেত্রী যশবীর কাউর। ১৯ জুলাই গাজিপুর বর্ডারে (গাজিয়াবাদ-লক্ষ্ণৌ জাতীয় সড়ক) বর্ণাঢ্য মিছিলে মুখ্যত উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা অংশ নেন। এখানে বলা দরকার, গাজিপুর বর্ডারেই গত ২৮ জানুয়ারী পুলিশী মদতে বিজেপি-আরএসএস গুন্ডারা কৃষকদের ওপর হামলা চালাতে এলে এবং যোগী আদিত্যনাথ প্রশাসন কৃষক নেতাদের গ্রেফতারের তৎপরতা নিলে জীবন বিসর্জনের হুমকি দেন কৃষকনেতা রাকেশ টিকায়েত। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২৯ তারিখ রাত থেকেই কাতারে কাতারে জাঠ সম্প্রদায়ের কৃষক ধর্ণাস্থলে এসে হাজির হয়ে বিজেপি-আরএসএস’কে উচিত শিক্ষা দেন। সত্যিকার অর্থে গাজিপুর বর্ডার হয়ে উঠেছে জাঠ ও শিখদের ঐক্যের প্রতীক। এখানে ধর্ণা মঞ্চে বক্তব্য রাখেন রাজারাম সিং। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রতিটি ধর্না মঞ্চের পাশে এআইকেএম’এর পাশাপাশি ছাত্রসংগঠন আইসা ও শ্রমিক সংগঠন এআইসিসিটিইউ’রও শিবির রয়েছে। এই ছাত্র ও শ্রমিক কমরেডরা পালা করে গত ২৬ নভেম্বর থেকেই লাগাতার ধর্ণাস্থলে উপস্থিত থাকছেন। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার গুরুত্বপূর্ণ শরিক হিসেবে এআইকেএম কার্যত টিকরি বর্ডারকে সঞ্চালন করছে। সিঙ্ঘু বর্ডারে এআইকেএম’এর দুটি শিবির রয়েছে। একটি শিবির পাঞ্জাবের গুরদাসপুর জেলার কৃষকরা ভরিয়ে রেখেছেন। শিবিরটি পরিচালনায় রয়েছেন প্রবীণ কৃষকনেতা বলবীর সিং রনধাওয়া। অপর শিবিরটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন ফতেগড় সাহিব অঞ্চলের কৃষকরা।

দিল্লী বর্ডারে কৃষকদের ধর্ণা আরো দীর্ঘতর হতে পারে। নানা কারণে এই ঐতিহাসিক কৃষক সংগ্রাম দেশের সর্বত্র সমানভাবে আলোড়িত হয়নি। তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে শুধু কৃষকদের স্বার্থই নয়, কৃষিমজুর, অসংগঠিত শ্রমিক, স্বল্পবিত্ত মানুষ — সকলেরই স্বার্থ জড়িত। সে কারণে এই আন্দোলনের বার্তাকে দেশের কোণে কোণে ছড়িয়ে দেওয়া এবং এক এক রাজ্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও নির্দিষ্ট আরো কিছু দাবি যুক্ত করে কৃষক আন্দোলনকে দেশব্যাপী বিস্তার ঘটানোর লক্ষ্যে এআইকেএম’এর জাতীয় কার্যকরী কমিটির সভায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সভা অনুষ্ঠিত হয় সিঙ্ঘু বর্ডারের নারেলায় ১৭-১৮ জুলাই। স্থির হয়, (১) আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত অবস্থান চালিয়ে যেতে হতে পারে এই বাস্তবতার মুখে সংগঠনের প্রতিটি রাজ্য ইউনিটকে পর্যায়ক্রমে বছরে কয়েকবার ভাল সংখ্যক কৃষক-কর্মীদের অন্তত চারদিন করে ধর্ণাস্থলে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। (২) আগামী ৯ আগস্ট ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ দিবসে দেশের সর্বত্র জেলা সদর ও ব্লকগুলিতে ‘মোদী, হয় তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার কর নয় তো গদী ছাড়ো’ দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সমাবেশে কৃষি ও গ্রামীণ মজুরদেরও সামিল করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। (৩) ২৮ সেপ্টেম্বর ভগৎ সিংএর জন্মদিবসে ‘কালো ইংরেজ তখত থেকে দূর হটো’ আওয়াজ সামনে রেখে রাজ্যে রাজ্যে কৃষকদের পাশাপাশি ফ্যাসিবাদী মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ব্যাপক জনগণকে সামিল করে গণসমাবেশ সংগঠিত করা হবে।

- দিল্লীর ধর্ণাস্থল থেকে এআইকেএম নেতা মুকুল কুমার

Whip of voters per MP_Delhi

শ্রীমতী/শ্রী ……………………………………………
সদস্য, লোকসভা/রাজ্যসভা
ইমেল

বিষয় : শাসক জোট এনডিএ সংসদ সদস্যদের প্রতি ভোটারদের হুইপ

প্রিয় সংসদ সদস্য,

আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা সংসদে জোর করে পাশ করিয়ে নেওয়া তিনটি কৃষক বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে দেশের কৃষকরা আন্দোলন করছে। কৃষকরা এই আইনগুলি বাতিল করার পাশাপাশি ‘এনসিআর’, ‘এয়ার পলিউশন আইন’ এবং ‘খসড়া বিদ্যুৎ বিল’এর কৃষক বিরোধী অংশগুলি অপসারণের দাবি করছে। দেশের সকল কৃষকের সব কৃষিজাত পণ্যের এমএসপি দামে কেনার নিশ্চয়তাযুক্ত একটি নতুন আইন প্রণয়ন করার জন্যেও কৃষকরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি করেছে।

আপনি দেখেছেন যে ২৬ নভেম্বর ২০২০ সাল থেকে সারা দেশের কৃষক দিল্লীর সীমান্তগুলিতে এবং দেশের শতাধিক জায়গায় তাদের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে লাগাতার ধর্ণায় বসেছে। এই আন্দোলন ভারতীয় জনসাধারণকে জাগিয়ে তুলেছে। সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। কিন্তু, আপনি এবং আপনার দল ইতিমধ্যেই প্রায় আট মাস অতিক্রান্ত হওয়া এই দীর্ঘ আন্দোলনে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় কৃষকের অংশগ্রহণ এবং অভাবনীয় কষ্ট স্বীকারের বিষয়টি লক্ষ্য করতে অস্বীকার করেছেন। কটু মন্তব্য, এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের অবমাননা, আন্দোলন ভাঙার চেষ্টা এবং আন্দোলনকারীদের দাবি ও দুর্ভোগের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের চরম ঔদাসীন্যকে সমর্থন — আপনার এই আচরণে দুর্ভোগের সাথে সাথে আন্দোলনকারীরা লাঞ্ছিতও হয়েছেন।

আপনি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন যে ভারতের কৃষক বিরোধী আইন ও কৃষকের দাবির কথা নিয়ে ইতিমধ্যেই ব্রিটিশ যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অফ কমন্স এবং কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার সংসদে বিতর্ক ও আলোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বিষয়টির ওপর নজর রাখছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক যে ভারতের সংসদ এই ঐতিহাসিক আন্দোলন ও দেশের প্রায় সমস্ত নাগরিকের সঙ্গে সম্পর্কিত ও জড়িত এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার এবং এপর্যন্ত আন্দোলনে নিহত প্রায় ৬০০ শহীদের প্রতি শোক জ্ঞাপন করার কোন সময় পায়নি।
সুতরাং, আমাদের সার্বভৌম ক্ষমতার বলে, আমরা নির্দেশ করছি,

১) ১৯ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া বাদল অধিবেশনের প্রতিটা দিন আপনি অবশ্যই সংসদে উপস্থিত থাকবেন।
২) আপনি এবং আপনার দল কৃষকের ইস্যুগুলি উত্থাপন করবেন এবং সংসদ কক্ষে কৃষক আন্দোলনের উপরোক্ত দাবিগুলি সমর্থন করবেন।
৩) যতক্ষণ কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের দাবিগুলি মেনে নেওয়ার আশ্বাস উভয় কক্ষে দিচ্ছে, ততক্ষন সংসদে অন্য কোন বিষয় উত্থাপিত এবং আলোচিত হতে দেবেন না।
৪) আপনি বা আপনার দলের কোন সদস্য কৃষকদের দাবির পক্ষে উত্থাপিত কোন মোশনের বিরোধীতা করবেন না, বিরুদ্ধে ভোট দেবেন না বা ভোটদান থেকে বিরত থাকবেন না।

এটাকে আপনার ভোটারদের হুইপ হিসেবে বিবেচনা করবেন এবং এই বিষয়ে আলাদা করে যদি আপনার দল কোন হুইপ জারি করে, তাহলে এই হুইপকে অগ্রাধিকার দেবেন। আপনি এবং আপনার দল যদি কোনোভাবে ভোটারদের এই হুইপ অমান্য করেন, তবে ভারতের কৃষকরা জনমঞ্চে ও জনসমক্ষে আপনার বিরোধীতা আরও তীব্র করে তুলতে বাধ্য হবে।

- দেশের সমস্ত কৃষকের পক্ষ থেকে, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা

 

Whip of voters

• কৃষকদের ইস্যু সংসদের উভয় সভায় তোলার জন্য এবং ‘ওয়াক আউট’ না করার জন্য লোকসভা ও রাজ্যসভার সাংসদদের হুইপ জারি করেছে এসকেএম।
• ২২ জুলাই থেকে পার্লামেন্ট প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার জন্য তামিলনাড়ুর মতো দূরবর্তী রাজ্যগুলি থেকেও আরও আরও বেশি করে কৃষকের দল সীমান্তে পৌঁছতে শুরু করবে।
• অল ইন্ডিয়া কৃষক মহাসভার সর্বভারতীয় কৃষক নেতাদের দল পৌঁছে গেছেন; সীমান্তের কৃষক শিবিরগুলিতে তাঁরা মিছিল করেছেন।
• কৃষকদের বিরুদ্ধে হরিয়ানা পুলিশ দ্বারা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আরোপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সিরসায় আয়োজিত মহাপঞ্চায়েত খুব বড় ভাবে সফল হয়েছে।
• নারীদের প্রতি বিজেপি নেতা মনীষ গ্রোভারের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে ১৯ জুলাই রোহতকে মহিলা মহাপঞ্চায়েতের ব্যবস্থাপনা প্রবল উৎসাহের সাথে চলছে।
• চন্ডীগড়ে বিজেপি’র মেয়র সঞ্জয় ট্যান্ডনের বিরুদ্ধে কৃষকরা বিক্ষোভ দেখিয়েছে; পুলিশ প্রতিবাদকারীদের পাশবিকভাবে মারধর করেছে, মহিলা ও শিশু সহ অনেককে গ্রেপ্তার করেছে।

 

demanding running of local trains

হুগলী

মেহনতি মানুষের রুটি-রুজির স্বার্থে এবং অন্যান্য গণপরিবহনে অনিয়ন্ত্রিত ভিড় কমাতে ও জনতার ব্যপক পরিবহন খরচের ব্যয়ভার লাঘব করার জন্য অবিলম্বে সর্বসাধারণের জন্য লোকাল ট্রেন চালু করার দাবিতে ২০ জুলাই এআইএসএ সহ রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন গণসংগঠনের ডাকে দাবি দিবস সংগঠিত হচ্ছে।

হুগলি জেলা জুড়ে এই দাবিকে জোরদার করার জন্য কোমর বেঁধে নামে নাগরিক উদ্যোগ ‘একুশের ডাক’। মেইন লাইনে কোন্নগর, মানকুণ্ডু, ব্যান্ডেল, বৈঁচি, গুপ্তিপাড়া ও কর্ড লাইনে ধনিয়াখালি হল্ট স্টেশন সহ জেলার বেশ কয়েকটি স্টেশনে বিক্ষোভ সমাবেশ, দাবির সপক্ষে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ ও স্টেশন ম্যানেজারের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করে ‘একুশের ডাক’। এই কর্মসূচিতে বিভিন্ন সাধারণ নাগরিক, মানবাধিকার ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন কর্মী, শ্রমিক, শিক্ষক, গবেষক, ক্ষেতমজুর, আদিবাসী মানুষজন সহ চন্দননগরের বন্ধ গোঁদলপাড়া জুটমিলের শ্রমিক পরিবারের ছাত্রছাত্রীরাও অংশগ্রহণ করেন।

running of local trains

উত্তর ২৪ পরগণা

খেটে খাওয়া মানুষের রুটি রুজির স্বার্থে অবিলম্বে লোকাল ট্রেন চালু করার দাবি নিয়ে বেলঘরিয়া স্টেশন চত্ত্বরে আইসার পক্ষ থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। অঞ্চলের হকার, সবজি বিক্রেতা থেকে সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে আন্দোলন আরো জোরদার করার আওয়াজও উঠে আসে।

