সম্পাদকীয়
দুদিকের কথা
Both sides

রাজ্যের তিনটি বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূল বিশাল বিশাল ব্যবধানে পুনর্বিজয়ী হল। প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপির প্রত্যাশায় আবার ছাই পড়ল। বিশেষ করে ভবানীপুর কেন্দ্রের উপনির্বাচন নিয়ে নানা কারণে কিছুটা হলেও বাজারে জল্পনা ছড়িয়েছিল। প্রথমত, বিজেপির আই টি সেল প্রচারে নামিয়েছিল ‘নন্দীগ্রামে তৃণমূলনেত্রীর পরাজয়ের ভূত’কে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনী কেন্দ্রটি কিছুটা কম-বেশি পঞ্চাশ পঞ্চাশ মিশ্র এলাকার। ৪৪-৪৫ শতাংশ অবাঙালী ভোটার। তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় এজেন্সীর জিজ্ঞাসাবাদের জেরে তৃণমূলকে মানসিক চাপে রাখার কৌশল ছিল। চতুর্থত, তৃণমূল নিয়েছিল অতি সাবধানী মনোভাব থেকে অতি সক্রিয় অবস্থান। আরও হয়ত কিছু উপসর্গ ছিল। তবে বিজেপি'র হেভিওয়েট প্রার্থীও ছিল না, আর দলের প্রচারে দিল্লী থেকে চূড়ামনি দুজনও আসার কার্যকারিতা খুঁজে পাননি। লক্ষ্য ছিল বিগত তৃণমূলের বিধায়কের প্রাপ্ত ভোটের তুলনায় এবার যদি ব্যবধান কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু বাজিতে ব্যর্থই থাকতে হল। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে এই বিধানসভা ক্ষেত্রে বিজেপি ১৮৫ ভোটে হলেও এগিয়ে গিয়েছিল, কোন রসদে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল তাও পরে যথেষ্ট উন্মোচিত চর্চিত হয়েছিল। কিন্তু এবার সবচেয়ে মিশ্র প্রবণ দুটি ওয়ার্ড সহ সমস্ত ওয়ার্ডেই বিজেপি পরাজিত হয়েছে। বাঙালী অংশে তো নয়ই, এমনকি অবাঙালী হিসাব কষেও গুজরাটি, মাড়ওয়াড়ি, বিহারি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবী ভোটারদের কোনও অংশের মধ্যে মেরুকরণ ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। পাঁচ মাস আগে যেখানে বিজেপির ভোট ছিল যথাক্রমে ৪৪,৭৮৬ ও ৩৫.১ শতাংশ, এবার নেমে এসেছে ২৬,৪২৮ ও ২২.২ শতাংশে। শ্যামাপ্রসাদ থেকে মোদী – কোনও ভাবমূর্তি ভাঙানো প্রচার দাগ কাটতে পারেনি। বরং ধাক্কা খেয়েছে বিদ্বেষ-বিভাজন-সাম্প্রদায়িকতা, মিথ্যাচারের রাজনীতি; ব্যাপক বেকারি ঘনিয়ে নিয়ে আসা ও কর্পোরেট ভজা অর্থনীতি।

পক্ষান্তরে, ‘ভবানীপুরের খেলা শেষ হবে ভারত জয়ে’ প্রচারে মাতোয়ারা তৃণমূল। নেত্রী এবার জিতেছেন প্রায় ৫৯,০০০ ভোটে, ২০১১-র চেয়ে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি ব্যবধানে। পেয়েছেন মোট প্রদত্ত ৫৭ শতাংশ ভোটের ৭১.৯০ শতাংশ। যাই হোক, ২০২১-এর বঙ্গভূমি থেকে শুরু করে ২০২২-এ উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, যেখানেই যা নির্বাচন হবে তার রণনীতি ও রণকৌশলগত বর্শামুখ থাকতে হবে ২০২৪-এ মোদী পতনের লক্ষ্যে, এ নিয়ে কোনও দ্বিধা থাকলে চলবে না। মানুষের আন্দোলনও চালিয়ে যেতে হবে নিরন্তর।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলার বিধানসভা নির্বাচন-উপনির্বাচনের ফলাফল অবশ্যই ইতিবাচক।

স্বৈর তৃণমূলকে ফ্যাসিস্ত বিজেপির সমতুল করে দেখা মুর্খামী। পক্ষান্তরে, আরও কিছু আশু গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সংস্কার ও গণদাবি সহ তৃণমূলের দুর্নীতি, দলতন্ত্র, সন্ত্রাস, ও মমতা সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে বহু লড়াই চলছে, আন্দোলন গড়ে তোলার গুরুত্ব রয়েছে, যা ঠিক এখনও তত কার্যকরি ও জনপ্রিয় রূপে নির্মাণ হয়ে উঠতে পারছে না। তৃণমূলের জনমন আকর্ষণের জোর তার চালু করা কিছু স্বল্পমেয়াদী একগুচ্ছ জনপ্রিয়তাবাদী সংস্কার কর্মসূচির মধ্যে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তুলোধোনার ঊর্দ্ধে। বরং তার ওপর চাপ আছে একপ্রস্থ, সেইসব ইস্যুতে সংগ্রাম-সমাবেশ গড়ে তোলা দরকার। কৃষিপণ্যের দেড়গুন ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চয়তা আইন, কৃষকের থেকে সরাসরি ফসল সংগ্রহ বৃদ্ধি, মনরেগা প্রকল্পের কর্মসংস্থান ও মজুরি বৃদ্ধি, মোদী সরকারের লেবার কোড প্রচলন না করা ও বন্ধ কলকারখানা খোলার নিশ্চয়তা বিধান, অবিলম্বে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা এবং শিক্ষান্তে কর্মসংস্থান, মহানগর-জেলাসদর-ব্লকস্তর থেকে গ্রামস্তরে স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামো, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থাগ্রহণ ইত্যাদি সহ বিরোধী কর্মসূচিকে পুলিশী-প্রশাসনিক হামলা করে-মামলা চাপিয়ে দমন করার ইস্যুতে বহু আন্দোলন করার আছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ ও তীব্র রাজনৈতিক সংগ্রাম ও গণসংগ্রামের ভারসাম্যের মেলবন্ধন করে এগিয়ে চলাই আজকের সময়ের মূল দাবি।

খণ্ড-28
সংখ্যা-36