কলকাতা

আজ এআইএসএ কলকাতা জেলা কমিটির উদ্যোগে অবিলম্বে লোকাল ট্রেন চালুর দাবিতে শিয়ালদহ ডিআরএম অফিসের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি নেওয়া হয় এবং ডেপুটেশন জমা দেওয়া হয়।

বক্তব্য রেখেছেন আইসা'র পক্ষ থেকে কলকাতা জেলা সভাপতি অভিজিৎ সহ অত্রি, সায়ন্তন এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে রাজ্য কমিটির সদস্য বাসুদেব বসু এবং কলকাতা জেলা সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী।

হাওড়া

অবিলম্বে লোকাল ট্রেন চালু করার দাবিতে বালি স্টেশন চত্বরে হপ্তাবাজারে এআইএসএ এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বিক্ষোভ কর্মসূচি। সেখান থেকে মিছিল হয় চৈতলপাড়া মোড় পর্যন্ত। কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন কমরেড তপন ঘোষ, কার্তিক পান্ডে, সৌত্রিক গোস্বামী এবং নীলাশিস বসু।

 the price of petroleum products

১৬ জুলাই পেট্রোল-ডিজেল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, কোভিড অতিমারী চিকিৎসায় ব্যবহৃত সরঞ্জামের উপর জিএসটি আরোপ, সেইলের আরএম ডিভিশন সরিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে শিলিগুড়িতে জেলা কার্যালয়ের সামনে থেকে মিছিল করে হাশমিচকে এসে বিক্ষোভ দেখানো হয়ে। পোড়ানো হয় মোদীর কুশপুতুল। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জেলা সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার জানান আরোও বেশি মানুষদের একত্রিত করে ফ্যাসিস্ট সরকারের জনবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে।

against the rise in prices

ধুবুলিয়ায় এআইসিসিটিটিইউ অনুমোদিত সংগ্রামী টোটো চালক ইউনিয়ন, সংগ্রামী বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়ন, সংগ্রামী মুটিয়া মজদুর ইউনিয়ন সমূহের পক্ষ থেকে ১৭ জুলাই সিপিআই(এমএল) লিবারেশন অফিস চত্বর থেকে এক মিছিল বের হয়ে ধুবুলিয়া বাজার ঘুরে নেতাজী পার্কে শেষ হয়। মিছিল শেষে প্রতিবাদীসভা অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলে সকলের গলায় শোনা যায় পেট্রাপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে, বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করতে হবে, কৃষকের ফসলের নায্য দাম দিতে হবে। সকলের জন্য দ্রুত করোনা ভ্যাকসিন দিতে হবে, সমস্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মাসিক ৭,৫০০ টাকা দিতে হবে। মিছিলে পা মেলান এআইসিসিটিইউ রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু, কাজল দত্তগুপ্ত, নীহার ব্যানার্জি, জয়কৃষ্ণ পোদ্দার ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। বক্তব্য রাখেন জীবন কবিরাজ, বাসুদেব বসু, সন্তু ভট্টাচার্য।

against anti-people Modi policy

কোভিড কাল যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে দেশজুড়ে বিধিনিষেধ, লকডাউন তত বাড়ছে। গরীব মেহনতি মানুষের রুটি-রুজি প্রায় বন্ধ। এই অবস্থায় রেশন, উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং মানুষের হাতে নগদ টাকা খুব জরুরী। প্রধানমন্ত্রীর বিনামূল্যে অন্ন যোজনা প্রকল্প বড় বড় হোর্ডিংএ যে মাত্রায় প্রচারের বহর দেখা যাচ্ছে সে তুলনায় মানুষ রেশন পাচ্ছে অপ্রতুল, তাও আবার শুধু চাল, গম, সাথে তেল, চিনি, ডাল দেওয়া যে প্রয়োজন তা উনি ভাবতে পারছেন না। গরিব মানুষের হাতে ৭,৫০০ টাকা দেওয়ার দাবিও মানছেন না! এই অবস্থায় রাজ্য সরকারের ‘দুয়ারে রেশন’ ব্যবস্থাও খাদ্য সুরক্ষা কার্ডের সাথে আধার সংযুক্তির গেরোয় আরও জটিলতার মধ্যে পড়েছে। বহু মানুষ এই রেশন থেকেও বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই সুযোগে কিছু অসাধু লোক আধার কার্ড করিয়ে দেওয়ার জন্য গরিব মানুষের কাছ থেকে ৫০০, ৭০০ বা তারও বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে মানুষের একগুচ্ছ দাবিতে গত ১৯ জুলাই আইপোয়ার হুগলির পক্ষ থেকে চৈতালি সেনের নেতৃত্বে জেলা শাসকের কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। দাবি ছিল --

১) সমস্ত নাগরিককে অবিলম্বে বিনামূল্যে টিকা দিতে হবে।
২) টিকা নেওয়া ও কোভিড বিধি পালনে যাঁরা অনীহা দেখাচ্ছেন তাঁদের সচেতন করতে পঞ্চায়েত ও পৌরসভার মাধ্যমে জোরদার গণপ্রচার চালাতে হবে।
৩) খাদ্য সুরক্ষা কার্ড ও আধার কার্ডের সংযুক্তি বাধ্যতামূলক করে গরীব মানুষকে রেশন থেকে বঞ্চিত করা চলবে না।
৪) সমস্ত নাগরিককে আধার ছাড়াই রেশন দিতে হবে।
৫) রেশনে শুধুমাত্র চাল-গম নয়, ডাল-তেল-চিনি-সাবান ইত্যাদি দিতে হবে ।
৬) রাজ্য সরকারের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প যা থেকে প্রতি মাসে ৫০০/১০০০ টাকা দেওয়ার কথা, তা দ্রুত চালু করতে হবে এবং এসসি-এসটি সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৭) সার্বিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ও পরিকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে।
৮) গরীব মেহনতি মানুষের রুটি-রুজির স্বার্থে বেশি সংখ্যায় লোকাল ট্রেন অবিলম্বে চালু করতে হবে।
৯) পেট্রোল-ডিজেল-রান্নার গ্যাস সহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ করতে হবে।
১০) কোভিড কালে বিপর্যস্ত সমস্ত গরীব মানুষের ঋণ মকুব করতে হবে এবং মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলো ঋণ আদায়ের নামে যে মানসিক অত্যাচার চালাচ্ছে তা বন্ধ করার ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে।

এই দাবিগুলো নিয়ে এডিএম-এর সাথে আলোচনা হয়। তিনি বলেন, টিকার সাপ্লাই কম, আমারা প্রত্যেক নাগরিককে পরিকল্পনামাফিক অবশ্যই দেব। রন্ধন কর্মীদের প্রাধান্য দেওয়ার দাবি রাখি। এবিষয়ে তিনি রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন। আধারের বাধ্যতা জটিলতা রেশন প্রশ্নে আলোচনায় তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প তাই আমাদের করতে হচ্ছে। তবে আধার সংযুক্তি না হলে গরিব মানুষ রেশন পাবে না, এরকম ভাবনা রাজ্য সরকারের নেই। এসসি-এসটি সার্টিফিকেটের ব্যাপারেও গুরুত্ব দেন।

ধনিয়াখালিতে ‘সজল ধারা’ প্রকল্পের অচলাবস্থা কাটানোর ব্যবস্থা নেবেন। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিয়ে দুর্নীতির প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হয়। যে মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলো ঋণ শোধের জন্যে চাপ সৃষ্টি করছে, ভীতি প্রদর্শন করছে, সেই কোম্পানিগুলোর নাম লিখিতভাবে সেই ব্লকে বিডিও-র কাছে জানাতে বলেছেন। সেই প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Protest against sedition laws

রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রত্যাহার ও হাওড়ায় হুগলি নদীর তীরে রেলের জমি বেসরকারি সংস্থাকে ঌঌ বছরের লিজ দেওয়ার নামে হস্তান্তরের প্রতিবাদে, বালি নিশ্চিন্দা তরুণ সংঘ ক্লাবের সামনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতৃত্বে প্রতিবাদ হয় ১৮ জুলাই।

প্রতিবাদসভার শুরুতে শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন দাবি তোলা হয়। করোনাকালে আমাদের হারানো প্রিয়জনদের স্মরণ করা হয়। কেন্দ্রের ফ্যাসিস্ট সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন প্রবীণ সাথী পার্থ সারথি মিত্র, দেবাশিস চ্যাটার্জি, বর্ষীয়ান নেতা অরুণ গুহ। পেট্রোপণ্যের এবং মানুষের ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এলাকার মানুষকে বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান। প্রতিবাদসভায় সংগীত পরিবেশন করেন গণসাংস্কৃতিক বন্ধুরা। সমগ্র সভা পরিচালনা করেন মাধব মুখার্জী। করোনাকালে এলাকার মানুষকে ভালো থাকা, সুস্থ থাকা এবং মানুষের জন্য মানুষের পাশে থাকা, মানুষের অধিকার আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

BJP accused of wreaking havoc

উত্তরপ্রদেশে গত ১০ ও ১২ জুলাই ব্লক পঞ্চায়েত প্রধানদের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের শেষ পর্যায় অনুষ্ঠিত হল এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটল। কিন্তু নির্বাচনের ফল নিজেদের অনুকূলে আনতে শাসক দল বিজেপি ব্যাপক হিংসার আশ্রয় নিয়েছে, এমন অভিযোগ এনেছে বিরোধী দলগুলো। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ গোটা প্রশাসনকেই ব্যবহার করে বিরোধী সদস্যদের হুমকি দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। শুধু হুমকি নয়, বিরোধী সদস্যদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে না দেওয়া, প্রার্থীদের অপহরণ করা, নারী প্রার্থীদের সঙ্গে অশালীন অচারণ, উৎকোচ দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া থেকে বিরোধী প্রার্থীদের বিরত করার মত ভুরি-ভুরি অভিযোগ উঠেছে। এক কথায় বললে, এপ্রিল মাসের গ্ৰাম পঞ্চায়েত সদস্য ও ব্লক পঞ্চায়েত সদস্য নির্বাচনে নিকৃষ্ট ফলের তুলনায় ব্লক পঞ্চায়েত প্রমুখ নির্বাচনে বিজেপির ফল যে ভালো হয়েছে তার পিছনে বিজেপির পেশি ও অর্থ শক্তি মূল ভূমিকায় থেকেছে এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনও শাসক দলের আজ্ঞাবহ সংস্থার মত আচরণ করেছে বলে সমাজবাদী পার্টি সহ অন্যান্য বিরোধীপক্ষ অভিযোগ এনেছে।

হিংসা ও বলপ্রয়োগের যে সমস্ত অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে তার দু’একটা এখানে তুলে ধরা হচ্ছে।

ভিডিও-১: এই ভিডিও’টাতে দুটো লোককে এক মহিলার শাড়ি ধরে টানতে দেখা যাচ্ছে। তিনি এক ব্লক পঞ্চায়েত প্রধান প্রার্থীর প্রস্তাবক। তাঁর জিনিসপত্র ও ৭,৫০০ টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়, এবং প্রস্তাবককে এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হওয়ায় প্রার্থী নিজের মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেন না। রিটার্নিং অফিসার এবং পুলিশের সামনেই বিজেপির দুষ্ক‌তিরা মহিলার অসম্মান ঘটানোর স্পর্ধা দেখায়। এই ঘটনায় হাত গুটিয়ে রাখার জন্য সাত পুলিশ কর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।

ভিডিও-২: এই ভিডিও’তে এক পুলিশ অফিসারকে তাঁর ঊর্ধ্বতন অফিসারকে পরিস্থিতি সম্পর্কে ফোনে অবহিত করতে দেখা যাচ্ছে। তিনি জানাচ্ছেন, “বিজেপি বিধায়ক আর জেলা নেতৃত্বের লোকজন ইট-পাথর ছুঁড়ছে স্যর! বোমা এনেছে। আমাকে থাপ্পড়ও মেরেছে।”

ভিডিও-৩: এই ভিডিও’তে দেখা যাচ্ছে উন্নাওয়ের প্রধান উন্নয়ন অফিসার দিব্যাংশু প্যাটেল সাংবাদিক কৃষ্ণ তিওয়ারির কান ধরে আছেন এবং তাঁকে মারছেন। সাংবাদিক বিজেপি দুষ্কৃতীদের চালানো হিংসার ছবি তুলছিলেন।

ভিডিও ছাড়াও আর যে সব অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে তার মাত্র দুটো এখানে রাখা হচ্ছে। সুন্দরলাল হলেন ব্লক ডেভেলপমেন্ট সদস্য ইয়াদুরাই দেবীর স্বামী। তাঁর বড় ভাই কিভাবে বিজেপি দুষ্কৃতীদের হাতে নিহত হন সে সম্পর্কে তিনি জানান — “ব্লক প্রমুখ প্রার্থী সবিতা যজ্ঞাসাইনির স্বামী সুধীর যজ্ঞাসাইনি ও তারসঙ্গে আসা দুষ্কৃতীরা রাত দুটোয় দিবাপূর্বা গ্ৰামে আমাদের বাড়ি থেকে আমার স্ত্রীকে অপহরণের চেষ্টা করে। আমার বড় ভাই মায়ারাম ওদের ঠেকানোর চেষ্টা করলে ওরা রাইফেলের বাঁট দিয়ে ওর মাথায় মারে এবং সঙ্গে-সঙ্গেই সে মারা যায়।” সুধীর যজ্ঞসাইনি বিজেপি কর্মী বলে সুপরিচিত।

সিতাপুরের জেলা শাসক বিশাল ভরদ্বাজ জানিয়েছেন — কাসমণ্ডার ব্লক প্রমুখ পদে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় গুলি চলেছে, গুলিতে একজন আহত হলে চিকিৎসার জন্য তাকে লক্ষ্ণৌ নিয়ে যাওয়া হয়, হিংসায় যুক্ত থাকার জন্য চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

poverty hints at huge profits

ভারতের শীর্ষ ব্যাঙ্ক আরবিআই জানালো, ২০১৯-২০’তে ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মোট ৮৪,৫৪৫টি জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, যার আর্থিক মূল্য হল ১,৮৫,৭৭২ কোটি টাকা। আর, এই সমস্ত আর্থিক কেলেঙ্কারির সাথে ব্যাঙ্কের কতজন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জড়িত, সে ব্যাপারে আরবিআই জানাচ্ছে এই সংখ্যাটা এখনও জানা যায়নি।

শীর্ষ ব্যাঙ্কের কাছে তথ্য জানার অধিকার আইনে একজন কর্মী অভয় কোলারকার প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা পাঠানোর পর এই তথ্য পেয়েছেন।

এদিকে, সেন্টার ফর মনিটারিং অফ ইন্ডিয়ান ইকনমি ২৮ মে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে দেখালো যে, নির্দিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জে যে সংস্থাগুলো নথিভুক্ত রয়েছে, তারা মার্চ ২০২১ বিত্তবর্ষের শেষে বিপুল মুনাফা কামিয়েছে। প্যান্ডেমিকে দ্বিতীয় তরঙ্গে সাধারণ মানুষ, দেশের অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত, সেই বিরাট বিপর্যয়ের মধ্যে অকল্পনীয় হারে এই মুনাফা লাভ রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা।

বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত ৪,৪০৬টি কোম্পানি ২০২০’র সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরের ত্রৈমাসিকে যে মুনাফা কামিয়েছে তার পরিমাণ হল যথাক্রমে ১.৫২ লক্ষ কোটি ও ১.৫৩ লক্ষ কোটি টাকা! ২০২১’র মার্চেপ্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় ৯৩৫টি নথিভুক্ত কোম্পানি ১.৫৮ লক্ষ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। আগের ত্রৈমাসিকে তাদের আর্থিক লাভের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট এখনো তিন-চতুর্থাংশ নথিভুক্ত সংস্থা প্রকাশ করেনি। এই কোম্পানিগুলো সম্মিলিতভাবে সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরের ত্রৈমাসিকে ২৫০ বিলিয়ন টাকা মুনাফা অর্জন করেছে। পরিহাস এটাই, সংস্থাগুলো পর পর তিনটি ত্রৈমাসিকে ধারাবাহিকভাবে যতই বিপুল মাত্রায় মুনাফা কামাক না কেন, দেখা গেল ৩১ মার্চে প্রকাশিত ২০২০-২১এ ভারতের জিডিপি সংকুচিত হয়েছে ৭.৩ শতাংশ হারে।

সিএমআইই এই মুনাফা বৃদ্ধির হারকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরের ত্রৈমাসিকে অ-বিত্তীয় সংস্থগুলোর (নন ফাইনান্সিয়াল কোম্পানি) মুনাফা সংকুচিত হয়ে পড়ে, আর অপরদিকে বিত্তিয় পরিষেবা সংস্থা বা ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসে মুনাফা কেন্দ্রীভূত হয়। যদিও, মার্চের ত্রৈমাসিকে অ-বিত্তিয় সংস্থার অভিমুখে মুনাফা বৃদ্ধির হারে পরিবর্তন ঘটে, যা অর্থনীতির ক্ষেত্রে পণ্য পরিষেবা উৎপাদন করে থাকে। যে অ-বিত্তিয় সংস্থাগুলো ২০২০’র সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরে যথাক্রমে ১১ এবং ১ শতাংশ লোকসান করে, তারাই ২০২১’র মার্চে লাভ করে ১৮.৬ শতাংশ হারে। অন্যদিকে, বিত্তিয় সংস্থাগুলোর লাভ হয় ২.১ শতাংশ।

দেখা যাচ্ছে, কর্পোরেট সেক্টরের ক্ষেত্রে অ-বিত্তিয় সংস্থাগুলোর মোট মুনাফা ২০২০’র সেপ্টেম্বরে ছিল ৭৩ শতাংশ, যা পরে ২০২১’র মার্চ ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৭৮ শতাংশ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই মুনাফা এসেছে উৎপাদন খরচ হ্রাস করে — শ্রম সংকোচন করে, মজুরী কমিয়ে, নতুন কোন নিয়োগ না করে অল্প সংখ্যক কর্মী নিয়ে অনেক বেশি কাজ করিয়ে নেওয়া, নতুন কোন বিনিয়োগ না করা, ইত্যাদি। এটা স্পষ্ট, যে কোম্পানিগুলো মুনাফা যতই কুক্ষিগত করুক না কেন, তা দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে কোন ভূমিকাই রাখতে পারছে না। আর্থিক দুনিয়ার এক মেরুতে উৎকট কেন্দ্রীভবন, আর বিপরীতে সীমাহীন দারিদ্র ও দৈন্য — আজ কোভিড সময়ের নির্মম বাস্তবতা।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক।

গত মাসে ফোর্বস এক রিপোর্ট প্রকাশ করে দেখায়, কোভিড১৯’র টিকার উপর একচেটিয়া অধিকার কায়েম করার ফলে নতুন ন’জন অর্বুদপতির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। আর বাকি যারা রয়েছেন, তাদের সম্পদ কয়েক মাসে চোখ ধাঁধানো পর্যায় গেছে। এতো বিপুল মুনাফা অর্জন করা সত্ত্বেও কোথাও কাজের বাজারে গতি এলোনা। অর্থনীতিও পরিত্রাণ পেলনা সংকট থেকে।

এই সংকট আজ বিশ্বব্যাপী। ক’দিন আগে অক্সফাম এক রিপোর্ট প্রকাশ করে, ‘দ্য হাংগার ভাইরাস মাল্টিপ্লাইস’। ওই রিপোর্ট জানিয়েছে, প্রতি মিনিটে বিশ্বে ১১ জন মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় মারা যাচ্ছে। আর, সারা দুনিয়ায়, গত বছরের তুলনায়, দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা ছ’গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অতিমারির সময়ে ও দুনিয়া জুড়ে সামরিক খাতে ব্যয় বেড়েছে ৫১ বিলিয়ন ডলার — বিশ্ব ক্ষুধা রোধ করতে রাষ্ট্রসংঘের যে তহবিল প্রয়োজন, এটা তার ছ’গুণ বেশি!

অতিমারি ছোবল মারার আগে থেকেই অর্থনীতির মন্থর গতি ও বিপুল মাত্রায় বেকারত্বের সাথে এই প্রথম কোভিডের দৌরাত্বে ৩২ লক্ষ মধ্যবিত্ত অবলুপ্ত হয়েছে — ভারতীয় অর্থনীতিতে যা আগে কখনও দেখা যায়নি। কোভিডের আসন্ন তৃতীয় ঢেউ আবার দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে তা ভবিষ্যৎই বলবে।

- অতনু চক্রবর্তী

Let's open school

কয়েকদিন আগে হোয়াটস অ্যাপে একটি বার্তা বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল, যাতে বলা হয়েছিল আমাদের সমাজ এক আশ্চর্য সমাজ যেখানে ‘পাঠশালা বন্ধ, আর মধুশালা খোলা’। এমনিতে যুক্তির নিরিখে দেখলে মধুশালায় যাতায়াত ব্যক্তিগত ইচ্ছার ব্যাপার, কিন্তু পাঠশালা ঠিক তেমন নয়, একটা নিয়মের বিষয় — তাই এই তুলনা খুব যথার্থ নয়। কিন্তু এখানে যুক্তির চেয়েও, ধ্বনিসাম্যের নিরিখে দুটি শব্দের চয়নের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল অন্য একটা প্রশ্ন — লকডাউন শিথিল করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব কোথায় দেব?

যখন মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়া হল তখনো এসেছিল একটা প্রতি তুলনা। কেউ কেউ বলেছিলেন যে নির্বাচন আয়োজনে যে গুরুত্ব দেওয়া হল, উচিত ছিল সেই গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনের বদলে পরীক্ষার আয়োজন করা। এমনকি নির্বাচনের পর অতিমারি যখন তুঙ্গে তখনো এই কথা উঠেছিল যে পরীক্ষা একেবারে বাতিল না করে অপেক্ষা করা হোক। অতিমারীর ঢেউ খানিক মন্দীভূত হলেই দরকারে জরুরি পরিষেবা ছাড়া অন্য সব কিছু দু’সপ্তাহ বন্ধ রেখে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়ার দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হোক। কারণ বিশ লক্ষেরও বেশি পরীক্ষার্থীর দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ এরসঙ্গে জড়িত।

আমরা জানি এই সব আলোচনার কোনও কিছুই শেষ পর্যন্ত সরকার মানেননি। কিন্তু এগুলি যে পাড়ার মোড়ের বা চায়ের দোকানের চর্চা শুধু নয়, হোয়াটস অ্যাপের ক্যাজুয়াল ফরওয়ার্ডিং বা ফেসবুক পোস্ট-এর ব্যাপার নয়, বিশ্বের সামনের সারির বিভিন্ন নীতি নির্ধারক সংস্থারও চিন্তাভাবনা, তাও আমরা সাম্প্রতিক সময়ে জেনেছি।

অল্প কয়েকদিন আগেই ইউনিসেফ জানিয়েছে যে বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকারী নীতি দেখা যাচ্ছে সবার আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করো আর সবার শেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলো। ইউনিসেফ-এর মতে হওয়া দরকার ঠিক এর বিপরীত। জরুরী প্রয়োজনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হলে তা করতে হবে সবার শেষে আর পরিস্থিতি স্বাভাবিকতার দিকে খানিক মোড় নিলে সবার আগে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে খুলে দিতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

ভারতবর্ষের মতো প্রথাগত শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে পড়ে থাকা এই দেশের জন্য এই চেতাবনি খুবই জরুরি। এমনিতেই অবহেলিত শিক্ষা এই অতিমারীর সময়ে অবহেলার দিকে আরো বেশি গড়িয়ে গেল, তা আমরা সবাই গত দেড় বছরে প্রত্যক্ষ করছি।

তবে এবার স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় — সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবি সমাজের মধ্যে থেকে ক্রমশ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এখনো অনেকে সংশয়ী নন তা নয়, কিন্তু সাবধানতা নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুর বিষয়ে জনমত ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। স্কুল খোলা নিয়ে যে সমস্বর উঠেছে শিক্ষক অভিভাবক সমাজের ভেতর থেকে, ইউনিসেফ থেকেও এসেছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব — সেই ভেতর বাইরের বক্তব্যের নিরিখে সরকার হয়ত এবার স্কুল খুলে দেবেন।

ফলে অনলাইন ক্লাস-এর ওপর একমাত্র নির্ভরতা অনেকটাই কমবে। কিন্তু মহামারী আগামীদিনে কোন বাঁক নেবে, থার্ড ওয়েভ ফোর্থ ওয়েভ ইত্যাদি ঢেউ আসতেই থাকবে কিনা, আসলে তার ব্যাপকতা কতটা হবে — এই সবই অনিশ্চিত। ফলে অনলাইন ক্লাস নিয়ে চিন্তাভাবনাকেও স্কুল কলেজ খোলার উদ্যোগের পাশাপাশি এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ক্লাসরুম শিক্ষার পাশাপাশি বিকল্প পদ্ধতিকেও তৈরি করে রাখতে হবে, যাতে প্রয়োজনে তাকে আরো অনেক ভালোভাবে, অনেক পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা যায়। এমনকি স্থান সংকুলানের কারণে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হয়ত রোটেশান পদ্ধতি নিতে হবে। এতে ক্লাসঘরের শিক্ষার সময় কমবে। সেই ক্ষতিপূরণের জন্য ক্লাসঘরের শিক্ষার পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষাকেও চালিয়ে যেতে হতে পারে।

Let's open school, college

 

অনলাইন ক্লাস ইস্কুলের বিকল্প হতে পারবে না কোনওভাবেই — তা প্রথম থেকে জানা ছিল। কিন্তু অনলাইন ক্লাস যতটা সীমাবদ্ধ হয়ে থাকল গত পনেরো ষোলো মাসে — ততটা সীমাবদ্ধ হয়ে যাবারও বোধহয় কথা ছিলনা।

বিশেষ করে যত ঘরে স্মার্ট ফোন আছে, ইন্টারনেট ডেটা প্যাক যতটা সস্তা হয়েছে আগের চেয়ে তার হিসাব নিকাশ করলে মনেই হয় যে অনলাইন ক্লাস যতটা সীমাবদ্ধ হয়ে থেকেছে, তার চেয়ে প্রসারিত হতে পারত।

কেন অনলাইন ক্লাস আরো খানিকটা প্রসারিত হতে পারলনা সেই আলোচনা একটা স্বতন্ত্র বিষয়। সেখানে স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেটের ডেটা প্যাক, কানেকশান ও গতির সহজলভ্যতা এসবের প্রশ্ন আছে, ছোটদের মনঃসংযোগের প্রশ্ন আছে, শিক্ষাদপ্তরের পরিকল্পনার খামতি নিয়েও প্রশ্ন যে একেবারেই নেই তাও নয়।

কেন এতদিনেও বিভিন্ন শ্রেণির বিষয়ভিত্তিক ক্লাস মেটেরিয়াল এক জায়গায় রাখার একটা ওয়েব সাইট ও অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ তৈরি করে ফেলা গেলনা, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা তাদের সময় সুযোগ মত ঢুকতে পারত আর দেখে নিতে পারত তাদের পাঠ্য বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনও ভিডিও, ছবি, চার্ট, ম্যাপ, গ্রাফ, লেখা ইত্যাদি তা বোঝা দুষ্কর।

ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন রাখার আর উত্তর পাওয়ার জায়গাও সেখানে রাখা যেতে পারত, ওয়েব পোর্টালটিকে ইন্টার‍এ্যকটিভ করে তোলার অনেক সুযোগ তো প্রযুক্তি করেই দিয়েছে। তবুও সেই সুযোগকে ব্যবহার করে নেবার দিকে শিক্ষা দপ্তর এগোলেন না।

এই অতিমারীকে মোকাবিলা করে এই সময়ে শিক্ষাকে কিছুটা হলেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটা যে এক একটি বিদ্যালয় ও তার শিক্ষক শিক্ষিকাদের বিচ্ছিন্ন উদ্যোগের বিষয় নয়, সেই উদ্যোগ যতই আন্তরিক হোক না কেন শেষ পর্যন্ত একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও পরিকাঠামো এই বিপুল সমস্যার মোকাবিলায় জরুরি — তা শিক্ষা দপ্তর বুঝে উঠতে পারেননি বলেই মনে হয়।

এই সমস্ত নানা ধরনের বিষয় ছাড়াও অন লাইন ক্লাস সংক্রান্ত সমস্যাটা অনেকটাই অর্থনৈতিক।

Let's open school_0

 

এমনিতেই সরকারী স্কুলে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশ দরিদ্র প্রান্তিক পরিবারের। বিশেষত শহর মফস্বলে। আর এই পুরো বা আধা লকডাউনে এই পরিবারগুলির জীবিকা সঙ্কট মারাত্মক জায়গায় পৌঁছেছে। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর জন্য সাধারণ পরিস্থিতিতে যতটা খরচ তারা যোগাতে পারতেন, কষ্ট করে একটা কম দামি নতুন স্মার্ট ফোন কিনে দিয়ে বা বেশি ডেটা প্যাক রিচার্জ করে — এই পরিস্থিতিতে তারা সেটা পারেননি।

অনেক ছাত্রছাত্রীকে আবার বাবা-মা’র সঙ্গে কাজে নামতে হয়েছে, পড়াশুনোতে ইতি টানতে হয়েছে। অন্যান্য বিষয়গুলোর সঙ্গে এই ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয় অনলাইন ক্লাসকে আরো সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। ফলে স্কুল খোলার দাবি সর্বস্তরে আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি এখন।

নতুন কোনও ঢেউ বিপর্যস্ত করে না দিলে বোধহয় এবার চলবে প্রত্যক্ষ ক্লাসরুমের পড়া। কতগুলি ক্লাস নিয়ে আর কতটা রোটেশনে সেগুলি ক্রমশ সামনে আসবে।

কিন্তু মানসিকভাবে বোধহয় এভাবেই সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে যে স্কুল খোলা বন্ধের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আরো ফ্লেক্সিবল হতে হবে সংক্রমণের গোটা পর্বটি জুড়ে। যা বেশ কয়েক বছর বা দশকও স্থায়ী হতে পারে।

সংক্রমণ বাড়লে সাথে সাথে বন্ধ করা আর ঢেউ স্থিমিত হলে দ্রুত খুলে দেওয়া — এই অভিযোজন ছাড়া বোধহয় গতি নেই।

করোনা বিষয়ে সাধারণ মানুষ দূর অস্ত, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, গবেষকরাও অনেকটাই অন্ধকারে এখনো। ফলে খোলা মনে এগিয়ে পিছিয়ে পথ চলা ছাড়া অন্য উপায় বোধহয় নেই।

স্কুল খোলার সময়ে আমাদের সকলকেই অনেক বেশি সতর্ক, দায়িত্ববান, সংবেদনশীল আন্তরিক হতে হবে। নতুন সময়ের ও পরিস্থিতির দাবিতে যে অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষিকা ভীষণভাবেই সাড়া দেবেন, তাদের বুদ্ধিবৃত্তি, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, উৎসাহ ও আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবেন — এটা আশা করাই যায়।

সতর্কতা ও আন্তরিকতা মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সঙ্কটের মোকাবিলা আমরা যে অনেকটাই করে উঠতে পারব — এরকম বিশ্বাস না রাখার কোনও কারণ নেই।

- সৌভিক ঘোষাল

Aadhaar card

দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে আগামী ৩১ জুলাই ২০২১’র মধ্যে দেশের সব রাজ্যের সমস্ত মানুষের রেশন কার্ডের সঙ্গে যেন আধারের সংযোগ ঘটানোর প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়। এই রায় দেওয়ার একটাই কারণ গত লকডাউনে যখন পরিযায়ী শ্রমিকদের দীর্ঘ হাঁটা সারা পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় তখন ওই আদালত তিরষ্কার করে কেন্দ্রীয় সরকারকে। কেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে দেশে যদি করোনার মতো অতিমারী আসে সরকার তা সামলাতে পারবে না? কেন মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাবেন? কেন কতজন পরিযায়ী শ্রমিক এই মুহূর্তে কাজ করছেন, তার কোনও তথ্য নেই, সেই প্রশ্নও কেন্দ্রীয় সরকারকে করেছে সর্বোচ্চ আদালত। সরকার অজুহাত হিসেবে বলেছে, রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার সংযোগ হচ্ছে না তাই মানুষ রেশন পাচ্ছে না। আদালত তাই আদেশ দিয়েছে, ঠিক আছে, সেটা তবে করা হোক।

এই আদেশের পর সব রাজ্যেই আধার সংযোগের কাজ শুরু হয়ে গেছে। হওয়ার কথা ছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের নিবন্ধীকরণের কাজ, তা কোথায় কি করা হল খবর নেই, চালু হয়েছে আধার সংযোগের কাজ। তবে ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে আধারের এবং রেশন কার্ড সংযোগ করার পরেও রেশন না মেলার অভিযোগ আসছে। বিভিন্ন সময়ে কাজের ধরন, বয়সের কারণ বা অন্যান্য অনেক কারণে মানুষের হাতের ছাপ মেলে না, তাহলে কি সেই মানুষটির অস্তিত্ব থাকেনা? রাজ্য সরকার দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে রেশন কার্ডের সঙ্গে আধারের সংযোগ করাচ্ছেন, কিন্তু তাতে কি সমস্যার সমাধান হবে? যেখানে আধারের তথ্য ভান্ডার কোনোদিন পরীক্ষিত হয়নি, কত ভুয়ো আধার আছে তা জানা নেই, দেশের নানান প্রান্তে বহু সময়ে যাঁদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে ধৃত দাবি করা হয়েছে তাঁদের কাছে ভুয়ো আধারও পাওয়া গেছে। আধার শুধু বাদ দেওয়ার উপকরণ নয়, এক ধরনের বড় দুর্নীতিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টাও বটে। একজন মানুষের পরিচয় যখন একটি সংখ্যায় পর্যবসিত হয় তখন সেই মানুষটির কি অস্তিত্ব বিপন্ন হয় না?

২০১৩ সালে যে খাদ্য নিরাপত্তা আইন লাগু হয় তাতে বলা হয় যে জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে রেশন কার্ড দিতে হবে। ২০১১’র জনগণনার নিরিখে সেই কাজ শুরু হয়েছিল, আর এই মুহুর্তে দেশের ৬০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৮০ কোটি মানুষের কাছে রেশন পৌঁছানোর জন্য যা করার তাই করতে হবে। কিন্তু তা কখনোই আধার সংযোগ নয়। খাদ্য সুরক্ষা আইন বলে একজন মানুষ ৫ কেজি খাদ্য শস্য পেতে পারেন অথবা পরিবার পিছু ৩৫ কেজি মাসিক খাদ্য শস্য পাবেন অন্তোদ্যয় যোজনায়। প্রতিটি অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট রেশন দোকান থেকে ওই মানুষেরা তাঁদের জন্য বরাদ্দ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতেন এতদিন। তাহলে ‘এক দেশ এক রেশন’ নতুন কি সুবিধা দেবে? যা বোঝা যাচ্ছে তা হল, এই প্রকল্পের ফলে একজন বিহারের মানুষ যদি বাংলায় বা কেরালায় কাজ করতে যান, তিনি সেই রাজ্যে যেখানে থাকবেন সেখানকার কোনও রেশন দোকান থেকে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে পারবেন।

শুনতে আকর্ষণীয় মনে হলেও বেশ কিছু প্রশ্ন এসেই যায়।

প্রথমত, সরকারের কাছে কি এই তথ্য আছে যে কতজন পরিযায়ী শ্রমিক এই সরকারি খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা থেকে আগে থেকেই খাদ্য শস্য সংগ্রহ করতেন? কিংবা কতজনের রেশন কার্ড আদৌ আছে? আত্মনির্ভর ভারতের যে ঘোষণা করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে, তাতে বলা হয়েছে যে আট কোটি পরিযায়ী শ্রমিককে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে গণবন্টন ব্যবস্থার মধ্যে, তার মানে অন্তত ন্যূনতম এই সংখ্যার মানুষের কোনও রেশন কার্ড ছিল না।

দ্বিতীয়ত, যে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকেরা গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে যান, বেশিরভাগ সময়ে পরিবারকে গ্রামে রেখেই যান, পরিবারের মানুষেরা রেশন দোকান থেকে খাদ্য দ্রব্য সংগ্রহ করে সংসার চালাতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বেশিরভাগ রাজ্যেই যেহেতু পরিবার পিছু একটি করে কার্ড তাই তাঁদের ক্ষেত্রে এটা সবসময়েই সত্যি যে তাঁরা শহরে কাজে গেলেও তাঁদের পরিবারের কার্ডটি বাড়িতে থাকে। তাহলে যদি কোনও ব্যক্তি তর্কের খাতিরে ধরা যাক রেশন কার্ডটি নিয়ে যেতে হয় তার আগে তো মাথা পিছু কার্ড তৈরি করতে হবে। নাহলে যে যেখানে থাকছেন অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট পরিযায়ী শ্রমিক ও তাঁর পরিবার কিভাবে পাবেন তাঁর বা তাঁদের প্রাপ্য খাদ্যশস্য? যদি আমাদের রাজ্যের মতো প্রত্যেকটি মানুষের জন্যে আলাদা কার্ডও থাকে তাহলেও শহরে এবং গ্রামে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে রেশন নিতে গেলে যদি মানুষেরা অসুবিধার সম্মুখীন হন, সেই অসুবিধা সামলানো যাবে কি করে? কোনও একজনকে যদি বলা হয় যে তাঁর প্রাপ্য রেশন তোলা হয়ে গেছে, তিনি কি করে প্রমাণ করবেন যে তোলা হয়নি? গ্রামের মহিলারা কি এতোটা প্রযুক্তি বান্ধব হয়ে উঠেছেন, কিংবা এতোটা সোচ্চার হতে পারবেন যদি চোখের সামনে দুর্নীতি হয়েও যায়? যদি বলা হয় যে শহরে তাঁর পরিবারের প্রাপ্য রেশন তোলা হয়ে গেছে, তাহলে তিনি কিভাবে তার প্রতিবাদ করবেন?

তৃতীয়ত, বেশ কিছু রাজ্য, কেন্দ্রের যে খাদ্য শস্য দেওয়ার প্রকল্প চলছে তার বাইরে গিয়ে আরও বেশ কিছু জিনিষ দিয়ে থাকে। তামিলনাডু, ছত্তিশগড় এবং হিমাচল প্রদেশ ডাল এবং ভোজ্য তেলও সরবরাহ করে ভর্তুকি দিয়ে। যেখানে কেন্দ্র শুধু চাল এবং গম দেয়, সেখানে রাজ্য সরকারের তরফে এই তেল, ডাল দেওয়ার ফলে মানুষ উপকৃতই হচ্ছেন। কেন্দ্র যেমন চালের জন্য পয়সা নিয়ে থাকে, কোনও কোনও রাজ্য বিনামুল্যে চাল দিয়ে থাকে। তাহলে একজন বাঙালী শ্রমিক যদি তামিলনাডুতে কাজ করতে যান, তাহলে তিনি বিনামুল্যে চাল পাবেন, এবং ভর্তুকিতে তেল, ডাল পাবেন। নাকি তাঁকে বলা হবে যে তিনি ওইসব পাওয়ার যোগ্য নন, যেহেতু বাংলায় এই খাদ্য দ্রব্য তাঁর পাওয়ার কথা নয়? এরসঙ্গে খাদ্যাভ্যাসের বিষয়টিও আছে, একজন মানুষের যদি শুধু ভাত খাওয়ার অভ্যাস থাকে, তিনি যদি রাজস্থানে বা পাঞ্জাবে যান তাহলে কি তাঁকে রুটি খেয়ে থাকতে হবে, যেখানে গণবন্টন ব্যবস্থা দিয়ে শুধু গমই সরবরাহ করা হয়? সমস্ত খাদ্যাভ্যাসকে এক করে দেওয়াও তো এক ধরনের ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বটে। আপনি কি খাবেন না-খাবেন সেটাও তো রাষ্ট্রের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত করা হয়ে যায়। রাজ্য রাজ্য প্রকার ভেদে রসদ সংক্রান্ত চাহিদা ও যোগানের সমস্যাও তৈরি হবে। আগে কোনও একটি অঞ্চলের রেশন দোকানে নির্দিষ্ট পরিমাণে খাদ্য দ্রব্য ফুড কর্পোরেশন বা কেন্দ্রীয় সংস্থা থেকে আসতো, কিন্তু ‘এক দেশ এক রেশন’ কার্ড যদি জুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে কত মানুষের জন্য খাদ্য দ্রব্য আনতে হবে তা হিসেব করাও মুশকিল হবে। ধরা যাক বিহার থেকে ২০ জন শ্রমিক বাংলার একটি জেলায় কাজ করতে এসেছেন এক মাসে, পরের মাসে সংখ্যা বাড়তে পারে কমতেও পারে, তাহলে কোনও একটি রেশন দোকানে খাদ্য শস্য সরবরাহ হবে কি হিসেবের ওপর দাঁড়িয়ে? তারফলে অঞ্চলে যারা স্থায়ী বাসিন্দা তাঁরা ঠিকঠাক পরিমাপ মতো খাদ্যশস্য পাবেন তো?

‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ হয়তো সম্ভব, কিন্তু তারজন্য যা যা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা করতে হবে তা কি করা হচ্ছে? হচ্ছে না। গত লকডাউনের সময়ে বেশ কিছু রাজ্য আধার দিয়ে যাচাই বা বায়োমেট্রিক্স দিয়ে মানুষ চেনার পদ্ধতি সাময়িকভাবে বাতিল করেছে। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন তো ক্ষমতায় আসার পরেপরেই এই প্রক্রিয়াতে মানুষ বাদ পড়ছেন বলে বাতিল করেছেন। যখন উচিত বিভিন্ন রাজ্যে আরো বেশি বেশি যৌথ সরকারি রান্নাঘরের, যখন প্রয়োজন শহরে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের জন্য তৈরি খাবারের বা রেশন ব্যবস্থাকে আরও সর্বাঙ্গীণ করে তোলার তখন আধারের সঙ্গে রেশন কার্ডকে সংযোগ করলে সমস্যা বাড়বে বই কমবেনা। বেশ কিছু রাজ্য কিন্তু সবার জন্য রেশন ব্যবস্থা চালু করে ফেলেছে, যারা ইচ্ছুক তাঁরা যাতে সরকারি ব্যবস্থা থেকে খাদ্যদ্রব্য নিতে পারেন, কিন্তু তাতে আধার সংযোগ বাধ্যতামূলক করা হয়নি। এই করোনা পরিস্থিতিতে একটি পিওএস মেশিন অর্থাৎ পয়েন্ট অফ সেল মেশিনে সমস্ত মানুষজন হাত দিয়ে আঙুলের ছাপ মিলাচ্ছেন সেটাও কি খুব সমীচিন হচ্ছে?

সারা দেশের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে আধারের কারণে বিভিন্ন রাজ্যে বহু মানুষ বাদ পড়ছেন। আমাদের পাশের রাজ্য ঝাড়খন্ডের একটি উদাহরণ দেখা যাক। কয়েকবছর আগেই বহু সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় স্থান পেয়েছিল একটি খবর। ১১ বছরের সন্তোষী ‘ভাত ভাত’ করতে করতে মারা যায়। তার পরিবারের রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার যুক্ত না থাকার ফলে সরকারি রেশন না পেয়ে খিদের জ্বালায় মারা যায় কিশোরীটি। যদিও তৎকালীন সরকারের তরফে এই মৃত্যু আধারের কারণে বঞ্চনার জন্য তা মেনে নেওয়া হয়নি, কিন্তু এটা স্বীকার করা হয়েছিল অপুষ্টি জনিত অসুস্থতার কারণে তার মৃত্যু হয়। অর্থনীতিবিদ জাঁ দ্রেজ এই বিষয়ে বিশদে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন যে শুধুমাত্র এই বায়োমেট্রিক দিয়ে বা আধার দিয়ে চিনতে গিয়ে বহু মানুষ রেশন পাচ্ছেন না। শুধু ঝাড়খন্ডেই বহু মানুষ রেশন না পেয়ে মারা গেছেন এরকম অজস্র উদাহরণ আছে।

পরিযায়ী শ্রমিকদের নিবন্ধীকরণের যে রায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত দিয়েছে তার পরিবর্তে আধারের যাঁতাকলে রেশন উপভোক্তাদের সুচতুরভাবে ছেঁটে ফেলা যে কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকারই করবে না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়?

- সুমন সেনগুপ্ত

economic freedom for girls

মেয়েদের অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করবার ইতিহাস এদেশে বহু প্রাচীন। তার দৈহিক পরিশ্রম চিরকালই অর্থমূল্যহীন পারিবারিক সেবামাত্র। বিনিময়ে বাসস্থান-আহার-বস্ত্র ছাড়া তার আর অন্য দাবি থাকা অনুচিত। কিন্তু ব্যাপার-স্যাপার চিরকালই কি এইরকমই ছিলো? নাকি বিবর্তনের চাকায় বাঁধা বলে দিন দিন আরো বেশি মজবুত হয়েছে এই রেওয়াজ? সমাজে পিতৃতন্ত্র যতো গেড়ে বসেছে, ততই কি মেয়েদের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে?

সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর একাধিক প্রবন্ধে অসীম যত্নে এই সবগুলো প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন ও আমাদের চোখের সামনে থেকে অনেক পরত পর্দা হটিয়ে দিয়েছেন। তবে সে প্রসঙ্গে যাবার আগে বর্তমানের আধুনিক ও সচেতন সমাজে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার কিরকম সেটা একটু জানার চেষ্টা করি। যদিও সব চেষ্টা সত্ত্বেও যেটুকু জানা যাবে তা হলো হিমশৈলের চূড়ামাত্র।

হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক দলের কেস স্টাডি এবং থিসিস থেকে জানা যায় যে গ্রামের তুলনায় শহরে মেয়েদের কিছু কিছু অর্থনৈতিক অধিকার থাকলেও, ছেলে মেয়ের সম অবস্থানের এখনও ঢের দেরী। দোকান ঘরে এখনও মালিকের নামের পাশে এন্ড সন্স লিখে রাখাই দস্তুর। আর ফ্ল্যাটের মালিকানা, লকারের মালিকানা ইত্যাদির ক্ষেত্রে গৃহস্বামীর অধিকার একচেটিয়া। গ্রামে কন্যার নামে জমি কেনা বা বাড়ির দলিল বানানো খুবই বিরল। বিবাহের পর স্ত্রী চিরবশ্য থাকবে এটা ধরে নিয়ে অল্পস্বল্প সম্পত্তি তার নামে রাখা যায়, যদি জমিজমার পরিমাণ বেঁধে দেওয়া সিলিংয়ের ওপরে উঠে যায়। গ্রাম এবং শহর একটি ব্যাপারে একেবারেই একমত, সেটা হলো মেয়ের বিয়েতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়, তারপর আর মেয়েকে সম্পত্তির মালিকানা না দিলেও চলে। বিশেষ করে পড়াশোনা শেখালে তো কথাই নেই। যেন ছেলের পড়াশোনায় কোনো অর্থব্যয় হয় না। তবে এটা ঠিক ছেলের বিয়ে মেয়ের বিয়ের থেকে আলাদা বলেই সমাজে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে। কারণ পণপ্রথা। ধরেই নেওয়া হয় যেখানে মেয়ে পার করতে প্রচুর টাকা খসবে, সেখানে নব বিবাহিত ছেলে ঘরে কিছু মালকড়ি ঢোকাবে। এইভাবে মেয়েকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবার পক্ষে একটা যুক্তি সমাজে নিজে থেকেই গড়ে ওঠে। আর পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সে যুক্তির পূর্ণ সদব্যবহার করে।

এই অর্থমূল্যে চুকিয়ে দেবার মনোভাবের জন্যই বিবাহের পর থেকে সবার সঙ্গে মেয়েটিও নিজেকে পর ভাবতে শুরু করে, যেন বাবার বাড়ির সঙ্গে তার সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হলো। শ্বশুরবাড়িতে নিগৃহীত হলেও সে ফিরে আসার কথা ভাবতে পারেনা, কারণ বিবাহের সঙ্গে সঙ্গে সে যেন বাবার বাড়ির ওপর সমস্ত অধিকারই হারিয়েছে। কেউ যদি ফিরে আসেও তাকে বহিরাগতদের মতোই দেখা হয়। বাবা মাও মেয়েটিকে ফিরে যাবার জন্য ঝুলোঝুলি করতে থাকে। সামাজিক সম্মান, ভবিষ্যৎ, সাময়িক ভুল বোঝাবুঝি, এইসবের অছিলায় মেয়েটিকে আবার ফেরত পাঠানো হয় শ্বশুর বাড়িতে। সেই সুযোগে ঘটে যায় অনেক অনাচার, অপমৃত্যু, বধূহত্যা।

আর সাংসারিক কাজের বিনিময়ে কোনো অর্থমূল্যের কথা ভাবাও পাপ। নারীর কল্যাণী মূর্তি নিজেকে বলি দিয়ে সংসারকে ধরে রেখেছে আবহমান কাল থেকে, রাখবেও মানব সভ্যতার অন্ত অব্দি৷ তার কোনো বিনিময় মূল্য হয়না।

বৈদিক যুগে এই রেওয়াজ কেমন ছিলো সে প্রসঙ্গে সুকুমারী ভট্টাচার্য বলেছেন যে বৈদিক সাহিত্য এব্যাপারে নীরব। তবে শাস্ত্র ইত্যাদিতে যা প্রমাণ আছে তাতে একেবারে শুরুতে কন্যাসন্তান মানেই আপদ, এইরকমই ভাবা হতো। অবশ্যই গৃহকর্ম তার এক্তিয়ারে ছিলো, কিন্তু তার কোনো অর্থনৈতিক হিসেব হতোনা। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে খুব স্পষ্ট ভাবে পুত্রকে দেবতার বর ও কন্যাকে অভিশাপ বলা হয়েছে। বিবাহের সময় দান করে দেবার আগে গৃহে কোনোমতে কন্যার উপস্থিতি সহ্য করা হতো। বিবাহের পর তার নিজের একটি পরিচয় হলেও, তার প্রতি অনেক নতুন রকম নির্মমতার শুরুও হয় ঐ সময় থেকেই। কন্যা থেকে স্ত্রীর পদে উত্তরণ তাকে আশাহীনতা এবং অপমান থেকে মুক্তি দেয় না।

যদি কোনো নারীর স্বামী দ্বিতীয় বার বিয়ে করে, তখন কেমন অবস্থা হবে প্রথমা স্ত্রীর অর্থনৈতিক অধিকারের? এপ্রসঙ্গে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ মনুর কী বিধান তা সুকুমারী আমাদের বলেন ‘প্রাচীন ভারতে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার’ প্রবন্ধে। যে নারীকে পুরুষটি দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে যাচ্ছে তাকে যতটা পরিমাণ স্ত্রী ধন দেবে সে, তার সম পরিমাণ ধন দেবে প্রথমা স্ত্রীকে। যদি প্রথমাকে স্ত্রী ধন আগেই ফেরত দেওয়া হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে দ্বিতীয় স্ত্রীকে দেয় ধনের অর্ধভাগ দেবে প্রথম স্ত্রীকে। কিন্তু এই প্রথমা স্ত্রী যদি পুত্রহীন হয়, যে ছুতো আগে একাধিক বিয়ে করার সময় আকছার দেওয়া হতো, তাহলে কিন্তু তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দান করে দেওয়া সম্পত্তি আবার সবটাই স্বামীটির কাছেই ফেরত আসবে। প্রথমার পুত্র না থাকলেও কন্যা থাকতে পারে। কিন্তু থাকলেও সে ধর্তব্যের মধ্যে আসবে না, এই ছিলো প্রাচীন রেওয়াজ।

এই স্ত্রীধন ব্যাপারটি কী? কতটা এর ব্যাপ্তি? শুনে কৌতুক বোধ হবে যে আট ধরনের বিবাহের বেশির ভাগেই বধূর পিতা বরের আত্মীয় স্বজনদের অর্থ বা পণ দিতো। কেবলমাত্র আসুর বিবাহে বর নিজের কামনা দ্রুত চরিতার্থ করতে বধূ এবং বধূর পিতাকে স্ত্রীধন দিতো। অর্থাৎ পণ বা স্ত্রীধন যাইই হোক না কেন, যে বধূ হতে যাচ্ছে সেই কন্যাকে হয় আরো অর্থ উপঢৌকন সহ বিক্রি করা হচ্ছে যেন সে একা সামগ্রী হিসেবে বিক্রিরও যোগ্য নয়। নয়তো সরাসরি পয়সার বিনিময়ে আসুর বিবাহের মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে। তাহলে বোঝা গেল নিজের সম্মানের বিনিময়ে এই স্ত্রীধন পাওয়াও সব মেয়ের কপালে জুটতো না, কেবলমাত্র আসুর বিবাহের বধূদের স্ত্রীধন দেবার রেওয়াজ ছিলো। তার ওপর আবার এতো শত নিয়ন্ত্রণ !

আসলে আইন থাকলে তার ফাঁকও আছে। এখনও আছে, তখনও ছিলো। ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য এক জায়গায় বলেছেন, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং নিজে কারারুদ্ধ থাকলে স্বামী স্ত্রীধন কাজে লাগাতে পারে। এখন যেমন কোভিডে দেশ ছেয়ে গেছে, সেইসময়ও রোগবালাই কিছু কম ছিলনা, স্বামী দেবতাটি এইরকম হলে চোখের পাতাটি না ফেলেই স্ত্রীধন আত্মসাৎ করতে পারতো। আর যেকোনো বিবাহেই নারী যদি নিঃসন্তান থাকে তাহলে তার যাবতীয় যা কিছু সব স্বামীর।

নারীর নিজস্ব সম্পত্তি থাকবে এটা তখন সমাজ মেনে নিতে পারতো না। এখনো তার কিন্তু কিন্তু ভাব যায়নি। নারীর সম্পত্তি থাকলেই সমাজ তার একজন অভিভাবক ঠিক করে দেবার জন্য উঠে পড়ে লাগে, সে মহিলাটি প্যারিস হিলটন হন বা সাধারণ কোনো লটারি প্রাপিকা। আরও সোজাসাপটা ভাবে বলতে গেলে তখন এই ধারণাই ছিলো যে নারীর সম্পত্তিতে অধিকার থাকা উচিত নয়, তাই তা নেই। মনুসংহিতায় বলা আছে নারী যা উপার্জন করে তা তার স্বামীর। কাত্যায়ন কোনো রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, যা নারী শিল্পকর্ম করে উপার্জন করে এবং যা তাকে ভালবেসে দেওয়া হয়, সমস্তটাই তার স্বামীর অধীন। তার মানে নিজস্ব উপার্জনও তার নিজের নয়। এই পরম্পরাই মনে এবং কাজে বহন করে নিয়ে চলেছে একবিংশ শতকের বহু পুরুষ পুঙ্গব, যারা স্ত্রীর নিজের বাবা মায়ের জন্য কোনো অর্থব্যয় করা নিয়ে স্ত্রীদের তুমুল বাধা দেয়। আমাদের চারপাশে এই মানসিকতা এখনো বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে।

মনুর মতো চালাক লোক একাল বা সেকালে বিরল। সবসময় এক কাঠি ওপরে তার অবস্থান। মনুর মতে স্ত্রীকে গায়ের জোর খাটিয়ে বশে রাখা যায় না, তারজন্য অনেকগুলি কৌশল অবলম্বন করা দরকার। তাদের নিযুক্ত করতে হবে আয়ব্যয়ের হিসাব রাখার কাজে। শিক্ষাবঞ্চিত করে তার অর্থ উপার্জন করতে দেওয়ার পথে কাঁটা বিছিয়ে দেওয়া হলো, শিল্পকর্ম করে যৎসামান্য আয় করলে তা কেড়ে নেওয়া হলো, তারপরে অন্যের উপার্জিত অর্থ কতো এলো, কতো গেল এই হিসাব সে রাখবে, যেন বধূ নয়, সে আসলে ভারবাহী গর্দভ!

এছাড়া নিজেদের দেহ, গৃহ, বিছানা, আসবাব, বস্ত্র, সব পরিষ্কার করবার কাজে তাকে লাগিয়ে দাও, যেন অন্য দিকে মন দেবার বিন্দুমাত্র সুযোগ সে না পায়।

The days of economic freedom for girls_0

 

এতো কাজের পাহাড় চাপানো কেন? যেহেতু গৃহে বন্দী থাকলে বা পুরুষ আত্মীয়ের কড়া পাহারায় থাকলেও দুষ্টা নারী যথেষ্ট রক্ষিত নয়, তাই তার মন যাতে অন্য দিকে না যায় সে কারণে চব্বিশ ঘন্টাই তাকে ব্যস্ত রাখা হোক। সুকুমারী বললেন, “তাহলে স্ত্রী’কে বশে রাখা, যা কিনা বৈধ পুত্রসন্তান লাভে আবশ্যিক, তার একটি উপায় হলো, তাকে নানারকম গৃহকর্মে নিযুক্ত রাখা, যেগুলি আর্থিক মূল্যে কখনোই রূপান্তরিত করা যায়না, যার ফলে সর্বদাই তার নিজেকে পরিবারের আর্থিক বোঝা বলে মনে হতো।”

তাহলে দেখা যাচ্ছে নারীকে কব্জায় রাখার জন্য এদেশের সমাজপতিরা প্রচুর মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়েও চর্চা করেছে। সবদিক থেকে মেয়েটিকে খাঁচায় বন্দী করে রাখাই ছিলো তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।

কোনো মেয়ে যদি তার স্বামীকে হারায়, তাহলে সমাজ তাকে দেখতো আর্থিক বিপদ এবং ভার হিসেবে। তার কারণ, তখন সমাজ ছিলো কৃষিপ্রধান, পরিবার ছিলো যৌথ। কর্ষণযোগ্য ভূমি ভাগ হয়ে যাক, এটা কোনো পরিবারই চাইতো না। এখনো গাড়োয়ালের গ্রামেগঞ্জে অনেক জায়গায় স্বামী মারা গেলে এই কারণেই বিধবা বধূর সঙ্গে তার দেবরের বিবাহ দেওয়া হয়। বৈদিক যুগে যাতে স্বামীর মৃত্যুর পর ভূমি ভাগ না হয়, এবং মেয়েটি আবার বিয়ে করলে নতুন স্বামী জমির ভাগ না চাইতে পারে, সেজন্য দু’একজন বাদে বৈদিক স্মৃতিকাররা নিয়ম করলেন বিধবাকে স্বামীর শবদেহের সঙ্গে দাহ করা হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে কু-আচারের শ্রেষ্ঠ যে সতীদাহ প্রথা তাও উদ্ভব হয়েছিলো মেয়েদের অর্থনৈতিক অধিকার কেড়ে নেবার জন্য। বঙ্গভূমিতেই ১৮১৫ থেকে ১৮৮০’র মধ্যে মোট ২,৩৬৬ জন বিধবাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো, শুধু কলকাতাতেই ১,৮৫৮টি সতীদাহ হয়। অর্থই দেখা যাচ্ছে সব অনর্থের মূল।

তাহলে কখন কোন মূল্যে এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের অর্থনৈতিক অধিকার নিঃশর্তে স্বীকার করে নিয়েছে? যখন তারা গণিকা হয়েছে। মেয়েদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে শেষ না করে দিলে এই সমাজের কাছ থেকে কিছু পাওয়া যাবেনা। সুকুমারী দেখিয়েছেন কীভাবে ধম্মপদের টিকায় সালাবতীর কন্যা সিরিমার প্রতি রাত্রে ১,০০০ পণ উপার্জন করার বিবরণ আছে। তবে নিরাপত্তার বোধ তাদেরও ছিলোনা। কোনও পুরুষ গণিকার কন্যার ওপর বলাৎকার করলে তার মাত্র ৫৪ পণ দন্ড হতো। মায়ের প্রাপ্যের ১৬ গুণ দন্ড দেবার কথাও শোনা যায়। গৌতম ধর্মসূত্রে তো পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে ‘বেশ্যার হত্যা অপরাধ নয়’।

তাহলে যতই ছোটবেলা থেকে আমাদের মৈত্রেয়ী অমৃতার গল্প শোনানো হোক না কেন, দেখা যাচ্ছে প্রাচীন ভারতে সাধারণভাবে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার ছিলনা। ঘরের মেয়েদেরও সামাজিক সুরক্ষা ছিল না। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে পত্নীর সম্পত্তির উপরে কোনও অধিকার নেই, নিজের শরীরের ওপরেও না। যজ্ঞে লাঠি দিয়ে যেমন হবিকে (যজ্ঞের ঘি) পেটানো হয়, তেমনি স্বামীও স্ত্রীকে পেটাবে যাতে তার শরীর বা সম্পত্তির ওপর অধিকারের সমস্ত বোধ অবলুপ্ত হয়ে যায়।

দ্রৌপদীকে যখন সবার সামনে অপমান করা হচ্ছিলো তখন তিনি দুঃশাসনকে প্রশ্ন করেছিলেন, আমাকে বাজি রাখার আগে কি যুধিষ্ঠির জুয়াখেলায় নিজেকে বাজি রেখেছিলেন? তিনি আসলে বলতে চাইছিলেন যদি আগেই নিজেকে যুধিষ্ঠির বাজি রেখে থাকেন ও হেরে যান, তাহলে দ্রৌপদীকে বাজি রাখার কোনো অধিকার তার থাকে না। অর্থাৎ দ্রৌপদী কোনো না কোনোভাবে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে তিনি তার স্বামীর সম্পত্তি। আগে থেকে হেরে গিয়ে না থাকলে স্ত্রীকে যুধিষ্ঠির বাজি রাখতে পারতেন। ঋগ্বেদের এক জুয়াড়িও স্ত্রীকে বাজি রেখেছিলো। তাহলে দেখা যাচ্ছে রাজা থেকে প্রজা, অভিজাত থেকে জুয়াড়ি, সবাই স্ত্রী নামক সম্পত্তিটিকে কথায় কথায় বাজি রাখতো।

সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতো বিদগ্ধ পন্ডিতদের চুলচেরা বিশ্লেষণ না থাকলে আমরা হয়তো প্রাচীন ভারতের সবকিছুই ভালো, এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়তাম। আর যা কিছু ভালো হোক, মেয়েদের অবস্থা মোটেই ভালো ছিলো না। গৃহে তারা যতই শ্রম দিক না কেন, তা উৎপাদনমূলক নয় বলেই ধরে নেওয়া হতো। তারা ছিল প্রজননের যন্ত্র, তাও সর্বত্র একতরফা পুত্রের মায়ের কথাই বলা হয়েছে। তারা যদি ক্ষেত্র হয়, তাহলে ফসল ছিলো বপনকারীর।

অনেক অনেক শতাব্দী ধরে সমাজ নারীর আত্মসম্মানকে খর্ব করে এসেছে। তাকে শিক্ষার অধিকার দেয়নি, সম্পত্তির অধিকার দেয়নি, গৃহে তাকে শুধু গৃহকর্ম ও প্রজননের নিশ্চেতন ভূমিকায় আবদ্ধ রেখেছে, যাতে তার সাধারণ বুদ্ধিও না থাকে এবং পুরুষ ঘোষণা করতে পারে যে, নারীর অর্থের প্রয়োজন নেই, অর্থ পেলেও তার ওপর কখনোই নির্ভর করা যায় না।

এই ট্র‍্যাডিশনের অনেকটাই কি আজও অটুট নেই?

- প্রতিভা সরকার

July 20, Prabir Dutt

বিগত শতকের সত্তরের দশকে রক্ত, কান্না, মৃত্যু, শপথ, লড়াই এবং লড়াইয়ের এক মহাকাব্য রচিত হয়েছিল। রাষ্টশক্তির লাগামহীন শ্বেতসন্ত্রাস সমসময়ে অবলীলায় দিনকে রাত্রিতে রূপান্তরিত করতো। বাকরুদ্ধ গণতন্ত্রের কান্না, দলিত মানবাত্মার আর্ত চিৎকার আর রাষ্ট্রশক্তির খুনি-গেস্টাপো বাহিনীর লাল চোখের স্পর্ধার দিকে প্রতিস্পর্ধায় চোখ রেখে স্বপ্নপাগল, মুক্তিপাগল তরুণদের রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে অসম দুঃসাহসী লড়াইয়ের রক্তাক্ত ইতিহাসের নামই সত্তর দশক। প্রচুর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নকশালপন্থী আন্দোলন নতুন করে ইতিহাসকে পড়তে, চিনতে, জানতে এবং বুঝতে শিখিয়েছিল; পুরানোর মোহ ভেঙে জীবনকে নতুনভাবে দেখতে, বুঝতে শিখিয়েছিল; নতুন শব্দ এবং বর্ণের সন্ধান দিয়েছিল, নতুন দিশা, নতুন স্বপ্নের আকাশ দেখিয়েছিল। সত্তর দশকের মাটিতে পা-রাখা দৃপ্ত তারুণ্যের দীপ্তিময়তা আরও একবার প্রমেথিয়ুস হতে চেয়েছিল। মুক্তির স্বপ্নতাড়িত তারুণ্যের এই নবজন্ম এবং তার উত্তাল উচ্ছ্বাসকে স্বভাবতই রাষ্ট্রশক্তি মেনে নিতে পারেনি। সারাদেশ হয়ে উঠেছিল জেলখানা, জেলখানা হয়ে উঠেছিল বধ্যভূমি। রক্তস্রোতে রঞ্জিত হয়েছিল সারাদেশ, তার ছড়ানো মানচিত্র।

এই সত্তরের দশকের প্রত্যূষ-পোষিত এক সকালে প্রথিতযশা কবি-বুদ্ধিজীবী এবং সর্বোপরি বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা সরোজ দত্তকে কংগ্রেসি জমানার পুলিশ প্রকাশ্যে হত্যা করেছিল। ১৯৭১ সালের ৫ অগাস্ট কলকাতা ময়দানে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ এই অপকর্মটি করেছিল অত্যন্ত শান্তমাথায় এবং পরিকল্পিতভাবে। তবে এই অপকর্মের কথা পুলিশ স্বীকার করেনি। পুলিশের খাতায় সরোজ দত্ত আজও নিখোঁজ! এই ঘটনার মাত্র এক বছরের মাথায় নকশালবাড়ি আন্দোলনের রূপকার চারু মজুমদারকে জেলের মধ্যে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে পুলিশ। ১৯৭২’র ২৮ জুলাই চারু মজুমদারকে খুন করার বিষয়টিও ছিল পূর্বপরিকল্পিত। এইসব পূর্বপরিকল্পিত খুন ও সমসময়ের হাজার হাজার গণহত্যার নায়করা কেউই শাস্তি পায়নি। বরং সাতাত্তর-উত্তর ‘বাম’ জমানায় তাদের পদোন্নতি ঘটেছিল, তাঁদের সামাজিক জীবনে নিরাপত্তার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল।

চারু মজুমদার-হত্যার ঘটনার ঠিক এক বছর একান্ন সপ্তাহের মাথায় সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ শত শত মানুষের বিস্ময়াহত চোখের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে কলকাতার কার্জন পার্কের কাছে হিংস্রতার সার্বিক প্রকাশ ঘটিয়ে হত্যা করেছিল নাট্যকর্মী এবং কবি প্রবীর দত্তকে। সেদিনটি ছিল শনিবার, ১৯৭৪’র ২০ জুলাই। এবারের এই দিনটি প্রবীর-নিধনের ৪৭তম উৎক্রান্তি দিবস।

১৯৭৩’র ৭ মার্চ দিল্লীর মিরান্দা হাউসে এক বক্তৃতায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শিহরণ-জাগানো একটি উক্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “আমি বিপ্লবী ছিলাম এবং এখনও বিপ্লবী আছি!” তাঁর বিপ্লবীয়ানার ফলিত রূপ তখনতো সমস্ত ভারতবাসী প্রত্যক্ষ করেছিলেন। একদিকে তিনি নিজের বিপ্লবীয়ানা যেমন জাহির করছিলেন, তেমনই অন্যদিকে আন্দোলনকে ‘বিলাসিতা’ হিসেবে আখ্যাত করেছিলেন! পশ্চিমবঙ্গে ইন্দিরার অনুগামী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশও আন্দোলনের নামে ‘বিলাসিতা’র টুঁটি চেপে ধরতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেনি। ভিয়েতনামের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে ১৯৭৪’র ২০ জুলাই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিবসে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের আহ্বানকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখতে পারেনি। আন্দোলনের নামে এই ‘বিলাসিতা’কে কোনও মতেই প্রশ্রয় দেওয়া যায়না। নাট্যকর্মী এবং এই অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা দেবর্ষি চক্রবর্তী সংস্কৃতি কর্মীদের মিছিলে যখনই প্রচারপত্র বিলি করতে শুরু করেন, তখনই পুলিশ তাঁকে ধরে টানতে টানতে অপেক্ষমান ভ্যানে নিয়ে তোলে। এদিনের মিছিলের গতিপথ ছিল কার্জন পার্ক থেকে ধর্মতলা, সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার, কলেজ স্ট্রিট, মহাত্মা গান্ধী রোড হয়ে শিয়ালদা। দেবর্ষি চক্রবর্তীকে এভাবে জোর করে পুলিশ ভ্যানে তোলার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে মিছিল। মিছিলের গতিমুখ পুলিশের ভ্যানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অকারণে এবং অন্যায়ভাবে দেবর্ষি চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁর মুক্তির দাবিতে শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকে। এসময় আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। একজন পুলিশ অফিসার হঠাৎই দু’জন সাংস্কৃতিক কর্মীর জামার কলার চেপে ধরায় প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক কর্মীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। আর তখনই শুরু হয়ে পুলিশের অপারেশান। প্রচুর পুলিশ অন্যান্য ভ্যান থেকে নেমে এসে নির্বিচারে লাঠি চালাতে শুরু করে। এই আকস্মিক আক্রমণে হতচকিত হয়ে সাংস্কৃতিক কর্মীরা যে যেদিকে পারে ছুটতে শুরু করেন। সেদিন এই সাংস্কৃতিক কর্মী-লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রবীণ গণশিল্পী পরেশ ধর, প্রয়াত সিপিআই(এমএল) নেতা সুশীতল রায়চৌধুরীর জীবনসঙ্গী অমিয়া রায়চৌধুরি, ডাক্তার অমিয় বসু, ঝর্ণা (বসু?), শান্তনু ভট্টাচার্য, শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়, সাগর চক্রবর্তী প্রমুখ। পুলিশের তাড়া খেয়ে এঁদের সঙ্গেই ছুটছিলেন প্রবীর দত্তও।

কিন্তু প্রবীর বেশিদূর যেতে পারেননি। তাঁর পিঠে পুলিশের লাঠির সজোর আঘাত লাগায় তিনি মুখ থুবড়ে পড়ে যান। খুনের নেশায় পুলিশের চোখ তখন জ্বলে ওঠে। তাঁকে চিৎ করে ফেলে তাঁর পেটের ওপর দু’জন পুলিশ সবুট লাথি মারতে থাকে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন প্রবীর। অস্ফূট গোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসে তাঁর মুখ থেকে। এই ঘটনা দেখে কিছু লোকজন প্রবীরকে উদ্ধার করার জন্যে এগিয়ে আসতেই পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে পুলিশ অকুস্থল থেকে সরে যায়। কলকাতা মেডিকেল কলেজে প্রবীরকে আনতেই তাঁকে ‘ব্রড ডেড’ বলে ঘোষণা করেন ডাক্তার।

কোনরকম প্ররোচনা ব্যতিরেকেই প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের চোখের সামনে এভাবেই ঠাণ্ডা মাথায় প্রবীর দত্তকে হত্যা করেও পুলিশ কিন্তু এই হত্যার দায় স্বীকার করেনি। পুলিশ নাকি সেদিন আদৌ লাঠি চালায়নি! অথচ কলকাতার লিগ্যাল এইড কমিটির কর্মী দীপা চক্রবর্তীর বাড়িতে গিয়ে সেদিন রাত্রে পুলিশ তাঁকে শাসিয়ে এসেছিল, কারণ দীপা গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের দু’জন কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে অকুস্থল থেকে একটি ট্যাক্সিতে প্রবীরকে মেডিকেল কলেজে নিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের সেই কর্মীদের খোঁজে রাতদুপুরে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলেও হানা দিয়েছিল পুলিশ।

চারু মজুমদারের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত যে ডাক্তারকে দিয়ে পুলিশ করিয়েছিল, সেই ডাক্তারকে দিয়েই মেডিকেল কলেজ থেকে জোর করে নিহত প্রবীর দত্তের মৃতদেহ তুলে লালবাজারে নিয়ে গিয়ে ময়নাতদন্ত করা হয়েছিল! এই ময়নাতন্তের সময় প্রবীরের মাকে থাকতে দেওয়া হয়নি! অথচ পুলিশ বলেছিল যে তারা আদৌ লাঠি চালায়নি! প্রবীরের মৃত্যুর ব্যাপারে তারা কিছুই জানে না!

১৯৭৪’র ২০ জুলাই সংস্কৃতি কর্মীদের ওপর এই নির্মম পীড়ন এবং প্রবীর দত্তকে ঠাণ্ডা মাথায় প্রকাশ্যে হত্যা করার কথা অস্বীকার করলেও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ অবশ্য দাবি করেছিল যে সংস্কৃতি কর্মীদের এই মিছিলটি আসলে ছিল নকশালপন্থীদের। আর নকশালপন্থীদের ওপর হামলা করার অধিকার তো পুলিশের আছেই! পুলিশের এই বক্তব্যের নিহিতার্থে যা প্রতিষ্ঠা পায় তা হলো: এই মিছিলে অংশগ্রহণকারী নাট্যকর্মী, কবি, সঙ্গীতকার, লেখক, বুদ্ধিজীবী সহ সকলেই ছিলেন নকশালপন্থী! আর সেইসঙ্গে শহিদ প্রবীর দত্তও ছিলেন নকশালপন্থী! সুতরাং এই ‘নকশালপন্থী’ প্রবীর দত্তকে পুলিশ জেনেশুনেই হত্যা করেছে। কোনও ব্যক্তিকে ‘নকশালপন্থী’ আখ্যা দিয়ে হত্যা করাটা সেসময় আইনানুগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

সেদিন সংস্কৃতি কর্মীদের ওপর হামলা আর প্রবীর দত্তকে নৃশংসভাবে হত্যা করার মধ্যে যে ফ্যাসিস্ত লক্ষণিকতা সুপ্রকট হয়ে উঠেছিল, তা অনতি-পরবর্তীতে আরও ভয়ঙ্কররূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল পঁচাত্তরের জরুরি অবস্থা জারির পর। প্রবীর দত্ত হত্যার প্রতিবাদে পশ্চিমবাংলার লেখক-কবি-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী তথা সংস্কৃতিকর্মীরা সোচ্চার হতে থাকেন। একইসঙ্গে নকশাল দমনে পুলিশি সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। শেষপর্যন্ত প্রবীর দত্ত হত্যার একান্ন সপ্তাহের মাথায় সারা দেশে জারি করা হয় কুখ্যাত জরুরি অবস্থা। আর তারই সঙ্গে প্রতিবাদী আন্দোলন নামক ‘বিলাসিতা’কে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্যে ফ্যাসিস্ত আক্রমণ তার দাঁত-নখ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

তবে প্রবীর দত্ত শহিদ হওয়ার ঠিক দু’সপ্তাহ পরে কার্জন পার্কেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল নাটক ‘মিছিল’। সেই নাটকে কেয়া চক্রবর্তী অভিনয় করেছিলেন। উৎপল দত্ত আবৃত্তি করেছিলেন শহিদ প্রবীর দত্তের কবিতা। নাটক শেষ হওয়ার পর হয়েছিল মিছিল। সেই মিছিলে ছিলেন বিভাস চক্রবর্তী, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, অশোক মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। সে দিনের ওই কর্মসূচিতে মৃণাল সেনের পাশাপাশি ছিলেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও। তবে প্রবীর-নিধনের আনুষঙ্গিক জরুরি কর্ম হিসেবে পুলিশ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল বলে জানা যায়। এদের মধ্যে তিনজন ছিলেন সিপিএম সমর্থক। এই ঘটনার দিনকয়েক পরে কলকাতায় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে এক কনভেনশনে কিছু স্বনামধন্য ‘বামপন্থী’ বুদ্ধিজীবী এই তিনজন সিপিএম সমর্থকের মুক্তির দাবি তুলেছিলেন!

প্রবীর দত্তের শহিদত্বের সাতচল্লিশ বছর অতিক্রান্তির পর্যায়ে আজ আমরা কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি? আজ ইন্দিরা গান্ধী নেই। দিল্লীর ক্ষমতায় কংগ্রেস নেই। এমনকি পশ্চিমবাংলায়ও কংগ্রেস বা সিপিএম-নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ক্ষমতার অলিন্দে নেই। কিন্তু দেশজুড়ে আছে সংঘ পারিবারিক ফ্যাসিবাদের উদগ্র আক্রমণ। দিল্লী সহ দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের অনুশীলনে পুরোমাত্রায় নেমে পড়েছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার। পঁচাত্তরের জরুরি অবস্থার তীব্র সমালোচনা করে বিজেপি সরকার তাদের লাগামহীন ফ্যাসিস্ত আক্রমণকে বৈধতা দিতে চায়। লাগামছাড়া মিথ্যাকথা, অবাস্তবকে বাস্তব বলে প্রদর্শন, ক্রিশ্চান, দলিত এবং আদিবাসী সহ মুসলিম জনসাধারণকে এই দেশ থেকে উৎখাত করার লক্ষ্যে উগ্রজাতিয়তাবাদের অতিপ্রসারণের মধ্যে দিয়ে তারা দেশের জনসাধারণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির এক কপট এবং ক্রূর রাজনীতির অনুশীলন করে চলেছে। দেশের প্রচলিত জনস্বার্থবিরোধী আইনগুলিকে ব্যবহার করে তারা একদিকে যেমন দেশের জনসাধারণের স্বাভাবিক প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে চলেছে, ইউএপিএ’র মতো ঔপনিবেশিক আইনের প্রয়োগে যাকে-তাকে বিনাবিচারে কারারুদ্ধ করে চলেছে, তেমনই সামাজিক ন্যায় থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত করে চলেছে দেশের আপামর জনসাধারণকে। শ্রম এবং কৃষি আইনের নামে তারা দেশের শ্রমিক এবং কৃষকদের ওপর অন্যায়ের জুলুম জারি করে চলেছে, তেমনই এই কুখ্যাত কৃষি আইনের প্রতিবাদে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আন্দোলন জারি রাখা কৃষকদের প্রতি কোনরকম সহানুভূতি দেখাতে নরেন্দ্র মোদীর সরকার বিন্দুমাত্র রাজি নয়। আলোচনার অজুহাতে বারবার তাঁদের আন্দোলনে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন তাঁরা। এখন তো এই সরকার এই আন্দোলনকারী কৃষকদের ‘দেশবিরোধী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে! মোদী বিরোধিতা আর দেশবিরোধিতাকে সমার্থক করে তুলেছে তারা। সম্প্রতি এই কৃষি আইনের প্রতিবাদকারী এক তেরো বছরের কিশোরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়ার ছবি ভাইরাল হয়ে গিয়েছে।

২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আমাদের দেশে এই কুখ্যাত ইউএপিএ আইনে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৫,৯২২ জন। ২০১৪ থেকে ২০১৯’র অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’র মামলা হয়েছে ৩২৬টি। কোনরকম বিরুদ্ধতার প্রতি অতি-অসহিষ্ণু এই সরকার প্রতিবাদের সমস্ত অধিকারকে কেড়ে নিয়েছে। সরকারের জনবিরোধী ভূমিকার কোনোরকম প্রতিবাদ এরা বরদাস্ত করেনা। ব্রিটিশ আমলে মীরাট ষড়যন্ত্র সহ বিভিন্ন মামলার অনুসরণে এখনও এলগার পরিষদ মামলার নামে দেশের প্রখ্যাত কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবী-আইনজীবী-সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করে দিনের পর দিন কারান্তরালে রাখা হয়েছে। এই কারান্তরালে থাকাকালীন সম্প্রতি তিরাশি বছর বয়সি অসুস্থ পাদরি স্ট্যান স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে।

পশ্চিমবংলার ‘পরিবর্তন’এর সরকারও ইউএপিএ আইন প্রয়োগ করতে দ্বিধা করেনি। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেমন রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিকে অগ্রাহ্য করে থাকে, পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রেও তার বিশেষ ব্যতিক্রম দেখা যায়না। এখানেও গত দশ বছরে ৭ জন বন্দি জেল হেফাজতে মারা গিয়েছেন। এই ৭ জনের মধ্যে ৬ জনই ছিলেন ‘বিচারাধীন’ বন্দি। চারু মজুমদারের মতো একই প্রক্রিয়ায় পুলিশ হত্যা করেছিল ‘পিপলস মার্চ’ পত্রিকার সম্পাদক ‘মাওবাদী’ কথিত স্বপন দাশগুপ্তকে। এখানকার জেলে এখনও ৬ জন মহিলা সহ কয়েকজন সত্তরোর্ধ্ব বন্দিও আছেন। ২০১৪ থেকে ২০১৯’র অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে পশ্চিমবাংলায় ৮ জনের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’র মামলা দায়ের হয়েছে আর তারমধ্যে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ৫টি মামলায়।

প্রতিবাদের অধিকার এখানেও সবসময় স্বীকৃত হয় না। সরকারি প্রতিবাদ ভিন্ন অন্যদের সংগঠিত প্রতিবাদকে এই সরকারও সম্মান জানাতে কার্পণ্য দেখাতে কসুর করে না। গত ১৬ জুলাই হাজরা মোড়ে এআইপিএফ, সিআরপিপি, পিইউসিএল, বন্দি মুক্তি কমিটি প্রভৃতি প্রায় কুড়িটি সংগঠনের তরফে রাজবন্দি পাদরি স্ট্যান স্বামীকে হত্যার প্রতিবাদে, সমস্ত রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির এবং ইউএপিএ, এনআইএ, আফস্পা সহ সমস্ত দমনমূলক আইন বাতিলের দাবিতে আহুত এক সভা করতে দেয়নি এই সরকার। ‘আত্মশাসন’এর অভিধায় লকডাউন জারি রেখে, জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলছে এই সরকার। সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের রুজি-রোজগারের জন্য লোকাল ট্রেন চালুর জনদাবি ক্রমাগত উপেক্ষা করে চলেছে। স্বভাবতই আন্দোলন কোনও ‘বিলাসিতা’ নয়। এটাই প্রতিবাদী জনতার প্রয়োজনের হাতিয়ার। এই হাতিয়ারকে ব্যবহার করতেই প্রতিবাদী মানুষ পথে নামবেই। আজ থেকে সাতচল্লিশ বছর আগে অনেক অনেক প্রতিবাদী মানুষজনের সঙ্গে প্রবীর দত্তও পথে নেমেছিলেন। সেদিন প্রতিবাদী মিছিলে সামিল হওয়ার জন্যেই তাঁকে শহীদ হতে হয়েছিল। আজ প্রবীর নেই, কিন্তু আন্দোলন রয়ে গিয়েছে, রয়ে গিয়েছে প্রবীরদের রেখে যাওয়া পথ।

ফলতই নতুন উদ্যমে পথে নামার সময় এসেছে। ২০ জুলাই প্রবীরের শহীদত্বের সাতচল্লিশতম বার্ষিকী নতুন করে আহ্বান জানাচ্ছে: পথে এবার নামও সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা।

- অশোক চট্টোপাধ্যায়

Mourning news

আশীর দশকে যাদবপুর-ঢাকুরিয়া এলাকার বামপন্থী সংগঠক ও  সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের তদানীন্তন দক্ষিণ কলকাতা আঞ্চলিক কমিটির সদস্য কমরেড দক্ষিণেশ্বর বিশ্বাস গত ১৭ জুলাই নিজের বাড়িতে প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা সহ বন্ধুজনদের। মারণ ক্যান্সার রোগের সাথে লড়াই করছিলেন তিনি। পার্টি মহলে তিনি “দীপু” নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁদের বাড়ি পার্টির এক নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ কেন্দ্র ও আশ্রয়স্থল ছিল। যাদবপুর-ঢাকুরিয়া লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে কমরেডকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। কমরেড দক্ষিণেশ্বর বিশ্বাস লাল সেলাম।

== সমাপ্ত ==

খণ্ড-28
সংখ্যা-27